#জীবন_পেন্ডুলাম
#পর্ব_২
#তাজরীন_ফাতিহা
রায়হানের মুখে একটু আগের কাঠিন্য ভাবটা আর নেই। খুব শান্ত ভঙ্গিতে ভাত খাচ্ছে সে। পাশে রুদাইফা একমনে বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে খেলছে। জয়নব বেগমের কোলে রাহমিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চা মানুষ খিদে আর টয়লেট মিটে গেলেই আর ঝামেলা করে না। জয়নব বেগম বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গুলুমুলু আদুরে মুখ! যেন ছুঁয়ে দিলে গলে যাবে। মাশআল্লাহ্ নজর যেন না লাগে। একটু আগে রায়হানের থেকে বাচ্চাটার বয়স জেনেছে। এইতো দশ দিন পর এক বছরে পা দিবে। মেয়েটা পাঁচ বছরের। আফজাল হোসেন রায়হানকে সতেরো বছরে বয়সী ভেবেছিলেন কিন্তু ছেলেটার বয়স উনিশ। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে। বাচ্চাগুলো এই বয়সেই এতিম হয়ে গেলো। রায়হান ছেলেটার কাঁধেই এখন তাঁদের গুরু দায়িত্ব। একটা দীর্ঘনিশ্বাস বের হলো জয়নব বেগমের বুক চিরে।
_______
——-
অন্ধকার ঘর। রায়হানের বুকের উপর রাহমিদ ঘুমিয়ে আছে। জয়নব বেগম বাচ্চাটাকে তাঁর সাথে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু রায়হান দেয়নি।ভাই বোনদের ছাড়া তাঁর ঘুম আসবে না। এক হাত দিয়ে রাহমিদকে আগলে ধরে পিঠের উপর হাতটা হালকা উঠানামা করছে। রাহমিদের মুখটা তাঁর বুকের সাথে লেগে আছে। ঠোঁটের ভিতর আঙ্গুল ঢুকানো। ঘুমের মধ্যেই একটু পর পর আঙ্গুল চুষছে। তাঁর অপর হাত দিয়ে রুদাইফাকে জড়িয়ে ধরা। রুদাইফা ঘুমাচ্ছে না। ভাইয়ের আঙুল ধরে খেলছে। একবার উঠে বসছে আবার শুয়ে পড়ছে।
“রুদাইফা দুষ্টুমি করে না। ঘুমাও।” রায়হান মৃদু ধমক দিয়ে বললো।
“বাবু ঘুমাই। রুদ ঘুমাই। রুদ দুষ্টু করে না।” রুদ রায়হানের হাতের সাথে মাথা বারি দিয়ে বলে।
“রুদ সোনা খুব দুষ্টু করে। না ঘুমালে ভূতু এসে রুদ সোনাকে খেয়ে ফেলবে।” রায়হান তাকে ঘুম পাড়াতে বললো।
“ভূতু…” রুদাইফা ভয়ার্ত গলায় বললো।
“হুম” রায়হান উত্তর দিলো।
“আমুর কাছি যাবু, আবু কুই?” রুদাইফা কাঁদো কাঁদো গলায় শুধালো।
রায়হান উত্তর দিতে পারলো না আর। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো তাঁর। এখন রুদকে কি উত্তর দিবে সে। কেন সে ভূতের ভয় দেখাতে গেলো? রুদটা তো ভয় পেলেই বাবা মার কোলের মধ্যে ঢুকে থাকতো। সে কিভাবে তা ভুলে গেলো? এখন কিভাবে সামাল দেবে রুদকে। এদিকে রুদ কান্না গলায় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। রায়হান রুদাইফাকে বুকের মধ্যে টেনে আদুরে গলায় বললো,
“আব্বু, আম্মু তো বেড়াতে গিয়েছে সোনা। এইতো কয়েকদিন পরই চলে আসবে। আব্বু, আম্মু রুদ সোনাকে অনেক মিস করছে। শীঘ্রই এসে পড়বে যদি রুদ সোনা কোনো দুষ্টু না করে, ভালো বাচ্চার মতো ঘুমায়, খায়, ভাইয়ুর কথা শুনে।”
“রুদ মিসড আমু, আবু। রুদ কোনো দুষ্টু কব্বে না। ভাইয়ুর কতা শুনবে। রুদ ভালু।” রুদাইফা ভাইয়ের গলা জড়িয়ে বলে।
রায়হান রুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“রুদ সোনা ভাইয়ুর কানে কানে কবিতা শুনাও তো। রুদ না সুন্দর সুন্দর কবিতা পারে?”
“হাম”
রুদাইফা ভাইয়ের গলা জড়িয়ে আস্তে আস্তে বলতে লাগলো,
“জনি জনি,
ইয়েস পাপা।
ইটিং সুগার,
নো পাপা।
ওপেন ইউর মাউথ
হাঃ..হাঃ.. হাঃ”
রুদাইফা লাস্টের লাইন বলতে গিয়ে জোরে হেঁসে দিলো সাথে রায়হানও। রাহমিদ নড়ে উঠায় সাথে সাথে রুদকে চুপ করতে বললো কিন্তু রুদ হেসেই যাচ্ছে। রায়হান বোনের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আর প্রার্থনা করলো সারাজীবন যেন তাঁর ভাইবোন এভাবেই হাসতে থাকে। ইংশা আল্লাহ্ একটুও কষ্টের আঁচ তাঁদের গায়ে সে পড়তে দিবে না। কিন্তু বাবা মা বিহীন নিঃস্ব রায়হান তা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে আল্লাহ্ তায়ালাই ভালো জানেন।
______
—–
সকাল ছয়টা বাজে। আফজাল হোসেনের বাড়িটা টিনশেডের। স্বল্প ভাড়ায় কয়েকটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার এখানে ভাড়া থাকেন। ঢাকা শহরের মতো জায়গায় এত কম টাকায় ভাড়া থাকা অমাবস্যার চাঁদের মতো। বাড়িটায় টয়লেট দুটো। রান্না ঘর দুটো, একটায় আফজাল হোসেনের ঘরের ও হোটেলের রান্না বান্না হয় আরেকটায় ভাড়াটিয়ারা রাঁধেন। সকালের এই সময়টায় ভিড় লেগে যায় রান্নাঘরে। পুরুষদের তাড়া থাকে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য, তাই মহিলারা আগেভাগেই উঠে রান্নার কাজটা সেরে ফেলেন। চুলা চারটা। তাই অতটা ঝামেলা কাউকেই পোহাতে হয়না। এইসব ভাড়া ঘরে তো ঝগড়া মারামারি অহরহ ঘটনা। কিন্তু আফজাল হোসেন নির্ভেজাল মানুষ। ঝুট ঝামেলা তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই ঝামেলা এড়াতে এই টিনশেড বাড়িটায় সাধ্যের মধ্যে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ভাড়াটিয়ারা আফজাল হোসেন ও জয়নব বেগমকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। আফজাল হোসেনের ভাতের হোটেলের রান্নার কাজেও তাঁরা জয়নব বেগমকে সাহায্য করে বিনা দ্বিধায়। মনেই হয়না টিনশেডের এই বাড়িটায় কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন নিম্নবিত্ত পরিবার থাকে, যেন একই পরিবারের আত্মীয়রা মিলেমিশে বসবাস করছে।
_____
জয়নব বেগম ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাটাকুটি করছেন। পাশে মাছ, মাংস, শাক সবজি ধোঁয়া এবং মশলা বাটাবুটির কাজ করছে ভাড়াটিয়া বিলকিস, রোমানা, পপি আর সহকর্মী আলেয়া। সকাল হলেই জয়নব বেগমের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। স্বামী ভাতের হোটেল চালায়। প্রতিদিন এই ভাতের হোটেলের রান্না সেই করে। আজকে রান্নার মেন্যু থাকবে, “লতি দিয়ে কুঁচো চিংড়ি, লাউ শাক, করল্লা ভাজি, ঢেঁড়স ভাজি, আলু দিয়ে ডিমের ঝোল, ছোট মাছের চচ্চড়ি, রুই মাছের ঝোল, বয়লার মুরগির ভুনা, আলু ভর্তা, পেঁপে ভর্তা, মুগের ঘন ডাল আর পাতলা ডাল।” আফজাল হোসেন দুপুর বারোটায় ভ্যানে করে খাবার গুলো নিয়ে হোটেলে যাবেন। জয়নব বেগম চুলোয় খুন্তি নাড়াচ্ছেন আর রোমানার সাথে কথা বলছেন। রোমানা কড়াইয়ে লাউ শাক ঢেলে দিয়ে জানতে চাইলো,
“কাইলকা অত রাইতে কেডা আইছে আফা?”
“আমগো চিন পরিচিত মানুষ।”
“ওহ আইচ্ছা।”
জয়নব বেগম আবার রান্নায় মনোযোগ দিল সাথে রোমানাও। জয়নব বেগম বেশি কথা বাড়াননি কারণ মানুষ একটা কথাকে নানা ভাবে রসকষ মিশিয়ে সবার কাছে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে যা তাঁর পছন্দ না। তাই অল্প কথায় মিটমাট করলেন।
_____
—–
রাহমিদের কান্নার আওয়াজে রায়হানের ঘুম ছুটে গেলো। রায়হান রাহমিদকে সহ তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। কান্না থামাতে কিছুক্ষণ দোলালো। ভাইয়ের পরশ পেয়ে বাচ্চাটার কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ করতে লাগলো। রায়হান ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার লাড্ডু কি চায়? রাহমিদ সোনা কি চায়?” বাচ্চাটাকে নানা কথা বলে কতক্ষন আদর করলো। বাচ্চাটাও অস্পষ্ট আওয়াজ করে ভাইয়ের আদরের জানান দিলো।
এর মধ্যেই রায়হান অনুভব করলো তাঁর বুক ভিজা। সে তৎক্ষণাৎ রাহমিদের দিকে চাইলো আর বললো,
“ওরে দুষ্টু, ভাইয়ুর গায়ে সুসু করে দিছো?”
রাহমিদ মুখে দুই আঙ্গুল ভরে বলে উঠলো, “য়ু… উ.. পু…উস”
“আমার লাড্ডুগুড্ডু” বলে রায়হান রাহমিদের পেটে নাক দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে ওকে নিয়ে চৌকি থেকে উঠলো। রাহমিদকে পরিষ্কার করতে হবে কিন্তু যে কয়টা জামা এনেছিল সব নষ্ট করে ফেলেছে বাচ্চাটা। কালকে থেকে তো পড়ানো লেগেছে। জামা গুলো ধুয়ে দিতে হবে। ধুয়ে শুকাতে তো সময় লাগবে। রাহমিদকে এখন পরাবে কি? জয়নব বেগমের কাছে কাপড় থাকতে পারে। কিন্তু ওনার কাছে চাইতে লজ্জা করছে। রাত থেকে উনাদের ঘাড়ে উঠে বসে আছে। কিছু চাইলে যদি অন্য কিছু মনে করে। রায়হান ভাবলো রুদাইফার কোনো গেঞ্জি রাহমিদকে পরাবে।যেই ভাবা সেই কাজ ব্যাগ খুলে রুদাইফার একটা গোলাপী গেঞ্জি বের করলো তারপর রাহমিদের গা থেকে পূর্বের পোশাক খুলে সেটা পরিয়ে দিলো। পোশাকটা রাহমিদের থেকে অনেক বড়। পায়ের নিচ পর্যন্ত চলে যায়। রাহমিদকে পুরো মেয়ে মেয়ে লাগছে। আদুরে কিউট বাচ্চা। রায়হান ওকে দেখে বললো,
“আমার গুলুমুলু টোটন সোনা। ভাইয়ু তোমায় মেয়ের পোশাক পড়িয়েছি দেখে রাগ করেছো? রাগ করে না। ভাইয়ু তোমায় অনেক গুলো জামা কিনে দিবো, ঠিক আছে লাড্ডুগুড্ডু।”
কথাগুলো বলে রাহমিদের গালে শব্দ করে চুমু খেলো রায়হান। রাহমিদ ফোকলা হেঁসে তাকিয়ে রইলো রায়হানের দিকে।
_______
“ওমা একি অবস্থা করেছো”
চলবে….