জীবন_পেন্ডুলাম
“এই ছেলে এভাবে শুয়ে আছো কেন?”
আফজাল সাহেব ছেলেটার গা ঝাকিয়ে বললেন। বছর ষোলো, সতেরোর একজন ছেলে রাস্তার পাশে শুয়ে আছে কোলে এক বছরের শিশু বা তারও কম হতে পারে। তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে রাখা। পাশে আবার পাঁচ কি ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে ছেলেটার গা জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।
একজন কিশোর এত রাতে দুটো বাচ্চা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে তাও আবার রাস্তার পাশে বিদঘুটে একটা ব্যাপার না? আফজাল হোসেন রাত একটা নাগাদ নিজের ভাতের হোটেল বন্ধ করে এই পথ দিয়েই বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর হোটেলের বেঁচাবেঁচি ভালোই চলে। প্রায় প্রতিদিনই বাসায় দেরি করে ফেরেন তিনি। যদিও রাস্তাটা জনশূন্য থাকে এই সময়টায় তবুও তিনি ও তাঁর সহকর্মী দিলদার এই রাস্তা দিয়েই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন পথ সংক্ষিপ্ত হয় বিধায়। আজকেও যথাযথ নিয়মে পথ চলছিলেন তাঁরা। হঠাৎ জনমানবহীন রাস্তার পাশে এই দৃশ্য দেখে অনেকটা চমকে যান দুজনেই। দিলদার তো ভয়ে দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।
এত রাতে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পক্ষে কোনোকালেই আগ্রহী নয় দিলদার। মারাত্মক ভীতু সে। শুধুমাত্র আফজাল হোসেনের কারণে এই রাস্তা দিয়ে তাঁকে যেতে হয় রোজ। তাঁর ভাষ্যমতে “রাত বিরাতে রাস্তাঘাট হলো ভূত প্রেতের আড্ডাখানা। এত রাতে এই রাস্তা দিয়ে না গেলেই কি নয়?” আফজাল হোসেন ভীষণ সাহসী মানুষ। তিনি জ্বীন ভূতে বিশ্বাস করলেও বলেন,
“দোয়া দুরুদ পড়ে বের হলে ভূত, জ্বীন কিছুই করতে পারবে না। একটুখানি পথ থাকতে আবার অতখানি হাঁটে কে?”
দিলদার আর তর্কে জড়ায় না। পৃথিবীর সব যুক্তি আফজাল হোসেনের কাছে আছে। অযথা কথা বাড়িয়ে চাকরি খাওয়ার মানে হয় না। কিন্তু আজ এই দৃশ্য দেখে সে ভয়ে কুপোকাত হয়ে গেল। ওর ধারনা ভূত মানুষের সুরত নিয়ে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এখন যদি তাঁরা এখান থেকে যায় আর ভূতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে তাঁদের দুজনের জীবনের এখানেই দফারফা। এই ভূতুড়ে রাস্তায় কে বাঁচাতে আসবে তাঁদের? জীবনে যত দোয়া সে শিখেছে সব পড়ছে কিন্তু কোনোটাই ঠিকমতো মনে করতে পারছে না। ভুলভাল পড়ছে সব।
আফজাল হোসেন প্রথমে চমকালেও একটু সামনে এগিয়ে দেখেন একজন অল্পবয়সী ছেলে শুয়ে আছে। দিলদার আফজাল হোসেনকে সামনে আগাতে বারণ করছেন। কিন্তু তিনি এইসব তোয়াক্কা না করেই সামনে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিলেন। দিলদার একটু দূরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে আর ভুলভাল দোয়া পড়ছে। ওদিকে আফজাল হোসেন ছেলেটার গায়ে আবারও ধাক্কা দিয়ে উপরিউক্ত কথাটি বললেন। ছেলেটা এবার নড়েচড়ে উঠলো। চোখ পিটপিট করে তাকালো আফজাল হোসেনের দিকে। আফজাল হোসেন বললেন,
” এইখানে শুয়ে আছো কেন? তোমার বাড়ি কই?”
ছেলেটা কি বুঝলো কে জানে তড়িঘড়ি করে উঠে কোলের বাচ্চাটাকে দেখলো আর ওর পাশের বাচ্চা মেয়েটাকে জড়িয়ে রাখলো। আফজাল হোসেন ছেলেটার তাড়াহুড়া দেখলো। বুঝলেন ছেলেটা ভয় পেয়েছে। তারপর বললেন,
” ভয় পেও না। তুমি কে? ওদের নিয়ে এভাবে রাস্তায় ঘুমিয়ে আছো কেন?”
ছেলেটা এবার মুখ খুললো।
” বাড়ি নেই। যাওয়ার জায়গা নেই তাই।”
আফজাল হোসেন ছেলেটার শ্যামলা বদনে রাজ্যের ক্লান্তি ও মলিনতা দেখলেন। যেন কতকাল ধরে অভুক্ত। গলাটা কেমন ফ্যাসফাসে শোনালো। ছেলেটাকে দেখে ভালো পরিবারের মনে হলো। কিন্তু রাস্তায় এভাবে দুটো বাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে আবার থাকার জায়গা নেই বললো কেন?
” থাকার জায়গা নেই কেন?” আফজাল হোসেন প্রশ্ন করলেন।
” পৃথিবীতে এতিম অনাথদের জায়গা থাকে না তাই।” ছেলেটার নির্লিপ্ত উত্তর।
আফজাল হোসেন অবাক হলেন। এতটুকু ছেলের এত ভারী কথাবার্তা তাঁর ঠিক হজম হলো না। একটু আগে কি বললো ‘ এতিম ‘। নিজের প্রথম জীবনের টুকরো কিছু স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আফজাল হোসেনের বুকটা ধক করে উঠলো। ছেলেটা এতিম। মানতে কষ্ট হচ্ছে। উনি নিজেকে সামলিয়ে বললেন,
” এই বাচ্চা দুটো…”
আফজাল হোসেনের কথা শেষ করতে না দিয়েই ছেলেটা উত্তর দিলো,
” আমার ভাই বোন।”
আফজাল হোসেন বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কি মায়া তাঁদের চোখে মুখে! আচ্ছা বাচ্চা দুটো কি জানে তাঁদের মা, বাবা এই পৃথিবীতে নেই। কি বুঝে এতটুকু বাচ্চা? পাঁচ কি ছয় বছরের একজন, আরেকজন কোলের শিশু। ছেলেটারই বা কত বয়স আর। উনি আর ভাবতে পারলেন না। দিলদার এখন আফজাল হোসেনের পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে দেখছে। তারও ভীষণ কষ্ট লাগছে। দিলদার এবার বললো,
” তোমার আত্মীয় স্বজন নাই?”
আফজাল হোসেন লক্ষ্য করলেন প্রশ্নটা শুনে ছেলেটার চোখ মুখ পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো।কিছুটা ইতস্তত করে মৃদু গলায় বললো,
” নেই।”
আফজাল হোসেনের মনে হলো ছেলেটা কিছু লুকালো। তাই তিনি আর ঘাটলেন না। শুধু বলল,
” তাহলে থাকবে কই? থাকার কোনো জায়গা আছে? এই শহরে কাউকে চিনো?”
” না। আল্লাহর উপর ভরসা করে এসেছি। থাকার জায়গা তিনিই করে দিবেন।”
আফজাল হোসেন বুঝলেন ছেলেটার কেউ নেই এই দুনিয়ায়। এর মাঝেই কোলের বাচ্চাটি নড়েচড়ে উঠলো। ছেলেটা বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য পিঠে হালকা বারি দিতে লাগলো। তাঁর মনে হলো ছেলেটা কোনোভাবেই চাচ্ছে না বাচ্চাটার ঘুম ভাঙ্গুক। কিন্তু বিধিবাম! বাচ্চাটা হঠাৎ জোরে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো আর ছেলেটা দিশেহারা হয়ে গেলো। বুকের মাঝে মিশিয়ে বার বার দোলাতে লাগলো। আর বাচ্চাদের ভুলাতে মানুষ সচরাচর যা বলে তাই বলতে লাগলো। তবে সে যে এইসব কাজে আনাড়ি তা বোঝাই যাচ্ছে। আচ্ছা বাচ্চা দুটো কি খেয়েছে? আফজাল হোসেনের মনে হলো খাইনি। তিনি বললেন,
” সারাদিন কিছু খেয়েছ?”
ছেলেটা বাচ্চাটাকে সামলাতে সামলাতে বললো,
” না। দুপুরে থেকে না খাওয়া। শুধু ওকে ফিডার খাইয়েছি কিন্তু অনেকক্ষণ হলো ফিডার শেষ। তাই ওকে আর রুদকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি যাতে ক্ষুধা অনুভব না করে। ক্ষুধা লাগলেই তো কাঁদবে আর খেতে চাইবে তখন ওদের কিভাবে সামলাবো? দুপুর থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখেছি কিন্তু কতক্ষণ পারবো জানি না।”
এর মধ্যেই বাচ্চার কান্নার শব্দে ছোট্ট মেয়েটিও উঠে পড়লো আর ভাইয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা মেয়েটার দিকে অসহায় বদনে তাকিয়ে রইলো। যেন বলতে চাইলো, ” কেন উঠলি বোন? খাওয়াবো কি তোদের? কাকে রেখে কাকে সমলাবো? আরেকটু ঘুমোতিস।” আফজাল হোসেন চেয়ে চেয়ে দেখলেন এক ভাইয়ের অসহায় চাহুনি আর ছোট বাচ্চাগুলোর অভুক্ত থাকার করুণ এক আকুতি! চোখটা ভিজে উঠলো কি?
________
———-
ছোট একখানা চৌকি, একটা আধ ভাঙা টেবিল, পুরোনো কাঠের আলমারি, একটা আলনা, রং চটা একটা ট্রাঙ্ক, কোনার দিকে হাঁড়ি পাতিল, গ্লাস আর কিছু প্লেট রাখা। রায়হান কোলে বাচ্চাটাকে নিয়ে বসে আছে চৌকির উপর। বাচ্চাটার মুখে ফিটার গোঁজা। বাচ্চাটা চুকচুক করে ফিটার খাচ্ছে আর ভাইয়ের দিকে পিটপিট করে তাকাচ্ছে। পাশে বাচ্চা মেয়েটা বসে আছে হাতে বিস্কুট। ক্ষণে ক্ষণে পা দোলাচ্ছে। বিস্কুট নিজে খাচ্ছে আবার ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
” রুদ তুমি খাও। আমাকে দিতে হবে না।” রায়হান বললো।
” নো নো। বিক্কিট মুজা। ভাইয়ু খাউ।” রুদ মাথা দুলিয়ে মজা বুঝালো।
রায়হান বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি মায়া মায়া মুখ। যদি বাবা, মার কাছে যাওয়ার বায়না ধরে তাহলে রায়হান কি বলবে। সেদিন মা, বাবার খাটিয়ার সামনে বসে পুতুল খেলছিল অবুঝ রুদটা। রায়হানের চোখে পানি দেখে বলেছিল, ” কান্দু কেনু?” মা, বাবা যে মারা গেছে সেটাই বুঝতে পারেনি বাচ্চাটা। জাইফ তো এক বছরের শিশু। ও তো বাবা, মার আদর ভালোবাসা বুঝার আগেই এতিম হয়ে গেলো। ভঙ্গুর হৃদয়ে কবর দিয়ে বাসায় এসে দেখলো রুদ পরে আছে ফ্লোরে। চিৎকার দিয়ে কাদঁছে আর মা বাবার কাছে যাওয়ার বায়না করছে। সামনে দাড়িয়ে এক বর্বর নারীমূর্তি! কি অসামান্য ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে ছিল। সে চলে আসায় রুদকে উঠিয়ে আদর করছিল। এসব ভাবতে ভাবতে রায়হানের চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠলো। সে ছাড়া বাচ্চা দুটোর পৃথিবীতে কেউ নেই। তারও নেই। এরাই তাঁর সম্বল। বাচ্চা দুটোর বাবাও সে মাও সে।
” এইখানে কোনো সমস্যা হইতাছে না তো?” একজন মধ্যবয়সী নারী ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বললো। হাতে তাঁর ভাতের গামলা আর তরকারি। রায়হান ওনাকে চিনে। আফজাল হোসেনের স্ত্রী। আফজাল হোসেন এখানে এনেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
” জি না।” রায়হানের উত্তর।
” তাড়াতাড়ি ভাত খাইয়া লও। বাচ্চাডারে আমার কাছে দাও।” রায়হানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো নারীটি।
রায়হান ভাইকে কে তাঁর কোলে দিলো। জয়নব বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করলো। প্রশ্ন করলো, ” তোমার নাম তো হুনছি ওগো নাম কি?”
” রুদাইফা জিনাত আর রাহমিদ জাইফ” রায়হানের ছোট উত্তর।
” মাশাআল্লাহ্ সুন্দর নাম।” প্লেট এগিয়ে দিয়ে জয়নব বলে উঠলো। তারপর প্লেটে ভাত তরকারি বেড়ে দিলো। ইতস্তত করে রায়হান রুদকে ছোট ছোট লোকমা তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। রুদাইফা বেশি খেতে পারলো না। একটু আগে বিস্কুট খেয়েছে দেখে রায়হান আর জোর করলো না।
” তুমি আমারে দেইখা অস্বস্তিবোধ কইরো না। আমি তোমার চাচীর লাহান। জয়নব চাচী ডাইকো।” কথাটা শুনে রায়হান ভাতের লোকমা মুখে দিতে গিয়েও দিলো না। জয়নব খেয়াল করলো ছেলেটার চোখমুখ শক্ত হয়ে গিয়েছে। ভুল কিছু বললো কি? বুঝতে পারলেন না তিনি।
চলবে….