জীবনের ডাকবাক্স পর্ব-০১

0
158

#জীবনের_ডাকবাক্স
[সূচনা পর্ব]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

ছাত্রীকে পড়াতে এসে নিজের ছবি ছাত্রীর বাসার দেওয়ালে ঝুলতে দেখে আমি অনেকটাই ঘাবড়ে গেলাম। এই বাড়িতে আজ আমার প্রথম দিন। মনে হয়না ওনারা এর আগে কখনও আমাকে দেখেছে। তাহলে আমার ছবি এই বাড়ির দেওয়ালে কীভাবে এসেছে? ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে খুব। অনেক্ক্ষণ হলো আমি এসে বসে আছি। কিন্তু আমার ছাত্রী অথবা বাসার কাওকে এখন পর্যন্ত দেখলাম না! আচ্ছা আমি কি ভুল ঠিকানায় চলে আসছি? মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো।

এই শহরে নতুন এসেছে আসিফ। শহরের তেমন কিছু ভালো ভাবে চীনেও না সে। একটা বন্ধুর মাধ্যমে একটা টিউশনের ব্যবস্থা করলো। যাতে করে নিজের পড়াশোনার খরচ অন্তত বহন করতে পারে। কিন্তু এখানে এসে তার সাথে ঘটে গেলো অবাক কান্ড। এই বাসায় প্রথম এসেছে সে। একজন ভদ্রমহিলার সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো। ঠিকানা তো এটাই ছিলো। তাহলে সবাই কোথায় হারিয়ে গেলো?

আসিফ সোফায় বসে আছে প্রায় অনেক্ক্ষণ হয়েছে। এই বাড়িটাও খুব অদ্ভুত লাগছে। সব থেকে বেশি ভাবাচ্ছে তার ছবি এই বাড়িতে কীভাবে এসেছে? এটা আদোও তার ছবি নাকি তার মতো হুবহু দেখতে অন্য কেউ? এসব প্রশ্ন যখন ঘুরপাক খাচ্ছে আসিফের মনে তখনই একজন মহিলার আগমন ঘটে আসিফের সামনে। আসিফ মহিলাকে লক্ষ্য করতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। মহিলা সালাম গ্রহণ করে আসিফকে বসতে বলে।

— তুমি কখন আসলে বাবা?

— জি আন্টি অনেক্ক্ষণ হলো। বাসায় কাওকে দেখলাম না। আমি তো ভেবেছি আপনারা কেউ নেই।

— আসলে আমি একটা কাজ করছিলাম। আচ্ছা তুমি বসো আমি গিয়ে নিঝুমকে নিয়ে আসছি।

এই কথা বলে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। অদ্ভুত লাগছে আসিফের কাছে। এই মহিলা আসিফকে দেখে তো তেমন কোনো রিয়াক্ট করেনি। অথচ এই বাড়িতে আসিফের ছবি! এখানে হচ্ছেটা কি? এর মধ্যে কি কোনো অজানা রহস্য লুকিয়ে আছ?

কিছুক্ষণ পরে ভদ্রমহিলা সাথে করে একটা মেয়েকে নিয়ে আসেন। মেয়েটাকে দেখে আসিফ দাঁড়িয়ে যায়। এতো সুন্দর মেয়ে! আসিফ যেনো কিছুতেই নিজের চোখ সরাতে পারছেনা।

— বাবা ও আমার এক মাত্র মেয়ে নিঝুম। এবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে। তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো।

আসিফ বসে পড়ে। ভদ্রমহিলা আর নিঝুম ও বসে।

— আরে তোমার সাথে সেই কখন থেকে কথা বলছি অথচ তোমার নাম জানা হলোনা। নাম কি তোমার?

— জি আন্টি আমার নাম আসিফ।

আসিফ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটার মুখে একটা মুচকি হাসি লেগে আছে। এই হাসির জন্য মেয়েটাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে।

— তা বাবা আজকে কি পড়াবে নাকি?

— না আন্টি আমি তো দেখতে এসেছি, আর ঠিকানা ঠিক আছে কিনা। আচ্ছা আন্টি আজ তাহলে উঠি আমি। কাল আসবো।

— চা খেয়ে যাও!

— আজ না। আজ আর আপনাদের কষ্ট দেবোনা। আজ তাহলে উঠি! কাল দেখা হবে।

— ঠিক আছে সাবধানে যাও।

আসিফ এবার সামনে দিকে যখন পা বাড়াবে তখনই তাঁর মনে পড়ে সেই ছবিটার কথা। এতক্ষণ সে ছবিটির কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলেই গিয়েছে। যখন যে ছবির কথা জিজ্ঞেস করার জন্য পিছনে তাকায় তখন যে দেখতে পায় সেখানে কেউ নেই। ভাবুক হয়ে উঠে আসিফ। সামান্য সময়ের মধ্যে এরা নিজেদের রুমে চলে গেলো? মনে মনে ঠিক করে আগামীকাল এসে জিজ্ঞেস করবে। তাই সে ছবিটার দিকে এক পলক তাকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে নিজের বাসার দিকে রওয়ানা হয়। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে হঠাৎ করে একটা কান্নার শব্দ ভেসে আসে তার কানে। সে চারদিকে একবার চোখ ভুলিয়ে নেয়। কিন্তু সে আশেপাশে তেমন কোনো কিছুই খেয়াল করেনা। তাই আবার সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ আসিফের ফোন বেজে উঠার শব্দ শুনে পকেটে হাত দিয়ে ফোন বের করে। আর ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে আসিফের বন্ধু নিলয় ফোন দিয়েছে।

— হ্যাঁ নিলয় বল।

— কিরে তোর ফোন এতক্ষণ বন্ধ ছিলো কেনো?

— কই ফোন তো অফ ছিলনা। মনে হয় নেটওয়ার্ক প্রব্লেম ছিলো।

— ওহ আচ্ছা ঠিক আছে। তো ওখানে গিয়েছিস?

— হ্যাঁ, এখন বাসায় ফিরছি। তুই তাড়াতাড়ি করে বাসায় আয় তোকে কিছু কথা বলার ছিলো জরুরী।

— আমি বাসায় আছি, তুই চলে আয়।

তারপর আসিফ ফোন কেটে বাসার দিকে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসিফ বাসায় পৌছে যায়। আসিফ নিজের রুমে গিয়ে দেখে নিলয় বসে আছে। আসিফ গিয়ে নিলয়ের পাশে বসলো। এতক্ষণ হেঁটে আসার কারণে সে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আসিফের ক্লান্ত মুখ দেখে নিলয় আসিফের দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে খেতে বলে। আসিফ কোনো কথা না বলে এক গ্লাস পানি একবারে খেয়ে শেষ করে।

— কিরে আসিফ কি হইছে তোর? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

— আসলে রোদের মধ্যে হেঁটে আসার কারণে অস্থির লাগছে। আচ্ছা শোন তোকে একটা কথা বলতে চাই।

— হ্যাঁ বল।

এবার আসিফ ওখানে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো বলল। আসিফের কথা শুনে নিলয় কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে বলল,

— শুনেছি পৃথিবীতে নাকি একি রকম চেহারার ৭ জন করে মানুষ থাকে। হয়তো সেটাই।

— কিন্তু তার মধ্যে একটা জিনিস আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। ওনারা আমাকে দেখে যেভাবে রিয়াক্ট করার কথা তেমন কিছুই আমি তাদের মধ্যে দেখেনি। আমি যেভাবে অবাক হয়েছি সেভাবে তো তাদের ও অবাক হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু তাদের মাঝে আমি তেমন কোনো কিছুই লক্ষ্য করলাম না। তাঁরা আমার সাথে খুব শান্ত ভাবেই কথা বলছিল। আর একটা জিনিস খেয়াল করলাম।

আসিফের বন্ধু খুব আগ্রহ নিয়ে কথা গুলো শুনছে। আসিফের কথা শুনে সে আগ্রহ নিয়ে বলল,

— কি জিনিস?

— আমি মেয়েটার মুখে একটা অদ্ভুত হাসি দেখলাম। কিন্তু মেয়েটা অদ্ভুত সুন্দরী। আমি প্রথম দেখাতেই কেমন যেনো হয়ে গেছিলাম।

— আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। তুই কাল ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করিস তাদের এই ছবির কথা। তাহলেই হয়তো উত্তর খুঁজে পাবি।

–ঠিক আছে।

তারপর নিলয় উঠে চলে গেলো। আসিফ খাটের উপরে বসা থেকে শুয়ে পড়ে। তখনই বাড়ি থেকে কল আসে তার।

— হ্যালো, মা কেমন আছো তুমি?

— এই তো ভালো আছি বাবা, তুই কেমন আছিস?

— আমিও ভালো আছি।

মা ছেলের মাঝে কিছুক্ষণ কথা হয়। কথা শেষ করে কল কেটে দেয় আসিফ। দেখতে দেখতে রাত হয়ে যায়। আসিফ রাতের খাবার খেয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে আসিফ। হঠাৎ মাঝ রাতে বুকের উপরে ভারী কিছু অনুভব করতেই ঘুম ভেঙে যায় আসিফের। আসিফ চোখ খুলে দেখে পুরো বাসা ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে চোখের সামনে কিছুই দেখতে পায়না। তখন সে উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কারণে সে উঠতে পারছেনা। আসিফ খুব ভয় পেয়ে যায়। হঠাৎ একটা চিৎকার দিয়ে বসে পড়ে।

— কিরে কি হইছে তোর?

আসিফ পাসে তাকিয়ে দেখে তার বন্ধু নিলয়। আসিফ বুঝতে পারে সে কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। তার সাথে হঠাৎ করে এসব কেন ঘটছে কোনো উত্তর জানা নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসিফ ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আসিফ ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে। ভার্সিটি বেশি একটা দূরে না তাই সে হেঁটেই চলে যায়। ভার্সিটির গেট দিয়ে ভিতরে যাবে এমন সময় তার চোখ আঁটকে যায় একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটা আর কেউ না, এটা নিঝুম। নিঝুমকে এখনে দেখে অবাক হয় আসিফ। আসিফ দেখে যে নিঝুম একা দাঁড়িয়ে আছে। তাই আসিফ নিঝুমের কাছে চলে যায়।

— আরে নিঝুম আপনি এখানে?

— আমার ও সেইম প্রশ্ন স্যার! আপনি এখনে?

— আমি তো এই ভার্সিটিতে নতুন ভর্তি হয়েছি। কিন্তু তুমি কলেজে না গিয়ে এখনে কি করছ?

— এখনে একটা কাজে এসেছি। আর স্যার আপনি আমাকে তুমি করে বলুন।

— আচ্ছা ঠিক আছে সমস্যা নেই।

হঠাৎ করে আসিফের কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পড়তেই আসিফ পিছনে ফিরে তাকায়। আসিফ দেখতে পায় তার বন্ধু নিলয়। নিলয় আসিফকে বলল,

— কিরে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?

— তোকে কাল বলছিলাম না আমার ছাত্রীর কথা? ওর সাথে কথা বলছি।

— কিহ? তুই কি পাগল হয়ে গেলি?

— পাগল হবো কেন? আয় পরিচয় করিয়ে দেই ওর না,,,

হঠাৎ করে এই মেয়েটা কোথায় চলে গেলো? এতক্ষণ তো এখানেই ছিলো? অদ্ভুত!

— কিরে কি হইছে?

— কিছুই বুঝতে পারছিনা, নিঝুম তো এতক্ষণ এখানেই ছিলো। হঠাৎ করে এই মেয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেলো?

— বুঝতে পেরেছি বন্ধু, তুমি তোমার ছাত্রীর প্রেমে পড়েছ। তাই তাকে যেখানে সেখানে দেখতে পাচ্ছো। এখন চল নাহলে ক্লাসে ঢুকতে দিবে না।

এই কথা বলে নিলয় আসিফকে নিয়ে যেতে থাকে। আসিফ তো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। এতো বড় ভুল সে কীভাবে দেখে? নিঝুম তার সাথে কথা বলেছে। এটা কি আসলেই তার মনের ভুল! নাকি অন্য কিছু?

কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাসে চলে যায় দু’জন। আজকের মতো ক্লাস শেষ করে আসিফ সেই বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বাসায় পৌছে যায়। বাসার ভিতরে গিয়েই আসিফ স্তব্ধ হয়ে যায়।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে