#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_১০
#তাজরীন_ফাতিহা
রায়হানকে দেখে তাদের ফুসুর ফুসুর বন্ধ হয়ে গেলো। রায়হান চাদর নিয়ে তাদেকে পাশ কাটিয়ে টয়লেটে চলে গেলো। ময়নার মা ভেংচি কাটলো। তারপর আবার কয়েকজন ভাড়াটিয়া মিলে রায়হানদের নিয়ে গবেষণায় নামলো। রায়হান চাদর ধুয়ে বের হয়ে দেখলো তাদের সমালোচনা এখনো শেষ হয়নি। যদিও এসব মহিলাদের সাথে সে তর্কে জড়াতে মোটেও ইচ্ছুক নয় তবুও কিছু কিছু মহিলার এইসব কানাকানি, একে অন্যের পিছনে কথা বলা রায়হানের চরম অপছন্দ। এদের কোনো কাজ নেই খালি মানুষের পিছনে দোষ গাইতে থাকে। রায়হান সেখানে গিয়ে চাদর হাতে নিয়ে বললো,
“আচ্ছা জানতে পারি কি, এইযে মানুষের পিছনে কানাঘুষা করেছেন এতে আপনাদের লাভ কি?”
মহিলাগুলো থতমত খেয়ে গেলো। এমনিতেই মালিকের আত্মীয়। তাদের নিয়েই আবার কথা বলছে। ছেলেটা সব শুনে ফেলেনি তো? ময়নার মা মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আরে কি যে কও না। কই কানাঘুষা করলাম। আমরা তো আমাগোর সাংসারিক আলাপ করতেছিলাম।”
“সাংসারিক আলাপ করছিলেন। আচ্ছা ধরে নিলাম আপনারা সাংসারিক আলাপ করছিলেন। আপনাদের এই সাংসারিক আলাপে কি কোনো মানুষ নিয়ে কটূক্তি করা হয়নি? যেমন আমি যতটুকু জানি মহিলারা একত্রে হলে তারা গীবত বা একজনের সমালোচনা না করে থাকতে পারেন না। তো আপনাদের সাংসারিক আলোচনায় নিশ্চয় আপনার শাশুড়ি, ননদ, শশুরবাড়ির লোক বা যেই হোক যাদের সাথে আপনাদের বনে না তাদের নিয়েই বলছিলেন? এম আই রাইট?”
মহিলা গুলো ভোঁতা মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ময়নার মা আর কয়েকজন মনে মনে ফুঁসতে লাগলো। এরা মালিকের আত্মীয় না হলে দেখিয়ে দিতো তারা কি? কত বড় স্পর্ধা তাদেরকে জ্ঞান দিতে এসেছে এই দুই দিনের ছেলে। রায়হান তাদের মুখ দেখে বুঝলো তার কথা এদের হজম হয়নি। সে আর কথা না বাড়িয়ে শুধু বললো,
“দয়া করে আল্লাহ্ তায়ালাকে ভয় করুন। মৃত্যুর উপরে কিন্ত আমাদের কারো হাত নেই। এসব করে মারা গেলে আল্লাহ্ তায়ালার কাছে কি জবাব দিবেন আছে কি কোনো উত্তর? তাছাড়াও গীবত করাকে আল্লাহ্ তায়ালা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য করেছেন। আপনারা নিশ্চয় আপনাদের মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবেন না? যদি খেতে চান বা খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সেটা ভিন্ন বিষয়। তাহলে গীবত করুন আর মজা করে চিবিয়ে চিবিয়ে ভাইয়ের গোশত খান। ছোট মুখে অনেক কথা বলে ফেললাম, ক্ষমা করবেন।”
কথাগুলো বলেই রায়হান প্রস্থান করলো। অন্যদিকে মহিলা গুলো পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। রায়হানের কথা কি তাদেরকে ছুঁতে পারলো। তাদের মনের মধ্যে কি কোথাও ঝড় বইয়ে দিয়ে গেলো। ভাইয়ের গোশত খেতে হবে শুনেই তো বমি চলে আসছে। কয়েকজন মনে মনে তওবা পড়ে নিলো। এত সুন্দর করে কেউ তাদের কখনো বুঝায় নি। এতটুকু ছেলের কথায় কি মুগ্ধতা রয়েছে তারা তা ভুলেও টের পেলেন না তবে একটা জিনিস ঠিক উপলব্ধি করতে পারলেন, তাদের মনের মধ্যে কিছু তো একটা খেলে গিয়েছে যা তাদেরকে আল্লাহ্ তায়ালার পথে আনলেও আনতে পারে। কিন্তু মনুষ্য জাতি কি এত সহজেই ঠিক হবে? এটাও একটা প্রশ্ন থেকে যায়।
______
—-
রায়হান ঘরে এসে দেখলো রাহমিদ রুদের গায়ের উপরে উঠার চেষ্টা করছে। রুদের মুখে হাত দিয়ে বারি দিয়ে বলছে, “উ.….পু… উ….পু।” রায়হান দ্রুত গিয়ে রাহমিদকে কোলে তুলে নিলো। তারপর রাহমিদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“পঁচা ছেলে, দুষ্টু ছেলে আপির ঘুম ভাঙাচ্ছো কেন?”
রাহমিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো গাল ফুলিয়ে। অর্থাৎ খুবই মহৎ কাজ করতে গিয়ে উঠিয়ে অনায় বেজায় রেগে গিয়েছে সে। রায়হানকে রেগে কথা বলতে দেখে হাত দিয়ে মুখে খামচি মেরে বললো,
“ভ…. য়ু…য়ু..”
রায়হান রাহমিদের খামচিতে ব্যথা পেয়ে হালকা চিৎকার দিয়ে উঠলো। রাহমিদ ভাইয়ের চিৎকারে ভয় পেয়ে তাকিয়ে আছে। রায়হান রাহমিদকে ধরে বললো,
“আজকে সম্পূর্ণ হাত কেটে ফেলবো। কথায় কথায় খালি খামচি মারা তাই না?”
রাহমিদ ভাইয়ের কথা না বুঝে ফোকলা হাসলো। তা দেখে রায়হান বলে উঠলো,
“দাড়াও পাজি ছেলে তোমার হাসা ছুটাচ্ছি।”
রায়হান ব্যাগ থেকে নেইল কাটার বের করলো। বাচ্চাটার হাতের নখ অনেক বড় হয়ে গেছে। কথায় কথায় যাকে তাকে খামচি দিচ্ছে। রায়হান, আফজাল হোসেন, জয়নব বেগম, দিলদার, কাউকে ছাড়ছে না। রায়হান রাহমিদকে কোলে শুইয়ে নখ কাটতে লাগলো। রাহমিদ যখন বুঝলো তার মোক্ষম অস্ত্র কেটে ফেলা হচ্ছে তখনই মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিয়েছে। রায়হান ওকে চেপে ধরে নখ কাটতে লাগলো। রাহমিদ এই অনাচার সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছে। রায়হান দ্রুত কোনরকম নখ কেটে ওকে কোলে নিয়ে কান্না থামাতে লাগলো। রাহমিদ ভাইয়ের গালে কামড় দিয়ে লালা লাগিয়ে দিলো। রায়হান তা দেখে চরম হতাশ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
“নখ কেটেছো তো কি হয়েছে দাঁত আছে না? দাঁত কি আর কাটতে পারবে? এসব ভাবছিস তাই না। ছোট খাটো পাতি গুণ্ডা একটা। বড় হলে পাক্কা সেয়ানা হবে। কাউকে এক চুলও ছাড় দিবে না।”
রাহমিদ কি বুঝলো কে জানে খিলখিল করে হেসে উঠলো। রায়হান ভাইয়ের হাসি মুগ্ধ হয়ে দেখে “ওরে আমার লাড্ডু রে, টোটন রে, জাদু রে, কলিজা রে” বলে রাহমিদকে ঠেসে চেপে আদর করতে লাগলো। রাহমিদ আরও জোরে হেঁসে উঠলো। এর মধ্যে রুদ ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। উঠেই ভাইকে ডেকে উঠলো। রায়হান দ্রুত রুদের কাছে গেলো। বললো,
“এইতো সোনা, কি লাগবে আমার রুদ পাখির?”
রুদ জরাজীর্ণ মৃদু গলায় বললো,
“আমু, আবুকে লাগবি। আমু, আবু কুথায় ভাইয়ু। আমার জ্বর হয়েছি আমু, আবু এখুনো আসি না কেনু?”
রায়হানের বুক ধক করে উঠলো। পৃথিবীর সব কিছু এনে দেয়ার ক্ষমতা থাকলেও মা, বাবাকে এনে দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। কিভাবে বুঝাবে এই বাচ্চাটাকে। গত চারমাস ধরে কত ছলাকলা করে রুদকে বুঝ দিচ্ছে মা, বাবা আছে। কয়েকদিন পরই চলে আসবে। তার রুদ টা ছিল বাবা ও তার ন্যাওটা। মা যখন বকা দিতো তখন তাদের কাছে দৌড়ে এসে মায়ের নামে বিচার দিতো। একটু পর মায়ের উপর অভিমান কমে গেলে মায়ের কোলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। মাও পরম মমতায় আগলে নিতো তার নাড়িছেঁড়া ধনকে। এসব ভেবে রুদের অলক্ষে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রায়হান দ্রুত চোখ মুছে ফেললো। তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। সে পরম মমতায় রুদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“আম্মু, আব্বু এসে পড়বে সোনা। তুমি স্ট্রং গার্লের মতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও দেখি। আম্মু, আব্বু তোমাকে অসুস্থ দেখলে আমাকে বকা দিবে তো সোনা। বলবে আমার মেয়েকে দেখে রাখোনি জাইম?”
কথা বলতে বলতে খেয়াল করলো তার চোখ ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। সে উল্টো দিকে ফিরে চোখ মুছে ফেললো আবার। তাও চোখ ভিজে যাচ্ছে। রাহমিদ ভাইয়ের কোলে বসে হাত, পা ছোড়াছুড়ি করছে। রুদ ভাইয়ের কথা শুনে চুপটি করে ভাইয়ের কোলে মাথা রাখলো। রায়হান আরও নানা কথা বলতে লাগলো রুদকে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একজন বাবা বুঝি তার সন্তানদের আগলিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
______
—–
“ওই ঢেঁড়সের কেজি কত?” দিলদার সবজি দেখতে দেখতে বললো।
“১৩০ টেকা?” সবজি ওয়ালা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো।
“কিহ এত দাম কেন?”
“এইডা তো ঢেঁড়সের সিজন না হেইলাইগা দাম বারন্তি।”
“পটল আর করল্লার কেজি কত?”
“পটল ১৪০ টেকা আর করল্লা ১৬০ টেকা কেজি।”
“ওই সব কিছুর এত চড়া দাম কেন?”
“এহন তো এইসবের দাম একটু চড়াই থাকবো। সিজন আইলে ঠিক হইয়া যাইবো।”
দিলদারের মাথা গরম হয়ে গেলো। রায়হান বুঝলো ঝগড়া শুরু করে দিবে দিলদার ভাই। কালকে কিছু না বলাতে ক্ষেপে গিয়েছিল আজকে তাই চুপ করে না থেকে সবজি ওয়ালাকে বললো,
“ভাই পটল ১২০ আর করল্লা ১৪০ করে রাখেন।”
দিলদার রায়হানের কথা শুনে থব্দা মেরে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। দিলদারকে ওভাবে তাকাতে দেখে রায়হান মনে করলো আজকে দিলদার ভাই বোধহয় খুশি হয়েছেন। সবজিওয়ালা সহজেই রাজি হয়ে বললো,
“আইচ্ছা ভাই।”
রায়হান দিলদারকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“ভাই সব জায়গায় মাথা গরম করলে হয় না। দেখেছেন কি সুন্দর কম টাকায় দিতে রাজি হয়ে গেলো। সুন্দর ভাষায় কথা বলেও মিটমাট করা যায়।”
দিলদারের রায়হানের কথায় হুঁশ ফিরলো যেন। পরমুহুর্তেই সবজি ওয়ালাকে সবজি দিতে মানা করে রায়হানের হাত ধরে টেনে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলো। বললো,
“পৃথিবীর সব চাইয়া মগা মাইনষের নাম যদি আমারে জিগায় আমি এক বাইক্যে তোমার নাম কমু। আমার লগে থাইকা তুমি এই বাজার করা শিখছো গত দুই দিনে। মানুষ এত বলদা হয় কেমনে? তুমি ওই বেডারে যে দাম কইছো ওই টেকা দিয়া ওই শালায় সবজি কিনেই নাই কিনছে আরও কমে। কাস্টমার গো কাছে বেশি বেশি দাম কয় যাতে ওগোর মেলা লাভ ওয়। তোমার মতো মগা গো ভাইংগাই এরা ব্যবসা করে। তোমারে এতদিন বাজার না করা শিখাইয়া তোমার এই আন্ডা ভাইরে বাজার করা শিখাইলে মেলা লাভ হইতো বুঝলা। হেয়ও প্রতিবাদ করতে পারে আর তুমি মগার লাহান খাড়াইয়া বলদামি করো। আরেকটা কতাও কইবা না আর। তোমারে দিয়া বাজার হইবো না বুইঝা গেছি। চাচারে কইয়া তোমারে অন্য কামের ব্যবস্থা করতে কইতে হইবো।”
রায়হান ভেবেছিল দিলদার ভাই খুশি হবে এখন দেখি হিতে বিপরীত হয়ে গেছে। আফজাল হোসেন এত ভরসা করে কাজের দায়িত্ব দিয়েছে আর সে এভাবে দায়িত্বজ্ঞান হীনতার পরিচয় দিলো। তার মন খারাপ হয়ে গেলো। এই পৃথিবীর নিয়ম কানুন বড় অদ্ভুত। এসবের সাথে সে কিভাবে মানিয়ে চলবে। কেমন হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে সে। পিঠ ঘামে ভিজে চপচপে হয়ে আছে সামনে রাহমিদ ঝুলছে। তার শরীর কেমন ছেড়ে দিতে চাচ্ছে ক্লান্তিতে। ভাগ্য তার সাথে কি এক আজব খেলায় মেতেছে। হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে।
______
—–
“চাচা রায়হান বাজার করা কিন্তু এহনো পারে না। কি করবেন কন তো? আইজকা কি করছে হুনবেন?”
চলবে…