জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-১৭+১৮

0
64

#জীবন_পেন্ডুলাম (নতুন অধ্যায়)
#পর্ব_১৭
#তাজরীন_ফাতিহা

(২ বছর পর)

রায়হানের ইদানীং প্রচুর মাথা ব্যথা হয়। স্টুডেন্টদের পড়াতে গেলে ভীষণ অসুস্থ অসুস্থ লাগে। প্রেশার বেড়েছে প্রচুর। ভার্সিটি শেষে টিউশনি করানো একটা যুদ্ধের সমান লাগে তার কাছে। টিউশনি এখন পাঁচটা। সপ্তাহ ভাগ করে দিয়েছে। কাদের কোন কোন দিন পড়াবে। সবাইকেই সপ্তাহে তিনদিন পড়ায়। একদিনে পাঁচজনকে পড়ানো তার দ্বারা পসিবল না। তাছাড়া রাহমিদ বাসায় একা থাকে। যদিও সাবলেট এক দম্পতি থাকে পাশের রুমেই। ওনাদেরকে শুধু একটু দেখে রাখতে বলে। বাচ্চা মানুষ কোনো অঘটন আবার না ঘটিয়ে ফেলে। রাহমিদটা এমনিতেই দুষ্টের শিরোমণি।ভাত রেঁধে রেখে আসে। ভদ্র বাচ্চার মতো থাকতে বলে। খিদে লাগলে ভাত যেন খায়। এসব তার নিত্যদিনের কথা। রুদকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে এক বছর আগেই। দুই বছর আগেই ভর্তি করাতো কিন্তু রাহমিদ ছোট দেখে আর করায় নি। এক বছর রুদই রায়হান বাসায় না থাকলে রাহমিদকে কোনরকম দেখে রাখতো। পাশের ঘরের আপুটাও সময় পেলে রুদ, রাহমিদকে দেখে যেতো। দুই বছর আগে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়ে আফজাল হোসেনের ঘর ছেড়ে উঠেছিল এক বস্তিতে। খুব কষ্ট হয়েছিল মানিয়ে নিতে। রাহমিদ, রুদকে একা হাতে মানুষ করতে। সেই দিন গুলোর কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। তবে এখন গা সয়ে গেছে। ঐ বস্তিতে বেশিদিন থাকতে পারেনি। কারণ বস্তির পরিবেশ ছিল জঘন্য। মানুষের মুখের ভাষা শুনলে রায়হানের বমি চলে আসতো। কি বিশ্রী বিশ্রী গালি দিতো ছোট থেকে বড় সবাই। পিচ্চি বাচ্চাদের মুখেও শোনা যেতো ভয়ংকর ভয়ংকর গালি। রায়হানের শুনেই গা ঘিনঘিন করতো। কোনরকম পাঁচ মাস থেকেছিল সেখানে। রুদ, রাহমিদ ইতোমধ্যেই কয়েকটা গালি আয়ত্ত করে ফেলেছিল। একদিন রায়হান রাহমিদকে ভাত খাওয়াতে নিলে বাচ্চাটা কিছুতেই খেতে চাচ্ছিলো না। রাহমিদ টুকিটাকি কথা বলতে পারে তবে অস্পষ্ট। অস্পষ্ট শব্দে বলে উঠেছিল,

“কুতার বাচা, হালামযাদা, ফুইননির পো”

রায়হান প্রথমে বুঝতে পারেনি পরে যখন রাহমিদ প্রত্যেকদিন খাওয়াতে গেলেই এগুলো অনবরত আউড়াতো তখন বুঝেছে গালি দেয় প্রতিদিন তাকে। রায়হানের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল রুদকেও দুই একটা গালি দিতে শুনেছিল। এরপর থেকে রায়হান কোনোভাবেই চায়নি এরকম অশালীন পরিবেশে ভাই, বোন বেড়ে উঠুক। সে এমনিতেই বাসায় থাকে না এসব অশালীন ভাষা এদের সাথে থেকে থেকে খুব ভালো ভাবেই রপ্ত করে ফেলতো। অনেক কষ্টে সাবলেট এই বাসাটা পেয়েছিল। বাসাটায় আগে আরেক দম্পতি থাকতো। তাদের পরিবর্তে এখন অন্য এক দম্পতি উঠেছে। ওনারা মোটামুটি ভালোই। ওনাদেরও সন্তান আছে রাহমিদ থেকে একটু বড়। রাহমিদ ওই বাচ্চাটার সাথে খেলে। রাহমিদটা হাঁটতে শিখেছে। তোতাপাখির মতো কথা বলতে শিখেছে। দুষ্টুও হয়েছে। সাড়ে তিন বছর বয়স বাচ্চাটার। এইতো সেদিন কোলে ঝুলে থাকতো এখন হাঁটতে পারে। দৌঁড়াতে পারে। অভিমান করতে পারে। রায়হানের কলিজা দুইটা।
____

ছোট্ট ছোট্ট দুইটা হাত ভাত বাড়ছে। বাড়ছে কম ফেলে দিচ্ছে বেশি। প্লেটে ঠিক মতো বাড়তে পারছে না। চারপাশে ভাত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পা দুইটা মেলে প্লেটটা উরুর উপরে রেখে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে থাবা দিয়ে ভাত খাচ্ছে। সব গুলো ভাত পড়ে যাচ্ছে। হাতের মধ্যে রাখতে পারছে না বাচ্চাটা। রায়হান এই দৃশ্য দরজা খুলে দেখলো। মাথা ব্যথা করায় আজকে আগে আগেই বাসায় চলে এসেছে। রাহমিদকে ভাতের সাথে যুদ্ধ করতে দেখে দ্রুত সেখানে গেলো। বললো,

“রাহমিদ ভাত ফেলে দিচ্ছো তো। এভাবে খায় কেউ। ভাত বেড়ে রেখে গিয়েছিলাম তো। ওটা খেতে। বাড়তে গিয়েছো কেন?”

“নাই, নাই ভাতু নাই।”

হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ভাইকে দেখাচ্ছে ভাত বেড়ে রাখা নেই। রায়হান চোখ কপালে তুলে দেখলো সত্যিই ভাত বাড়া নেই। সে কিভাবে ভুলে গেলো। আল্লাহ্! কপাল ঘষতে ঘষতে বিড়বিড় করতে লাগলো রায়হান। তারপর হাত ধুয়ে এসে খাইয়ে দিতে লাগলো। বাচ্চাটা খাচ্ছে মজা করে। অথচ মজা করে খাওয়ার মতো কোনো আইটেম নেই। ভাত, ডাল চচ্চড়ি। আহারে অনেক খিদা পেয়েছিল বোধহয়। ভাত ছোট ছোট লোকমা তুলে খাইয়ে মুখ ধুইয়ে দিলো। বাচ্চাটা পানি খেতে গিয়ে জামা ভিজিয়ে ফেলেছে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফোকলা হেঁসে ঘর থেকে দৌঁড় দিয়ে বের হয়ে গেলো। যাওয়ার আগে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে চুমু দিতে ভুললো না। পাশের ঘরের ছেলেটার সাথে এখন সে খেলবে। ছেলেটার অনেক খেলনা আছে। রাহমিদের তো কোনো খেলনা নেই। আছে শুধু একটা গাড়ি। রায়হান কিনে দিয়েছিল ওটা। তাই ছেলেটার খেলনাগুলো দেখলে তার অনেক ভালো লাগে। সারাক্ষণ ওখানে থাকতে ইচ্ছা করে। রায়হান হেঁসে সব কিছু গুছিয়ে গোসল করতে গেলো। ভাইবোনের জামা কাপড় ধুয়ে দিলো। আজকে বাসায় তাড়াতাড়ি আসায় রুদকে স্কুল থেকে আনতে যাবে। রেডি হয়ে রাহমিদকে একবার দেখলো। বাচ্চাটা একমনে খেলছে খেলনা দিয়ে। ওকে আর ডেকে বিরক্ত করলো না। বোনকে আনতে চলে গেলো।
____
—-

“রুদ”

ভিড়ের মধ্যে উচ্চস্বরে রায়হান রুদকে ডাকলো। রুদ ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে দৌঁড় দিয়ে আসলো। ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান হেঁসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“ক্লাস কেমন হলো?”

“ভালো।”

আস্তে করে বললো। রুদের বয়স সাত বছর। এবার ক্লাস টুতে পড়ে। রায়হান ওয়ানে না পড়িয়েই টুতে উঠিয়ে দিয়েছে। যেহেতু গ্যাপ গিয়েছে পড়াশোনায়। ওয়ানের পড়া বাসায় বসেই পড়িয়েছে রায়হান। তাছাড়া বাচ্চাটার মেধা ভালো। মাশা আল্লাহ। বোনকে নিয়ে কিছু বাজার করলো। এখন মোটামুটি ভালোই দরদাম করতে পারে সে। রুদ ছোট ভাইয়ের জন্য চকলেট নিতে বললো কয়েকটা। বাচ্চাটা খালি আপির কাছে চকলেট খোঁজে। সে স্কুল থেকে গেলেই দৌঁড়ে আসে তার কাছে। ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে মায়াবী বদনে চেয়ে থাকে। তখন কিছু না দিতে পারলে তার বড্ড খারাপ লাগে। বাচ্চাটা এতো আশা নিয়ে আসে ওকে নিরাশ করতে মোটেও ইচ্ছা করেনা। যদিও ওর সাথে মারামারি বেশি হয়। রাহমিদ ওকে ধুমধাম মেরে দৌঁড় লাগায়। কখনো বা চুল জোরে টান দেয়। রুদের রাগ উঠলে রুদও কয়েকটা লাগিয়ে দেয়। রায়হান ওদেরকে বারণ করে তবুও শোনে না। বিশেষ করে রাহমিদ। রুদ যদি কখনো ওর নামে রায়হানের কাছে বিচার দেয় তখন এমন ইনোসেন্ট মুখ করে তাকায় ইচ্ছা হয় কয়েকটা চটাস চটাস করে চুমু লাগিয়ে দিতে। এসব ভেবে ভেবে সব কিছু কিনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো দুই ভাই বোন।
_____

“রাহমিদ কান্না করছো কেন?”

রায়হান আর রুদ বাসায় ঢুকে দেখে রাহমিদ ফ্লোরে বসে কাদঁছে। রায়হান ওর কাছে গিয়ে তড়িঘড়ি করে উপরোক্ত কথাটি জিজ্ঞাসা করলো। রাহমিদ ভাইকে দেখে কান্না আরও বাড়িয়ে দেয়। রায়হান আবারও জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে। রাহমিদ কান্না গলায় বলে,

“মালছে”

রায়হান অবাক। কে মেরেছে বাচ্চাটাকে। এর মধ্যেই পাশের ঘরের আপুটা এসে বললো,

“তোমার ভাই, সিয়ামের হাতে খামচি দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছে। সিয়াম খেলনা দেয়নি দেখে। আচ্ছা বলো তো, খেলনা আমার ছেলের। ওর খেলনা দিয়ে ও খেলবে না তো কি তোমার ভাই খেলবে? কথায় কথায় খালি খামচি, থুতু ছোঁড়া। এগুলো কয়দিন টলারেট করবো বলো? প্রতিদিন এমন করে। আজকে সহ্য সীমার বাইরে চলে যাওয়ায় সিয়ামও ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। সব সময় সহ্য করবে কেন আমার ছেলে। তোমার ভাইকে এসব বুঝিও।”

এই বলে সিয়ামকে নিয়ে উনি চলে যান। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে আসে। রাহমিদ অনবরত কাঁদছে। বাচ্চাটার হাতের কনুই ছিলে গেছে। রুদ ভাইকে আদর করে দিলো। চোখে পানি চলে এসেছে ছোট ভাইয়ের জন্য। ইস্ খেলনার জন্য আজকে ভাইটা আঘাত পেয়েছে। এসব ভেবেই রুদ ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। রায়হান কিছু বললো না। স্যাভলন লাগিয়ে দিল। রুদ ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে ভাইকে দিলো। বাচ্চাটা চকলেট দেখেও নিলো না। উল্টো ছুঁড়ে ফেলে দিলো জিদে। খেলনা লাগবে তার। এরকম করে খালি ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো। রায়হান নিজের মনের জমানো কষ্ট, ক্ষোভ আকারে বের করে দিলো প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিয়ে। কখনো যে ভাইয়ের গায়ে হাত দেয়নি সেই ভাইয়ের গায়ে এই প্রথম এতো শক্তি দিয়ে মারলো রায়হান। রাহমিদ চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। রুদ বড় ভাইয়ের গম্ভীর মুখ জোড়ায় চেয়ে ভয় পেলো। ছোট ভাইকে কোলের মধ্যে টেনে আদর করতে লাগলো। পিঠ ডলে দিতে লাগলো। রাহমিদ কেঁদেই যাচ্ছে অনবরত। থামার কোনো লক্ষণ নেই। পিঠে অতো জোরে থাপ্পড় মারায় বাচ্চাটা ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। রায়হান চুপচাপ নিষ্প্রাণ হয়ে দাড়িয়ে থাকলো।
_____

“ওই দিলু, আছিস।”

রুস্তমের চেলা বাচ্চুর ডাকে দিলদার আসলো। জিজ্ঞাস করলো,

“কি হইছে ভাই।”

“তোরে রুস্তম ভাই বোলায়। জলদি ল।”

“কি কারণ?”

“অতো কতা কস ক্যা? আইতে কইছে আইবি।”

দিলদার প্রচুর বিরক্ত হলো। হোটেল ফেলে যাবে বখাটের আস্তানায়। এই রুস্তম বখাটের কোনো কাম, কাজ নাই। খালি এরে ওরে জ্বালাবে। এজন্যই রুস্তমকে দিলদার দুই চোখের পাতায় সহ্য করতে পারেনা। আফজাল হোসেনের কাছে অনুমতি নিয়ে বাচ্চুর সাথে গেলো। গিয়ে দেখলো, রুস্তম ও তার চেলারা চাঁদা উঠাচ্ছে দোকানে দোকানে। বাচ্চু রুস্তমকে গিয়ে দিলদারের কথা বলায় রুস্তম চাঁদা উঠানো বাদ দিয়ে চায়ের দোকানে আয়েশ করে বসলো। হাতের ইশারায় দিলদারকে ডাকলো। দোকানদারকে কড়া লিকারের লাল চা দিতে বললো। দিলদার গিয়ে সালাম দিলো। রুস্তম সালামের উত্তর দিয়ে বললো,

“কিরে আজকাল বহুত পালাই পালাই করিস মনে হয়। তোরে কি কাম দিছিলাম তোর মনে আছে? নাকি কামের কতা কইছি দেইখা পলাইয়া পলাইয়া থাহোস।”

দিলদার বুঝলো না কোন কাজের কথা জিজ্ঞাসা করলো রুস্তম ভাই। তাই নিরীহ কণ্ঠে বললো,

“কোন কাম ভাই?”

রুস্তম আকাশ থেকে পড়লো মনে হয়। সে মেজাজ দেখিয়ে বললো,

“এক বছর আগে যে কইলাম রায়হান গো খোঁজ নিতে তুই নিছিলি? পোলাডায় সিফাতরে পড়ানো ছাইড়া দিছে এর লাইগ্যা খোঁজও নিতে পারতাছি না কই আছে। এতিম মানুষ কই আছে কে জানে? আর তুই কস কি কাম। থাবরাইয়া থোবরা মোবরা সব বচকাইয়া দিমু।”

দিলদার খোঁজ নেয়নি এমন না। নিয়েছিল তবে পায়নি। তাই বললো,

“ভাই নিছিলাম তো খোঁজ কিন্তু পাই নাই। অনেক খুঁজছি কিন্তু ওরা কই আছে কইতে পারুম না। এত্তো বড় শহরে কই খুঁজুম। আপনে কাম দিছেন এডা আবার না কইরা পারি।”

দিলদার বিনয় নিয়ে বললো। রুস্তম চোখ মুখ কঠিন করে দিলদারের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

“তুই যেমন মার্কামারা, তোর কাজ কামও তেমন মার্কামারা। এরকম মার্কামারা খোঁজাখুঁজি করলে হইবো না কিছুই। আমার চেলারা তোরে সাহায্য করবো। তুই সময় বাইর কইরা রাহিস।”

চলবে,

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৮
#তাজরীন_ফাতিহা

রাত সাড়ে আটটা বাজে। রায়হান মাত্র বাসায় ফিরেছে। টিউশনি করিয়ে এশার নামাজ মসজিদ থেকে পড়ে এসেছে। দুপুরে রাহমিদকে মারার পর ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর আর বাসায় ফেরেনি। বাচ্চাটাকে মেরে শান্তি পায়নি। সারাদিন বুকটা চিনচিন করে ব্যথা করছিল। এত্তো জোরে এতো ছোট একটা বাচ্চার গায়ে হাত তুললো সে। এতো রাগ উঠেছিল কেন? কি চেয়েছে এমন। খেলনাই তো। এবার হাতে টাকা আসুক অনেকগুলো খেলনা কিনবে। যেটা পছন্দ হবে সেটাই কিনে দিবে। ঘরে ঢুকে দেখলো রুদ পড়ছে আর রাহমিদ রুদের কোলে বসে বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো বই দেখছে। মাঝে মাঝে দুষ্টুমিও করছে। ছোট্ট ছোট্ট চোখ দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকাচ্ছে আর নানা কথা বলছে। রুদ বিরক্ত হয়ে বললো,

“রাহমিদ বিরক্ত কোরো না। পড়তে দাও। আপু পড়ছি দেখছো না। তুমি তোমার বই পড়।”

কথাটা বলেই রাহমিদকে কোল থেকে নামিয়ে বাচ্চাদের “একের ভিতর সব” বইটা ওর সামনে মেলে দিলো। কিন্তু রাহমিদ এটায় খুশি হয়নি। সে মুখ ফুলিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়াবী চোখ দুটিতে অশ্রু টলমল করছে। ভাইয়ু, আপু খালি বকে। কেউ ভালোবাসে না। মন খারাপ করে বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে পড়লো। রুদ আর ঘাটলো না। এখন যদি রাহমিদকে আহ্লাদ করে তাহলে বাচ্চাটা পড়তে দিবে না। রুদের পড়া বাকি অনেক। হোমওয়ার্ক করতে হবে। এমনিতেই আজকে সারাদিন রাহমিদকে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। ভাইয়া মাইর দেয়ায় বাচ্চাটা সারাদিন কেঁদেছে। রুদ কত কিছু করে কান্না থামিয়েছে। এখন আবার ওকে নিয়ে পড়ে থাকলে পড়া কিচ্ছু হবে না। কাল মিসের হাতে বকা খেতে হবে। এইসব ভেবে আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো। রায়হান হাত, মুখ ধুয়ে এসে ফ্লোরিং বিছানায় বসলো। রুদ ভাইকে দেখে গলা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান হেঁসে গালে, কপালে চুমু দিলো। বললো,

“পড়া কমপ্লিট?”

“না একটু বাকি। ভাইয়ু একটা ম্যাথ সলভ করতে পারছি না। এট্টু দেখিয়ে দাও।”

“আচ্ছা দিবো। প্রিন্স রাহমিদের রাগ কমেনি?”

“না। জানো ভাইয়ু আজকে ওকে কিছু খাওয়াতে পারিনি। রাগ করেছে তোমার উপর, জিদ দেখায় খাবারের উপর।”

রায়হানের বুকটা মুচড়ে উঠলো। এত্তো রাগ ভাইয়ের প্রতি। রাহমিদকে শোয়া থেকে কোলে নিলো। রাহমিদ মোচড়ামুচড়ি করতে শুরু করলো। কিছুতেই ভাইয়ের কোলে যাবে না। মাইর দিয়ে আদর দেখানো লাগবে না। সবাই পঁচা। তাকে কেউ ভালোবাসে না। রায়হান তার ছোট্ট ছটফটে শরীরটা ঝাপটে ধরে আদর করলো। রাহমিদ কিল, খামচি দিতে লাগলো। রায়হান অনেক্ষণ ঝাপটে ধরে আদর করে বাচ্চাটার চেহারার দিকে তাকালো। এইতো তার ছোট্ট রাহমিদ। যে জিদে হাত, পা ছুড়তো। খামচি দিতো। পার্থক্য শুধু ওই রাহমিদের শরীরটা আরও ছোট্ট ছিল। এখন একটু বড় হয়েছে। বাচ্চাটার পেটে নাক দাবিয়ে কাতুকুতু দিতে থাকলো। রাহমিদ খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। রায়হান বাচ্চাটার হাসি দেখে নিজেও হাসলো। ছোট্ট শরীরটা আগলে ধরে বললো,

“কলিজা রাগ করেছেন। ভাইয়ু অনেক পঁচা তাইনা? আপনি খাননি কেন সারাদিন?”

“ইখানে বেতা দিসু।”

ভাইকে পিঠ দেখিয়ে বললো। রায়হান পিঠ ডলে দিতে লাগলো। পিঠে অনেকগুলো চুমু খেলো। রাহমিদ শান্ত বাচ্চার মতো ভাইয়ের আদর খেতে লাগলো। রুদ এতক্ষণ বড় আর ছোট ভাইয়ের খুনসুটি দেখছিল। ওর ভীষণ ভালো লাগছে। তিন ভাইবোন বেশ কিছুক্ষণ মজা করলো। রায়হান রুদকে ম্যাথটা বুঝিয়ে দিলো। এরপর রায়হান রাহমিদকে কোল থেকে নামিয়ে রান্না ঘরে যেতে চাইলো কিন্তু রাহমিদ ভাইয়ের কোল থেকে নামবে না। ভাইয়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। নিরুপায় হয়ে রায়হান ওকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে আসলো। পাতিলে পরিমাণ মতো চাল নিয়ে ধুয়ে বসিয়ে দিলো। রাহমিদকে একটা টুলে বসিয়ে দিয়ে পেঁয়াজ কুঁচি করতে লাগলো। আজকে বাজার থেকে টাটকা টাটকা বেগুন এনেছিল। একটা বেগুন পুড়িয়ে ভর্তা করবে। সাথে থাকবে ডিম ভর্তা আর পাতলা ডাল। কয়েকটা শুকনো মরিচ তেলে ভেজে নিলো। সরিষার তেল বেগুনে মেখে পোড়ালো। আস্ত রসুন মরিচের তেলে ভেজে উঠিয়ে পাশে রাখলো। ডিম সিদ্ধ বসালো। ভাত নামিয়ে মাড় গাললো। এর মধ্যে রাহমিদের হাজারটা প্রশ্ন করা শেষ। এই যেমন,

“ভাতু তিকে পানি পলে কিনো?

বেগুন দেখিয়ে বলে, “ইতা কি?”

বেগুন পোড়ানোর সময় বলেছিল “আমি এত্তু ইতা কাই।”

রায়হান এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছে। পিঁয়াজ হালকা ভেজে ডিম ভর্তা করলো। তারপর বেগুন ভর্তা করে একটা বাটিতে রাখলো। কালকের ডাল গরম করলো। ব্যাস, রান্না শেষ। রাহমিদকে নিয়ে ঘরে চলে আসলো সাথে ভাত, ডিম ভর্তা, বেগুন ভর্তা আর ডাল। রাহমিদ আর রুদকে রায়হান খাইয়ে দিলো। একই প্লেটে সেও খেলো। রুদ রাহমিদকে কাগজ দিয়ে একটা নৌকা বানিয়ে দিয়েছিল। ও সেটা দিয়ে খেলছে আর দু’পা মেলে মজা করে ভাত খাচ্ছে। তরকারি বেশি কিছু না থাক, মিলেমিশে ভালোবেসে খেলে সবই অমৃত। তিন ভাইবোন খেয়ে দেয়ে সব গুছিয়ে রাখলো। রুদ ভাইকে প্লেট ধোঁয়ায় সাহায্য করলো। রাহমিদ পাশে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
______

রাত বাজে সাড়ে বারোটা। রাহমিদ আর রুদকে ঘুম পাড়িয়ে রায়হান পড়তে বসেছে। আগামীকাল অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যাথমেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করছে। রাত জেগে পড়ার কারণে মাথা ব্যথা বেড়েছে প্রচুর। সারাদিন এতো ধকলের পর পড়ার সময় হয়েই উঠে না। ক্লান্তিতে শরীরটা খালি বিছনা খুঁজতে চায় কিন্তু কিছু করার নেই। পড়তে তো হবে। একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এগিয়ে যেতে হবে কষ্ট করেই। অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করতে বেশ রাত হলো। ঘুমে চোখ দুটো বুজে আসছে। আর চলছে না শরীর। শরীরের চার্জ সব শেষ। এখন চাইলেও আর জোর করে পড়তে পারবে না। ক্লান্তিতে সব কিছু গুছিয়ে রাখার সময়ও পায়নি। ভাইবোনের পাশে টুপ করে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
______
—–

এক অদ্ভুত কারণে কোনো এলার্ম ছাড়াই ফজরের সময়ে রায়হানের ঘুম সব সময় ভেঙে যায়। রায়হান যত রাত করে ঘুমাক না কেন ফজরের আযান শুনেই তার ঘুম ভাঙে। সে অনেক ওয়াজে শুনেছে, “এলার্ম ছাড়াই যদি কোনো মুমিন ব্যক্তির ঘুম ভেঙে যায় তাহলে বুঝতে হবে ওই ঘুম স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ভাঙিয়ে দিয়েছেন।” রায়হানেরও তাই মনে হয়। নাহলে এতো রাত করে শুলেও তার ঘুম এতো অল্প সময়ের ভিতরে ভাঙে কিভাবে। চোখে কত ঘুম নিয়ে সে ঘুমায় অথচ অল্প কিছুক্ষণ ঘুমালেই ঘুম পূরণ হয়ে যায়। শরীরে ফুল এনার্জি ফিরে পায় সে। ভাবনার মধ্যেই উঠে ওযু করলো রায়হান। মসজিদে যাওয়ার আগে রুদকে উঠিয়ে দিলো। রুদকে অনেক আগে থেকেই নামাজ পড়ার ট্রেনিং দিয়ে ফেলেছে রায়হান। অল্প কয়টা সূরা মুখস্ত পারে বাচ্চাটা। প্রতিদিন মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে রুদ আরবি পড়ে। রায়হান ইমাম সাহেবকে পারিশ্রমিক দিতে চাইলে উনি রাজি হননি। রুদকে এমনিতেই পড়ায়। রায়হান জোর করে কিছু দিতে চাইলে ইমাম সাহেব বলেন,

“আল্লাহর রাস্তায় জ্ঞান বিতরণ করি। এখানে টাকা দিয়ে আমাকে অসম্মানিত কোরো না। তাছাড়া এতিমদের প্রতি আল্লাহ্ সদয় হতে বলেছেন। তোমাদের যত বেশি মায়া, মহব্বত করবো কাল হাশরের মাঠে আল্লাহ্ তায়ালাও আমাকে এর চেয়ে বেশি মায়া, মহব্বত করবেন।”

খুব ভালো একজন মানুষ ইমাম সাহেব। কাঁচাপাকা দাড়ি। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। মানুষটার চেহারায় আল্লাহ্ তায়ালা নূর ঢেলে দিয়েছেন যেন। রায়হান, রুদ কিংবা রাহমিদকে দেখলে অনেক আদর করেন। এসব ভাবতে ভাবতেই রায়হান মসজিদে পৌঁছে গেলো।
_____
—-

“কিরে মামা, আজকে নাকি রাশেদ স্যার প্র্যাক্টিকাল নিবো, জানিস কিছু?”

রায়হান ভার্সিটিতে বন্ধু সাইমুন, হাবিব, ইমন, জুবায়ের এদের সাথে কথা বলছিল। হঠাৎ করেই ইমন উক্ত কথাটা বলে উঠলো। ওরা বন্ধুরা সবাই হতাশ। এই রাশেদ স্যার কাউকে না জানিয়ে প্র্যাক্টিকাল নিতে ওস্তাদ। জুবায়ের বলে উঠলো,

“ধুর ওই বেডার কথা কইস না আর। জীবন ত্যানা ত্যানা বানায় ফেলছে। মেইন কথা হইলো আমগোরে ওনার বকার লাইগা একটা উসিলা দরকার তাই সপ্তাহে সপ্তাহে একটা নাটক মারায়। পুরা নাটকবাজ শালায়। এইসব কতা বাদ দে। নেক্সট মান্থে নাকি পিকনিকে নিবো শুনছিস কিছু?”

হাবিব বললো,

“শুনছি। এবার ডিপার্টমেন্ট থেকে যাওয়া নাকি বাধ্যতামূলক করছে।”

সাইমুন দুই গালে হাত দিয়ে বললো,

“হুম। এডা ভালোই করছে। কি বলিস তোরা। কিরে রায়হান কিছু ক।”

“আমি যেতে পারব নারে। আমার টিউশনি আছে। গার্ডিয়ানরা মানবে না। তাছাড়া বাসায় কাজ আছে আমার। তোরা যা। আমি স্যারের সাথে কথা বলে নিবো।”

“ধুর বাল। তোর সব সময় একটা না একটা সমস্যা লেগেই থাকে। আগের বছরেও যাস নাই। এবার অন্তত চল। কিছু করতে চাইলেই তোর হাজার হাজার বাহানা। এগুলা কি ভাই?”

জুবায়েরের কথার কোনো জবাব না দিয়ে রায়হান চুপ করে থাকলো। তার যে বাবা, মা নেই সেটা তার বন্ধুরা কেউ জানে না। ছোট্ট দুইটা ভাইবোনের যে দায়িত্ব তার কাঁধে সেটাও ওরা জানে না। রায়হানই জানাতে চায়নি। কারণ অনাথদের মানুষ প্রতি পদে পদে হেয় করে। সে চায়না আর হেয় হতে। ওর বন্ধুগুলো যথেষ্ট ভালো। প্রথম যেদিন ভার্সিটিতে এসেছিল র্যাগিং এর শিকার হতে হতেও বেঁচে গিয়েছিল এদের কারণে। ক্লাসে সবাই যখন রায়হানকে দেখে এড়িয়ে চলতো ওর গম্ভীর স্বভাবের কারণে তখন এরাই ওর সাথে জোর করে মিশেছে। টিফিন না খেতে চাইলে জোর করে খাইয়েছে। কখনো জিজ্ঞাসা করেনি “তোর কি তিনটাই শার্ট?” ওর সব বন্ধুরা ওর মতোই নরমাল চলাফেরা করে। আগ বাড়িয়ে কিছুই কখনো জিজ্ঞাসা করেনি তাকে। তাই ওদের এইসব কথায় রায়হান রাগ করেনা। ওরা তো রায়হানের সঙ্গ চায়। তাই এমন করে বলে।

রায়হানের পরিস্থিতি তো আর তারা জানে না। পকেটে আছে দুই হাজার টাকা। এটা দিয়েই আগামী দশদিন চলতে হবে। টানাপোড়নে চলতে হবে দশটা দিন। এর মধ্যে পিকনিকে যাওয়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। এসব ভেবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো সে। তার বন্ধুরা কি আলাপ করছে এসব তার কানে ঢুকছে না। তার চিন্তা কিভাবে মাসটা পার করবে। দায়িত্বের বোঝা বড্ড ভার। মাথায় সারাক্ষণ চিন্তা আর চিন্তা নিয়ে ঘুরতে হয় রায়হানদের মতো ছেলেদের। সুখ, আহ্লাদ করার সময় তাদের নেই।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে