জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-১৩+১৪

0
60

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৩
#তাজরীন_ফাতিহা

রায়হান সারা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। রাহমিদকে সেলাইন দিয়ে রেখেছে। বাচ্চাটা এখন শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। সারাটা রাত রায়হান এক দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। অন্যদিকে রুদের চিন্তায় অস্থির লাগছিল। চারদিকে ফজরের আজান দিচ্ছে। রায়হান ওযু করে এসে হাসপাতালে দেয়া একটা গামছা বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নিলো। নামাজ শেষে অনেক্ষণ আল্লাহর কাছে তার ভাই বোনদের সুস্থ রাখার জন্য দোয়া করলো। দোয়া পড়ে ঘুমন্ত রাহমিদের সারা শরীরে ফুঁ দিয়ে দিলো। এক দিনেই বাচ্চাটার শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। আর কিছুটা বেলা হলে ডাক্তার এসে বাচ্চাটাকে দেখে গেলো। সেলাইন দেয়া শেষ হয়েছে। দিলদার হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঘুমিয়েছে। রুস্তম ও তার সাগরেদ দের রায়হান কালকেই পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা যথেষ্ট করেছে। রাতে আফজাল হোসেনও এসেছিলেন। দিলদার ফোন করে বলেছে রাহমিদকে ভর্তি করানো হয়েছে। এই অবস্থার কথা শুনে না এসে পারেননি তিনি। উনি রাতে থাকতে চাইলেও রায়হান মানা করে দিয়েছে। হাসপাতালে এতো মানুষের না থাকাই ভালো। যেহেতু উনি হাঁপানির রোগী। হাসপাতাল থেকে যাওয়ার আগে ডাক্তার তার চেম্বারে যাওয়ার জন্য বলেছেন। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে যায়। ডাক্তার রায়হানকে বসতে বলে। তারপর রাহমিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। হেঁসে বলেন,

“অনেক রাগী বাচ্চা মনে হচ্ছে। কালকে সেলাইন দিতে গিয়ে কি কাণ্ডটাই না করলো।”

“জি, ওই আসলে ও পরিচিত কেউ ছাড়া কারো কাছে তেমন যায়না। অপরিচিত কেউ ওকে কোলে নিলে বিরক্ত হয়।”

“বাহ্ বা জেদি বাচ্চা।”। ডাক্তার ঘুমন্ত রাহমিদকে আদর করে বললেন। পরক্ষণেই মুখ গম্ভীর করে বলে উঠলেন,

“কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো?”

“জি করুন।”

“আপনার বাবা, মা কেউ আসলো না যে। আপনি ওর ভাই বুঝলাম কিন্তু আপনার মা, বাবাকে তো বাচ্চাটার এই অবস্থায় দেখলাম না? ওনারা নিশ্চয় চাকরি করেন তাও একটা বাচ্চাকে এভাবে হেলায় ফেলে রেখে একদমই ঠিক করেননি তারা। ওনারা এখানে আসলে ওনাদের এই বিষয়ে অবগত করতাম। এছাড়াও বাচ্চাটাকে এই অবস্থায় বুকের দুধ বেশি বেশি খাওয়ানো লাগবে। মায়ের দুধ বাচ্চাটার জন্য এখন খুবই জরুরি। বাচ্চাটাকে দেখলে মনে হয় বুকের দুধ পায়না। এটা কিন্তু মোটেও হেলাফেলার বিষয় না। দয়া করে আপনার মা, বাবাকে এসব বিষয়ে সতর্ক হতে বলবেন।”

রায়হান এতক্ষন নির্জীব মূর্তির মতো বসে ছিল। এত ভারী কথার বিপরীতে সে কি বলবে ভেবে পেলো না। সে বহু কষ্টে মুখ খুলে বললো,

“বুকের দুধ কি খাওয়ানো জরুরি? এর পরিবর্তে কি খাওয়ানো যেতে পারে?”

“মায়ের দুধের মতো উপকারী ওষুধ আল্লাহ্ তায়ালা এই দুনিয়ায় আর একটিও পাঠান নি। আল্লাহ্ তায়ালার এক বিচিত্র সৃষ্টি। এতে অনেক পুষ্টি বিদ্যমান আছে। বাচ্চাদের রোগ অসুখে এটি এন্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে বুঝলে ইয়াং ম্যান।”

“আসলে ওর মা, বাবা নেই তাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম।” রায়হান মুখ নামিয়ে মিনমিন করে বললো।

ডাক্তার স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর রায়হানের কথার মানে বুঝতে পেরে নিজের মধ্যে অনুশোচনা হতে লাগলো। এতক্ষণ এতো ডায়ালগ একটা অনাথ, এতিম ছেলেকে শুনাচ্ছিলেন তিনি। তাও আবার রূঢ় ভাষায়। ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে আসলো। তারপর বললেন,

“সরি ইয়াং ম্যান। আসলে আমি বুঝতে পারিনি। ওকে যা খাওয়াতে তাই খাইয়ো। বেশি করে পুষ্টি জাতীয় খাবার দিও। খেতে না চাইলে জোর করে হলেও খাওয়াতে হবে নাহলে বাচ্চাটা অসুস্থ হয়ে পড়বে। যদি পারো একটু গাভীর খাঁটি দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করো কেমন। কোনো সমস্যা হলে যোগাযোগ কোরো। যে ওষুধ গুলো লিখে দিয়েছি টাইম টু টাইম খাওয়াবে ঠিক আছে।”

“জি আচ্ছা।”
_____
—-

রায়হান বাসায় প্রবেশ করে দেখলো রুদ রোমানা আন্টির রুমের তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ ফোলাফোলা বাচ্চাটার। জয়নব বেগম পাশে বসে থালা বাসন ধুচ্ছেন। রায়হান দ্রুত রুদের কাছে এগিয়ে গেলো। ওকে দেখে রুদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কেঁদে দিয়েছে বাচ্চাটা। জয়নব বেগম উঠতে গেলে দেখলেন রায়হান এসেছে। উনি আর না গিয়ে বসে পড়লেন। ভেবেছিলেন বাচ্চাটা আবার পড়ে গিয়েছে বোধহয়। যাক নিশ্চিত হলেন তিনি। রায়হান রুদকে নানা রকম কথা বলছে। আদর করে বলছে,

“কি হয়েছে আমার রুদ সোনার। ভাইয়ু এসে পড়েছি তো। কাঁদে না রুদ পাখি।”

রুদ কেঁদে কেঁদে ভাড়াটিয়া রোমানার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছে। রায়হানের মনে হলো সে না থাকায় এরা কিছু করেছে নাকি রুদের সাথে। এতটুকু বাচ্চার সাথে কার লাগলো আবার। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়েই নিচে বসে পড়লো। রুদকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে বললো,

“কি হয়েছে? কেউ বকা দিয়েছে তোমায়। কি চায় আমার রুদ সোনা?”

“আমু, আবু চাই। ওই আন্ট তার বাবু আদুর করে। আমার আমু, আবুও আমায় আদুর কুরতো। এখুন আমাকে কেউ আদুর করে না। তুমি কি আমার জন্ন আমু, আবু এনিছো?”

রোমানাদের ঘর দেখিয়ে রুদ বাচ্চা গলায় বলে উঠলো। তারপর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো কান্না চোখে উত্তরের আশায়। রায়হানের বুক কেঁপে উঠলো। চোখ দুইটা ভিজে গেলো। রুদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। বাচ্চাটার কথা শুনে জয়নব বেগমের হাত সেই কখন থেমে গেছে। তারও চোখ ভিজে গেছে। কালকে কিভাবে যে বাচ্চাটাকে সামলিয়েছে সে আর আল্লাহ্ জানেন। ভাইয়ের জন্য, বাবা, মায়ের জন্য কেঁদে অস্থির করে তুলেছে তাকে আর আফজাল হোসেনকে। কি হবে এদের ভবিষ্যৎ? জীবন তাদের কোথায় দাঁড় করায় সেটাই দেখার বিষয়।
_____
—–

কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। রায়হান এই কয়েকদিনে নতুন জীবনের সাথে খুব ভালোভাবে না হলেও মোটামুটি ভালোই পরিচিত হয়েছে। জীবন তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। সংগ্রাম করে কিভাবে বাঁচতে হয় সব আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যেন। রায়হান এডমিশন পরীক্ষা দিবে আজ। তার জীবনের একটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে সে। ভাত রান্না করতে করতে এসব ভাবছে। এখন আর জয়নব বেগমদের সাথে খায়না রায়হান। শরম লাগে। আর কয়দিন তাদের ঘাড়ে বসে খাবে। বাজারে যায় প্রতিদিন। তার বিনিময়ে চাল, ডাল নেয় রায়হান তাদের থেকে। এখন টুকটাক বাজার করা শিখেছে সে। তবুও হাজার ভুল হয়। দিলদার শিখিয়ে দেয় কখনো, আবার রেগে যায় কখনো। এই কয়দিনে রায়হান অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। আগের রায়হান আর এই রায়হানের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। যে ছেলেকে রাজপুত্রের মতো লাগতো তার চেহারা এখন মলিন। পড়নের পোশাক পুরাতন। পুরোনো হয়ে গেছে কিন্তু কিনার সামর্থ্য নেই। একটা শার্ট আছে। একটু নতুন। ওটা পড়েই আজ পরীক্ষা দিতে যাবে সে। রাহমিদ ঘুমাচ্ছে। সারা রাত জ্বালিয়েছে সে। রায়হান পড়েছে আর ওকে সামলেছে। রাহমিদ এর মধ্যে ওর বইয়ের পাতাও ছিঁড়ে ফেলেছিল একটা। মাগো কি রাগ! এটা ভেবেই রায়হান হেঁসে দিলো। ভাড়াটিয়া একজন বলে উঠলো,

“কি ছেলে, কতক্ষন লাগবে রাঁধতে। চুলা খালি করো আমারও তো রাঁধবো। বেলা গড়ালো বলে। সাতটা বেজে গেছে প্রায়। তোমার আংকেলকে খাইয়ে পাঠাতে হবে তো। তাড়াতাড়ি করো।”

এতক্ষণ যিনি কথা বললেন তিনি ভাড়াটিয়া লাবনী আন্টি। ওনার কথা খুব সাবলীল। রুদকে ভীষণ আদর করেন। ঝামেলার মধ্যে বেশি একটা থাকেন না। রায়হান কোনো কথা না বলে দ্রুত ভাতের মাড় গাললো। তরকারি কালকে রাতের টাই গরম করলো। তরকারি আর কি ওই তো ডাল আর আলু ভর্তা। জয়নব বেগম একটু মুরগির গোশত দিয়েছিলেন সেটা দিয়ে রুদকে ভাত খাইয়েছে। আর যেটুকু বাকি ছিল সেটা রেখে দিয়েছিল। এখন ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিবে। রাহমিদকেও ভাত চটকে পানি দিয়ে নরম করে খাওয়াবে। একটু ডানো দুধ কৌটায় থাকলে সেটা পানি দিয়ে গুলিয়ে খাইয়ে দিবে যদি থাকে আর কি। এসব ভেবে ভেবে দ্রুত কাজ শেষ করলো। হাতও পুড়িয়ে ফেললো কয়েক জায়গায়। আগে জ্বললেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
______
—-

রায়হান পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় রাহমিদ ভীষণ চিল্লালো। কিছুতেই ভাইকে ছাড়া থাকবে না সে। জয়নব বেগমের কোলে বসে ভাইয়ের কোলে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে। কঠিন কান্না জুড়ে দিয়েছে সে। রায়হানের এটা দেখে এতো কান্না পেলো। মনে হলো ভাইকে রেখে কিভাবে পরীক্ষা দিবে সে। তার যে কলিজা পুড়ছে। রায়হান কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে আদর করলো। তারপর জয়নব বেগমকে দিতে গেলে রাহমিদ শক্ত করে গলা জড়িয়ে রাখলো। জয়নব বেগম কিছুতেই বাচ্চাটাকে কোলে নিতে পারলেন না। রুদ ছোট ভাইয়ের কান্না দেখে নিজেও কেঁদে দিলো। তার মনে হলো ভাইও বুঝি মা, বাবার মতো আদর করে চলে যাবে আর ফিরবে না। রায়হানের এখন অসহায় লাগছে। এভাবে ছোট ভাইবোনদের কাঁদিয়ে কিভাবে পরীক্ষায় বসবে সে। ওদিকে পরীক্ষার সময়ও হয়ে যাচ্ছে। আফজাল হোসেন বুঝলেন ওর মনের ভাষা। রায়হানের কাছে গিয়ে দ্রুত রাহমিদ কে কোলে নিলো। রাহমিদ চিৎকার করে উঠলো। আফজাল হোসেনকে খামচি দিয়ে লাল বানিয়ে ফেললো। রায়হান কান্না চোখে চেয়ে দেখলো। আফজাল হোসেন বললেন,

“তুমি আল্লাহর নাম নিয়ে যাও। ওদেরকে তোমার আন্টি দেখবে। আমরা আছি। চিন্তা না করে ঠাণ্ডা মাথায় পরীক্ষা দিবা। এদিক ওদিক না তাকিয়ে যা পারো লিখবা। দোয়া দুরুদ পড়ে লিখা শুরু করবা। তাহলে আল্লাহ্ তায়ালাই উপর থেকে ফয়ছালা করে দিবেন। আমার আর তোমার আন্টির দোয়া থাকবে। যাও আল্লাহর নাম নিয়া বের হয়ে যাও। দিলদার তোমার সাথে যাবে। ভয় পাবে না। আল্লাহ্ হাফেজ।”

আফজাল হোসেনের কথা শুনে মনে কিছুটা সাহস পেলো রায়হান। তারপর রুদকে আদর করে বের হয়ে পড়লো। রাহমিদকে আর ধরলো না। বাচ্চাটা ননস্টপ চেঁচিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। রায়হানের বুক ভারী হলো। রাস্তায় হাঁটছে আর ওর কান্না শুনতে পাচ্ছে। আস্তে আস্তে বাচ্চাটার কান্না মিলিয়ে গেলো। রায়হান আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

“হে পরওয়ারদিগার, আমার ভাইবোনকে দেখে রাইখেন। আপনি আমার ভাইয়ের কান্না কমিয়ে দেন। আপনি তো সবই পারেন মালিক। হে আল্লাহ আমাকে সাহস দেন, শক্তি দেন এইসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য। হে আল্লাহ, আপনার সৃষ্টির কান্না আপনি কমিয়ে দেন পরওয়ারদিগার।”

চলবে…

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১৪
#তাজরীন_ফাতিহা

বিকেল চারটা বাজে। বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরলো রায়হান। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার। গায়ের ভিজে শার্ট লেপ্টে রয়েছে শরীরে। বাসায় ঢুকেই চোখে পড়লো দুই ভাইবোনের দিকে। বিছানায় খেলা করছে দুইজন। রাহমিদ খেলছে কম কাদঁছে বেশি। একটু পর পর কেঁদে উঠে আর বোনের কোলের মধ্যে গড়াগড়ি খায়। রুদ ভাইকে আদর করে দেয়। রাহমিদ আবার কান্না থামিয়ে বোনের মুখের দিকে তাকায় মুখে আঙ্গুল ভরে। রুদ ওর তাকানো দেখে গাল টিপে আদর করে দেয়। রাহমিদ গাল ফুলিয়ে তাকায়। বোনের এই গাল টিপা তার পছন্দ হয়নি বোঝাই যাচ্ছে। সেটা দেখে রুদ গালে আদর করে দেয়। রাহমিদ আবার কি মনে করে যেন কেঁদে ওঠে। রুদ নিজের বাচ্চা বাচ্চা হাত দিয়ে ভাইকে কোলের মধ্যে কোনরকম টেনে নিলো আর বললো,

“বাবুন এতু কাঁদে কেনু? বাবুনকে মিরেছে কে? বাবুনের আপি বাবুনকে আদুর করে তো। কাঁদে না বাবুন, কাঁদে না। ভাইয়ু আসি পড়বে।”

রাহমিদ বোনের কথা শুনে চুপ করে মুখে আঙ্গুল ভরে তাকিয়ে থাকলো। তারপর মুখ থেকে আঙ্গুল বের করে বোনের চুল ধরে টান দিলো। রুদ ব্যথা পেয়ে চিৎকার দিলো। রাহমিদকে সরিয়ে দিয়ে ধমক দিলো,

“আবার চুল টান দিয়েছু কেনু পুঁচা ছিলে। পিট্টি দিবো।”

রাহমিদ বোনের ধমকে আবারও কেঁদে দিলো। এতক্ষণ রায়হান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাইবোনের আদুরে মুহূর্ত দেখছিলো। ভাইয়ের কান্নার শব্দে তার ঘোর কাটলো। সে দ্রুত রুমে ঢুকে ভাইকে কোলে তুলে নিলো। রাহমিদ কান্নার তালে বুঝতে পারলো না কে কোলে নিয়েছে। সে ভেবেছে আবারও জয়নব বেগম কোলে নিয়েছে। সে তাই আরো জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। রায়হান কোলে নিয়ে আদর করে বলতে লাগলো,

“ভাইয়ু এসে গিয়েছি তো টোটন সোনা। আমার কলিজা কাঁদে কেন? আমার কলিজাকে কে কাঁদিয়েছে? কার এতো বড় সাহস আমার টোটনকে মারে, বকে? ভাইয়ু মেরে দিবো তাকে ঠিক আছে।”

রায়হান ভাইয়ের কণ্ঠ শুনে কান্না থামিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রুদ রায়হানকে দেখে খাট থেকে নেমে ভাইয়ের পা জড়িয়ে ধরলো। রায়হান বোনকে আগলে নিলো। জয়নব বেগম ফিটারে দুধ ভরে এনে দেখলেন রায়হান এসে গেছে। তিনি ফিটার টা ঠাণ্ডা করে এনেছেন। রায়হানের হাতে দিয়ে বললেন,

“আলহামদুলিল্লাহ তুমি আইসা পড়ছো। তোমার ভাই তো তুমি যাওনের পর একমিনিটও কাঁন্দন থামায় নাই। কেমনে সামলাইছি আল্লাহ্ জানে। তোমার বইনের কাছে গেলে একটু কাঁন্দন থামায় নইলে কাঁনতেই থাহে। থামাথামি নাই কোনো। যাক চিন্তা মুক্ত হইলাম। তোমার পরীক্ষা কেমন হইছে?”

“জি আলহামদুলিল্লাহ দিয়েছি যতটুকু পেরেছি।”

“আইচ্ছা। পোশাক ছাইড়া লও। ঘাইমা গেছো তো একবারে। আমি ভাত দিতাছি।”

“না আন্টি ভাতের দরকার নেই। আমি রেঁধে নিবো।”

“কেমনে রাঁধবা এই কেলান্ত শরীলে। বেশি কতা না কইয়া গোসল কইরা আহো। ওরে দুধ খাওয়াইতে পারি নাকি দেহি। যাও। বেশিক্ষণ ভেজা শরিলে থাকন ভালা না।”

রায়হান রাহমিদকে কিছুক্ষণ আদর করে টয়লেটে চলে গেলো। রাহমিদ আবার কাঁদতে লাগলো। রায়হান দ্রুত গোসল শেষ করে এসে রাহমিদকে কোলে নিলো। বাচ্চাটা দুধ খায়নি। সে এসে মুখে ফিটার দিলো। ভাইয়ের কোলে শান্ত বাচ্চার মতো পড়ে রইলো রাহমিদ। রায়হান রুদকে কাছে ডেকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে কপালে গালে আদর করলো। জিজ্ঞাসা করলো,

“বাবুন জ্বালিয়েছে পাখি? ভাইয়ুর উপরে রাগ করেছো বাচ্চা?”

“নো। বাবুন চুলি বিথা দিছে। বাবুন কিছু খাইনি সারাদিন। এট্টু ফিটার খিয়েছে শুধু। তুমি কুই ছিলে ভাইয়ু?”

“ভাইয়ু পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম সোনা। তুমি খেয়েছো কিছু?”

“খিয়েছি। ভাত আর গুস্তো।”

রায়হান বোনকে জড়িয়ে রাখলো। বাচ্চাগুলোর প্রতি এই কয়দিন একেবারেই খেয়াল রাখা হয়নি। রাহমিদ চোখ পিটপিট করে ভাই বোনের কথা শুনছে। ফিটার দুই হাত দিয়ে ধরে চুক চুক শব্দ করে দুধ খাচ্ছে সে। ভাইয়ের কোলে একেবারে শান্ত বাচ্চার মতো পড়ে আছে অথচ সারাদিন ছিল অশান্ত অগ্নিগিরি লাভা।
_____
—-

জয়নব বেগমের মেয়ে আয়েশা ও তার শাশুড়ি এসেছে বেড়াতে। আফজাল হোসেন ও জয়নব বেগম দম্পত্তির একটি কন্যা। আরও দুইজন ছেলে মেয়ে ছিল। মেয়েটা পাঁচ মাস বয়সে মারা যায় টাইফয়েডে আর ছেলেটা তিন বছর বয়সে পানিতে পড়ে। আফজাল হোসেন ও জয়নব বেগম প্রচুর ভেঙে পড়েছিলেন। দুইজন সন্তান, কলিজার ধনের অকাল মৃত্যু জয়নব বেগমকে খুবই ব্যথিত করে। প্রথম প্রথম আফজাল হোসেন জয়নব বেগমকে কিছুতেই মানাতে পারতেন না। সেই দিন গুলো তাদের কাছে ছিল অসহনীয় বেদনায় মোড়ানো। সেইসব স্মৃতি কখনোই ভোলার মতো না। এখনো জয়নব বেগমের কাছে দিন গুলো কেমন তাজা। পরে আল্লাহ্ তায়ালার উপর ভরসা করে তিনি নিজেকে সামলেছিলেন। কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সেই হাদিস তাকে প্রশান্তি দেয়।

“যে ব্যক্তির দুইটি বা তিনটি সন্তান ছোট বা নিষ্পাপ অবস্থায় মারা যাবে তার জন্য জান্নাত ফরজ হয়ে যাবে। অর্থাৎ ওই সন্তানগুলো জাহান্নামের ঢাল হবে।” (বুখারী)

এই হাদিসটি জয়নব বেগমকে শান্তি ও আশ্বাস দেয়। রায়হানদের দেখে প্রথমেই তার সন্তানের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তাদের জন্য জয়নব বেগমের অনেক মায়া কাজ করতো। চোখের সামনে মৃত সন্তানের বয়সী এতিম ছেলেমেয়েদের দেখলে কোনো মানুষই মায়া না দেখিয়ে থাকতে পারবে না। পাষাণ ব্যক্তির মনও গলে যাবে। আর আফজাল হোসেন দম্পত্তি তো দিল খোলা মানুষ। আসলে আমাদের সমাজে ধনীদের তুলনায় গরীব মানুষদের মনে মায়া মহব্বত বেশি। নাহলে তো রায়হানের মতো মানুষদের এই দুনিয়ায় টিকে থাকাটা দুষ্কর হয়ে পড়তো। আয়েশার শাশুড়ি আসাতে আফজাল হোসেন বাজার করে এনেছেন নিজের সাধ্যের মধ্যে। মেয়ের শশুরবাড়ির লোকজনকে ভালো খাওয়াতে না পারলে, মাসে মাসে কিছু না পাঠালে কত কথা শুনতে হয় মেয়েকে। মেয়ের জামাইয়ের আড়তের ব্যবসা আছে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারেই কন্যা সম্প্রদান করেছেন আফজাল হোসেন। মেয়েটা খুব বেশি একটা বাবার বাড়ি আসতে পারেনা। আসলে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিলে বাবা মায়ের আর অধিকার থাকে না মেয়ের উপর। তখন মেয়ে হয়ে যায় বাবার ঘরের মেহমান। জয়নব বেগম রান্নাবান্না করছে। মুরগি ধুয়ে কাটা বাছা করে কাটতে লেগে গেলেন তিনি। আয়েশা মায়ের হাতে হাতে কিছু এগিয়ে দিচ্ছে। জয়নব বেগম মানা করেছিলেন তাও শুনেনি। এতো রান্না মা একা করবে আর সে বসে বসে পায়ের উপর পা তুলে খাবে এটা কখনোই সে মানবে না। জয়নব বেগম আর কথা বাড়াননি। আয়েশা পোলাওয়ের চাল ধুয়ে আনলো। আয়েশার শাশুড়ি সেলিনা পারভীন জয়নব বেগমদের ঘরে শুয়ে আছেন। এই বাসায় আসলেই তার বিরক্তি ধরে যায়। ছোট ছোট রুমে কিভাবে এরা থাকে। উনি কখনোই এই বাসায় রাত কাটান না। ছেলেকেও কাটাতে দেন না। এবার এসেছেন ভিন্ন এক কারণে। বেয়াই নাকি অনাথ আশ্রম খুলে বসেছেন। সেটাই দেখতে এসেছেন। নিজেদেরই চলে না আবার তিন তিনটা ছেলে মেয়ের ভরণপোষণ সামলাচ্ছেন তিনি। এমনিতে তো নিজের মেয়ের জামাইকে কিছু দিতে ওনার হাত কাঁপে। তখন নানা বাহানা দেয়া শুরু করে আর এখন নাকি কোথাকার কোন এতিম অনাথদের উঠিয়ে এনেছে। তাদেরকে পালছে। তাও আবার চার মাস ধরে ভাবা যায়। তাদেরকে এসব জানায় পর্যন্ত নি। তার স্বামী হামিদ আলী নাকি কার কাছ থেকে শুনেছেন। এসব ভেবেই সেলিনা পারভীন রাগে দিশেহারা হয়ে পড়েন। এর একটা বিহিত করতে হবে।
_____
—–

রায়হান দুটো টিউশনি করায়। টিউশনি অবশ্য রুস্তম ভাই জোগাড় করে দিয়েছেন। তার চেলা আব্বাসের আত্মীয়ের বাড়িতে একটা আরেকটা বাচ্চুর পাড়ার এক ছোট ভাই। রায়হান টিউশনি করাতে যায় রাহমিদকে নিয়ে। বেবি ক্যারিয়ার ব্যাগে রাহমিদ ঝুলতে থাকে আর ভাই স্টুডেন্ট পড়াতে থাকে।মাঝে মধ্যে গরম লাগলে চেঁচিয়ে উঠে। স্টুডেন্টের মা প্রথমে মানতে নারাজ। বাচ্চা নিয়ে টিউশনি করায় নাকি কেউ? বাচ্চা চিৎকার করবে, টয়লেট করবে, খেতে চাইবে এতে করে বাচ্চার দিকে মনোযোগ বেশি থাকবে স্টুডেন্ট আর কি পড়াবে? এসব ভেবে দুইজন স্টুডেন্টের অভিভাবকই নাকচ করে দিয়েছেন প্রথমে। কিন্তু রুস্তম ভাইয়ের কাছে রায়হানের করুন কাহিনী শুনে মন তাদের কিছুটা গলেছে। তবুও শর্ত জারি করে দেয়া, তাদের সন্তানের পড়লেখার কোনো ক্ষতি যেন না হয়। বাচ্চা যেন অহেতুক চিল্লাচিল্লি না করে। রায়হান সব শর্ত মেনেছে কিন্তু বাচ্চা কি আর শান্ত থাকার জিনিস। রাহমিদ সাহেব ভাই পড়ানো শুরু করলে ভাইয়ের সাথে সাথে অস্পষ্ট আওয়াজে নানান কথা বলতে থাকে। রাহমিদ এখন মোটামুটি কিছু কথা বলতে পারে। হাঁটতেও পারে কিছুটা। তবে তিনি হাঁটতে রাজি নন। ভাইয়ের কোলে চড়তেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। রুদকে জয়নব বেগমের কাছেই রেখে যায় সে। রায়হান রুদকে শান্ত বাচ্চার মতো বাসায় থাকতে বলে। এর বিনিময়ে প্রতিদিন চকলেট নিয়ে আসে বোনের জন্য। বোনটার দেখাশুনা তেমন করতে পারেনা সে। টিউশনি করিয়ে এসে রান্না করা, ভাই বোনের জামাকাপড় ধোয়া এসব করতে করতেই ক্লান্তি ধরা দেয় শরীরে। পরে আর ভাই বোন কারোর প্রতি কোনো যত্নআত্তি করতে পারেনা সে। রুদ প্রথম প্রথম কাঁদতো খুব। বড় ভাই ছোট ভাইকে নিয়ে চলে যায় কেন প্রতিদিন? পরে রায়হান বুঝিয়েছে অনেক। রাহমিদকেও নিতো না কিন্তু ও তো ছোট। একা থাকতে পারবে না। খালি কাঁদবে তাই ওকে নিয়ে যায়। রাহমিদ একটু বড় হোক ওকেও বাসায় রেখে যাবে রায়হান। এরকম নানা কথা বলে রুদকে সান্ত্বনা দিয়েছে সে। রুদ ভাইয়ের কথা মেনে নিয়েছে এখন। রায়হান আজকেও ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে। কয়েকদিন ধরে এরকম বিধ্বস্ত হয়েই সে বাড়ি ফেরে। ভার্সিটির রেজাল্ট দিবে পরশু। সেই নিয়ে চিন্তিত রায়হান। আল্লাহর উপর ভরসা করে আছে। নামাজের পর দোয়া তো আছেই। ভালো একটা ভার্সিটিতে যেন চান্স হয়ে যায়। বেশি কিছু চাওয়ার নেই তার। আল্লাহ্ তায়ালা তার ভাই বোনকে নিয়ে চলার একটা গতি করে দিক। এটাই চাওয়া। এসব ভেবেই রায়হান রুমে ঢুকে দেখে রুদ বালিশে মুখ ঢুকিয়ে কান্না করছে। রুদ তো সচরাচর কাঁদে না হঠাৎ আজ এভাবে কাদঁছে কেন? রায়হান রুমে ঢুকে রাহমিদকে নামিয়ে বিছানায় শোয়ালো। তারপর রুদের কাছে গিয়ে ওকে বিছানা থেকে উঠিয়ে কোলে নেয়। আদর করতে করতে জিজ্ঞাসা করে,

“কি হয়েছে রুদ। কাঁদে কেন আমার পাখিটা?”

রুদ ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁছে। রায়হান মনে করলো সে দেরি করে আশায় বোধহয় বাচ্চাটা কাদঁছে। তাই সে বললো,

“কাঁদে না রুদ। তুমি না ভাইয়ুর স্ট্রং সিস্টার। এইতো ভাইয়ু এসে পড়েছি। আর কাঁদে না সোনা।”

এরকম নানা কথা বলে রুদের কান্না থামালো রায়হান। কান্না কিছুটা কমে এলে রায়হান বললো,

“রুদকে না ভাইয়ু বুঝিয়েছি। ভাইয়ু কাজ করে তো সোনা। কাজ না করলে খাবো কি? তুমি না বলেছো আর কাঁদবে না তাহলে আজকে কাঁদলে কেন? স্ট্রং গার্লরা কখনো কাঁদে না পাখি। আর কাঁদবে বলো?”

“এক আন্টি বুকা দিছে। আমাকে ধাক্কা দিছে। হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছি। আমি কিছু করিনি। এট্টু মুখ ধুতে গেছি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিছে। রেগে রেগে অনেক কিছু বলিছে। আমি কান্না করলে নাকি আরও মারবে তাই দৌঁড় দি ঘরে এসে বালিশি মুখ ঢুকিয়ে কানছি। কান্নার আউয়াজ যাতে কম হয়। পরে আবার মারলে। ইখানে বিথা।” রুদ হাঁটু দেখিয়ে বললো।

রায়হান কথা বলতে ভুলে গেলো। জামা উঠিয়ে দেখলো হাঁটু অনেক খানি ছিলে গেছে। রক্ত বার হয়নি। বাচ্চাটা ব্যথায় কান্না করছে। যে রুদ একটু ব্যাথা পেলে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিতো আজ সেই রুদ কারো মারের ভয়ে চুপিচুপি কেঁদেছে যাতে আবার মার না খায়। তার বোনটা কি বড় হয়ে গেলো অনেক। তার ভাই বোনের নসিবে এসবই কি লিখা ছিল? এতিম হয়ে রাজকীয় ঘর ছেড়ে বস্তিতে থাকছে, মানুষের মার, লাথি উষ্ঠা খাচ্ছে এসবই কি তাদের কপালে লিখে রেখেছেন আল্লাহ্। রাহমিদ চিৎকার করে কান্না করছে। রুদ ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে আর সে অদৃষ্টের পরিহাস দেখছে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে