জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৮

0
11

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৮
#তাজরীন_ফাতিহা

মাথার উপরে দিবাকর তীব্রবেগে তার তেজ ছড়িয়ে যাচ্ছে। সকাল সাড়ে আটটায় এত তীব্র রোদ সচরাচর দেখা যায়না। রাহমিদকে কোলে নিয়ে হাঁটতে রায়হানের কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষন আগে বমি করার কারণে তাঁর হাত,পা কেমন অসাড় হয়ে আসছে। রায়হান ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। মাথা ঘুরাচ্ছে তার। রাহমিদ ভাইয়ের কোলে দুষ্টুমি করছে আর মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে নানা রকম অস্পষ্ট কথা বলে চলছে। দিলদারের খুব মায়া হলো ছেলেটার জন্য। সে বলে উঠলো,

“একটা রিসকা নেই? দেরি হইয়া গেছে এমনিতেই, জলদি যাওন যাইবো।”

রায়হান না বলতে যেয়েও কেন যেন বলতে পারেনি। তার শরীরটা কেমন ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। সে মৃদু গলায় বললো,

“ভাই বাবুর জন্য পাউডার দুধ কিনতে হবে। তখন মনে ছিল না। সামনে কি দোকান আছে? রিক্সায় গেলে দোকান থেকে দুধ কিনতে পারবো কি?”

“কেন পারবা না। অবিশ্যই পারবা। লও আল্লাহর নাম লইয়া রিসকায় উইড্ডা যাই।”

রায়হান নিভুনিভু কন্ঠে বললো,

“চলুন।”
______

রায়হান আর দিলদার রিক্সায় বসে আছে।রায়হানের শরীর ছেড়ে দিচ্ছিলো দেখে রাহমিদকে কোলে নিতে গিয়েছিল দিলদার। বাচ্চাটা কি বিচ্ছুর বিচ্ছু! তার হাতে কামড়ে দিয়েছে হাত বাড়িয়েছে দেখে। যদিও দাঁত দুই তিনটা উঠেছে মোটে তবুও ইঁদুর দাঁতের কামড়ে জ্বলতেছে একটু। এখন ভাইয়ের কোলে শান্ত হয়ে বসে তার দিকে মুখে হাত ঢুকিয়ে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে। কে বলবে এই মায়াবী গুলুমুলু চেহারায় পিছনে একটা বিচ্ছু বাস করে। রুস্তম বখাটে কি কম ছিল এতদিন এখন এই দুই দিনের ল্যাংটার হাতেও মাইর খেতে হচ্ছে। এই দুঃখ কই রাখবে সে। যে যেভাবে পারছে মারছে এমনকি ল্যাদা বাচ্চাও বাদ গেলো না। এই লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়না। দিলদার মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে বসে রইলো।
____

দিলদার একটা মুদি দোকানের সামনে রিকশা থামাতে বলল। রায়হানকে বসিয়ে দোকান থেকে সেরেলাক আর নিডো কিনলো। অবশ্য এইসব রায়হানই কিনতে বলেছিল। সে শুধু টাকা নিয়ে দামাদামি করে কিনে আনলো। রিক্সায় বসে জিনিসগুলো রায়হানের হাতে দিলো। রাহমিদ এসব নিয়ে খেলতে থাকলো আর “এ…এ… আ…বা.. ভ..বে..” এইসব অদ্ভুত আওয়াজ করতে লাগলো। দিলদার প্যাকেট দিয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো নাহলে বিচ্ছু কখন কামড়ে দেয় বলা যায়না। সে মুখ গোমড়া করে রাহমিদকে ভেংচি দিলো। রাহমিদ এটা দেখে প্যাকেট কামড়ে ফিচ ফিচ করে হেঁসে দিলো। যেন সে খুব মজা পেয়েছে দিলদারের কাণ্ডে। রায়হান রাহমিদের মুখ থেকে প্যাকেট নামিয়ে রাখলো ওর চারপাশে আপাতত ধ্যান নেই। শরীর কেমন নেতিয়ে পড়েছে।
_____
—-
রিক্সা বাড়ির গলির মুখে থামলো। ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকলো তারা। হঠাৎ করে রায়হানের সামনে চোখ যেতেই দুনিয়া স্থির হয়ে গেলো। সামনে রুদকে ধরে জটলা পেকে আছে। রুদ চিৎকার দিয়ে কাদঁছে। জয়নব বেগম রুদকে কোনোভাবেই থামিয়ে রাখতে পারছে না। বাচ্চাটার মুখ থেকে অঝোরে রক্ত পড়ছে। রায়হান আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। বাজারের ব্যাগ ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ডেকে উঠলো,

“রুদ…”

রায়হান ভিড় ঠেলে দৌড় দিয়ে রুদের কাছে গেলো। রুদ ভাইকে দেখে কান্নার বেগ আরও বাড়িয়ে দিলো। রাহমিদকে জয়নব বেগমের কাছে দিয়ে রুদকে ধরলো দ্রুত। রাহমিদ ভাইয়ের কোল থেকে অন্যের কোলে যাওয়ায় চিৎকার দিয়ে কান্না করে উঠলো। মুহূর্তেই পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেলো। রায়হান রুদকে জড়িয়ে ধরে বললো,

“কি হয়েছে সোনা? কিচ্ছু হয়নি। কাঁদে না।”

রায়হানের কন্ঠস্বর কাঁপছে। সে কথা বলতে পারছে না। ভাড়াটিয়া পপি বেগম বাচ্চাটার নাকে সরিষার তেল, বরফ দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বাচ্চাটা কান্না থামাচ্ছেই না। ভাইয়ের কোলে বসে কেঁদেই যাচ্ছে। ওদিকে রাহমিদ জয়নব বেগমের কোলে কেঁদে যাচ্ছে। রায়হান কথা বলতে ভুলে গেলো যেন। রুদের এই অবস্থায় চারপাশের কোনো কিছু তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। এর মধ্যেই আফজাল হোসেন ভ্যান নিয়ে আসলেন। রুদকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। তিনি রায়হানকে তাগাদা দিলেন। রায়হানের হঠাৎ হুঁশ ফিরলো যেন। সে দ্রুত রুদকে কোলে নিয়ে ভ্যানে উঠলো। ভ্যান চলতে থাকলো আর রায়হান ক্রন্দনরত বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণের গিলে রাখা কান্না ছেড়ে দিলো।
_____
—-

রুদকে ড্রেসিং করিয়ে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাচ্চাটার নাক ও ঠোঁট কেটে গেছে ভীষণ বাজে ভাবে। ঠোঁটে কি যেন একটা ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে ডাক্তার আর নিয়মিত এটা মুখে দিতে বলেছে। নাকের জন্য সিরাপ ওষুধ দিয়েছে। সব টাকা আফজাল হোসেনই দিয়েছে। তাড়াহুড়োতে রায়হান টাকা নেয়নি দেখে আফজাল হোসেনকে বাসায় গিয়ে টাকা দিয়ে দিবে বলেছে। আফজাল হোসেন কিছু বলেনি। তাঁর টাকা নেয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। কতটুকুই বা খরচ হয়েছে। ফার্মেসি দেখে অযথা কথা বাড়ায়নি সে। রায়হানদের আসতে দেখে জয়নব বেগম দ্রুত ছুটে আসলো। কোলে রাহমিদ কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ। ভাইকে দেখে কোলে যাওয়ার জন্য ছটফট করে উঠলো। জয়নব বেগমকে খামচি দিতে থাকলো। রায়হান রুদকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে কিছুক্ষণ ঘুমাবে। উঠানোর দরকার নেই। রায়হান ঘেমে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। সে প্রচুর ক্লান্ত। রাহমিদকে কোলে নিয়ে বসলো বিছানায়। জয়নব বেগম পানি দিলো। সে ঢকঢক করে পানি খেলো যেনো কতবছর ধরে পানি খায়না সে। রায়হান জয়নব বেগমকে বললো,

“এসব কেমন করে হলো আন্টি?”

রায়হানের ভেঙে যাওয়া কণ্ঠ। জয়নব বেগম ইতস্তত করতে লাগলেন। রায়হান কত ভরসা করে তার কাছে বাচ্চাটাকে আমানত রেখে গেলো আর সে একটু দেখে রাখতে পারলো না। সে মাথা নিচু করে বললো,

“তুমি চইলা যাওনের অনেক্ষণ পর রুদ ঘুমের থিকা উঠছে। উইঠা আসে পাশে তোমারে না দেইখা কান্না করতে লাগছিল। তখন আমি বুঝাইয়া শুনাইয়া কল পাড়ে লইয়া যাই মুখ ধোওনের লাইগা। রোমানার ডাকোনে রান্নাঘরে যাই বাচ্ছাটারে দাঁড় করাইয়া। হঠাৎ ওর চিৎকারে দৌড়াইয়া যাইয়া দেহি ওয় পইড়া রইছে কল পাড়ের নিচে সিমেন্টের শক্ত জায়গাডায়। তারপর…”

“তারপরের কাহিনী আর বলা লাগবে না আন্টি। বুঝেছি। আপনি যান। রান্নার সময় চলে যাচ্ছে।”

জয়নব বেগম বুঝলেন ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে ভীষণ। তার উপর রেগে আছে বুঝাই যাচ্ছে। তাই সে বললো,

“বাবা, তুমি আমায় ভুল বুঝো না। আমি…”

“না আন্টি আপনাকে মোটেও ভুল বুঝিনি। এটাই আমাদের নিয়তি মেনে নিয়েছি। আরও কত ঝড় আসবে জীবনে এটা তো কিছুই না।”

রায়হানের ভাঙা গলার নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বরে জয়নব বেগম কেঁপে উঠলেন। বাচ্চাটার অবস্থা দেখে তার হু হু করে কান্না আসছে। চোখে আঁচল চেপে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অপরাধবোধ তাঁকে ঝেঁকে ধরেছে। বাচ্চাটাকে রক্ষা করতে পারলেন না। আহারে! কি রক্ত গিয়েছে। ভাবতেই তাঁর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে আঁচল ভিজিয়ে দিলো।
_____
—–

রাত দশটা। রুদকে এক গ্লাস নিডো দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে রায়হান। দুধ খাওয়ানোর আগে অবশ্য কিছু হালকা তরল জাতীয় খাবারও খাইয়েছে একটু। অবশ্য তা জয়নব বেগম দিয়ে গেছেন। বাচ্চাটা কিচ্ছু মুখে দেয়নি সারাদিন। ব্যথায় জ্বর এসে গিয়েছে। ঠোঁট ফুলে উঁচু হয়ে গেছে। ওষুধ খাইয়ে দিয়ে রুদকে জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে সে। রাহমিদ পাশে খেলনা দিয়ে খেলছে। রায়হান ওযু করে নামাজ পড়ে নিলো। রাহমিদের চিৎকারে নামাজ সংক্ষিপ্ত করে উঠে ওকে কোলে নিলো। বাচ্চাটাকে আজকের আনা সেরেলাক বানিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু রাহমিদ না খেয়ে দুষ্টুমি করছিল। এমনিতেই আজকের সারাদিনের ধকল তার উপর রাহমিদের নখরামি। শরীরটা ভালো না, রুদের চিন্তা, রাহমিদের দুপুরে না খাওয়া, নিজের পেটে দানাপানি না পড়া। আর সহ্য করতে না পেরে রাহমিদের পিঠে জোরে থাপ্পড় দিলো। বাচ্চাটা কানে তালা লাগানোর উপক্রম করলো যেন। চিল্লিয়ে কেঁদেকেটে নাক মুখ ফুলিয়ে ফেললো। রায়হান ওই অবস্থায় খাইয়ে দিতে লাগলো। বাচ্চাটা মুখ থেকে সব গলগল করে ফেলে দিলো। জিদে হাত, পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলো। রুদের ঘুম ভেঙে যাবে দেখে রায়হান ওকে কোলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। পিঠে আদর করে দিতে লাগলো কিন্তু কান্না থামছে না বাচ্চাটার। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে বাইরে বের হলো। বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলো আর রাহমিদকে চারপাশ দেখিয়ে কান্না থামাতে চেষ্টা করলো। তার শরীরটা ভেঙে আসছে যেন। কত রাত ঠিক করে ঘুমাতে পারেনা সে। রাহমিদ কান্না থামিয়ে হেঁচকি দিতে থাকলো। রায়হান অনেকক্ষণ পর ঘরে আসলো। কোলে রাহমিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বালিশ দিয়ে বর্ডার করে দিলো চারপাশ। ঘুমের ঘোরে পড়ে যাতে না যায়। রায়হান নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে খিদে পেটেই বালিশে মাথা রেখে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো। তাকে দেখে যে কেউ বলবে, একটা যুদ্ধ করে এসে অনেকদিন পর একটু চোখ বুঝলো যেন। কারণ তার চোখের নিচের কালো দাগ ভাঙা শরীর, ঘামে ভিজা গেঞ্জি, জানান দিচ্ছে অনন্ত কাল ধরে সে ক্লান্ত।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে