জীবনের ডাকবাক্স পর্ব-০৬

0
72

#জীবনের_ডাকবাক্স
[ ষষ্ঠ পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

বয়স্ক লোকটি আসিফের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে। লোকটা কেমন যেনো হয়ে গেলো। তার চোখ গুলো ছানাবড়া হয়ে গেছে। আসিফ আর নিলয় হতবাক হয়ে আছে। এই লোকের হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো?

তখনই লোকটা আসিফের দিকে তাকিয়ে বলল,

— রিহান তুমি বেঁচে আছো?

এই কথা শুনে নিলয় আর আসিফ দু’জন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। আসিফ তো বুঝতেই পারছেনা এই লোক তাকে রিহান কেন বলছে?

তখন নিলয় লোকটাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। নিলয় এবার তাকে বলল,

— ওর নাম রিহান নই। ওর নাম আসিফ। আপনি ভুল করছেন।

— না, এতো বড় ভুল আমার হয়না। এটা রিহান। রিহানকে আমি ছোট বেলা থেকে বড় করছি। রিহান বাবা তুই এতো দিন কোথায় ছিলি?

লোকটা বিছানা থেকে উঠে আসিফকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করে। কেউ কিছুই বুঝতে পারছেনা। নিলয় লোকটাকে বোঝাতেই পারছেনা যে এটা রিহান না এটা আসিফ। তখনই সেই ভদ্রলোক রুমের ভিতরে আসে। উনি রুমের ভিতরে এসে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তার বাবাকে খাটের উপরে বসিয়ে দেয়। তখন উনি তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল।

— বাবা ও যদি রিহান হতো তাহলে ও কি এখনও এই বয়সে থাকতো? রিহানের বয়স তো এতো দিনে চল্লিশ পার হতো। তোমার ভুল হচ্ছে কোথাও। হয়তো তুমি চোখে ভুল দেখছ।

— আমি ভুল দেখছিনা। দাঁড়া আমি এক্ষুনি প্রমাণ দিচ্ছি তোদের।

এই কথা বলে লোকটা একটা ব্যাগ বের করে। সেখান থেকে একটা ছবি বের করে তার ছেলের হাতে দেয়। লোকটা ছবির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। ছবিতে যে ছেলেটা হুবহু আসিফের মতো দেখতে। এই ছবির ছেলেটার থেকে কিছুতেই আসিফ কে আলাদা করা যাচ্ছেনা। দুইটা মানুষ একই চেহারার কীভাবে হতে পারে? এবার লোকটার হাত থেকে নিলয় ছবিটি নিয়ে দেখে এখানে চারজন মানুষ আছে। একটা বয়স্ক মহিলা সাথে একটা মেয়ে আর এই বয়স্কলোক আর আসিফ। এই ছবি দেখে নিলয় ও হতবাক হয়ে যায়। নিলয় এবার আসিফের দিকে ছবিটি এগিয়ে দেয়। ছবির দিকে তাকাতেই আসিফের পায়ের তোলার মাটি সরে যায়। ছবি মধ্যে যে দু’জন আছে এরা আর কেউ না, এরা হচ্ছে নিঝুম আর তার মা। আসিফ তো কিছুই বুঝতে পারছেনা।

আসিফ এবার বলল — এই দু’জনকে তো আমি ছিনি। আর এই মেয়ের নাম তো নিঝুম, ওনাদের বাসায় আমি টিউশনি করি।

আসিফের কথা শুনে ভদ্রলোকটা অবাক হয়ে বলল,

— কি বলছ তুমি এসব? ওনারা তো আজ থেকে ৩০ বছর আগে মারা গিয়েছে।

লোকটার কথা শুনে আসিফ যেনো আকাশ থেকে পড়লো। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই। আসিফ কিছুই বুঝতে পারছেনা। আসিফ এবার বুঝতে পারে সে কেনো একাই সব সময় নিঝুমকে দেখতে পেতো। এবার সবাই এক যায়গায় গিয়ে বসে। ভদ্রলোকটা এবার আসিফকে বলল।

— আসিফ ছবিতে যে ছেলেটা আছে ওটা তুমিই ছিলে। হয়তো ওটা তোমার আগের জন্ম ছিল। তুমি একটু চেষ্টা করো কোনো কিছু মনে করতে পারো কিনা।

— দেখুন আপনারা বলতে চাইছেন আমার পুনর্জন্ম হইছে? পুনর্জন্ম বলতে কিছু হয়না।

নিলয় আসিফকে বলল — আসিফ তুই একটু কিছু মনে করার চেষ্টা কর।

— তুইও কি পাগল হইলি?

— একটা জিনিস কেন বুঝতে পারছিস না! ছবিতে তোর ছবি, আর ওনারা মা-মেয়ে তোর সামনে আসে। এর মধ্যে তো কারণ অবশ্যই আছে। আর একটা জিনিস মনে আছে? তোর সেই এক্সিডেন্ট এর কথা? আমার তো মনে হয় নিঝুমের আত্মা তোকে সেদিন বাঁচিয়েছে।

নিলয়ের কথা শুনে আসিফ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। সে অতীতের স্মৃতি গুলো মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কিছুই সে মনে করতে পারছেনা।

এবার বয়স্ক লোকটি আসিফের কাছে এসে বলল,

— রিহান, বলতে গেলে তুমি আমার কাছেই বড় হয়েছো আগের জন্মে।

নিলয় বলল — আচ্ছা আপনি আমাদের সব ঘটনা খুলে বলুন। এই পরিবারের সাথে কি কি হয়েছে। আপনি যেটুকু জানেন সেই টুকুই বলুন।

অতীত
______________

আমি অনেক বছর থেকেই জামাল সাহেবের বাসায় কাজ করি। (জামাল সাহেব নিঝুমের বাবা) আমি একদিন বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে আমার চোখে পড়ে একটা সাত থেকে আট বছরের বাচ্চা কান্না করছে। আমি তাড়াতাড়ি করে ছেলেটার কাছে চলে গেলাম।

— কে তুমি বাবা? আর এখানে দাঁড়িয়ে এভাবে কান্না কেনো করছ তুমি?

ছেলেটা কান্না করেই যাচ্ছে।

— তোমার মা-বাবা কোথায়?

— আমার মা-বাবা কেউ নেই। দু’জনেই মারা গিয়েছে।

— ওহ। তোমার বাসা কোথায়? আর তুমি এখানে কার সাথে এসেছ?

— আমি এখানে একাই এসেছি। আসলে আমি বাড়ি থেকে চলে আসছি। আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমাকে কিছু খেতে দেন।

ছেলেটার মুখ দেখে আমার খুব মায়া হয়। আমি ছেলেটাকে নিয়ে একটা দোকানে গেলাম। তারপর তাকে কিছু খাবার কিনে দিয়ে খেতে দেয়। ছেলেটা খাবার হাতে পেয়েই খেতে শুরু করে। ছেলেটার এমন অবস্থা দেখে মনে হলো অনেক দিন ধরেই কিছু খায়নি। আমি ছেলেটাকে নিয়ে আমার বাসায় চলে গেলাম। আমার পরিবার থাকতো গ্রামে। আমি একাই শহরে ছিলাম। আর জামাল সাহেবের বাড়িতেই আমি একটা রুমে থাকতাম। ছেলেটাকে গোসল করিয়ে দিয়ে ভালো একটা জামা পড়িয়ে দেই। তারপর আমি তাকে নিয়ে বসলাম।

— তোমার নাম কি বাবা?

— আমার নাম রিহান।

— তুমি বাসা থেকে কেন চলে আসলে? তোমার বাসার লোকেরা তোমার জন্য চিন্তা করবেনা?

— যারা আছে তারা কখনও আমার জন্য চিন্তা করবেনা। বাবা মা মারা যাওয়ার পরে আমি আমার চাচার বাসায় থাকতে শুরু করি। ওনারা কেউ আমাকে পছন্দ করেনা। ঠিক ভাবে খাবার খেতে দেয়না। আমাকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেই। ইতি আপু আমাকে খুব মারে।

— ইতি কে?

— আমার চাচাতো বোন। আপুকে আপু বলে ডাকলেও আমাকে মারে। আপুর সব কাজ আমি করে দেই। তাও আপু আমাকে দেখতে পারেনা। সেদিন চাচা আমাকে খুব মেরেছে।

এই কথা বলে ছেলেটা তার পিট আমাকে দেখায়। ছেলেটার পিঠের উপরে মারের দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। কতটা খারাপ হলে একটা বাচ্চাকে এভাবে আঘাত করতে পারে মানুষ? ছেলেটার এমন অবস্থা দেখে আমি নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। কিছুক্ষণ পরে আমি রিহানকে নিয়ে জামাল সাহেবের বাসায় নিয়ে গেলাম। বাসার ভিতরে যেতেই দেখি সবাই খাওয়া দাওয়া শুরু করছে। আমাকে দেখে জামাল সাহেব বলল,

— আরে রহিম। আসো আসো খাবার খেতে বসো। এক সাথে খাই।

এই কথা বলে শেষ করার আগেই জামাল সাহেবের চোখ পড়ে রিহানের দিকে।

— আরে এই ছেলেটা কে?

জামাল সাহেবের কাছে আমি ছেলেটার ব্যাপারে সব কিছু খুলে বলি। জামাল সাহেব ও তার পরিবারের সবাই খুব ভালো ছিলেন। ছেলেটার কথা শুনে জামাল সাহেব নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে রিহানকে তার সাথে খাওয়ার জন্য বসায়। আমিও তাদের সাথে বসি। নিঝুম ও খুব ভালো আর শান্ত মেজাজের মেয়ে ছিলো। নিঝুমের বয়স তখন চার অথবা পাঁচ এমন হবে। রিহান আর নিঝুম এক সাথেই খেলাধুলা করতো। যতই দিন যায় ততই দুজন বড় হতে থাকে। জামাল সাহেব আর তার স্ত্রী রিয়ানকে নিজের ছেলের মতো করেই ভালো বাসতেন। খুব ভালো ভাবেই সময় যাচ্ছিলো। রিহান আর নিঝুম এখন কলেজে পড়ছে। জামাল সাহেব ছিলেন অনেক বড় ব্যবসায়ী। যার কারণে ওনার অনেক শত্রু হয়ে যায়। একদিন আমি বাসার কাজ করছিলাম। হঠাৎ একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। আমি ফোন রিসিভ করতেই এমন কথা শুনি যেটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারলাম না। আমার হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। আমি একটা চিৎকার দিয়ে ফ্লোরের উপর বসে পড়ি।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে