#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৯
#তাজরীন_ফাতিহা
চারদিকে অন্ধকার কমতে শুরু করেছে। রাহমিদের কান্নার আওয়াজে রায়হানের ঘুম ভেঙে গেলো। তবে উঠতে যেয়ে মনে হলো তার শরীরে কেউ অসংখ্য সূচ বিঁধে দিয়েছে। শরীরে অনেক ব্যথা। রাহমিদের চিৎকারের আওয়াজে তাড়াহুড়া করে উঠতে যেয়ে ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলো সে। তার মনে হলো হাড্ডি পর্যন্ত ব্যথা করছে। শরীরটা কেমন ঝিমিয়ে আসছে। তারপরও কোনরকম শরীরটা উঠিয়ে রাহমিদকে কোলে নিলো। ওকে দুলিয়ে কান্না কমানোর চেষ্টা করতে লাগলো। হাতে ভিজা অনুভূত হওয়ায় প্যান্ট পাল্টে দিলো। তারপর ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগলো। রাহমিদ ভাইকে বেশি না জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। রায়হান ওকে আবার শুইয়ে দিলো। বিছানা ভিজে গেছে বাচ্চাটার টয়লেটে। সকালে রোদ উঠলে চাদর ধুয়ে দিতে হবে সাথে তোষকটাও শুকোতে দেয়া লাগবে।
রুদের গালে কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর কিছুটা ছেড়েছে। চারপাশ আলোকিত হওয়ার আগে নামাজটা পড়ে নিতে হবে নাহলে ওয়াক্ত চলে যাবে। কোনরকম ব্যথা শরীরটা টেনে নিচে নামলো। নিচে নামতে গিয়ে মনে হলো শরীরটা এখনই ছেড়ে দিবে। খুব কষ্টে আস্তে ধীরে যেয়ে ওযু করে আসলো। নামাজটা পড়ে কিছুটা ফ্রেশ লাগছে। শরীরটা ভালো না লাগায় শুয়ে পড়লো। বাজারের সময় হলে উঠে যাবে। দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দে আবার উঠে বসলো। দরজা খুলে দেখলো আফজাল হোসেন এসেছেন।
“আসসালামু আলাইকুম, আংকেল। ভিতরে আসুন।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। না ঠিক আছে। আসলে রুদাইফাকে দেখতে এসেছি। ওর জ্বর কমেছে?”
“জি কমেছে কিছুটা।”
“তুমি কালকে রাতে নাকি ভাত খাওনি? তোমার আন্টির সাথে রাগ করেছো?”
“না না, এসব কি বলছেন। ওনার উপরে রাগ করার প্রশ্নই উঠে না। আসলে কালকে ক্লান্ত ছিলাম প্রচুর। বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের শরীরটাও ছেড়ে দিয়েছিল তাই ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম।” রায়হান দ্রুত বললো।
“তোমার আন্টি তো ভেবেছে তুমি রাগ করে খাওনি। তাই অনেকে কষ্ট পেয়েছে। বাচ্চাটার জন্য খালি কষ্ট পাচ্ছিলো।”
“ঠিক আছে আন্টির সাথে কথা বলবো আমি। আপনি ভিতরে আসুন।”
আফজাল হোসেন ভিতরে প্রবেশ করে দেখলেন সেরেলাকের বাটি পড়ে আছে চৌকির উপরে। বাচ্চাগুলো ঘুমিয়ে আছে। আহা! কি মায়া মায়া মুখ। এদেরকে দেখলেই তার কলিজাটা ছিঁড়ে যায়। মা, বাবা ছাড়া এদের ভবিষ্যৎ আসলে কেমন হবে? তিনি ভাবতে পারেন না। আল্লাহর কাছে এই মাসুম বাচ্চাগুলোর জন্য দোয়া করেন যেন ওরা সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ পায়। রায়হান চৌকির এক পাশে আফজাল হোসেনকে বসতে দিলো। রায়হান নিজেদের ব্যাগ খুলে কিছু বের করতে লাগলো। আফজাল হোসেন রুদের কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করলো। রাহমিদকে আদর করে দিলো। বাচ্চাটা এখন কি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে অথচ জাগ্রত থাকলে তাকে দেখলেই হাত উঁচিয়ে মার দেখাতো। জোর করে কোলে তুলতে চাইলে খামচি দিতো নাহলে কেঁদে দিতো। মানে তাকে কোনোভাবেই কোলে নেয়া যাবে না। এটা ভেবে উনি একটু জোরেই হেঁসে দিলো। ভীষণ পাজি বাচ্চা। হেসেই ফুলো ফুলো গালে চুমু বসিয়ে দিলো। রুদের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকেও চুমু খেলো। দুটোই মায়া আর কিউটের ডিব্বা। মাশ আল্লাহ্!
“আংকেল আপনার টাকা টা?” রায়হান টাকা বাড়িয়ে বললো।
“কিসের টাকা?”
“কালকে যে ডাক্তার দেখলাম তার ফিস আর ওষুধের টাকা।”
“টাকার প্রয়োজন নেই। রায়হান একটা কথা বলি শোনো, তুমি আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ছেলে। তোমার এই স্বভাব আমার খুবই পছন্দ কিন্তু সব সময় আত্মসম্মানবোধ দেখানো উচিত না। তোমার আজকের কাজটায় আমি কষ্ট পেয়েছি। সামান্য কয়টা টাকাও তোমাকে শোধ করতে হবে বুঝি? বাসা ভাড়া দিবে, নিজের ভরণপোষণ নিজে চালাবে, কাজ করে খাবে সব মেনে নিয়েছি এখন তোমার উচিত নয় কি আমাদের সামান্য কথা শোনা? তোমাকে আমরা মোটেও দয়া করছিনা। তোমার এই টাকাটার সামনে প্রয়োজন পড়তে পারে। আমি খুশি হয়ে দিয়েছি আর টাকাটা আমি নিবো না। এতেও তোমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে আমার কিছু করার নেই।”
আফজাল হোসেন কিছুটা কঠোর সুরে কথাগুলো বলে থামলেন। রায়হান কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলো না কারণ আফজাল হোসেনের কঠিন মুখশ্রী। আফজাল হোসেন রুদ আর রাহমিদকে আদর করে চলে গেলেন।
______
—-
রায়হান আর দিলদার বাজারে এসেছে। দিলদার তিনদিন রায়হানকে সঙ্গ দিবে। রায়হানকে ধরে ধরে বাজার করা শিখাচ্ছে সে। রায়হানের কোলে রাহমিদ। বেবি ক্যারিয়ারে ভাইয়ের বুকে লেপ্টে আছে। ক্ষণে ক্ষণে তার ছোট মাথাটা বের করে বাইরে উঁকি দিচ্ছে। রায়হানের যদিও শরীরটা ভালো লাগছিল না তারউপর রুদ অসুস্থ। ওকে রেখেও আসতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু জয়নব বেগমের আকুতির জন্য ভরসা করে রেখে এসেছে। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে ছিল দেখে তার আর উঠানোর ইচ্ছে হয়নি। এমনিতেও কাজ যেহেতু করছে ফাঁকি দেয়ার ইচ্ছা তার নেই। জয়নব বেগমকে রুদকে কি কি ওষুধ খাওয়াতে হবে বলে এসেছে সে। জয়নব বেগম তাকে আশ্বাস দিয়েছে। চিন্তা করতে নিষেধ করেছে। রায়হান ও দিলদার কথা বলতে বলতে সামনে আগালো। রায়হান সবজি কিনেলো সাথে সবজির নামও জেনে নিলো। মাছ, মাংসের বাজারে ঢুকার আগে নাকে টিস্যু চাপা দিলো। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগবে। দিলদার রায়হানকে মাছ চিনাচ্ছে আর বলছে,
“এডা হইলো পাঙ্গাস মাছ। মেলা সুয়াদ। আর এইডা হইলো লইট্যা মাছ। এইডা রুত মাছ আর এইদিকের এইডা হইলো তেলাপিয়া। বুঝছো?”
“জি বুঝেছি।”
দিলদার দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলো,
“তেলাপিয়া আর রুতের কেজি কত?”
“তেলাপিয়া ৪৫০ আর রুই ৫০০ টেকা কেজি।”
দিলদার ক্ষেপে গিয়ে বললো,
“কাইলকাই তো দাম আছিলো চাইরশো কইরা আইজকা পঞ্চাশ বাড়লো কেমনে?”
“হুনেন নিলে নেন, না নিলে যান গা। আপনেরে কেউ সাদছে?”
“ওই বেডা মুখ সামলাইয়া কতা ক। নিলে নিমু মানে। নেয়ার লাইগাই তো খাড়াইছি। এক দাম তিনশো। প্যাকেট কর।”
“এহ্ মগের মুল্লুক নাকি? ৫০ টেকা কম রাখতে পারি এর এক টেকাও কম না।”
“আইচ্ছা তাইলে আর কি তোর মাছ তুই খা। অন্য জায়গাত্তে কিনুম।”
কথাটা বলেই দিলদার হাটা ধরলো। অন্য জায়গায় দামাদামি করে তিনশোতে আনলো। দিলদার দোকানিকে এক কেজি তেলাপিয়া আর রুই মাছ দিতে বলল। দোকানি একজনকে হাক ছেড়ে ডেকে মাছ গুলো দিতে বললো। দোকানি জিজ্ঞাসা করলো,
“কাইট্টা দিমু?”
দিলদার সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। মাছ কেনা শেষে ওই দোকানের সামনে যেয়ে বললো,
“দেখ তিনশতে কিনছি। তোর মাছ তুইই খা। দেমাগ দেহাস। তোর এই মাছ কেউ কিনতো না শয়তান বেডা।”
রায়হান এতক্ষণ নির্বাক হয়ে সব কিছু দেখছিল। তার এসব দামাদামি দেখে মাথায় চক্কর আসতে লাগলো। এভাবেও দামাদামি করা যায়। দিলদার অন্য সব কিছু কিনে নিলো। রায়হান শিখে নিলো কোনরকম। তার মনে হচ্ছে বাজার করা তার জন্য না। এভাবে পায়ে পা লাগিয়ে সে কোনোদিনও ঝগড়া করতে পারবে না। এভাবে হলে সেতো আফজাল হোসেনের লস করে দিবে। দিলদার রিক্সা নিলো। রিক্সায় করে যাওয়ার সময় দিলদার বললো,
“কিছু মনে না করলে তোমারে একখান কতা কই?”
“জি বলুন।”
“তুমি একটা বলদা। যহোন মাছের বাজারে ঝগড়া করতেছিলাম তহোন একটা কতাও না কইয়া এমন মগার মতো খাড়াইয়া আছিলা কেন? তোমার এই ছুডু ভাইও হাত নাড়াইয়া চিল্লাইয়া প্রতিবাদ করছে ওই বেডার আর তুমি চেগাইয়া খারাই আছিলা। কিছু না কইতা অইন্তত কইতে তো পারতা দাম বেশি চাইতাছেন। তোমার বাজার করা শিখন লাগবো না? এমনে হইলে হইবো।”
রায়হান কিছু বলতে পারলো না। চুপ করে থাকলো।
_____
—-
রায়হান বাসায় এসে দেখলো রুদ উঠেনি। বাচ্চাটার জ্বর বেড়ে গেলো নাকি? মাথায় হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আবারও উঠছে। সে দ্রুত রুদকে উঠিয়ে মাথায় পানি দিলো। রুদকে কিছু খাওয়ালো তারপর ওষুধ খাইয়ে দিলো। রাহমিদকে শুইয়ে দিয়ে নিজে একটু ফ্যানের নিচে বসলো। এতক্ষণ রাহমিদ বেবি ক্যারিয়ারে তার কোলেই ছিল। বাচ্চাটা ঘেমে গেছে। সে জামা পাল্টে দিলো। কয়েকটা খেলনা দিলো ওকে। বাচ্চাটা খেলতে লাগলো। রায়হান বিছানার চাদর উঠিয়ে ধোঁয়ার জন্য টয়লেটে যাওয়ার পথে একটা কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। ভাড়াটিয়া কয়েকজন মিলে রায়হানদের নিয়ে কথা বলছে।
“এরা বলে মালিকের আত্মীয়। তো আত্মীয় হইলে দুই দিনও হইলো না বাজার করাইতে পাডাইছে কেন? তার উপর আবার বাপ, মায়রেও দেহি না এগো। কাহিনী কি কিছু বুঝতাছো?”
অন্যরাও সাথে তাল দিলো। ঠিকই তো বাপ, মা ছাড়া অত ছোট ছেলে মেয়ে থাকে কেমনে?
চলবে…