জীবন পেন্ডুলাম পর্ব-০৩

0
83

#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_৩
#তাজরীন_ফাতিহা

আফাজাল হোসেন বিছানায় বসে গতকালের খবরের কাগজ পড়ছেন। প্রতিদিন হোটেলে থাকাকালে পত্রিকা কিনেন, পড়েন আবার রাতে ফিরার সময় বগলদাবা করে বাসায় নিয়ে আসেন। পরদিন সকালে পুরোনো পত্রিকা ঘাটা তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাস। তাঁর মনোযোগ পত্রিকার পাতায়। দেশে খুন-খারাবি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেড়ে গেছে। এই যেমন পত্রিকার পাতায় বড় বড় করে লিখা, “সুনামগঞ্জের কালীঘাটে গলাকাটা লাশ উদ্ধার” এর পরের পাতায় “আরাই বিঘা জমি নিয়ে কাকরাইলে দাঙ্গা এবং তিনজন নিহত” এইসব এখন নিয়মিত ঘটনা প্রায়। খালি খুন, হত্যা, লড়াই, ঘাত-প্রতিঘাত, ধর্ষণ। দেশটা রীতিমত গোল্লায় চলে গেছে। তিনি শব্দ করে কাগজ ভাঁজ করে রেখে দিলেন। চোখের চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন। জয়নব বেগম হাত মুছতে মুছতে ভিতরে এসে বললেন,

“কিগো আপনে এহনো এইহানে বইয়া রইছেন? বাচ্চাগুলার খোঁজ নেন নাই?”

আফজাল হোসেন রায়হানদের কথা ভুলেই বসে আছেন। সকালে উঠে ফজরের নামাজ, কুরআন পড়ে পত্রিকা পড়ায় এমনভাবে ডুবে গিয়েছিলেন যে বাচ্চাগুলোর কথা মনে ছিল না। জয়নব বেগম আবারও বললেন,

“আল্লাহ্ আপনারে আক্কল কবে দিবো কন তো? আপনেরে রাইতে কইলাম না রায়হান পোলাডায় সহজে কিছু কইতে চায়না, কিছু লাগলে জীবনেও মুখ ফুইটা কইবো না যে এইডা দ্যান?”

“তুমি হুদাই রাগ করছো জয়নব। অনেক রাতে আসছে এখনো ঘুমাচ্ছে বোধহয়।” আফজাল হোসেন হেঁসে বললেন।

“আপনের শুইদ্ধ কতা আপনের কাছেই রাহেন। একবার কইছি না আমার লগে শুইদ্ধ কইবেন না নাকি দেহাইতেছেন আপনে শিক্ষিত আর আমি মূর্খ।” রেগে উত্তেজিত হয়ে বললেন জয়নব বেগম।

আফজাল হোসেনের মুখ চুপসে গেলো। প্রতিদিন জয়নব বেগমের সাথে তাঁর এই কথা বলা নিয়ে একটা রায়েট হয়ে যায়। পড়ালেখায় মেট্রিকের গণ্ডি তিনি পেরিয়েছেন। তাই শুদ্ধ কথা বের হয়ে যায় মুখ থেকে। তবে জয়নবের সাথে তিনি আঞ্চলিক ভাষায়ই কথা বলেন কিন্তু মাঝে মাঝে ভুলে শুদ্ধ কথা বের হয়ে যায়। আফজাল হোসেন মেকি হাসি দিয়ে বললেন,

“ওই কইতরী রাগতাছো ক্যান। এই দেহো অহন ঠিক আছে না।”

জয়নব বেগম আর রাগ করে থাকতে পারলেন না। ‘কইতরী’ ডাকটায় আলাদাই এক মায়া রয়েছে যা তাঁর রাগকে পানি করে দিলো। তিনি এবার বললেন,

“এহন নয়টা বাজে। অহনো ঘুমাইয়া থাকবো না। নির্ঘাত ওই পোলা ঘরের মধ্যে বইয়া রইছে। কাইলকা কতাবার্তায় বুঝছি অনেক আত্মসম্মানবোধ পোলার। ভালা পরিবারের বাচ্ছাগুলা। চাইয়া খুইজ্জা খাওনের মতো না। একটু খোঁজ নিয়া আহেন।”

আফজাল হোসেন স্ত্রীর এহেন বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হলেন। আসলেই জয়নব বেগম যা বলেছেন সেটা তিনিও লক্ষ্য করেছেন। ছেলেটা কালকে রাতে তাঁকে বলছিল, “আংকেল একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিবেন। ওদের নিয়ে উঠার মতো জায়গা নেই। কম ভাড়ায় একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিলে মাস শেষে খেয়ে পড়ে যেন থাকতে পারি।” আফজাল হোসেন তখনই তাঁদেরকে সাথে করে নিয়ে এসে তাঁর ভাড়া ঘরটায় থাকতে দেন। তিনি অবশ্য বলেছিলেন কোনো টাকা পয়সা লাগবে না থাকার জন্য। রায়হান তাঁর কথার উত্তর না দিয়ে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিলেন। ছেলেটার আত্মসম্মানবোধ ও দায়িত্ববোধ তাঁকে মুগ্ধ করেছে।
______
——
আফজাল হোসেন রায়হানদের ঘরের দরজায় দুইবার টোকা দিলেন। একটু পর দরজাটা খুলে গেলো। তিনি চেয়ে দেখলেন রায়হানের গায়ে হাগু ভর্তি। রায়হান ওনাকে দেখে কাচুমাচু করছে। উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,

“ওমা একি অবস্থা করেছো?”

রায়হান বললো,

“আসলে রাহমিদ এইমাত্র টয়লেট করে দিয়েছে। দরজা নকের শব্দে তাড়াহুড়া করে খুলে দিলাম। দুঃখিত! টয়লেট টা যদি দেখিয়ে দিতেন নিজেকে ও রাহমিদকে পরিষ্কার করিয়ে জামা কাপড় গুলো ধুয়ে দিতাম। ওকে পড়ানোর মতো কোনো কাপড় নেই ওর কাপড়গুলো নোংরা হয়ে গেছে।”

আফজাল হোসেন রায়হানকে টয়লেট দেখিয়ে দিল। রায়হান রাহমিদকে নিয়ে টয়লেটে ঢুকলো। রাহমিদের জামা খুলে ওর পটি পরিষ্কার করে পিছন ধুয়ে দিলো। রায়হান নিজের জামা খুলে অন্য একটা গেঞ্জি পরলো। তারপর রাহমিদের গায়ে পানি ঢাললো। গায়ে পানি পড়ায় রাহমিদ চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। রায়হান ওকে দাড় করিয়ে গায়ে পানি ঢালছে কিন্তু বাচ্চাটা স্থির থাকছে না। কেঁদে উঠছে। রায়হান হালকা ধমক দিয়ে বললো,

“পিট্টি দিবো কিন্তু। বোনুর জামা নোংরা করেছো উঠে পিটাবেনে। এখন আবার দুষ্টু করছো। সোজা হয়ে দাঁড়াও পঁচা ছেলে।”

রাহমিদ মোটেও সোজা হলো না, ভাইয়ের ধমক শুনে আরও জোরে কেঁদে উঠে মোচড়ানো শুরু করলো যাতে ভাইয়ের হাতের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে। রায়হান তা দেখে তাড়াতাড়ি অল্প একটু সাবান ডলে গোসল শেষ করলো। রাহমিদ রায়হানকে খামচি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে। রায়হান দ্রুত ওকে তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসলো। রাহমিদ রায়হানের গলা জড়িয়ে ধরা। রায়হান ওর মাথা গা ভালোভাবে মুছে দিলো। রাহমিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কোলের মধ্যে লাফ দিয়ে উঠে হেসে দিলো। তা দেখে রায়হান বললো,

“ওরে দুষ্টু, এই বয়সেই পলিটিক্স শিখে গেছিস। বুদ্ধি দেখো দুইদিনের লাড্ডুর। বাবাগো বাবা! গোসল না করার জন্য কত নাটক করলো। এখন আবার খুশির ঠেলায় লম্ফ জম্ফ শুরু করেছে। এখন তোকে বেঁধে পিটাবো। আমাকে খামচিয়ে কি করেছে। জংলি বিল্লি।”

রাহমিদ ভাইয়ের কথা শুনে কোলের মধ্যে হাসি দিয়ে লাফালাফি বাড়িয়ে দিলো। রায়হান ওর গাল চেপে ধরে চুমু খেলো। “ওরে জাদুরে, লাড্ডুরে, গুলুমুলুরে, টোটনরে” বলে ওর পেটের মধ্যে নাক চেপে, গালে গাল ঘষে আদর করতে থাকলো। আদর করতে করতে শোয়ায় দিলো। তারপর ওর গালে গাল লাগিয়ে বললো,

“আমার লাড্ডুগুড্ডু, ভাইয়ু জামা কাপড় ধুয়ে আসি। তুমি বোনুর পাশে শান্ত হয়ে খেলো, ঠিক আছে।”

কথাটা বলে ব্যাগ থেকে কিছু খেলনা ওর হাতে আর পাশে ছড়িয়ে দিলো। সাথে মাথার বালিশ চারপাশে বর্ডার করে দিলো যাতে হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে না যায়। রুদ এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে ছিল। ওকে ঠিক করে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
_____
——
রায়হান টয়লেটের সামনে এসে দেখে কিছু মহিলা দাঁড়ানো। তাঁরা টয়লেটে বাচ্চাদের জামা কাপড় দেখে নানা কথা বলছে। জয়নব বেগম কলে হাত ধুতে এসে দেখেন রায়হান আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মহিলাদের দেখে। সে দ্রুত সেখানে গিয়ে সবাইকে বললো,

“এইহানে জটলা পাকায় রাখছো ক্যান? যাও নিজেগো কামে।”

ভাড়াটিয়া একজন বললো,

“ভাবি টয়লেট করতে আইসা দেখি বাচ্ছাগো জামা কাপড়ে ভরা। এত জামা একদিনে ভিজাইছে কোন বেক্কল কন তো? আমরা টয়লেটে যামু না।”

জয়নব বেগম বুঝলেন রায়হান না বুঝে সব গুলো কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছে। এই পরিবেশে নতুন বলে বুঝতে পারেনি। এটা যদি এরা জানে তাহলে তুলকালাম লাগিয়ে দিবে যেহেতু এই ভাড়া বাসাগুলোর টয়লেটের চাহিদা বেশি, লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তাই তিনি বললেন,

“আমাগো মেহমানের বাইচ্চার জামা কাপড় এগুলান। তোমরা অন্য টয়লেটে কাম সারো আইজকার লাইগ্যা।”

জয়নব বেগমের কথা শুনে তাঁরা প্রস্থান করে কারণ মালিকের আত্মীয় হইলে তাঁদের এইখানে কিছু বলার নাই। জয়নব বেগম রায়হানকে জামা কাপড় ধুতে বলে চলে গেলো রান্না ঘরে। রায়হানদের নাস্তা দিতে হবে। বেলা অনেক হলো বাচ্চাগুলো না খেয়ে আছে।
_____
রায়হান কাপড় দ্রুত ধুয়ে শুকাতে দিলো। ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো রুদাইফা উঠে গেছে। রাহমিদ রুদাইফার চুল ধরে টানছে আর রুদ ছড়ানোর চেষ্টা করছে। রাহমিদ বোনের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসলো আর হাত বাড়িয়ে দিলো। রুদ ওকে কোলে নিলো যদিও ভালো করে পারেনি। এই দৃশ্য দেখে রায়হানের চোখ জুড়িয়ে গেলো। রায়হান ভিতরে ঢুকে বললো,

“রুদ সোনা উঠে গেছো। বাবুনকে দাও। চলো হাত মুখ ধুয়ে দেই।”

রুদ রাহমিদকে ভাইয়ের কোলে দিলো। রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়ে রুদকে হাত মুখ ধোয়াতে টয়লেটে নিয়ে গেলো। রুদ টয়লেট করে বের হলে রায়হান রাহমিদকে কোলে নিয়েই রুদকে ব্রাশ করিয়ে হাত মুখ ধুয়ে দিল। রাহমিদ মোটেও স্থির থাকছে না। দুজনকে সামলাতে রায়হান হিমশিম খেলো আর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। একদিনেই এই অবস্থা হলে সামনের দিনগুলো কিভাবে পার করবে? রায়হান বেশ বুঝতে পরলো আগামী দিনগুলো তাঁর জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জের হতে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জের নাম বাচ্চা সংসার নামক যুদ্ধ।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে