#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাক বাক্স
পর্ব- বারো
মাহবুবা বিথী
রোশান নিজের বিরক্তি ও রাগ লুকিয়ে রেখে সাথীর প্রস্তাবে রাজী হয়। আসলে আজ অবধি রোশানকে কোনো মেয়ে এভাবে নাকানি চুবানি খাওয়াইনি। সে কারনে সাথীকে নিজের করে পাওয়ার তরে একটা জেদ চেপে বসে। তাই রোশান ওর পরিবারে নিজের বিয়ে করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এতে ওর বাবা আফজাল চৌধুরী হাফ ছেড়ে বাঁচেন। ভাবলেন,ছেলে বুঝি তার উচ্ছৃঙ্খল জীবন থেকে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। রোশানের মা নীলা চৌধুরীও ছোটোবেলা থেকে ছেলের উপর খুব একটা নজর রাখেননি। গর্ভনেস রেখে দিয়ে মা হিসাবে নিজের দায়িত্ব সেরেছেন। পার্টি নয়তো বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেশ বিদেশ ঘুরে নিজের জীবনটাকে পরিপূর্ণ উপভোগ করছেন। তেমনি রোশানো নিজের মতো করে সুখ খোঁজার চেষ্টা করেছে। এই সুখ খুঁজতে গিয়ে ও নিষিদ্ধ পল্লীতে যাওয়া থেকে শুরু করে কখনও বা সরাব পান করে জীবনের থ্রিল খোঁজার চেষ্টা করেছে।
যাইহোক রোশান বিয়ে করতে রাজী হওয়াতে সাথী ভীষণ খুশী। সাথীর আজ খুব আনন্দের দিন। রোশানের মা আসতে পারেননি। উনি এই মুহুর্তে সিঙ্গাপুরে আছেন। রোশানের বাবা রোশানকে সাথে নিয়ে লা মেরিডিয়ানে এসেছেন। এই খরচ উনিই বহন করবেন। সাথীর পরিবারের উপর উনি কোনোরকম চাপ দিতে নারাজ। এটা উনার সম্মান না করুনা সাথীর বাবা সোলেমান সাহেব সেটাই বোঝার চেষ্টা করছেন। রোশানের বাবা আফজাল চৌধুরী সাথে করে উনার কয়েকজন শুভাকাঙ্খি এনেছেন। ছেলের যেহেতু চারিত্রিক সমস্যা আছে সেক্ষেত্রে উনি খুব বেশী লোকজন নিয়ে আসেননি। আসলে ছেলের বিয়ে কতোদিন টিকবে এটা নিয়ে উনি নিজেই সন্দিহান। তাই খুব বেশী লোক জানাজানি করতে চাননি। এদিকে সাথী ওর বাবা মা আর দু’জন বন্ধুবান্ধব নিয়ে লা মেরিডিয়ানে চলে এসেছে। সাথীর দাদী আসেননি। কারণ উনিও বলে দিয়েছেন ফাহিম জেল থেকে ছাড়া না পাওয়া অবধি সাথী আর ওর মায়ের সাথে উনি কোনো সম্পর্ক রাখবেন না।একই বাড়িতে থেকে উনি আলাদা রান্না করে খান। সোলেমান সাহেব একটা রান্নার লোক রেখে দিয়েছেন।
সোলেমান সাহেব তার বন্ধু এবং বেয়াই আকরাম সাহেবকে দিতিকে সাথে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু দিতি সাফ ওর বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে ফাহিম যতদিন জেলখানায় বন্দী থাকবে দিতি সাথীর কোনো কিছুতে থাকবে না। এমনকি বাবার বাড়ির সাথেও তেমন সম্পর্ক রাখার পক্ষে দিতি রাজী নয়। এতে অবশ্য আকরাম সাহেব বাঁধা দিয়ে বলেছিলেন,
“সন্তান হিসাবে বাবার খোঁজ খবর করা তোমার জন্য ফরজ দায়িত্ব।”
দিতি অবশ্য কিছু বলেনি। তবে ওর ফুফু শাশুড়ী মোমেনা খাতুন দিতির উপরে খুব খুশী। সে তার ভাইকে বলেছে, “দিতি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
আকরাম সাহেবের বোনটার কোনো সন্তান হয়নি। সে কারনে নিজের স্বামীকে আবার বিয়ে দিয়েছেন। সেই ঘরে আবার সন্তান হয়েছে। উনি আকরাম সাহেবের কাছেই বেশী থাকেন। তবে ফসল উঠার সময় মাসদুয়েক যশোর সদরে চাউনিয়া গ্রামে স্বামীর সংসারে গিয়ে থাকেন। এটা তার স্বামীর আদেশ। যদিও ছোটো বউ এবং ছেলে মেয়েরা মোমেনা খাতুনকে অনেক সম্মান করে। তারপরও উনি বছরের বেশীরভাগ সময়ে ভাইয়ের কাছে থাকেন। আকরাম সাহেবও বড় বোনকে মায়ের মতো সম্মান করেন।
যারফলে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ নিয়ে সাথীর বিয়ের আনুষ্টানিকতা কোনোরকমে সম্পন্ন হলো। সোলেমান সাহেবের কাছে রোশান এবং ওর বাবাকে খুব একটা পছন্দ হয়নি। টাকার অহঙ্কার যেন ওদের শরীর থেকে চুঁইয়ে পড়ছে। তবে সাথী কিংবা ওর মায়ের এসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। ওদের কথা বড়লোকদের ওরকম এক আধটু অহঙ্কার থাকে। ওটাই ওদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করে রাখে। সুতরাং এতে কোনো সমস্যা নেই। সাথী রোশানের ব্যাপারে সবই জানতো। কিন্তু ওর বিশ্বাস বিয়ের পর ও রোশানকে বদলে ফেলতে পারবে। বিশলক্ষ টাকা দেনমোহরে ওদের আকদ সম্পন্ন হয়। সাথীর পুরো শরীর যেন সোনা দিয়ে মোড়ানো। সালেহা বেগম মেয়ের কপালে এতো সুখ দেখে আনন্দে আত্মহারা। কিন্তু সোলেমান সাহেবের কাছে ভালো লাগেনি। উনি বরং রোশানকে নিয়ে একটু শঙ্কিত আছেন। আকদ এর পর যদিও সোলেমান সাহেব সাথীকে পাঠাতে চাননি। অনুষ্টান করে সাথীকে তুলে দিবেন। কিন্তু উনার এ চাওয়া ধোপে টেকেনি। রোশানের বাবার কথা হচ্ছে বিয়ে যখন হয়ে গিয়েছে তখন নতুন বরবউকে আলাদা রাখা ঠিক নয়। তাছাড়া সাথী রোশানের সাথেই এখন থাকতে চাইছে। এতে অবশ্য সাথীর মা সালেহা বেগমেরও সমর্থন আছে। অবশেষে সাথী শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা হয়।
রোশান আর সাথীকে নিয়ে আফজাল চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ঐ রাতে উনিও সিঙ্গাপুরে রওয়ানা দেন। একটা বড় ব্যবসায়িক ডিল হওয়ার কথা আছে। বাসরঘরে সাথী বসে আছে। রোশানের কোনো পাত্তা নেই। রাত বারোটা পার হয়ে ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁয়েছে। ঢংঢং করে দেওয়াল ঘড়িটা সেটাই জানান দিচ্ছিলো। সাথীর চোখদুটো একটু লেগে এসেছে। হঠাৎ কে যেন ওকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিলো। ও কাঁচাঘুমে ধরমড়িয়ে উঠে তাকিয়ে দেখে রোশান অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর রোশান ওর চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে বললো,
—-আজ তোর বিয়ে করার সাধ আমি চিরজনমের মতো মিটিয়ে দিবো।
সাথী অসহনীয় যন্ত্রনায় কঁকিয়ে উঠলো। তবে সাথী বুঝতে পারছে, রোশান এখন পরিপূর্ণ ড্রাঙ্ক অবস্থায় আছে। ওকে কিছু বলে লাভ নেই। এরপর ওর সাথে যা ঘটলো ও তা কখনও কল্পনা করেনি। রোশান নরখাদকের মতো ওর পুরো শরীরটাকে খুবলে খেলো। একসময় ক্লান্ত হয়ে রোশান ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল। আর সাথী রক্তাক্ত বিদ্ধস্ত অবস্থায় পুরো রাতটা পার করলো। চোখের জলে ওর বালিশ ভিজলো। অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করলো। বিয়ে, বাসর এসব নিয়ে ওর অনেক স্বপ্ন ছিলো। সব যেন আজ তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়লো। খুব ভোরে বিছানা থেকে উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওয়াশরুমে গেল। গিজার অন করে গরম পানি দিয়ে গোসল করে এসে ডিভানের উপর গা,টা এলিয়ে দিলো। রোশান আধোঘুম আধো জাগরনে পাশে হাত দিয়ে সাথীকে খুঁজলো। কিন্তু বিছানা খালি পেয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে পাশে সাথী নেই। তারপর আয়নাতে চোখ পড়তেই দেখে সাথী ডিভানে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। রক্তাক্ত বিছানা দেখে সাথীর কাছে গিয়ে সরি হয়। সাথীও ভাবে, হয়তো ড্রাঙ্ক অবস্থায় ভুল করে ফেলেছে। তাই ও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রোশান প্রতি রাতেই ওর সাথে পশুর মতো আচরণ করে। সাথীও আস্তে আস্তে কেমন যেন হয়ে যায়। রাত আসলেই ওর মাঝে প্যানিক এ্যাটাক শুরু হয়। এরমাঝে সাথী একদিন রোশানের এমন আচরনের জন্য প্রতিবাদ করেছিলো। এতে রোশান তেঁতে উঠে বলে,
—+তোর জন্য এটাই প্রযোজ্য। এটা মেনে নিয়েই থাকতে হবে।
সাথীও রেগে গিয়ে বললো,
—-আমি তোমার নামে নারী নির্যাতন আইনে মামলা দিবো।
সাথীর কথা শুনে রোশান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এরপর সাথীর চুলের মুঠি ধরে বলে,
—-+আমাকে ফাহিম পাসনি। ফাহিমকে নিয়ে তুই যে ষড়যন্ত্র করেছিলি তা আমি মোবাইলে টেপ করে রেখেছি। আমার বিরুদ্ধে মুখ খুলবিতো ওসির কাছে সব চালান করে দিবো। তোকে তখন লেহার গরাদে রাখা হবে। এখন তো শুধু আমি ভোগ করি। তখন থানার ওসি থেকে শুরু করে কনস্টেবল সবাই তোকে চেটেপুটে খাবে। আর ফাহিমকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে দিবে।
ভয়ে সাথী আর মুখ খুলেনি।এভাবে মাস দুয়েক যাবার পর ও শ্বশুর বাড়ি বনানী থেকে মিরপুরে বাবার বাড়িতে চলে যায়। ভর সন্ধায় কে যেন কড়া নাড়ছে। সালেহা খাতুন একটু বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে সাথীকে এরকম বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠেন। হাত ধরে মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলেন,
—-এ কি হাল হয়েছে তোর? রোশান আসেনি?
—-না,আসেনি।
—–তোর এভাবে একা আশা ঠিক হয়নি।
চলবে