#জীবনের_ডাকবাক্স
[ সপ্তম পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ
আচমকা চিৎকারের শব্দ শুনে সবাই তাড়াতাড়ি করে চলে আসেন। সবাই এসে দেখেন আমি ফ্লোরের উপরে বসে আছি। আর এক সাইডে পড়ে আছে আমার ফোন। আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে আছি। যেনো আমি কিছুক্ষণের জন্য কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছি। নিঝুমের আম্মু মিসেস জাহানারা বেগম আমার কাছে এসে বলল,
— রহিম ভাই আপনার কি হইছে? এভাবে চিৎকার করছেন কেন? আর আপনি এমন করছেন কেন? কি হইছে আপনার?
আমি কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছিলাম না। কী ভাবে সবাইকে বলব জামাল সাহেব আর নেই আমাদের মাঝে। আমি বুঝতে পারছিনা আমার কি করা উচিৎ।
রিহান আমার কাছে এসে বলল — চাচা কি হইছে আপনার? আপনার বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?
— না বাবা।
— তাহলে কি হইছে?
— আপনারা সবাই আমার সাথে চলুন নিজের চোখে দেখবেন।
এই কথা বলে আমি রিহান,নিঝুম আর জাহানারা বেগমকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাকে একটা হাসপাতালে এড্রেস দিয়েছে তারা। সেখানেই নাকি জামাল সাহেবের লাশ রাখা হয়েছে। আর জামাল সাহেবের মৃত্যু একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে হয়। যদিও আমি তখনও কাওকে কিছুই বলিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা হাসপাতালের সামনে এসে পড়লাম।
— চাচা আমরা হাসপাতালে কেন এলাম?
— বাবা আগে ভিতরে আসো।
এবার সবাই মিলে ভিতরে গেলাম। আমি সবাইকে দাড়াতে বলে আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেলাম। ডাক্তারের সাথে কথা বলে শেষ করে আবার তাদের কাছে ফিরে আসি। কেউ এখন অব্দি আন্দাজ করতে পারেনি,তাদের জন্য কি অপেক্ষা করে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সামনে একটা মৃত লাশ নিয়ে আসে। লাশের মুখ সাদা কাপড় দিয়ে ডেকে রাখা। লাশটি আমাদের সামনে এনে রাখায় সবাই কিছুটা অবাক হয়। রিহান আমাকে বলল,
— চাচা এই লাশ আমাদের সামনে কেন নিয়ে আশা হলো? এটা কার লাশ?
আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। কান্নার জন্য আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা। রিহান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে লাশের মুখ থেকে কাপড় সরাতেই চমকে উঠে। সাথে সাথে রিহান পিছনে সরে আসে। আর জামাল সাহেবের মুখের কাপড় সরে যাওয়াতে এবার সবাই মুখ দেখতে পায়। জাহানারা বেগম নিজের স্বামীর লাশ দেখে সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়। আর নিঝুম বাবার লাশ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে। আমি গিয়ে নিঝুমকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করি। আর রিহান জাহানারা বেগমের জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা। এবার একটা এম্বুল্যান্স নিয়ে জামাল সাহেবের লাশ আর সবাইকে নিয়ে বাসায় চলে যাওয়া হয়। জাহানারা বেগম তখনও অজ্ঞান ছিলো। লাশ বাড়িতে নিয়ে আশার পরে অনেক মানুষের আগমন ঘটে। জাহানারা বেগম নিজের জ্ঞান ফিরে পায়। নিঝুম অঝোরে কান্না করছে। রিহান নিঝুমকে শান্তনা দেয়। দেখতে দেখতে কিছু সময় পার হয়ে যায়। জামাল সাহেবের লাশ দাফন করে আমরা বাড়িতে আসি। তারপর কেটে গেলো দুই দিন। সবাই খুব নিরব হয়ে গিয়েছে। কেউ কারোর সাথে ঠিক করে কথা বলেনা। কেউ টাইম মতো খাবার খায়না। রিহান তবুও জোর করে সবাইকে খাবার খাইয়ে দেয়। আসলে রিহান এই পরিবারের সবাইকে নিজের পরিবার মনে করে। জামাল সাহেব রিহানকে অনেক ভালোবাসেন। সব সময় নিজের সন্তানের মতোই দেখেছেন।
কিছুদিন পরে আমরা সবাই খাবার খেতে বসি। তখনই জাহানারা বেগম রিহানকে বলল,
— রিহান। এখন থেকে আমাদের সব ব্যবসার দ্বায়িত্ব তোমার। আগে সব কিছুর দেখা শোনা তোমার আংকেল করেছে। আমি চাই ওনার পরিবর্তে তুমি সব কিছুর দেখবাল করো।
— আন্টি আমি কি পারবো এতো বড় দ্বায়িত্ব নিতে?
— তুমি ঠিক পারবে। তোমার উপরে আমাদের সেই আস্থা আছে।
— আমি যতো টুকুন পারি চেষ্টা করব। আর আমার জন্য দোয়া করবেন। আর একটা কথা।
— কি কথা?
— আমাকে সাহায্য করার জন্য চাচাকে আমার সাথে থাকতে হবে।
জাহানারা বেগম একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
— তাহলে তো আরো ভালো। কাল থেকে তোমরা দুজনে ব্যবসার দ্বায়িত্ব নাও।
বুঝতেই পারছেন পরিবার টা ঠিক কেমন? এতো ভালো একটা পরিবারের সাথে কি কি হচ্ছে!
পরের দিন থেকে রিহান সব কিছুর দেখা শোনা করতে শুরু করে। রিহান বুদ্ধিমান একটা ছেলে। সে খুব সহজেই সব বুঝে নেই। আর খুব ভালোই ব্যবসায় মনোযোগী হয়। ব্যবসার জন্য রিহান পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেয়। যদিও জাহানারা বেগম এতে রাজি ছিলেননা। এদিকে নিঝুমের পরিক্ষা ও শেষ হয়ে যায়। রাতে সবাই এক সাথে খেতে বসেন।তখন হঠাৎ করে জাহানারা বেগম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— তোমাদের সবার সাথে আমার একটা কথা ছিলো। আসলে কথাটা ঠিক আমার নই। আমার হাসবেন্ড এর।
— কি কথা আন্টি?
— রিহান তোমার আংকেল আমাকে প্রাই সময় বলতো। তুমি আর নিঝুম যখন পড়াশোনা শেষ করবে তখন তোমাদের চার হাত এক করে দিবে।
এই কথা শুনে রিহান সহ উপস্থিত সবাই অবাক হয়। যদিও আগে থেকেই নিঝুম রিহানকে পছন্দ করতো কিন্তু কখনো সেটা মুখ খুলে বলেনি। কথাটা শুনে নিঝুম মুচকি একটা হাসি দেয়। তখন রিহান বলল,
— আন্টি এটা আপনি কি বলছেন? আমার মতো একটা এতিম ছেলেকে রাস্তা থেকে তুলে এনে সন্তানের যায়গায় বসিয়েছেন। আমার আর কিছু চাইনা। নিঝুমের সাথে আমার যায়না আন্টি। আমি একটা এতিম ছেলে।
জাহানারা বেগম রাগি কণ্ঠে বলল — আর যদি কখনও তোমার মুখে এই কথা শুনি তাহলে তোমার খবর আছে। তুমি কীসের এতিম? আমরা কি মরে গেছি নাকি? নাকি আমাদের তুমি আপন মনে করোনা?
— আন্টি এটা কি বলছেন? আপনারা যদি আমাকে আপনাদের বাসায় যায়গা না দিতেন তাহলে তো আজ আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। আমি ভালো করে মা-বাবার ভালোবাসা পাইনি। আদর পাইনি। আপনাদের থেকে পেয়েছি।
— তাহলে তুমি কি আমাদের এই আবদার রাখবেনা? তোমার আংকেলের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করবেনা? বাবা আমি জানিনা আমি আর কতো দিন বেঁচে থাকবো। আমি মৃত্যুর আগে তোমাদের চার হাত এক করে দিয়ে মরতে চাই।
— আন্টি প্লিজ এভাবে বলবেন না।
— আমি বিয়ের ডেট ঠিক করে রেখেছি আগামী শুক্রবার তোমাদের বিয়ে। আর বিয়ের সব আয়োজন করবে রহিম ভাই।
লজ্জা পেয়ে নিঝুম খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে যায়। তারপর যে যার রুমে চলে যায়। হঠাৎ করে নিঝুম রিহানের রুমে আসে।
— নিঝুম এতো রাতে তুমি আমার রুমে কেন আসলে? কেউ দেখলে কি বলবে?
— কে কি বলবে? আমি আমার হবু হাসবেন্ডের রুমে তো আসতেই পারি।
— না পারো না। কারণ আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি। সো নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
— রিহান ছাদের উপরে চলো প্লিজ। আজ আকাশে অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে।
— এতো রাতে ছাদে? যদি আমাদের ভূতে আক্রমণ করে তখন কি হবে?
— তুমি এতো ভীতু কেন হ্যাঁ? ছেলেদের এতো ভয় পেতে হয়না। তুমি যাবে নাকি আমি একাই যাবো?
বাধ্য হয়ে রিহান নিঝুমের সাথে ছাদের উপরে চলে যায়। দু’জনে গিয়ে ছাদের এক পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আজ আকাশের চাঁদ অনেক বেশি সুন্দর লাগছে দু’জনের কাছে। হয়তো আগে কখনও এমন ভাবে চাঁদ উপভোগ করেনি তারা। দু’জন নিরবতা পালন করছে। নিরবতা ভেঙে নিঝুম বলল,
— রিহান তুমি কি কখনো আমার মনের ভাষা বুঝতে পারোনি? আমি সেই ছোট বেলা থেকে তোমাকে পছন্দ করি সেটা কি তুমি কখনও অনুভব করতে পারো নি?
রিহান একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
— পেরেছি। তাও না বোঝার বান করে থেকেছি। আমি কখনও চাইনা আমার জন্য তোমার পরিবারের মানুষ গুলো কষ্ট ফাক। যে মানুষ গুলো একটা এতিম ছেলেকে নিজের সন্তানের মতো করে বড় করছে তাদের আমি আঘাত কীভাবে দেই?
— তাহলে তুমি আগে থেকেই সব জানতে?
— হ্যাঁ।
— যাও তোমার সাথে কথা নেই।
এই কথা বলে নিঝুম যখন চলে যেতে চাইল তখনই রিহান নিঝুমের হাত ধরে টেনে তার বুকের কাছে নিয়ে আসে।
— কোথায় যাবে তুমি?
— তুমি তো আমাকে ভালোবাসোনা। এখানে থেকে কি করব?
— ইশ! আমি আমার পাগলিটাকে ভালো না বাসলে কে বাসবে?
— সত্যিই?
— হ্যাঁ। ভালোবাসি তোমাকে। অনেক বেশি ভালোবাসি।
রিহানের কথা শুনে নিঝুম খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিহানকে। রিহান ও নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ করে কিছু একটা শব্দ শুনে দু’জন দু’জনকে ছেড়ে দেয়।
চলবে?