#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৪
#তাজরীন_ফাতিহা
রায়হান রুদের হাত, মুখ ধুইয়ে ওকে নিয়ে ঘরে আসলো। রাহমিদকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। বাচ্চাটা হাত,পা ছড়িয়ে খেলতে লাগলো। রায়হান ব্যাগের মধ্যে চিরুনি খুঁজতে গেলো। রুদ রাহমিদের সাথে খেলছে। রাহমিদ বোনকে দেখে হাত বাড়িয়ে ফিচ ফিচ করে হাসলো। রুদ রাহমিদের গালে গাল ঘষলো আর আদর করলো। রাহমিদ বোনকে কাছে পেয়ে বোনের খোলা চুলে হাত ঢুকিয়ে টানতে লাগলো। এতে রুদ ব্যথা পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে রাহমিদের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো। রাহমিদের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। সে ফ্যালফ্যাল করে বোনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে জোরে কেঁদে উঠলো। রায়হান চিরুনি খোঁজা বাদ দিয়ে দ্রুত রাহমিদের কাছে আসলো। রুদ ভয় পেয়ে গেলো। ও তো অতটা জোরে মারেনি। তাহলে বাবুন কাঁদলো কেন? রায়হানকে পেয়ে রাহমিদের কান্না আরও বেড়ে গেলো। রায়হান ভাইকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলো,
“আমার লাড্ডুর কি হয়েছে? এইতো ভাইয়া। কি হয়েছে কাঁদে কেন? আমার টোটন, গোল্লার কি খিদে পেয়েছে? এইতো ভাইয়ু খাবার দিব। কাঁদে না, একদম কাঁদে না। কে কাঁদিয়েছে আমার লাড্ডুকে, কার এত বড় সাহস?”
রাহমিদের কান্না কিছুটা কমে গেলো। ফোঁপাচ্ছে বাচ্চাটা। রায়হান ভাইয়ের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটতে লাগলো। রুদ কাচুমাচু করছে। কিছুক্ষন হাঁটার পর বাচ্চাটা ভাইয়ের কোলে শান্ত হয়ে পরে রইলো। রায়হান এবার রুদের দিকে তাকালো। দেখলো রুদ বালিশে মাথা দিয়ে ফোঁপাচ্ছে। ফুস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। বুঝতে পারলো রুদই কিছু করেছে। রুদ যদি কখনো কোনো কাণ্ড ঘটাতো তখন এরকম বালিশে মুখ ঢুকিয়ে কাঁদতো। নিশ্চয়ই রাহমিদকে মেরেছে নাহলে বাচ্চাটা কি সুন্দর হাসছিল হঠাৎ করে এত জোরে কেঁদে উঠবে কেন। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে রুদের কাছে গেলো। বোনের কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,
“ভাইকে মেরেছো রুদ? ভাই ব্যাথা পেয়েছে না? ভালো বাচ্চারা কাউকে মারে না। আদর করে দাও ভাইকে। ওঠো সোনা।”
রুদ ভাইয়ের শান্ত কথায় কেঁদে উঠে ভাইয়ের কোলে মুখ লুকালো। রায়হান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো। রাহমিদ মুখে আঙ্গুল ভরে ভাইয়ের ঘাড় থেকে মুখ তুলে বোনের দিকে তাকালো। রায়হান ওর দিকে তাকিয়ে গালে গাল ঘষে চুমু দিলো। রাহমিদ বোনের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে ভাইয়ের কাঁধে মুখ লুকালো যেন বলতে চাইলো তোমার আদর লাগবে না। রুদের কান্না কিছুটা কমে এলে রায়হান আবারও তাঁকে ভাইকে আদর করতে বললো। রুদ এবার নাক টেনে বললো,
“বাবুন চুলি বিথা দিছে, তাই মিরেছি কিন্তু বিশি জুরে দি নাই।”
রাহমিদ রুদদের কথা শুনে ভাইয়ের ঘাড় থেকে মুখ উঠিয়ে বোনের দিকে উঁকি মারলো। তারপর ভাইয়ের দিকে ফুলো ফুলো গালে তাকিয়ে রইলো। রায়হান রুদকে উঠালো। উঠিয়ে চোখ মুছে দিলো। আদর করে বলতে লাগলো,
“বাবুন ছোট তো সোনা। ওকে আস্তে মারলেও ব্যথা লাগবে, জোরে মারলেও লাগবে। বাবুনের আপি না তুমি? বড় আপিরা কি ছোট ভাইকে মারে, উল্টো আরও আদরে রাখে। তুমি আদর করে দাও।”
রুদ মুখ কালো করে রাহমিদের দিকে চাইলো তারপর বড় ভাইয়ের দিকে। রায়হান ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। রুদ এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। রায়হান তা দেখে হেঁসে দিয়ে রাহমিদকে ওর কাছে দিতে চাইলো কিন্তু রাহমিদ যেতে নারাজ। ভাইয়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো। ভাবটা এমন একটু আগে মাইর দিয়ে এখন দরদ দেখানো লাগবে না। রায়হান সেটা দেখে ওর গালে গাল লাগিয়ে বললো,
“দুষ্টু বাচ্চা একটা। তুমি আপির চুল টান দিয়েছো পঁচা ছেলে? ভারী দুষ্টুমি করো তুমি। যাও আপির কাছে, আপি আদর করে দিবে।”
রাহমিদ কেঁদে উঠে রায়হানের গলা জড়িয়ে মুখে আঙ্গুল ভরে চুষতে লাগলো। রায়হান বুঝে গেলো বাচ্চাটার খিদে পেয়েছে। রুদের মারায় যতটা না ব্যথা পেয়ে কান্না করেছে, খিদের চোটে এর থেকে বেশি কেঁদেছে। রায়হান রুদের দিকে একবার চাইলো, দেখলো রুদের মুখ শুকিয়ে গেছে সকাল থেকে না খাওয়ার দরুন। রায়হানের হঠাৎ করেই নিজেকে অসহায় লাগতে শুরু করলো। বাবা, মা না থাকলে পৃথিবীটা কি সবার কাছেই এমন মনে হয়?
_____
—
জয়নব বেগম রায়হানদের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। একটু পর দরজা খুলে গেলো। তিনি দেখলেন, রায়হান রাহমিদকে শান্ত করতে করতে দরজা খুলে দিয়েছে। জয়নব বেগমের হাতে খাবার। রায়হান তাঁকে ঘরে ঢুকতে জায়গা করে দিলো। তিনি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
“বেশি দেরি কইরা ফালাইলাম মনে অয়। অনেক বেলা হইয়া গেছে। আসলে হোটেলের রান্দন চুলায় চাপানো আছিল। রাইন্দা শেষ কইরা তোমগো লাইগ্যা কয়টা রুটি বানাইলাম আর বাবুর লাইগা ল্যাটকা খিচুড়ি। তাঁর লাইগ্যা দেরি হইয়া গেছে। আইচ্ছা বাবু ল্যাটকা খিচুড়ি খাইতে পারে তো? ওর বয়সের বাবুরা খাইতে পারে দেইখ্যা বানাইলাম। কাইলকা রাইত থেইকা তো হুদা দুধ খাওয়া তাই ভাবলাম একটু ভারী খাওন দেই।”
রায়হান বাবুকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো, “খেতে পারে সমস্যা নেই। এত কষ্ট করে রুটি বানানোর দরকার ছিল না।”
“অত কতা না কইয়া বাবুরে আমার কাছে দাও। আমি ওরে খাওয়াই দেই। তুমি তোমার বইনরে খাওয়াইয়া তাত্তারি খাও। বেলা অনেক হইলো।”
রায়হান রাহমিদকে জয়নব বেগমের দিকে বাড়িয়ে দিলো কিন্তু রাহমিদ ভাইয়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো মানে অপরিচিত করো কোলে সে যাবে না। জয়নব বেগম তা দেখে বললো,
“ওমা কি হইলো? কাইলকা রাইতেই তো কোলে বইসা ফিটার খাইলো এহন এরোম করতেছে ক্যান? ওরে তো ঠাণ্ডা ভাবছিলাম।”
রায়হান রাহমিদকে আদর করতে করতে বললো,
“আসলে অপরিচিত কারো কাছে ও যায় না। কালকে রাতে চোখে ঘুম ছিল দেখে কার কোলে ছিল বুঝতে পারেনি। আপনি আপনার কাজে যান আন্টি। এমনিতেই আমাদের জন্য যথেষ্ট করেছেন। আমি ওদের খাইয়ে নিজে খেয়ে প্লেট বাটি ধুয়ে দিয়ে আসবো।
“তা হইলে কেমনে হইবো? ওদের খাওয়াইতে সময় লাগবো তো অনেক, তুমি খাইবা কখন তাইলে?”
“সমস্যা নেই আন্টি। আপনি কি সবসময় আমাদের দেখার জন্য থাকবেন? ওদেরকে তো আমারই দেখতে হবে। এখন একদিন সাহায্য করলে পরবর্তীতে আমার খারাপ অভ্যাস হয়ে যাবে। ওদেরকে তখন সামলানো মুসকিল হবে, তাই এখনই এই অভ্যাস করে নি।”
জয়নব বেগম ছেলেটার ম্লান বদনে তাকিয়ে ভাবলেন এই বয়সেই দায়িত্বের বেড়াজাল ছেলেটার চিন্তা ভাবনা কতটা পরিপক্ব করে দিয়েছে। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন ছেলেটা তাঁর সিক্ত চোখ দেখে ফেললো নাতো?
_____
—-
রায়হান রুদকে রুটি ছিঁড়ে ছোট ছোট করে দিলো। রুদকে রুটি ছিঁড়ে দিলে ও নিজ হাতে খেতে পারে। রুদ নিজ হাতে খেতে লাগলো আর রায়হান রাহমিদকে ল্যাটকা খিচুড়ি খাওয়ানোর মিশনে নামলো। রাহমিদকে কোলে শুইয়ে বুকের উপর তাওয়াল দিয়ে দিলো যাতে নড়েচড়ে খাবার শরীরে ভরে না ফেলে। চামচে করে রাহমিদের মুখে কয়েকবার দিলো। হঠাৎ করে বাচ্চাটা খাবার মুখ দিয়ে ফেলে দিলো। রায়হান কয়েকবার চেষ্টা করেও ওকে খাওয়াতে পারলো না। শেষে বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বললো,
“খুব জালাচ্ছো রাহমিদ, পিটাবনে এখন। পাঁচ চামচও খাওনি, খাও।”
রাহমিদ ভাইয়ের ধমক শুনে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো। রায়হান ওকে বুকের সাথে মিশিয়ে আদর করলো তাও বাচ্চাটার কান্না থামলো না। রায়হানের নিজেরই কান্না এসে গেলো। সে রুদের দিকে তাকিয়ে দেখলো রুদ রুটি খেতে গিয়ে বেশিরভাগ ফেলে দিচ্ছে। তাঁর মা,বাবাকে খুব করে মনে পড়লো। রাহমিদ, রুদ খেতে না চাইলে মা কত কি করতো। ওরা খেতে না চাইলে মা বকা দিলে, বাবা উল্টো মাকে বকা দিতো। চোখের সামনে সেইসব স্মৃতি ভেসে উঠতে লাগলো। রায়হানের চোখ ছলছল করে উঠলো। কিভাবে সে দুই ভাইবোনকে মানুষ করবে? এটা তো কেবল শুরু এখনো কত পথ বাকি। এইসব ভাবতে ভাবতে রায়হানের চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো কান্নারত ছোট ভাইয়ের মুখে।
_____
—-
আফজাল হোসেন ও তাঁর সহকর্মী দিলদার ভ্যান গাড়িতে করে খাবার নিয়ে হোটেলে চলে গিয়েছে। জয়নব বেগম স্বামীকে বিদায় দিয়ে এসে দেখলেন রায়হান কল পাড়ে থালা বাসন ধোঁয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ভাড়াটিয়ারা নিজেদের থালাবাসন পরিষ্কার করছে আর রায়হানের দিকে তাকিয়ে ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে। তিনি দ্রুত সেখানে গেলেন। গিয়ে শুনতে পেলেন একজন জিজ্ঞাসা করছে,
“আইচ্ছা তুমি জয়নব বুবুগো কেমন আত্মীয় লাগো? তোমারে সকালেও দেখলাম টয়লেটে কতগুলা বাবুর কাপড় ভিজাইয়া রাখছো, তোমার মা, বাবা কই, হ্যাঁগো তো দেখলাম না?
রায়হান উত্তর দিতে পারলো না। কেমন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকলো, যেন এইরকম ভারী প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা নেই। জয়নব বেগম দ্রুত বললেন,
“তোমার এত কৌতূহল ক্যান সব কিছুতে ময়নার মা? ওয় আমগো কেমন আত্মীয় লাগে হেইডা যায়না তোমার কি কাম? নিজের চরকায় তেল দিতে পারো না, খালি এর কি হইছে, ওর কি হইছে, ক্যান এগুলান হইলো এইসব জিগাইয়া তোমার কি কোনো লাভ আছে? এইসব কতা কইয়া ওরে আর বিব্রত করবা না কইলাম। নিজের কাম সাইরা তত্তারি সরো এইহান তে। আমরাও কাম করমু, দাঁড়াইয়া থাকনের সময় নাই।”
ময়নার মা প্রচণ্ড অপমানিতবোধ করলো। নিজের থালাবাসন ধুয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলো। রায়হান থালাবাসন হাতে নির্জীবের মতো দাড়িয়ে রইলো। আজকে একজন জিজ্ঞাসা করছে কালকে আরও কতজন কত কি জিজ্ঞাসা করবে, এটা তো মাত্র শুরু। এইসব ভেবেই নিজের ভাগ্যের উপর হাসলো।
চলবে….