#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১২
#তাজরীন_ফাতিহা
আজকের আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। চারপাশে কেমন ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। এমন পরিবেশে আত্মা জুড়িয়ে যায়। রায়হানের এই রকম আবহাওয়া বরাবরই প্রিয় কিন্তু আজকে রায়হানের এই সুন্দর চারিপাশ বিষাক্ত ঠেকছে। রাহমিদটার জ্বর, ঠাণ্ডা। নাজেহাল অবস্থা প্রায়। বাচ্চাটা থেকে থেকে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠছে, কাশি দিচ্ছে। যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছেনা বাচ্চাটা। রায়হান ওকে কোলে নিয়ে গায়ের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। বাচ্চাটার কান্না থামছে না। রায়হানের অস্থির লাগছে। কয়েকদিন পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে গিয়ে বাচ্চাগুলোর প্রতি যত্ন নিতে পারেনি সেভাবে। রায়হান এডমিশনের জন্য জান প্রাণ লাগিয়ে পড়ছে। সেদিনের পর বিশ দিন কেটে গেছে। আর কিছুদিন পরই এডমিশন পরীক্ষা। আফজাল হোসেনের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নীলক্ষেত থেকে সস্তা মূল্যে এডমিশনের বই কিনে এনেছে সে। দিলদার ভাই অবশ্য এই নীলক্ষেতের ঠিকানা দিয়েছিল। এখানে নাকি সস্তায় বই পাওয়া যায়। এটা শুনে রায়হান দিলদারকে নিয়ে বই কিনে এনেছে। দিন রাত এক করে পড়ছে সে। তাকে একটা ভালো পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেতেই হবে। কিন্তু পড়ালেখায় সময় দিতে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে সময় দিতে পারছে না সে। এটা তাকে খুবই পীড়া দিচ্ছে। মনে হচ্ছে পড়ালেখা করার দরকার নেই আবার পরক্ষনেই মনে হচ্ছে পড়ালেখা না করলে এই ভাইবোনদের সে কিভাবে মানুষ করবে। দুনিয়াটা যে সোজা না এটা সে গত কয়েকদিনে বুঝে গিয়েছে। রাহমিদ রায়হানের কোলের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে। বাচ্চাটার শরীর গরম অনেক। কিভাবে যে জ্বর আসলো জানা নেই রায়হানের। আর এমনিতেও বাচ্চাদের রোগ শোক লেগেই থাকে। রায়হান জলপট্টি দিলো। রাহমিদ টা জ্বরের ঘোরে খালি কান্না করছে। রায়হান রাহমিদকে কোলের মধ্যে নিয়ে ঝাপটে ধরে জলপট্টি দেয় আর বলে,
“আমার টোটনের কি হয়েছে। আল্লাহ্ আমার টোটনকে ভালো করে দাও। ও রাহমিদ, রাহমিদরে, আমার কলিজা ভাইয়ু তোমায় সময় দেয়নি দেখে জ্বর বাধিয়েছো। ভাইয়ু পঁচা তাই নারে।”
রাহমিদের কান্না কোনোভাবেই থামার নয়। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। রায়হানের অস্থির লাগছে ভীষণ। কি করবে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না। কিভাবে জ্বর কমাবে? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? কিছু টাকা আছে এতেই হয়ে যাবে বোধহয়। নাহ্ আর বসে থাকা যায় না। এসব ভেবেই দাঁড়িয়ে পড়লো রায়হান। আবহাওয়া যদিও ভালো না তবুও ঘরে বসে থাকলে সমাধান হবে না। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে বের হলো। রুদকে জয়নব বেগমের কাছে দিয়ে যাবে ভাবলো। জয়নব বেগম কলপাড়ে হাঁড়ি পাতিল মাজছিলেন। রায়হান সেখানে গিয়ে বলে উঠলো,
“আন্টি?”
জয়নব বেগম ফিরে চাইলেন। বললেন,
“কি হইছে বাবা? কিছু লাগবো?”
“রাহমিদের অনেক জ্বর। জলপট্টি দিয়েছি কাজ হয়নি ওকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। বাচ্চাটা মারাত্মক কান্না করছে? রুদকে যদি একটু দেখতেন।”
জয়নব বেগম বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। রাহমিদের গালে কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“হায় হায় এত জ্বর? কহন থেইক্কা এমন?”
“সকাল থেকে। এমনিতেও কয়েকদিন ধরে খাবার দাবারে প্রচুর অরুচি ওর। প্রথম এত পাত্তা দেইনি আবার টাকারও ব্যাপার ছিল। চাইলেও ওষুধ কিনে খাওয়াতে পারিনি কিন্তু আজকে সকাল থেকে এত জ্বর যে কিছুতেই কমে না। তাই ভাবলাম একটু ডাক্তার দেখিয়ে আনি।”
“ঠিক আছে যাও। তয় টেকা আছে তোমার তে?”
“কিছু আছে আন্টি।”
“ওই টেকায় হইবো? খাড়াও এহানে।”
“আন্টি হয়ে যাবে। আর লাগবে না। শুধু শুধু আপনার টাকা দেয়ার প্রয়োজন নেই।”
“তাও লইয়া যাও। যদি লাগে। পড়ে দিয়া দিও তোমার টেকা হইলে।”
কথাটা বলেই জয়নব বেগম দ্রুত ঘরে গেলেন। ঘরে গিয়ে কিছু টাকা নিয়ে এসে রায়হানের হাতে দিলেন। রায়হান নিতে চায়নি কিন্তু তিনি জোর করে দিয়ে দিয়েছেন। রাহমিদ কেঁদে যাচ্ছে একনাগাড়ে। রায়হান আর দেরি না করে দ্রুত ফার্মেসিতে রওনা দিলো।
____
—-
“হাওয়া মে উড়তা রাহে,
মেরা লাল দুপাট্টা মাল মাল
মেরা লাল দুপাট্টা মাল মাল।
ওহো ওহো”
চায়ের দোকানে বসে রুস্তম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা গান গাচ্ছে। ভুলভাল গান। তাও আবার বাকের ভাইয়ের বিখ্যাত গান। রুস্তম আবার বাকের ভাইয়ের বিরাট ভক্ত। কাজ কাম সব বাকের ভাইকে কপি করে করে সে। হাতে, গলায় চেইন দিয়ে মুড়ানো। হাতে চায়ের কাপ। তার দুই চেলা বাচ্চু আর আব্বাস ঘাড় টিপে দিচ্ছে। দিলদার মোবাইলে টাকা ভরে হোটেলে যাচ্ছিলো। এর মধ্যেই এই আজাইরাদের দেখা। ফোনে টাকা শেষ হওয়ার আর সময় পায়নি। দিলদারের মনে হলো এই রাস্তা দিয়ে না গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে যাবে যদিও পথ বড় হবে তাতে কি এদের থেকে তো মুক্তি পাবে। পুরাই বিরক্তিকর একটা গ্যাং। দিলদার উল্টো পথ ধরতেই দেখলো রুস্তমের আরেক চেলা এইখানেই আসছে। এসেই দিলদারকে বললো,
“কিরে হোটেল তো সামনে তুই এই পথ দিয়ে কই যাস?”
কথায় আছে না “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়” কথাটা একেবারে দিলদারের সাথে খাটে। দিলদার কাচুমাচু করে বললো,
“সবুজ ভাই সামনে একটু কাম আছে তাই যাইতাছি আরকি।”
“কিন্তু তোরে দেখলে তো তা মনে হয়না। কেমন চোরের মতো লাগতেছে।”
শুরু হয়ে গেছে অপমান করা। এসব সহ্য করা যায় না। শেষ পর্যন্ত চোর। দিলদার বললো,
“না ভাই সত্যই কাম আছে।”
“আইচ্ছা যাবি নে। আগে ভাইয়ের লগে দেহা কইরা যা।”
গোদের উপর বিষফোঁড়া। যে ভয়টা দিলদার পাচ্ছিলো সেটাই হলো। সবুজ ওকে টানতে টানতে রুস্তমের সামনে আনলো। রুস্তম চায়ে চুমুক দিয়ে ওর দিকে তাকালো। দিলদার চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বাচ্চু ওকে বললো,
“কিরে চেগাইয়া খাড়ায় আছোস কেন? সালাম দে ভাইরে।”
দিলদার সালাম দিলো। রুস্তম চা খেয়ে বললো,
“কিরে বগা, এহানে কি তোর?”
দিলদারের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। আবারও অপমান। সে বললো,
“একটা কাম আছিলো ভাই তাই।”
“কি কাম আবার। যাউকগা হুন। দেখতো আমারে কেমন লাগতেছে।”
রুস্তম পোজ দেয়ার চেষ্টা করলো। দিলদারের বলতে ইচ্ছা করলো, “ভাই বান্দর দেখছেন, বান্দরের থেকেও বিশ্রী।” কিন্তু মুখে কিছুই বললো না। আব্বাস বলে উঠলো,
“কিরে কস না কেন? ভাইরে হেব্বি লাগতেছে না।”
দিলদার হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু হাসাটা ঠিক ফুটে উঠতে চাইলো না মুখে। বললো,
“হ ভাই হেব্বি।”
এর মধ্যেই কে যেন ডেকে উঠলো,
“দিলদার ভাই?”
দিলদার ও রুস্তমের সব সাঙ্গপাঙ্গ রা ঘুরে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিলদার দ্রুত সেখানে গিয়ে বললো,
“রায়হান তুমি এইহানে কি করো?”
“ভাই রাহমিদের অনেক জ্বর। ওরে নিয়ে ফার্মেসিতে গিয়েছিলাম। উনি বলছে হাসপাতালে ভর্তি করতে। অবস্থা নাকি ভালো না। আমি তো হাসপাতাল চিনি না এখানকার তাই আপনাকে দেখে ডাক দিছি।”
কথাগুলো বলতে বলতে রায়হান কেঁদে দিলো। ভাইয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে সে। বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে গেছে। রায়হান কি করবে দিশা না পেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তখন দিলদারের কথা শুনে তাকে ডাক দিয়েছে। রুস্তম এতক্ষন রায়হানের কথা শুনছিল। আব্বাস বলে উঠলো,
“ভাই এই পোলারেই হেদিন দিলু কতা হুনাইতেছিল।”
বাচ্চু বলে উঠলো,
“এ মনে ওয় দিলুর পরিচিত। আহারে পোলাডার চোক্ষে কি মায়া। বাচ্চাটা কানতাছে।”
রুস্তম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা সেখানে গিয়ে কাহিনী জানলো। তারপর এখনকার একটা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে দিলো।
_____
—-
রায়হান হাসপাতালের বেডে রাহমিদকে নিয়ে বসে আছে। বাচ্চাটার হাতে স্যালাইন লাগানো। সরকারি হাসপাতাল গুলোর এই এক সমস্যা। অনেক ভিড়। অনেক গুলো বেড এক রুমের মধ্যে। ডাক্তার রাহমিদকে দেখে বলেছেন, বাচ্চাটার নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারতো আর একটু দেরি করে ভর্তি করালে। খাবারে অনিয়ম বাচ্চাটার শরীর ভেঙে আরও অসুস্থ করে ফেলেছে। ঘন ঘন গোসল, ভিজা জামাকাপড়ে থাকলে নাকি নিউমোনিয়া অনেক মারাত্মক আকার ধারণ করে। রায়হান মনে করে দেখলো গত কয়েকদিনে রাহমিদকে ঠিক মতো দেখাশোনা করতে পারেনি। হয়তো ভেজা জামাকাপড়ে থেকেই এতটা জ্বর হয়ে গেছে। আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে নিউমোনিয়া হয়নি। এর আগেই রায়হান হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিলো। এটা নিয়ম করে খাওয়াতে বললো। রুস্তম, দিলদার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বাইরে অপেক্ষা করছে। ভিতরে বেশি মানুষ থাকা উচিত না দেখে তারা বাইরে অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে গেলো। রায়হান বের হলো তার অল্প কিছুক্ষণ পর। রায়হানকে দেখেই দিলদার বললো,
“গুরুতর কিছু?”
“না ভাই তবে হতে পারতো। কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছে। ওকে নিয়মিত খাওয়াতে বলেছে।”
“ছাইড়া দিছে নাকি থাকন লাগবো এইহানে?”
“স্যালাইন দিয়েছে তো তাই কালকে সকালে চলে যেতে বলেছে। আমার রুদের জন্য টেনশন হচ্ছে। ও তো আমাকে ছাড়া কখনো থাকেনি ভাই। ও যদি কান্না করে।”
“টেনশন কইরো না। চাচি দেইখা রাখবো। তুমি রাহমিদ রে দেহো।”
“ভালো লাগছে না কিছুই। আমার ভাই, বোনদের রোগ শোক পিছু ছাড়ে না কেন ভাই?”
রায়হানের কান্না গলা। রুস্তম ও তার চ্যালা প্যালা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে তারা যেয়ে কি করবে। যতই বখাটে গিরি করুক দিন শেষে মানুষের বিপদে বখাটেপনা সাজে না। এটা তারা খুব করে মানে। রায়হান দিলদারের সামনে থেকে গিয়ে রুস্তমদেরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালো। তারাই তো এই হাসপাতালের ঠিকানা দিয়েছে নাহলে অতো টাকা দিয়ে কিভাবে সে রাহমিদকে ভর্তি করাতো।
চলবে…