#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী
ফাহিম আর দিতি হানিমুন প্যাকেজে হোটেল কক্স টুডে তে হানিমুন স্যুটে উঠেছে। ব্যাগটা রেখেই ওরা দুজন বুফেতে ব্রেকফাস্ট করে নিলো। এরপর বীচের দিকে বেরিয়ে পড়লো। সৈকতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেই দিতি ফেসবুকে পোস্ট করে দিয়ে মনে মনে ভাবলো,”সাথী এই ছবি টা দেখে অনেক খুশী হবে। ও হয়তো ভাবছে, ওর কারনে ওদের হানিমুন মাটি হয়ে গেল। বেচারা হয়তো মনে মনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এই ছবিটা দেখার সাথে সাথে ওর সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।”
দিতির আজকে ডাবল আনন্দ। কাল যখন শুনেছিলো সাথীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না সেই মুহুর্তে ওর পৃথিবীটা ভুমিকম্পের মতো দুলে উঠেছিলো। তখন মনে হয়েছিলো সাথীকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পাওয়াটা ওর সবচেয়ে কাঙ্খিত চাওয়া। অবশেষে সাথীর খোঁজ পেলো। পরম আনন্দে বাড়ি ফিরে মনে হয়েছিলো হানিমুন আজ হয়নি তো কি হয়েছে কাল হবে। বোনটাকে তো অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া গিয়েছে। তবে ফাহিমের জন্য ওর খারাপ লাগছিলো। পরীক্ষার কারনে এই মুহুর্তে ফাহিমের সাথে মুন্সিগঞ্জে যেতে পারবে না। বেচারা বড় শখ করে হানিমুনের ব্যবস্থা করেছিলো। না যেতে পারলে টাকার লোকসান তো হতোই মনের বোঝাপড়াটা অসম্পূর্ণ থেকে যেতো।
কিন্তু বাড়ি ফিরে যখন জানলো আগামীকাল প্লেনে ও কক্সবাজার যেতে পারছে ওর যে কি আনন্দ হয়েছিলো তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আজকের এমন একটা মধুরতম দিন ওর জীবনে আসবে ও কাল ভাবতেও পারেনি। আল্লাহপাকের অসীম রহমতে সব কিছু ভালোভাবে মিটে গেল। সাথীও বাড়ী ফিরে আসলো। এদিকে ওর ফুফু শাশুড়ী ওর শ্বশুরকে দিয়ে সকাল সাতটার প্লেনের টিকিট কেটে রেখেছিলো। ওর রিজিকে আল্লাহপাক লিখে রেখেছিলেন বলেই কোনো বাঁধাই আর বাঁধা হলো না। দিতি আজ ভীষণ খুশী। প্রিয় মানুষের সাথে সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে সুর্যোদয় আর সুর্যাস্ত দেখার আনন্দটাই একদম অন্যরকম।
সারি সারি ঝাউবনের মোহমায়া সাগরের উত্তাল জলরাশি আর বালুর নরম বিছানায় দিতি ফাহিমের প্রণয়ের আবেগে ভাসতে লাগলো। জীবন যে এতো সুন্দর হতে পারে দিতির ধারণা ছিলো না। মাকে হারিয়ে বড় হওয়া দিতির জীবনে ভালোবাসা ছিলো সোনার হরিণ। আজ আঁজলা ভরে ও স্বামীর ভালোবাসা গ্রহণ করছে। সমুদ্রের বালুকার গালিচায় দিতি ওর আর ফাহিমের নাম খুব গভীর করে লিখে ফাহিমকে বললো,
—-দেখো ঐ ঢেউ এসে আমাদের এই নাম কখনও মুছে ফেলতে পারবে না।
ফাহিম দিতির ছেলেমানুষীগুলো খুব উপভোগ করছে। তার পর দিতির কাছে খুব ঘণিষ্টভাবে বসে বললো,
—শুধু এই বালুর বিছানা কেন আমি তো তোমার নাম হৃদয়ে খোদাই করে লিখে রেখেছি। যেখান থেকে তোমার নাম কখনও মুছবে না। আল্লাহপাকের কালাম স্বাক্ষী রেখে তোমাকে আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য আমি গ্রহন করেছি। আমৃত্যু এই দায়িত্ব যেন আমি পালন করে যেতে পারি। আল্লাহপাক যেন আমাকে এই তওফিক দান করেন।
আনন্দ অশ্রুতে দিতির চোখের পাতাটা ভিজে গেল। আর মনে মনে গাফুরুর রাহীমের কাছে শোকরিয়া আদায় করলো।
অনেকক্ষণ সাগরের পানিতে দাপাদাপি করে রুমে ফিরে আসলো। গোসল করে যোহরের কসর নামাজ আদায় করে দিতি একটা নীল রঙের শিফন জর্জেটের শাড়ি পড়লো। হ্যাড ড্রায়ার দিয়ে চুলটা শুকিয়ে নিয়ে একটা পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকে শাড়ির সাথে ম্যাচ করে হেজাব পড়ে নিলো। মুখে হালকা প্রসাধনী ব্যবহার করলো। ফাহিম ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দিতিকে দেখে বললো,
—-তোমার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছি না। তোমাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
—-তাহলে হয়েছে,লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গেলে পেটে যখন ইঁদুর লাফানো শুরু করবে তখন আদর করার মজা বুঝবে। তাড়াতাড়ি কসর নামাজ পড়ে রেডী হয়ে নাও।
ফাহিমের একটু দুষ্টুমী করার ইচ্ছে ছিলো তাই হাত বাড়িয়ে দিতিকে ধরার চেষ্টা করলো। দিতি খিলখিল করে হেসে সরে গিয়ে বললো,
—-জনাব,সব রাতের জন্য তোলা থাক। এখন তাড়াতাড়ি চলো। আমার খুব ক্ষিদে লেগেছে। সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় মনে হয় খিদেটা বেড়ে যায়।
ওর খিদে লাগার কথা শুনে ফাহিম দুষ্টমীর চিন্তা আপাতত মাথা থেকে বাদ দিলো। দ্রুত রেডী হয়ে লাঞ্চ করে বীচে চলে আসলো। ফাহিমের এইআচরণটুকু দিতির খুব ভালো লাগলো। দিতির ইচ্ছেটাকে ও গুরুত্ব দিলো। সময় তো পেরিয়ে যাচ্ছে না। সারাটা রাত তো পড়ে আছে। আসলে দুজন দুজনকে কেয়ার করা, চাওয়া পাওয়ার গুরুত্ব দেওয়া,সর্বোপরি দুজনের দুজনকে বোঝার চেষ্টা করা। তাহলেই না জীবন অনেক সুন্দর হবে। দুজনে হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। সাগরের নীল জলের ঢেউয়ের সাথে দিতির নীল শাড়ি সব যেন মিলেমিশে একাকার। ফাহিমও দিতির সাথে ম্যাচ করে নীল রঙের পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা পড়ে নিয়েছে। দূর থেকে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন ভেসে আসছে। ফাহিম একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে মেরিন ড্রাইভের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো। রাস্তার একপাশে ফেনিল সাগরের ঢেউ আর অপর পাশে পাহাড় যেন ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ইনানী বীচে নেমে ফাহিম প্যারাসেলিং করতে চাইলো। দিতির ভয় লাগছে তাও বাঁধা দিলো না। ফাহিম প্যারাসেলিং শেষ করে ও আর দিতি মিলে কিছু ফটোশূট করলো। এমন সময় শ্রাবনের টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। এই সময়টাতে পর্যটকদের ভীড় কম থাকে। সেকারনে সৈকত অনেকটাই নিরিবিলি থাকে। হোটেল স্যুট গুলোতে ৫০% ডিসকাউন্ট থাকে। ফাহিমের জন্য সে কারনে এই খরচ বহন করা সহজ হয়েছে। নতুন চাকরিতে এতোটা ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য। ডিসকাউন্টের সুবিধা থাকায় ওর জন্য সহজ হয়েছে। ওরা দুজন আবার গাড়িতে উঠে বসলো। সন্ধা ঘণিয়ে আসছে। হোটেলের পথে রওয়ানা দিলো। সৈকত নিরিবিলি থাকলে যেমন ভালো লাগে তেমনি নিরাপত্তার বিষয়টা মাথায় রাখতে হয়। যদিও বীচের প্রহরায় পুলিশ থাকে তারপরও একটা দুটো অঘটন হঠাৎ ঘটে যায়। সেকারনে ফাহিম দিতিকে নিয়ে সন্ধার আলো আঁধারি নামার আগেই হোটেলে পৌঁছে গেল। ড্রেস চেইঞ্জ করে ওরা দুজন ক্যাফেতে চলে গেল। কফি আর স্ন্যাকস খেতে খেতে ওরা দুজন সমুদ্রের ঢেউ দেখতে লাগলো। সাগরের হিমেল হাওয়ায় মন প্রাণ সব শীতল হয়ে যায়। এরমাঝে ঝরছে শ্রাবনের টিপটিপ বৃষ্টি। শ্রাবনের বারিষধারার মাঝে অন্ধকার রাতে সমুদ্র দেখার আনন্দই আলাদা। দিতির কাছেও ভীষণ ভালো লাগছে। ভাগ্যিস ওর বিয়েটা শ্রাবন মাসে হয়েছে। রাতে ডিনার শেষ করে রুমে এসে দিতি রুমের লাগোয়া বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি স্পর্শ করতে লাগলো। ফাহিম একসময় দিতির পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ওর সরু কোমরটা জড়িয়ে ধরলো। ফাহিমের গভীর শ্বাস দিতির ঘাড়ের উপর পড়তে লাগলো। দিতি যেন এক অজানা শিহরনে কেঁপে উঠতে লাগলো। ফাহিমও হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি নিয়ে দিতির চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলো। ফাহিম একসময় দিতিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। বিয়ের একসপ্তাহ হতে চললো তবুও দিতির লজ্জা কাটেনি। ও ফাহিমের চোখের দিকে লজ্জায় বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। দিতির লজ্জাবনত মুখটা দেখতে ফাহিমের ভীষণ ভালো লাগছে। রাত গভীর হতে লাগলো। ফাহিম দিতিকে পাঁজাকোলা করে হোটেলের নরম বিছানায় শুয়ে দিলো।
দুদিন আনন্দে কাটিয়ে ওরা এয়ারে করে ঢাকায় ফিরে গেল। বাসায় ফিরতে ওদের সকাল দশটা বেজে গেল। কাল ফাহিমকে মুন্সিগঞ্জে ফিরতে হবে। এ কারনে দিতিকে নিয়ে ফাহিম বিকালের দিকে শ্বশুর বাড়িতে গেল। দিতির শ্বশুর আকরাম সাহেব ওকে বাবার বাড়িতে দুদিন থেকে আসতে বললেন। দিতিও অমত করলো না। ফাহিম দিতিকে নিয়ে সন্ধারদিকে শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে গেল। ওদের দুজনের সুখী সুখী চেহারাটা যেন সাথির শরীরে আগুন ধরিয়ে দিলো। দিতিকে রেখে ফাহিম বাসায় চলে আসলো। দিতিকে পেয়ে সোলেমান সাহেব ওর কাছে ওর শ্বশুর বাড়ির গল্প শুনতে চাইলেন। এবং মেয়ের জন্য সাথীর মাকে ওর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করতে বললেন। এতে যেন সাথীর জ্বালা আরো বেড়ে গেল। কিচেনে গিয়ে ওর মাকে বললো,
—–,আমার খুব অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে বিষ খাইয়ে ওকে মেরে ফেলি।
সালেহা বেগম মেয়ের দিকে তাকিয়ে শীতল স্বরে বললেন,
—-যুদ্ধে জিততে হলে অনেক সময় দু’পা পেছাতে হয়। কথাটা মনে রেখো।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে দিতি সাথীর রুমে চলে গেল। ইচ্ছে ছিলো দু’জন মিলে সারা রাত গল্প করবে। কিন্তু সাথী মাথা ব্যথার কথা বলে দিতির কাছ থেকে এড়িয়ে থাকতে চাইলে। অগত্যা দিতি দাদী আমেনা বেগমের কাছে চলে গেল। আমেনা বেগম দিতিকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে বললেন,
—-বিয়ের পর কখনও স্বামীর কাছ থেকে আলাদা থেকো না। এতে সম্পর্কের গভীরতা হতে সময় লাগে।
—–কিম্তু আমার তো পরীক্ষা আছে। তাছাড়া এখন পড়ালেখা শেষ হয়নি।
—-ঠিক আছে। কিন্তু ছুটির দিনগুলোতে ওকে তোমার কাছে চলে আসতে বলবে। ও আসতে না পারলে তুমি ওর ডরমেটরীতে চলে যাবে।
সাথীর আচরনে ও একটু অবাক হলো। সাথী কেন যেন ওর সাথে স্বাভাবিক হতে পারছে না। ওর ছোটো মাও কেন যেন স্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারছেন না। সবদিক বিবেচনা করে দিতি শ্বশুরবাড়িতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলো।
দু,মাস ভালোই কাটলো। ফাহিম এই শুক্রবারে ঢাকায় আসতে পারবে না। ঢাকা থেকে সচিব মহোদয় যাচ্ছেন তাকে প্রটোকল দিতে হবে। দিতির সাথে কথা হয়েছে। ফাহিম ওকে শনিবারে আসতে বলেছে। ড্রাইভার দিতিকে পৌঁছে দিয়ে যাবে। সে কারনে ফাহিম নিশ্চিন্ত আছে।দিতিরও পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ভাবছে কটাদিন ফাহিমের সাথে ডরমেটরিতে কাটিয়ে আসলে মন্দ হয় না।
ফাহিম শুক্রবারে সচিব মহোদয়কে প্রটোকল দিয়ে শনিবার একটু ছুটির আমেজে বাসায় বিশ্রামে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। আজ দিতি আসছে সেই খুশীতে ফাহিম অনেক আনন্দিত। যদিও এক সপ্তাহ সময় পার হয়েছে কিন্তু ওর কাছে মনে হচ্ছে কতোদিন যেন ও দিতিকে কাছে পায় না।প্রাণভরে আদর করা হয় না। বিরহকাতর মনটা দিতিকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে। ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা এগারোটা বাজে। ভাবলো দিতির এই সময়ই রওয়ানা দেওয়ার কথা। মোবাইল স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে সাথী ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সাথী বলে উঠলো
—-ফাহিম ভাই আমার খুব বিপদ। আমি পদ্মা রিসোর্টে আছি। কিছু বখাটে ছেলে আমার ক্ষতি করতে চাইছে। প্লিজ আপনি এখনি চলে আসুন।
—–তুমি ওখানে কেন?
——ভাইয়া,এখন বেশী কথা বলার সময় নাই। সাক্ষাতে সব বলবো। প্লিজ আপনি চলে আসুন।
চলবে