#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৫
#তাজরীন_ফাতিহা
“এই দিলু এক প্লেট ভাত দে দ্রুত?”
দিলদার টেবিলে টেবিলে কাস্টমারকে খাবার দিচ্ছিলো। এর মধ্যেই প্রতিদিনের কাস্টমার হাফিজ ভাই এসেই উক্ত কথাটা বললেন। দিলদার প্লেটে ভাত বেড়ে হাফিজ ভাইয়ের টেবিলে দিয়ে গেলো। সাথে দিলো আলু ভর্তা আর মুগের ডাল। এই লোক জীবনেও মাছ,গোশত খায় না। খায় না নাকি পকেটে টাকা নেই কে জানে? তবে দিলদার তাঁর কর্মজীবনে এখন পর্যন্ত তাকে এসব খেতে দেখেনি। খুব বেশি হলে ডিম দিয়ে খায়, এর বেশি কিছু খেতে দেখেনি। দিলদার আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আফজাল হোসেন ক্যাশিয়ারে বসে আছেন আর পেপার পড়ছেন। এর মধ্যেই হোটেলে এলাকার বখাটে রুস্তম হাজির তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। দিলদার চরম বিরক্ত হলো। এই লোক ও তাঁর সঙ্গীরা এসেই তাঁর নামের দফারফা করবে। তাঁকে নিয়ে মজা করবে। এর সাথে যে তাঁর কীসের শত্রুতা আল্লাহ্ মাবুদই ভালো জানেন। একে দেখলেই সে দূরে দূরে থাকে কিন্তু ভাগ্য খারাপ বলে এই বাদাইম্মা গুলোর সাথে প্রতিদিন আল্লাহ্ তাঁকে সাক্ষাত করায়। সে হতাশ, চরম হতাশ। রুস্তম এসেই দিলদারকে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো,
“এই কে কোথায় আছিস, তাড়াতাড়ি কইয়া ফেলা কমিডি ম্যান দিলদার কোথায়?”
দিলদার কোনো সাড়া দিলো না। এর কাজ এসেই ঢংয়ের আলাপ করা। মেজাজ গরম হয় তাঁর। বখাটে রুস্তম ও তাঁর সাগরেদরা একটা টেবিলে বসে সেটার উপর বারি দিতে দিতে গেয়ে উঠলো,
“ভাত বেঁচা দিলদার বানাইলো মোরে বৈরাগী, দিলদারের হোটেলে ভাতও খাইলাম, ডাইলও খাইলাম
ভাত আর ডাইল দিয়া বানাইলাম মিক্স খিচুড়ি
ওরে ভাত আর ডাইল দিয়া বানাইলাম মিক্স খিচুড়ি
ভাত বেঁচা দিলদার বানাইলো মোরে বৈরাগী… ই.. ই।”
রুস্তমের সব চেলাপেলা গান শেষে চিৎকার করে উঠলো। তারই দলের সবুজ চিক্কুর দিয়ে বলে উঠলো,
“ভাই আপনে এক্ষান চীজ, কি মিলাইছেন ভাই। আহা”
আরেক চেলা তাল মিলিয়ে বললো,
“হ ভাই আপনে জিনিস, ভাই জিনিস।”
রুস্তম এতক্ষণ এত প্রশংসায় গদগদ হয়ে যাচ্ছিল। নিজের সামনের চুল ( যদিও চুল নাই, হালকা একটু মাথার টাকের সাথে ঝুলে আছে সেটাই ) পিছনের দিকে নেয়ার একটা পোজ দিচ্ছিলো। হঠাৎ জিনিস বলায় ক্ষেপে গেলো। এটা আবার কেমন প্রশংসা। জিনিস মানে কি? সে কেন জিনিস হতে যাবে? সে রাগান্বিত কন্ঠে ওই চেলার দিকে তাকিয়ে বললো,
“জিনিস মানে কি? এক চড়ে দাঁত ফালায়া দিমু তোর? আমি কি বেঁচাবেচির কিছু। ফাউল কোনহানের।”
ওই চেলার নাম বাচ্চু। সে থতমত খেয়ে গেলো। সে তো ওই জিনিসের কথা বলেনি। বলেছে ঐযে বুদ্ধিমান গো কয় ঐটা কিন্তু ভাইয়ে দেখি রাইগ্গা গেছে। তাঁর দিকে সবাই কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে সবুজের দিকে তাকালো অসহায় নয়নে। সবুজ বুঝতে পরলো এই বদ একটা বলতে গিয়ে আরেকটা বলে গড়বড় করে ফেলছে। বদের ঘরের বদ ইংরেজি না জানলে কইতে গেছস ক্যান? তাই সে দ্রুত মফিজ ভাইকে ঠাণ্ডা করতে বললো,
“ভাই আপনে জানেন না এই ছাগলে ইংরেজি জানে না? ওয় মূলত কইতে চাইছিল জিনিয়াস। কইয়া ফেলাইছে জিনিস। কইতে পারেনা তো তাই। আপনে রাগ কইরেন না।”
রুস্তম এবার ঠাণ্ডা হলো। পড়ালেখা তাঁর ক্লাস এইট পর্যন্ত।। সে জানে জিনিয়াস মানে কি, আর কিছু বললো না। পোলায় তো প্রশংসাই করছে, তাই রাগ কমে গেলো তাঁর। হঠাৎ দিলদারের কথা মনে পড়ায় জোরে হাক দিয়া ডাকলো,
“আমার দিল আহে না ক্যা্?”
দিলদার ভেবেছিল এই আপদ আজকে রেগেমেগে বিদায় হবে, সে খুশি হয়েছিল প্রচুর কিন্তু ঐযে তাঁর কপাল। তুই বেডা মানুষ তুই ইভটিজিং করবি মাইয়া মাইনষেরে, তা না কইরা এই আপদ তাঁর পিছনে লাগছে ক্যান? উফফ একটা বিহিত করতেই হবে এই ফাউল লোকের। বিরক্ত হয়ে দিলদার সেখানে গিয়ে বললো,
“ভাই আপনের সমস্যাটা কি একটু খুইল্লা কন তো? আপনি কি ঐযে বেডা বেডা আকর্ষণ থাহে হেই রকমের কিছু?”
রুস্তম না বুঝে বললো,
“কি কইলি?”
“কইলাম আপনে কি বেডা বেডা যে করে, ওই যে আছে না ঐরকম কিছু কিনা?
“বেডা বেডা করে মানে?” রুস্তম হতভম্ব গলায় জানতে চাইলো।
“হেইডা তো আমার থেইকা আপনের ভালো জানার কথা।”
রুস্তমের দলের সব লোক বড় বড় চোখ করে দিলদারের দিকে তাকিয়ে আছে। কামাল ফট করে বলে উঠলো,
“তুই কি গে* গো কতা কইলি?”
“গে* মে কইতে পারুম না কিন্তু যেইডাই হউক, ওইডাই কিনা জিগাইছি।” দিলদার সরল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বললো।
রুস্তম তড়াক করে উঠে দিলদারকে একটা চড় বসিয়ে দিলো। হোটেলের সবাই এতক্ষন ভয়ে ভয়ে ছিল এই বখাটে কোনো গণ্ডগোল করবে কিনা। আজকে রুস্তমের মন মেজাজ ভালো ছিল বলে ভেবেছিল কিছু করবে না কিন্তু দিলদারের এই কথা শুনে সবারই ভয় লাগা শুরু হয়েছিল আজকে তুলকালাম না হয়ে যায়। ঠিক ভেবেছিল তাঁরা। রুস্তম বখাটে বেজায় ক্ষেপেছে। আফজাল হোসেন একটু কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। এসেই দিলদারকে গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে আর রুস্তমকে রাগে কাপতে দেখে দ্রুত সেখানে গেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,
“কি হয়েছে এত ভিড় কেন এখানে?”
রুস্তম আফজাল হোসেনকে কিছু না বলে দিলাদারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মজা করি দেইখা আমারে ফাউল মনে অয়। এইসব ফাউল ভাবনা তোর মাথায় আহে কেমনে? তোরে ছোট ভাই ভাইবাই একটু মজা করি আর তুই, ছি।”
দিলদার এমনিতেই ভীতু। আজকে রুস্তম ভাইয়ের এত রাগ দেখে ভীষণ ভয় পেলো। সে এইসব বলতে চায়নি। একবার মাসুদ ভাই বলেছিল, “যখনি রুস্তম তোরে ক্ষেপাইবো তুই সাহস কইরা এই কতা কইয়া দিবি দেখবি আর ক্ষেপাইবো না, শরমে পালাইবো।” প্রতিদিন ক্ষেপানো কার ভালো লাগে, তাইতো আজকে সাহস করে বলেছে। কিন্তু বুঝতে পারেনি কথাটা অনেক খারাপ কিছু মিন করে।
_____
—-
সন্ধ্যা নেমেছে একটু আগে। রায়হান রাহমিদকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। বাচ্চাটা ঘুমে ঢুলছিল। ওকে ঘুম পাড়িয়ে রুদের কাছে গেলো চিরুনি নিয়ে। রুদকে বললো,
“রুদ সোনা ভাইয়ুর কাছে আসো, চুলে তেল দিয়ে বেঁধে দেই। চুলে জট পাকিয়ে ফেলেছো তো?”
রুদ ভাইয়ের কথা শুনে ভাইয়ের কাছে গেলো। রায়হান রুদের মাথায় খুব যত্ন সহকারে তেল দিয়ে আঁচড়ে দিলো। রুদ শান্ত বাচ্চার মতো বসে ছিল। বেণী করার সময় রায়হান বললো,
“রুদ ভাইয়ুকে A,B,C গুলো শুনাও তো একদম Z পর্যন্ত।”
রুদ শুনালো। রায়হান মনোযোগ দিয়ে শুনলো আর বললো,
“গুড। আমার রুদ সোনা দেখি পুরোটা পারে। বলোতো রুদ স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণ কয়টি?”
“সরবন্ন এগারোটি, ব্যঞ্জনবন্ন উঁচল্লিশটি।”
“ব্যঞ্জনবর্ণ চল্লিশটি সোনা। ক্ষ- কে বাদ দেয় দেখে ঊনচল্লিশটি ধরা হয়। ক্ষ- ও কিন্তু একটি ব্যঞ্জনবর্ণ। আগে একে ধরা হতো না বর্তমানে ধরা হয়, বুঝেছো সোনা।”
“বুঝিচি।”
“গুড, ভেরি গুড।”
রায়হানের চুল বাঁধা শেষ। রুদকে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে। রায়হানের দ্রুত একটা কাজের প্রয়োজন। ভাইবোনদের একটা সুন্দর ভবিষ্যত তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে। আজকে আফজাল হোসেন বাসায় আসলে তাঁর সাথে কথা বলতে হবে। আগামী দিনের চিন্তায় তাঁর ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। বাচ্চা দুটোর একটা গতি না করা পর্যন্ত এই চিন্তার শেষ হবে না বোধহয়।
চলবে…