জীবনের ডাকবাক্স পর্ব-০৮

0
26

#জীবনের_ডাকবাক্স
[ অষ্টম পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

হঠাৎ কিছু একটার শব্দ শুনে দু’জন দু’জনকে ছেড়ে দিয়ে আলাদা হয়ে যায়। তখনই তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাই আমি। তারা দু’জন আমাকে এখানে দেখে অনেক বেশি লজ্জা পায়। আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,

— এতো রাতে ছাদের উপরে থাকা ঠিক হবে না। তোমরা রুমে যাও। আর হ্যাঁ আমি কিন্তু কিছু দেখিনি।

এই কথা বলতেই নিঝুম দৌড়ে চলে যায়। আমি রিহানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আমরা যে যার রুমে চলে আসি। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে সবাই। বিয়ের সময় বেশি না থাকায় পরের দিন আমরা কেনাকাটা করতে যাই। বিয়ের কেনাকাটা শেষ করে আমরা বাসায় ফিরে আসছি। গাড়িতে বিয়ের জিনিস পত্র বেশি থাকার কারণে আমি আর জাহানারা বেগম অন্য একটা গাড়িতে উঠি। আর রিহান আর নিঝুম আমাদের সামনের গাড়িতে করে যাচ্ছে। গাড়ি ড্রাইভিং করছে রিহান। আর রিহানের পাশে বসে আছে নিঝুম। দু’জনেই খুব খুশি। হঠাৎ সামনে একটা দ্রুত গতিতে একটা ট্রাক তাদের দিকে ছুটে আসছে। গাড়িটার গতি অনেক বেশি ছিলো। ট্রাকটা এসে সজোরে রিহানের গাড়িতে এসে ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে গাড়িটা রাস্তার এক পাশে এসে পড়ে। গাড়ির ভিতরে নিঝুম আর আর রিহান তখনও রয়েছে। তাদের এমন এক্সিডেন্ট দেখে সাথে সাথে আমি গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আর সেই ট্রাক চলে যায়। দু’জনের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। নিঝুমের থেকে বেশি আঘাত পেয়েছে রিহান। রিহানের পুরো শরীর লাল হয়ে গিয়েছে। আর নিঝুম অজ্ঞান হয়ে আছে। রিহানও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। আমরা আর দেরি না করে দুজনকে কাছের একটা হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার দু’জনকে অপারেশন রুমে নিয়ে যায়। ডাক্তার জানাত নিঝুম ঠিক আছে কিন্তু রিহান আর নেই। মানে রিহান মারা গিয়েছে। এই খবর টা শুনে আমি যেনো পাগলের মতো হয়ে গেছি। যে ছেলেটা আমার চোখের সামনে বড় হয়েছে সে আজ লাশ হয়ে গিয়েছে! এটা যেনো আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। জাহানারা বেগম তো কান্না করেই যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিঝুমের চিৎকার শুনে আমরা নিঝুমের কাছে চলে যায়।

— মা রিহান কোথায় রিহান ঠিক আছে তো?

জাহানারা বেগম কান্ন করছে। তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা। নিঝুম আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল — চাচা আমার রিহান কোথায় আমি একটা বার আমার রিহানকে দেখতে চাই।

— মারে রিহান আর আমাদের মাঝে নেই।

আমার কথা শুনে নিঝুম একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। একটু পরে নিঝুমের জ্ঞান ফিরে আসতেই নিঝুম পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করে। রিহানকে হারিয়ে সে যেনো উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। এর আগে বাবাকে হারিয়েছে। এবার নিজের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে সে পুরো উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে আমরা রিহানের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরি যায়। যেই বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হওয়ার কথা সেই বাড়ি টা মৃত হয়ে গিয়েছে। রিহানের লাশ জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করে নিঝুম। সবাই কান্না করছে। জাহানারা বেগম নিজের মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কান্না করছে। কিছুক্ষণ পরে জামাল সাহেবের কবরের পাশে রিহানকে দাফন করা হলো। রিহানের শোকে সবাই পাথর হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একদিন আমি বাজার থেকে এসে দেখি পুরো বাড়িতে কেউ নেই। বাড়িটা পুরো খালি। নিঝুমরা কোথাও গেলে তো অবশ্যই আমাকে জানিয়ে জেতেন। আমি এবার তাদের রুমে চলে গেলাল। সেখানে গিয়ে দেখি তারা নেই। কিন্তু রুমের অবস্থা খুব খারাপ। বাড়ির অনেক যায়গায় রক্তের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমি দৌড়ে নিঝুমের রুমে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি অবস্থা আরো খারাপ। পুরো রুমে রক্ত। কিন্তু রুমে কোনো মানুষ নেই। আমি তখনও কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ওনাদের সাথে খারাপ কিছু হয়ে যায়নি তো? তখন আমার চোখ পড়ে একটা যায়গায়। আমি তাকিয়ে দেখি নিঝুমের জামাটা পড়ে আছে। আর সেটায় প্রচুর রক্ত। আমি সাথে সাথে থানায় ফোন দেই। পুলিশ এসে সব কিছুই দেখেন। কিন্তু কোথাও নিঝুম আর জাহানারা বেগমের লাশ পাওয়া যায়না।

অতীত শেষ করে বাস্তবে ফিরে আসে। সবার চোখে পানি টলমল করছে।

আসিফ বলল — পুলিশ কি খুনিদের ধরতে পারেনি?

— না কিছুদিন পরেই পুলিশ তাদের মামলা বন্ধ করে দেয়। কোনো প্রমাণ আর লাশের সন্ধান না পাওয়ার জন্য। আজো তাদের সেই লাশ পাওয়া যায়নি। আমার মনে হয় তাদের আত্মা মুক্তি পাওয়ার জন্য তোমার সামনে তারা এসেছে। আর তাদের খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

সব কিছুই আসিফের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে কি করবে বুঝতে পারছেনা। এগুলো কি আসলেই বাস্তব নাকি কোনো গল্প? এটাই আসিফ মানতে পারছেনা। হঠাৎ করে নিলয়ের ফোন বেজে উঠে। নিলয় কথা বলা শেষ করে আসিফকে বলল,

— আসিফ আমাদের এখন হাসপাতালে যেতে হবে। রিয়া ও যাবে প্রিয়াকে দেখার জন্য।

— আচ্ছা ঠিক আছে চল তাহলে।

সবার থেকে বিদায় নিয়ে আসিফ আর নিলয় বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা রিয়ার সাথে দেখা করতে যায়। তারপর তিন জন এক হয়ে চলে যায় হাসপাতালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা একটা হাসপাতালের সামনে গিয়ে নামে। তারপর সবাই মিলে হাসপাতালের ভিতরে চলে যায়। প্রিয়ার কেবিন নাম্বার জিজ্ঞেস করে সবাই প্রিয়ার কেবিনের দিকে চলে যায়। সবাই কেবিনের সামনে গিয়ে দেখে প্রিয়া তার মায়ের সাথে কথা বলছে। প্রিয়ার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। হয়তো এক্সিডেন্টের সময় মাথায় আঘাত পেয়েছে। প্রিয়া সবাইকে দেখে অনেক খুশি হয়। সব থেকে বেশি খুশি হয় সে আসিফকে দেখে। সে হয়তো ভাবতেও পারেনি আসিফ তাকে দেখতে আসবে। প্রিয়ার আম্মু বাহিরে চলে যায়। আর সবাই প্রিয়ার কাছে গিয়ে বসে। তখনই নিলয় বলল,

— তোমার এক্সিডেন্ট হলো কীভাবে?

এবার প্রিয়া বলতে শুরু করলো,

— আমি তোমাদের সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং করছিলাম। দেরি হবে ভেবে ড্রাইভার নিয়ে আসিনি আজ। আমি একাই বের হইছি গাড়ি নিয়ে। আমি দেখলাম রাস্তা পুরো খালি। আমি গাড়ি ড্রাইভিং করছি আচমকা আমি গাড়ির সামনে একটা মেয়েকে দেখে আর গাড়ি কন্ট্রোল করতে পারিনি। সাথে সাথে গাড়িটা রাস্তার পাশে থাকা একটা কাজের সাথে ধাক্কা খায়। আমি সিট ব্যালট পড়ে থাকার কারণে বেশি একটা আঘাত পাইনি। কিন্তু মাথায় বাড়ি খাওয়ার কারণে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরে আসতেই আমি নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি। অজ্ঞান হওয়ার পরের কোনো কিছু আমার মনে নেই।

নিলয় আর আসিফ এবার দু’জন দু’জনের দিকে তাকায়। দু’জনেই বুঝতে পারে প্রিয়ার এক্সিডেন্টের আসল রহস্য।

প্রিয়া আসিফকে বলল — আপনি এসেছেন আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমিতো ভাবতেই পারিনি আপনি আসবেন। ধন্যবাদ আপনাকে।

— ধন্যবাদ দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। আপনি এখন ঠিক আছেন তো?

— হ্যাঁ। অনেকটাই সুস্থ লাগছে এখন, শুধু মাঝেমাঝে মাথা একটু ব্যাথা করে।

— চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ পরে প্রিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে তিন জন বেরিয়ে পড়ে হাসপাতাল থেকে। রিয়াকে তার বাসায় দিয়ে নিলয় আর আসিফ নিজের বাসার দিকে চলে যেতে থাকে। তখন নিলয় বলল,

— আসিফ তুই কি কিছু বুঝতে পারছিস?

— কীসের কথা বলছিস?

— প্রিয়ার হঠাৎ এক্সিডেন্ট, আর সে এক্সিডেন্টের আগে একটা মেয়েকে তার গাড়ির সামনে আসে! ওটা নিঝুমের আত্মা নয়তো?

— যদি নিঝুমের আত্মা হয়ে থাকে তাহলে সে প্রিয়ার কেন ক্ষতি করতে চাইবে?

— তাও ঠিক। বাই দ্যা ওয়ে! প্রিয়া তোর সাথে কথা বলেছে কারণ কি তাহলে সেটা?

— তোর কি মাথা ঠিক আছে? এমন হলে সে তো তোর আর রিয়ার ও ক্ষতি করতে চাইত।

দু’জনের মাঝে আবার নিরবতা শুরু হলো। হঠাৎ একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসে আসিফের কানে। এই শব্দটা তার পরিচিত। এর আগেও এই শব্দ সে শুনেছে। এবার আসিফের চোখ আচমকা একটা যায়গায় আঁটকে যায়।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে