#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১১
#তাজরীন_ফাতিহা
আফজাল হোসেন হোটেলে বসে আছেন। হিসেবের খাতা খুলে হিসেব মিলাচ্ছেন। দিলদার কাস্টমারকে খাবার দিচ্ছে। দিলদার ফ্রী হয়ে আফজাল হোসেনের কাছে এসে বললো,
“একটা কতা আছিলো চাচা।”
“বল”
“চাচা, রায়হান কিন্তু বাজার করা এহনো পারে না। কি করবেন কন তো? আইজকা কি করছে হুনবেন?”
আফজাল হোসেন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কি করেছে আজকে?”
দিলদার আজকের সকালের ঘটনা অদ্যপন্ত বর্ণনা করলো। আফজাল হোসেন মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। দিলদার জিজ্ঞাসা করলো,
“কি করবেন এহন?”
“ভেবে দেখছি। কাজে যা।”
দিলদার “আইচ্ছা” বলে প্রস্থান করলো। নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। এর মধ্যেই রুস্তম বখাটে ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের আগমন। দিলদার এদেরকে দেখে অবাক হয়েছে। সেদিনের ঘটনার পর রুস্তম ভাইকে এই হোটেলে দেখা যেতো না। দিলদার ভেবেছে আপদ বিদায় হয়েছে। এখন তো দেখছে সে ভুল ছিল আপদ আবার এসে জুটেছে। বিরক্তিকর একটা নিশ্বাস ফেললো সে। রুস্তমের চেলা বাচ্চু দিলদারকে ডেকে আনলো। দিলদার বিরক্তি চেপে রেখে রুস্তমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রুস্তম কোনো কথা না বলে আয়েশি ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে দিলদারকে দেখছে। দিলদার আর থাকতে না পেরে বললো,
“কিছু বলবেন ভাই?”
এতক্ষণ পর রুস্তম মুখ খুললো,
“তুই নাকি বিরাট মস্তান হয়েছিস?”
দিলদার আকাশ থেকে পড়লো মনে হয়। মস্তান আর সে। কোথায় আকাশ আর কোথায় পাতাল। দিলদার বিরক্ত হয়ে বললো,
“এইসব কি বলতাছেন ভাই? আমি মস্তান হুমু কেন?”
“সেটা আমি কেমনে জানমু। কয়দিন আহি নাই দেইখ্যা নিজেরে পাতি গুণ্ডা মস্তান ভাবা শুরু করছিস নাকি?”
“এইসব ফাউ কতা আপনেরে কেডা কইছে? আমি কোনো গুন্ডামি করি নাই? কারতে হুনছেন এই আজগুবি কতা?”
এবার রুস্তমের চেলা আব্বাস কথা বলে উঠলো। বললো,
“ভাই এই সেয়ানার কতা হুনবেন না। আমি নিজের চোক্ষে দেখছি একটা পোলারে ধমকাইয়া ধমকাইয়া কতা কইতে আছিলো। মগা, বলদাও কইছে। পোলাডার কোলে একটা বাইচ্চাও আছিল। পোলাডা এক্কেরে মন খারাপ কইরা খাড়ায় আছিলো ভাই। নিজেরে সিনেমার হিরো ভাবে।”
দিলদার হা হয়ে এতক্ষণ আব্বাসের কথা শুনলো। রুস্তম বললো,
“বহুত বাড়ছিস বুঝলাম। হেদিনের কতায় হেব্বি মেজাজ খারাপ হইছে তোর উপ্রে তাই কয়দিন আহি নাই অমনি উড়া শুরু করছিস। রাস্তায় যারে তারে কতা হুনাস। যাউকগা মাইনষেরে মগা কস তুই কি তাইলে? উম তুই হইলি মগার বড় ডা বগা।”
রুস্তমের সকল চেলা হেঁসে উঠে সহমত জানালো। দিলদার অপমানিত বোধ করলো। সে তো রায়হানকে একটু বকা দিয়েছে আর এরা তাকে না জেনে যা তা বলছে। রায়হানকে ওভাবে বলায় নিজেরও খারাপ লাগছিল। এতিম ছেলেটার সাথে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। আচ্ছা, এতিম ছেলেটার সাথে ওভাবে কথা বলায় আল্লাহ্ নারাজ হয়েছেন? রুস্তমকে আল্লাহ্ তায়ালা তার শাস্তি দিতে পাঠান নি তো আবার?
_____
—–
রায়হান রুদের জামা খুলে সারা শরীর মুছিয়ে দিচ্ছে। রুদ জ্বরের ঘোরে থরথর করে কাঁপছে। ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর রায়হান শরীর মুছিয়ে দিয়ে মুখ ধুইয়ে দিলো। বালতিতে রুদকে কুলিকুচি করালো। পাশে রাহমিদ হামাগুড়ি দিয়ে বসার চেষ্টা করছে। রাহমিদ এখন বসতে পারে। তবে নিজে নিজে অনেকক্ষণ বসে থাকতে পারেনা। কারো সাহায্যে বসতে হয়। সে এখন বসে খেলনা দিয়ে খেলছে তবে ব্যালেন্স করতে না পেরে পিছনের দিকে হেলে পড়ে গেলো। বালিশের উপর পড়েছে। শুয়ে শুয়ে এখন হাত, পা ছড়িয়ে খেলছে। পা উপরে তুলে মুখে আঙ্গুল ভরে নানা ধরনের অস্পষ্ট আওয়াজ করতে লাগলো। মাঝে মাঝে কি জানি বলে চিল্লিয়ে উঠে আর হাসে। রায়হান সেটা দেখে মৃদু হাসলো। রুদকে জামা কাপড় পরিয়ে শুইয়ে দিলো। গায়ে কাঁথা টেনে দিলো। বাচ্চাটা জ্বরের তালে কিছুই ঠিক মতো খেতে পরছে না। সেজন্য আজকে সকালে বার্লি কিনে এনেছে সে। দেখা যাক বার্লি খাওয়াতে পারে কিনা। রায়হান রাহমিদকে আদর করে বালিশ দিয়ে চারপাশে বর্ডার করে দিলো। খেলনা দিলো যাতে সে চলে গেলে না চিল্লায়। রুদের কপালে চুমু দিয়ে রাহমিদকে দেখে রাখতে বলে সে রান্না ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলো। রান্না ঘরে এসে দেখে জয়নব বেগম কি যেন রান্না করছে। রায়হানকে দেখে সে দ্রুত বললো,
“কি লাগবো বাবা?”
“কিছু না আন্টি। একটু বার্লি রাঁধবো। রুদ কিছু খেতে পারছে না তাই।”
“দাও আমারে, আমি অক্ষণই রাইন্দা দিতাছি?”
“না না আন্টি দরকার নেই। আমি রাঁধতে পারবো। আপনি শুধু চুলা খালি হলে আমাকে ডেকে দিয়েন।”
“চুলা তো খালিই। আমার রান্না শেষ। তুমি রাঁনতে পারো? আমারে দাও। আমি সুন্দর কইরা পাকাইয়া দেই।”
“সমস্যা নেই। আমি পারবো।”
জয়নব বেগম বুঝলেন রায়হানকে মানানো সহজ না তাই তিনি চুলা খালি করে দিয়ে তরকারি নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আরেকবার রায়হানকে জিজ্ঞাসা করলো সে পারবে কিনা? উত্তরে রায়হান সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। রায়হান চুলায় পাতিল বসিয়ে পানি ঢাললো। পানিতে বার্লি ঢেলে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। বার্লি ফুটে আসলে নামাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেললো। তার মুখ থেকে আর্তনাদ বের হলো। হাতের চামড়া পুড়ে গেছে। সে দ্রুত পানিতে হাত ভিজিয়ে দিলো। এখন একটু জ্বলুনি কম লাগছে। কিছুক্ষন ভিজিয়ে রেখে হাতটা উঠালো। চুলা থেকে পাতিল টা নামিয়ে একটা বাটিতে বার্লি ঢেলে নিলো। বাটি নিয়ে ঘরে এসে দেখলো রাহমিদ বসে বসে বোনের চুল নিয়ে খেলছে। রুদ এক হাত দিয়ে রাহমিদকে জড়িয়ে রেখেছে। রায়হানের হাত টা জ্বলছে আবারও। পানিতে কিছুক্ষণ রাখায় ভালো লাগছিল এখন আবার জ্বলছে। রায়হান রুদকে উঠিয়ে একটু একটু বার্লি খাইয়ে দিতে লাগলো। বাচ্চাটার মুখ শুকিয়ে গেছে। দুই দিনের জ্বরে বাচ্চাটা কাবু হয়ে গেছে। রুদকে খাইয়ে দেখে রাহমিদ তাকিয়ে আছে খাবারের দিকে। রায়হান হেঁসে বলে, “খাবে?” বাচ্চাটা কি বুঝলি কে জানে ফিচ করে হেঁসে গড়াগড়ি খেলো। রায়হান আবার রুদকে খাইয়ে দিতে লাগলো। রাহমিদ আবার মুখে আঙ্গুল ভরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান এবার কোনো কথা না বলে রাহমিদের মুখে এক চামচ ঢুকিয়ে দিলো। রাহমিদ মুখে নিয়ে মুখ নাড়ালো তারপর হঠাৎ করে মুখ বিকৃত করে খাবার ফেলে দিলো। সম্পূর্ণ জামা ভরিয়ে ফেললো। রায়হান হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকলো ওদিকে হাতের জ্বলুনিও বাড়ছে।
_____
—–
আজকে আফজাল হোসেন একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছেন। রায়হানের সাথে তার জরুরি আলাপ আছে। জয়নব বেগম রায়হানকে ডেকে আনলো। আফজাল হোসেন আর রায়হান ভাত খেলো। খাওয়া শেষে আফজাল হোসেন রায়হানকে বললো,
“তুমি কি পড়াশোনা করবে না? সেদিনও জিজ্ঞাসা করেছিলাম।”
“কিভাবে পড়াশোনা করবো আংকেল। ওরা ছোট আর ভার্সিটি তে এডমিশনের জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হবে। যা এখন ওদের নিয়ে করা সম্ভব না। টাকারও একটা ব্যাপার আছে।”
“শোনো একটা কথা বলি। পড়াশোনা ছেড়ো না। পড়াশোনা জানা থাকলে একটা না একটা জায়গায় চাকরি অনায়াসে হয়ে যাবে। চাকরি না হলেও মানুষকে পড়িয়ে দু, চার টাকা ইনকাম করতে পারবা কিন্তু পড়াশোনা না করলে কোথাও কাজ পাবে না। অনেক কষ্টের কাজ করে টিকে থাকতে হবে তোমাকে। যা তোমার দ্বারা সম্ভব না। তুমি ছোটবেলা থেকেই রাজকীয়ভাবে বড় হয়েছো এখন কোনো কঠিন কাজ দিলেই তুমি খেই হারিয়ে ফেলবে। তাল রাখতে পারবে না। পদে পদে বিপদে পড়বে তাই বলছিলাম একটু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও পড়াশোনা ছাড়বে নাকি ধরে রাখবে।”
রায়হান কি বলবে ভেবে পেলো না। এত ছোট ভাইবোনকে রেখে কিভাবে প্রিপারেশন নিবে আর কিভাবেই বা টিকবে। একটা পাবলিক ভার্সিটিতে টিকা তো মুখের কথা না। যদিও রায়হান যথেষ্ট মেধাবী তবুও একটা গাইডলাইন তো থাকতে হবে। আফজাল হোসেন আবারও বলে উঠলেন,
“তোমার ভাই বোনের চিন্তা করো না। ভার্সিটিতে একবার ভর্তি হয়ে গেলে প্রতিদিন নাহয় না গেলে। শুধু পরীক্ষার সময় উপস্থিত থেকে পরীক্ষা দিলে শিক্ষকদের বলে। তারা নিশ্চয় বুঝবে তোমাকে।”
“আসলে আংকেল ঠিক তা না। এখন কিভাবে প্রিপারেশন নিবো। অল্প কয়েকদিন বাকি বোধহয় এডমিশনের। আমার কাছে তো বইও নেই কোনো। তার উপর ওদেরকেও দেখতে হবে। সব মিলিয়ে সাহস হচ্ছে না পড়ার। ”
“তোমার ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট কি?”
রায়হান মুখ নামিয়ে মিন মিন করে বললো,
“জিপিএ ফাইভ।”
আফজাল হোসেন অবাক হয়ে গেলেন। এত ভালো একজন ছাত্রের এভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে এটা তিনি মানতে পারছেন না কিছুতেই। আফজাল হোসেন বললেন,
“এত ভালো রেজাল্ট নিয়ে তুমি পড়াশোনা ছেড়ে দিবে? আচ্ছা জানতে পারি, তোমার কী হওয়ার ইচ্ছা ছিল?”
রায়হানের মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। কিছু স্মৃতি বোধহয় তার মানসপটে তীব্রভাবে উঁকি দিয়ে তার যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিলো। রায়হান মুখ নামিয়ে বললো,
“বাবা, মায়ের শখ ছিল দেশের নামকরা ডাক্তার বানাবেন। কারণ বাবার মা মানে আমার দাদি চিকিৎসার অভাবে মারা যান যা আমার বাবাকে খুব ব্যথিত করেছিল। আর আমারও ইচ্ছা ছিল কিন্তু এখন আর নেই।”
রায়হানের ভাঙা গলা। আফজাল হোসেন আর জয়নব বেগম পাথরের মতো বসে আছেন। ছেলেটার এত দুঃখ তাদের সহ্য হচ্ছে না। আফজাল হোসেন বললেন,
“এখন তো আর মেডিকেলে পরীক্ষা দিতে পারবে না মনে হয়। তুমি ভার্সিটিতে চেষ্টা করো। আমি বই খাতা এনে দিবো। তুমি পড়বে?”
“না না আংকেল। আপনি আর আন্টি এমনিতেই আমাদের জন্য অনেক করছেন। আমি চাই না আমাদের জন্য আর কোনো টাকা খরচ করেন। আমি চাচ্ছি না আপনাদের ঘাড়ে বসে খেতে। প্লিজ আংকেল, জোর করবেন না। পড়াশোনা আমার জন্য না। আমি আমার ভাই বোনকে পড়াবো যেভাবেই হোক। আমার না পড়লেও চলবে।”
“রায়হান জানো, তুমি সব সময় আমার দেয়া কিছুকে দয়া ভাবো। আমার কাছ থেকে ধার হিসেবে নাও এখন পরে নাহয় টাকা হলে পরিশোধ করে দিলে। তোমাকে দেখলে আমার যৌবন কালের কথা মনে পড়ে ভীষণ। আমিও এতিম ছিলাম। তাই বোধহয় তোমার প্রতি টানও একটু বেশি। এতিম খানায় বড় হয়েছি বুঝলে। কোনরকম মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কাজে লেগে যাই নিজের ভবিষ্যতের জন্য। তখন থেকে খেটে খেয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই পর্যন্ত এসেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় পড়াশোনা টা যদি করতে পারতাম তাহলে ভালো একটি পর্যায়ে আজকে থাকতাম। মা, বাবা থাকলে নিশ্চয় পড়াশোনা করাতো। তাই আফসোস লাগে নিজের ভাগ্যের উপর প্রায়ই। যদিও আল্লাহ্ আমাকে যথেষ্ট ভালো রেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ। আমি চাই এই আফসোসটা যেন তোমার কখনো না হয়। তারপরও যদি তুমি পড়াশোনা না করতে চাও আমার কিছু বলার নেই। এটা একান্তই তোমার সিদ্ধান্ত। আমি তো তোমার কেউ নই। তোমার উপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার অধিকারও আমার নেই।”
চলবে…