#জীবনের_ডাকবাক্স
[তৃতীয় পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ
আসিফের চোখ হঠাৎ করে একটা যায়গায় আঁটকে যায়। সে দেখতে পায় কেউ একজন দূরে দাঁড়িয়ে আছে। গণ চুলে ঢাকা তার মুখ। চুলের ফাঁকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা পরিচিত হাসি। আসিফ সেদিকে তাকিয়ে আছে। তখনই নিলয় বলল,
— কিরে কি হইছে? ঐ দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?
আসিফ নিশ্চুপ। আনমনে তাকিয়ে আছে হাসিটার দিকে। পরিস্থিতি বুঝার জন্য নিলয় আসিফকে একটা ধাক্কা দিতেই আসিফ নড়েচড়ে উঠে।
— কি দেখছিস ঐ দিকে? কখন থেকে প্রশ্ন করছি।
— আমি ওখানে কাকে যেনো দেখেছি। আমি মুখ দেখতে পাইনি কিন্তু হাসিটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। এই হাসি আমি আগেও দেখেছি।
— আমি তো কাওকে দেখলাম না। ভাই তোর কি হইছে একটু বলবি? তোর কোনো কিছুই আমার ভালো লাগছেনা।
— আমিও জানিনা, আমার সাথে কি হচ্ছে এসব? এতো বড় একটা এক্সিডেন্টের হাত থেকে কে আমাকে রক্ষা করছে? তাকে একটা ধন্যবাদ ও দিতে পারিনি। সব কিছুই অদ্ভুত লাগছে ভাই।
— আচ্ছা ভাই এসব বাদ দে, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আমার গার্লফ্রেন্ড রিয়া হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
— আচ্ছা চল।
তারা একটা রিকশা দেখে রিকশার মধ্যে উঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা রিয়ার বাসায় সামনে গিয়ে নামে। নিলয় আর আসিফ রিকশা থেকে নেমে দেখে রিয়া তাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। নিলয় গিয়ে রিয়ার সাথে আসিফের পরিচয় করিয়ে দেয়। তার সবাই এক সাথে বাসার ভিতরে যায়। সবাই এক সাথে বসে আড্ডা দিতে থাকে। কিন্তু সেই প্রথম থেকে আসিফ চুপচাপ হয়ে আছে। সে যেনো কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন। আসিফের এমন অবস্থা দেখে রিয়া বলল।
— ভাইয়া আপনি এমন চুপচাপ হয়ে বসে আছেন কেন? কোনো কথা বলছেন না। আমাদের সাথে আড্ডা দিতে আপনার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
— আরে তেমন কিছুই না। আপনারা আড্ডা দেন আমি শুনছি।
এখানে অনেকেই এক সাথে আড্ডা দিচ্ছে। রিয়ার অনেক গুলো বান্ধুবী আছে এখানে। আবার কয়েকটা ছেলে ফ্রেন্ড ও আছে। একটা মেয়ে আসিফের পাশে বসে।
— হাই, আমি প্রিয়া। রিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড।
— আমি আসিফ, নিলয়ের বন্ধু।
— সেটা তো জানি। আপনি কি এমন চুপচাপ স্বভাবের?
— দেখতেই তো পারছেন। আমি আসলেই এমন।
— প্রেম করেন?
— প্রেম! সেটা আমার জন্য না।
— কেন?
— অনেক বড় ইতিহাস। থাক সেসব কথা। আপনারা আড্ডা দেন। আমি একটু আসছি।
এই কথা বলে আসিফ উঠে চলে যায়। সে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বাহিরের মনরোর পরিবেশ দেখতে থাকে। কোনো এক অজানা কারণে আসিফের চোখ দিয়ে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে নিজের হাত দিয়ে পানি মুছে নেয়। হঠাৎ করে তার কোন এক অজানা অতীত মনে পড়ে। কারোর আশার শব্দ শুনে আসিফ নিজের চোখ ভালো করে মুছে নেয়। আসিফ বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে যায় প্রিয়া।
— কি ব্যাপার মন খারাপ নাকি আপনার? ওভাবে উঠে চলে আসলেন যে!
— মন খারাপ নই। এমনিতেই ভালো লাগছেনা। তাই এদিকে আসলাম। এখানকার পরিবেশ খুব সুন্দর। আর কতো সুন্দর ফুল ফুটে আছে।
— আপনি ফুল পছন্দ করেন?
— হ্যাঁ খুব।
— বাহ! আমারও ফুল খুব পছন্দের। আমি শুনেছি যারা ফুলকে ভালোবাসে তাদের মন নাকি ফুলের মতো সুন্দর।
মেয়েটার কথা শুনে আসিফ একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
— হতে পারে, তবে জানা নেই।
— ওহ, আচ্ছা বাসায় কে কে আছে?
— আমি আর আম্মু।
— বাবা নেই?
— নাহ, বাবা অনেক আগেই গত হয়েছেন।
— ওহ! সো সেড। সরি আপনার বাবার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।
— আরে কোনো ব্যবহার না। আমি কিছু মনে করিনি।
— ধন্যবাদ।
— আবার ধন্যবাদ কেন?
— কিছু মনে না করার জন্য। হিহিহি।
দু’জনেই হেসে উঠে। হঠাৎ করে তাদের পিছনে এসে দাঁড়ায় নিলয়।
— কিরে তোরা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? ওখানে আমরা সবাই আড্ডা দিচ্ছি।
— দুলাভাই আপনার বন্ধুর মন খারাপ তাই একটু ভালো করার চেষ্টা করছি।
— ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার তাহলে? ওকে ক্যারিওন।
এই কথা বলে নিলয় চলে গেলো। নিলয় বুঝতে পারে আসিফের মনের অবস্থা। তাই সে চলে গেলো৷ এদিকে আসিফ প্রিয়ার বলা কথা গুলো শুনে কিছুটা লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে থাকে।
— এই-যে মশাই আপনি আবার চুপচাপ হয়ে গেলেন কেন?
— কই না তো।
— জানেন আমার ইচ্ছে করছে একটা গান শুনতে।
— তো শুনেন।
— কে শোনাবে? আপনি একটা শুনান প্লিজ।
— আমি গান পারিনা, সরি মাপ করবেন।
— এই-যে মিস্টার আমাকে কি আপনার ভিক্ষুক মনে হয়?
কোমরে দুই হাত দিয়ে আসিফের দিকের তাকিয়ে কথাটা বলল প্রিয়া।
আসিফ একটা হাসি দিয়ে বলল — ভিক্ষুক কেনো মনে হবে?
— তাহলে মাপ করতে বললেন কেন?
— আমি গান পারিনা সেই জন্য বলছি।
— দূর আপনার সাথে আর কোথায় বলব না।
— আচ্ছা।
— আবার আচ্ছা কি? একদম চুল টেনে ছিড়ে ফেলবো।
— আমি আবার কি করলাম?
— আপনি কেন কিছু করবেন। আপনি তো একটা কুচি খোকা। আপনার ফোন নাম্বার টা দেন তো।
— আমার ফোন নাম্বার দিয়ে কি করবেন?
— প্রেম করব দিতে বলছি দেন।
কথাটা শুনে আসিফ চুপ হয়ে যায়। তখন প্রিয়া খিলখিল করে হেসে দেয়। এই মেয়ের কাহিনি বুঝতে পারেনা আসিফ। একটু পর পর রং পাল্টে যায়। একটু আগে রাগ দেখাল এখন আবার খিলখিল করে হাসছে।
— ভয় পাবেন না। প্রেম করব না, আপনার নাম্বার এমনিতেই দেন। মাঝেমধ্যে খোঁজ খবর নেবো আরকি।
আসিফ নাম্বার দিতে কিছুটা নার্ভাস ফিল করে। একটা সময় সে প্রিয়াকে নাম্বার দিয়ে দেয়। তারপর দুজনে দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে। তাদের কথার মাঝে রিয়া চলে আসে।
— আর কতক্ষণ খালি পেটে থাকবেন। খেতে আসেন সবাই অপেক্ষা করছে। প্রিয়া তুইও আয়।
এই কথা বলে রিয়া চলে গেলো। আসিফ আর প্রিয়া খাবার খাওয়ার জন্য চলে গেলো। সবাই এক সাথে খেতে বসে।কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই খাওয়া দাওয়া শুরু করে। আসিফ আনমনে খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রিয়া বার বার আসিফের দিকে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যায়। এবার যে যার বাসার দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। সবাই সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে। প্রিয়া আসিফের কাছে এসে বলল,
— সাবধানে যাবেন। আর হ্যাঁ বাসায় গিয়ে কিন্তু কল দেবো।
আসিফ কিছুই বলল না। এবার মেয়েটা চলে গেলো। আসিফ নিলয় রিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাত অনেক হয়ে যাওয়াতে রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই।
— আসিফ মনে হচ্ছে আমাদের হেঁটেই বাসায় যেতে হবে। এতো রাতে গাড়ি পাওয়া সম্ভব নই।
— হেঁটে গেলেই ভালো হবে। রাতের শহর উপভোগ করা যাবে। জনমানব শুন্য শহর।
— তা ঠিক বলছিস। আচ্ছা আসিফ প্রিয়া মেয়েটাকে কেমন লেগেছে?
— ভালোই তো, কিন্তু বকবক একটু বেশি করে।
নিলয় একটা হাসি দিয়ে বলল — মেয়েরা একটু বেশিই কথা বলে।
— তাহলে,,
— তাহলে কি?
— কিছুনা বাদ দে। তোর কথা বল।
আসিফ নিলয়ের থেকে কিছু একটা লুকিয়ে রাখে। নিলয় বুঝতে না পেরে বলল,
— আমার আর কি বলব,
— তোদের সম্পর্কের বয়স তো অনেক হয়েছে বিয়ে কেন করছিস না?
— বিয়ে করে খাওয়াবো কি? আমি তো এখনও পড়াশোনা করছি। পড়াশোনা শেষ হোক, ভালো একটা চাকরি নিয়ে তারপর বিয়ে করব।
— লক্ষ্য রাখিস মানুষটা যেনো হারিয়ে না যায়। প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রণা মানুষকে ভালো ভাবে ঘুমতে দেয়না।
— তুই এসব কীভাবে জানিস? তুই তো কখনও প্রেম ও করিসনি। তাহলে তোর মুখ থেকে এসব কথা কীভাবে আসে?
নিলয়ের প্রশ্ন শুনে আসিফ কি বলবে বুঝতে পারেনা। তখনই নিলয়ের ফোন বেজে উঠে। নিলয় ফোন বের করে দেখে রিয়া কল দিয়েছে। তাই সে দেরি না করে ফোন রিসিভ করে। ফোনের ওপাশ থেকে রিয়া নিলয়কে কিছু একটা বলে যেটা শুনে নিলয়ের হাসি মুখ কালো হয়ে যায়। আর সে স্তব্ধ হয়ে যায়।
চলবে?