জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৭

0
12

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৭
#তাজরীন_ফাতিহা

সারা রাত রায়হান দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। রাহমিদ প্রচুর জ্বালিয়েছে। বাচ্চাটা নিজেও ঘুমায়নি তাকেও ঘুমাতে দেয়নি। রায়হানের চোখে ঘুম নামছে। চোখ খুলে রাখতে পারছে না সে কিন্তু এখন ঘুমালে চলবে না। সকাল সকাল বাজার করতে যেতে হবে। তাছাড়াও এখন ঘুমালে ফজর মিস হয়ে যেতে পারে। সে কোনোভাবেই বিনা ওজোরে নামাজ ছাড়তে ইচ্ছুক না। বাবাকে দেখতো যতই অসুস্থ থাকতো, নামাজ কখনোই ছাড়তো না। মা কখনো নামাজে গাফিলতি করলে বাবা কববের আযাব ও হাশরের দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিতো। সেই ছোট্ট রায়হান বাবার হাত ধরে মসজিদে যেতো হাতে থাকতো জায়নামাজ। পড়নে থাকতো বাবা ও তাঁর শুভ্র পাঞ্জাবি। তখন তো রাহমিদ, রুদ কেউ ছিল না। বাবা মায়ের সকল আদর, ভালোবাসার ভাগীদার একমাত্র সে ছিল। বাবা, মায়ের কোলে চড়ে দুষ্ট, মিষ্টি খুনসুটির সেইসব স্মৃতি তাঁর মানসপটে উঁকি দিচ্ছে তীব্রভাবে। সেইসব ভাবলেই তাঁর চোখের কোনা ভিজে উঠে। এখন সব কেমন ধোঁয়াশা, স্মৃতি! রায়হান এইসব ভাবতে ভাবতেই ভিজা চোখে ভাইবোনের দিকে তাকালো। সে তো তাও আদর, ভালোবাসা পেয়েছে কিন্তু রুদ, রাহমিদ তো কিচ্ছু পেলো না। রুদটা যাও একটু পেয়েছে রাহমিদ তো মাত্র আট মাস বয়সে দুধের শিশু অবস্থায় বাবা, মাকে হারিয়েছে। এইসব ভেবেই রায়হানের মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। রাহমিদকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলো আরেক হাতে রুদকে আগলে নিলো। এরা ছাড়া তাঁর এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই কথাগুলো ভেবেই চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রু ঝরলো।
_______

দূর থেকে ফজরের আযানের আওয়াজে রায়হানের ঘুমে লেগে আসা চোখ খুলে গেলো। স্মৃতিচারণ করতে করতে কখন যে চোখ দুইটা লেগে আসছিল সে জানে না। রায়হান বিছানা থেকে উঠে বসলো। রাহমিদের প্যান্টে হাত দিয়ে দেখলো ভিজা। তৎক্ষণাৎ প্যান্ট পাল্টে ফেললো। কিছু না পরিয়েই ছোট কাথা দিয়ে ওকে ঢেকে দিলো। নিজেও রাহমিদের প্রসাবে ভিজে গেছে। জামাকাপড় নিয়ে টয়লেটে গেলো দ্রুত। একটু বেলা হলেই মানুষ উঠতে শুরু করলে টয়লেটে ভিড় লেগে যাবে তখন গোসল করতে পারবে না। রায়হান দ্রুত টয়লেটে গিয়ে গোসল করে নিজের, রুদের আর রাহমিদের জামা কাপড় ধুয়ে বের হলো। ততক্ষণে আকাশ কিছুটা অন্ধকার মুক্ত হওয়ার পথে। রায়হান বুঝলো ফজরের ওয়াক্ত বেশি নেই। বাচ্চাগুলোর জামাকাপড় ধুতেই অনেক সময় লেগে গেলো। দ্রুত ঘরে যেয়ে নামাজ আদায় করলো। রায়হান জায়নামাজে বসে জিকির, দোয়া খায়ের করে উঠলো। বাইরে বের হয়ে দেখলো চারপাশ আলোকিত হয়ে গেছে। ভোরের মিষ্টি হাওয়া বইছে চারপাশে। তাঁর বাবা বলতো, এই সময় নাকি বেহেশতের দরজা খুলে দেয়া হয়। কি সুন্দর এই সময়টা! রায়হানের বরাবরই ভালো লাগে। বলে উঠলো, সুবহানাল্লাহ্!
______

জয়নব বেগম জায়নামাজ ভাঁজ করে উঠলেন। সেই সময় আফজাল হোসেন মসজিদ থেকে এসে ঘরে ঢুকলো। জয়নব বেগম বললেন,

“রায়হানের লগে কতা কইছো? কি নাকি কইবা?”

“এত সকালে উঠছে?” আফজাল হোসেন টেবিলে টুপি রাখতে রাখতে বললেন।

“আরে আমি দেখছি ওগো ঘরের দরজা খুলা। যাইয়া দেইখা আসো। আইজকা না বাজার করবো? অহনো ঘুমায় থাকবো না।”

“আইচ্ছা দেখতেছি।”

আফজাল হোসেন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন উদ্দেশ্যে রায়হানদের ঘর। উনি ঘরের সামনে গিয়ে দুটো টোকা দিলেন। দুই মিনিট পর দরজা খুলে গেলো। রায়হানকে দেখে আফজাল হোসেন বললেন,

“ডিস্টার্ব করলাম?”

“জি না। আমি জেগেই ছিলাম। ভিতরে আসুন আংকেল।”

“না আর ভিতরে বসবো না। তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে আসলাম।”

“জি বলুন।”

“কালকেই জিজ্ঞাসা করতাম কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি বাজার করতে পারো?”

রায়হান ইতস্তত করলো। আসলে কখনোই সে বাজার করেনি। বাজার করার প্রয়োজনও পড়েনি। বলতে গেলে রাজার হালেই সে থেকেছে এতদিন। এইসব করার লোক ছিল তাঁদের কিন্তু নিয়তি যে এমন হবে সে যদি জানতো তাহলে অবশ্যই বাজার করা ও অন্যান্য কাজ শিখে রাখতো। আফজাল হোসেন বুঝলেন ছেলেটা বাজার করেনি কখনো। তাই তিনি বললেন,

“ঠিক আছে, সমস্যা নাই। আজকে সাথে দিলদারকে নিয়ে যেয়ো। ওই তোমাকে শিখিয়ে দিবে।”

রায়হান ঘাড় কাত করে বললো, “জি আচ্ছা।” আফজাল হোসেন চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়াচ্ছিলেন হঠাৎ একটা কথা স্মরণ হওয়ায় থেমে গিয়ে বললেন,

“ভালো কথা। তোমার ভাইকে কি করবে? ওতো তোমার আন্টির কাছে থাকতে চায়না। তোমার বোনকে তো রাখা যাবে কিন্তু তোমার ভাই?”

রায়হানের যে কথাটা মনে হয়নি তা না, মনে হয়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই। রেখে যেতেই হবে। ঘুম পাড়িয়ে রেখে যাবে আন্টির কাছে। ও জলদি চলে আসার চেষ্টা করবে। সেটাই আফজাল হোসেনকে বললো। আফজাল হোসেন তাঁর কথায় সম্মতি দিলো। যাওয়ার আগে আরেকটা প্রশ্ন করলেন যা রায়হানকে স্তব্ধ ও নিশ্চল করে দিলো। রায়হান মুখে কথাটা আউরালো,

“তুমি কি আর পড়াশোনা করবে না।”

রায়হান আসলেই জানে না এর উত্তর কি।
______
—-
রায়হান ও দিলদার কাঁচাবাজারে এসেছে। রায়হানের কোলে রাহমিদ। ভাইয়ের গলা জড়িয়ে আছে। বাচ্চাটাকে রেখে আসতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে বাচ্চাটা বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিল। কিছুতেই জয়নব বেগমের কাছে থাকবে না সে। রায়হান আর রেখে আসতে পারেনি। এখানে এসেই মাছ, মাংসের উৎকট গন্ধে তাঁর নাড়িভুড়ি উল্টে আসতে চাইলো। কোনরকম রাহমিদকে এক হাত দিয়ে ধরে আরেক হাতের বাজু দিয়ে নাক মুখ ঢাকলো। দিলদারের হাতে বাজারের ব্যাগ। সে রায়হানের কাণ্ড দেখে হেঁসে ফেললো। বললো,

“আল্লাহ্ তুমি দেহি গন্ধ সহ্যই করতে পারতেছ না? প্রতিদিন কেমনে বাজার করবা?”

“আসলে এইসবে অভ্যস্ত না তো তাই। আপনি চিন্তা করবেন না আমি পারবো।”

“এহনো তো মাছ গোস্তের পাশে গেলামই না এহনি এমন হইলে তহন কি হইবো?”

“ভাই এইসব কথা বাদ দেই। দেরি হচ্ছে, বাজার করে ফিরতে হবে।”

কথাটা শুনে দিলদারের হঠাৎ সম্বিত ফিরলো। আসলেই তো হোটেলের রান্নাবান্না শুরু করতে হবে তাড়াতাড়ি। সে দ্রুত পা চালালো। সবজি যা যা প্রয়োজন সব কিনলো আর রায়হানকে সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো। রায়হান মনোযোগ দিয়ে সব শুনলো। তবে বিপত্তি বাজলো এক জায়গায়। মাছের বাজারে ঢুকেই রায়হান হর হর করে বমি করে দিলো। এতক্ষণ সহ্য করা গেলেও এখন কোনোভাবেই নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি সে। দিলদার বাজারের ব্যাগ রেখে দ্রুত রায়হানকে ধরলো।রাহমিদকে কোলে নিতে চাইলে সে গেলো না। রায়হান ক্লান্ত হয়ে রাহমিদকে নিয়ে রাস্তায় বসে পড়লো। বাজারে কয়েকজন এগিয়ে আসলো। পানি এগিয়ে দিলো। দিলদার রায়হানের মাথায় পানি ঢেলে দিয়ে কুলি করিয়ে পানি খাওয়ালো। কিছুক্ষন পর রায়হান নিজ থেকেই উঠলো। দিলদার বললো,

“চলো তোমারে বাসায় দিয়া আহি।”

“না তাঁর প্রয়োজন নেই। এখন ঠিক আছি।”

“তুমি অসুস্থ হইয়া পড়ছো এই অবস্থায় বাজারে থাকন লাগবো না। গন্ধে আরও বমি করবা।”

“না ভাই। প্রথম তো তাই সহ্য করতে পারিনি। কয়েকদিন বাজার করতে করতে ঠিক হয়ে যাবে। আপনি চলুন। অনেক দেরি হচ্ছে।”

দিলদার আর কিছু বললো না। মাছ, গোশত কিনলো। রায়হান নাকে টিস্যু চেপে তাঁর সাথে দাঁড়িয়ে থাকলো আর দিলদার যা যা কিনলো সব চিনে রাখলো। কোলে রাহমিদ তোয়ালে দিয়ে পেঁচানো। ভাইয়ের কোলে নাড়াচড়া করছে সে। বাজার শেষ করে আসার পথে রায়হান রাহমিদকে বহন করার জন্য একটা বেবি ক্যারিয়ার ব্যাগ কিনলো। দাম সাড়ে চারশো রাখলো। চেয়েছিল সাতশো। রায়হান টাকা দিতে গেলে দিলদার বাঁধা দিলো। দিলদার দামাদামি করে সাড়ে চারশোতে কিনে দিলো। রায়হান অবাক হলো। সে খেয়াল করেছে প্রত্যেকটা বাজার দিলদার ভাই এভাবে দামাদামি করে কিনেছে। এভাবে দামাদামি করা যায়, সে জানতো না। দিলদার হাঁটতে হাঁটতে বললো,

“এই দুনিয়ায় চলতে হইলে এরকম বলদ হইলে হইবো না। যে যা চাইবো তাই দিয়া দিলে দুই দিনে রাস্তার ফকির হইয়া যাইবা। দেখলা না আইজকা কেমনে দামাদামি করলাম। চাচায় যা টেকা দিছিলো সব কিন্তু খরচ হয় নাই। কিছু বাইচ্চা গেছে। এই টেকা দিয়া বাকি দিন আবার বাজার করমু। বুঝছো?”

রায়হান বোকার মতো মাথা নাড়ালো। তাঁর কাছে অল্প কিছু টাকা ছিল। সেই টাকা দিয়েই ব্যাগটা কিনলো। আজকে দিলদার ভাইয়ের সাথে থেকে সে অনেক কিছু শিখলো। দুনিয়ার নিয়মনীতি বুঝা বড় দায়।
_____

“রুদ……..”

রায়হান বাজার ফেলে জোরে চিৎকার দিলো।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে