#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী
দিতি ফোন রেখে দৌড়ে নীচে লিভিং রুমে চলে আসলো। ওখানে ওর শ্বশুর আর ফাহিম গল্প করছিলো। দিতিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে ফাহিম জিজ্ঞাসা করলো,
—দিতি,কোনো সমস্যা?
—-সাথীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফাহিম অবাক হয়ে বললো,
—-আমি তো তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। কে ফোন দিয়েছিলো?
—-আব্বু কাঁদতে কাঁদতে ফোনে একথা জানালো।
কথাগুলো বলে দিতিও কাঁদতে শুরু করলো। আকরাম সাহেব দিতির কান্না দেখে বললেন,
—-এখন কান্নার সময় নয়। তুমি ভেঙ্গে পড়লে তোমার বাবা মাকে কে সামলে রাখবে।
এরপর ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-দেখ তো তোর পরিচিত মিরপুর থানায় কেউ আছে নাকি?
—-খোঁজ তো নেওয়াই যায়। কিন্তু —
দিতি অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-কিন্তু কি?
—-ওর তো একটা বদনাম রটে যাবে। পরবর্তীতে ওর বিয়েশাদী সর্বোপরি ওর ভবিষ্যত হুমকির মুখ পড়বে।
আকরাম সাহেব একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,
—-এখন প্রতিটি সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যত নিয়ে পরে ভাবা যাবে। তুই দেরী না করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়।
দিতির এখানে থাকতে এই মুহুর্তে ভালো লাগছে না। ওর মনে হচ্ছে এই সময় ওর বাবার পাশে থাকা উচিত। সে কারনে শ্বশুরকে বললো,
—-আব্বু আমি ফাহিমের সাথে যেতে চাচ্ছি।
ফাহিম তৎক্ষনাত বলে উঠলো,
—-তুমি থানায় গিয়ে কি করবে?
দিতি একটু কাঁদ কাঁদ হয়ে বললো,
—-আব্বুর এই সময়ে আমার তার পাশে একটু থাকা উচিত।
আকরাম সাহেব ফাহিমকে বললেন,
—-ঠিক আছে ও যখন যেতে চাইছে তখন ওকে একটু সাথে নিয়ে যা। থানায় যাওয়ার আগে ওকে ও বাড়িতে নামিয়ে দিস।
মোমেনা খাতুন নিজের ঘরে এশার নামাজ পড়ছিলেন। লিভিংরুমে ওদের হাঁকডাক আর ব্যস্ততায় বেরিয়ে এসে বললেন,
—-কিরে ফাহিম ঘরে কি ডাকাত পড়েছে? এতো চিৎকার চেঁচামেচি কিসের?
আকরাম সাহেব বুঝলেন বোনের নামাজে মনে হয় ডিস্টার্ব হয়েছে। তাই একটু মোলায়েম স্বরে বললেন,
—সোলেমানের ছোটো মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।সকালে কোচিং এর উদ্দেশ্য বের হয়েছে। রাত দশটা বাজতে চললো এখনও বাসায় ফেরেনি।
মোমেনা খাতুন ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-ঐ মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে নয়। ও তোমাকে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেঁচতে পারবে। তুমি যেতে চাইছো যাও। মাঝখানে নিজেদের বেরাতে যাওয়াটা মাটি করলে।
দিতি একটু বিরক্ত হলো। কিন্তু বাইরে থেকে কাউকে বুঝতে দিলো না। ফাহিমকে তাগিদ দিয়ে বের হয়ে গেল। ওরা চলে যাবার পর মোমেনা খাতুন আপন মনে বললেন,
“যতসব ঝামেলা। যেমন মা তেমন তার ছা।”
দিতিরা বের হয়ে মিরপুর থানার দিকে রওয়ানা দিলো। শ্যামলি পার হতেই দিতির মোবাইলটা বেজে উঠলো। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। দিতি ফোনটা ধরতে চাইছিলো না। ফাহিম দিতিকে ফোনটা ধরতে বললো। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে সাথী কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-আপু তুই কি সাজেকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিস?
দিতি ব্যস্ত হয়ে বললো,
—-আমার যাওয়ার কথা এখন থাক। তুই কোথায় কি অবস্থায় আছিস বল?
—–আমি নোভাদের বাসায় আছি। তুই তো ওদের বাসা চিনিস। এখানে চলে আয়। আমি তোকে সাক্ষাতে সব বলবো।
নোভাদের বাসা মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকায়। একটু ভিতরে হওয়াতে গাড়ি নিয়ে যেতে ওদের খুব কষ্ট হলো। ফাহিম গাড়িতেই বসা ছিলো। দিতি দরজা নক করতেই নোভা এসে দরজা খুলে দিলো। দিতির খুব লজ্জা লাগছিলো। এতো রাত পর্যন্ত সাথী ওখানে আছে কিংবা কি কান্ড ঘটিয়েছে এসব ভাবতে ভাবতে পুরোটা পথ এসেছে। আঙ্কেল আন্টিকে কি বলবে? বাসায় এসে দেখে নোভার বাবা মা কেউ বাসায় নেই। উনারা একটা বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছেন। নোভা দিতিকে ওর রুমে নিয়ে গেল। দিতি নোভার রুমে সাথীকে এ অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে গেল। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা আছে। ব্যান্ডেজের বাইরে হালকা রক্তের দাগ লেগে আছে। সাথী দিতিকে দেখে শোয়া থেকে অনেক কষ্টে উঠে বসলো। দিতি ওকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তোর এ অবস্থা কি করে হলো?
সাথী বলার আগেই নোভা বললো,
—আপু ও রিকশা থেকে পড়ে গিয়েছিলো। সাথে সাথে মাথার ঐ জায়গা কেটে গিয়ে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিলো। ও জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। আমি সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। ওখানেই মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হলো। ওর জ্ঞান ঘন্টা খানিক আগে ফিরে এসেছে। তারপর আমি ওকে নিয়ে বাসায় ফিরেছি। ওর মোবাইল বন্ধ ছিলো। আমি আসলে আপনাদের বাসায় ফোন দিতে সাহস পাইনি। আঙ্কেল আন্টিকে কি বলবো বুঝে পাচ্ছিলাম না। ওর জ্ঞান ফিরে আসার পর আপনাকে ও ফোন দিতে চাইলো।
সাথী ব্যথায় গোঙ্গাতে লাগলো। তারপর কোনো রকমে দিতিকে বললো,
—-আব্বুকে জানাতে সাহস হয়নি। দেখা যাবে আমার কোচিং এ যাওয়াই বন্ধ করে দিবে। তোর কথা আব্বু ফেলতে পারবে না। তুই বুঝিয়ে বললে আব্বু আর কিছু বলবে না।
—-ঠিক আছে,এখন বাড়ি চল। তুই হাঁটতে পারবি তো।
সাথী মাথা নাড়িয়ে বললো,”পারবে।”দিতি নোভাকে ধন্যবাদ জানিয়ে মনে মনে আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করলো। ও আসতে পথে মনে মনে কত কি ভেবেছে। ও কি কিডন্যাপ হলো নাকি এক্সিডেন্ট করে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকলো নাকি কোনো বাজে ছেলের পাল্লায় পড়লো। যাক ভালোয় ভালোয় ওকে ফিরে পেয়েছে। গাড়ির কাছে আসতেই ফাহিম গাড়ি থেকে নেমে সাথীকে বসতে বললো। সাথী ফাহিমকে দেখে বললো,
—–সরি ভাইয়া,আমার কারনে আপনাদের হানিমুনে যাওয়া হলো না।
—-সমস্যা নাই,হানিমুনে পরেও যাওয়া যাবে। তোমাকে যে আমরা সহিসালামতে ফিরে পেয়েছি এজন্য আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া জানাই।
সাথী ফাহিমের কথা শুনে মনে মনে বললো,”আপনার হানিমুন করার ইচ্ছা শুধু স্বপ্নেই দেখতে পাবেন।”
দিতি ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ওর বাবাকে পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বললো। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সোলেমান সাহেবের মনটা এমনিতেই বেশ নরম হয়ে আছে। সেখানে সাথীকে বড় কোনো বিপদে পড়তে হয়নি। মেয়ে সহিসালামতে বাড়ি এসেছে এতেই উনি অনেক খুশী। ফাহিম আর দিতিকে থাকতে বললো। অন্য আর একদিন এসে থাকবে এ কথা বলে বিদায় নিলো। সাথী অবশ্য চাইছিলো না আজকে দিতি আর ফাহিম থাকুক। তাহলে ওর শয়তানী ধরা পরে যাওয়ার শঙ্কা আছে।
পরদিন সকাল এগারোটায় ওর দাদীর ডাকে সাথীর ঘুম ভাঙ্গলো। দাদী খুব খুশী হয়ে উনার মোবাইলে দিতি আর ফাহিমের একসাথে কক্সবাজারের সীবিচের ছবি দেখালো। সাথে সাথে সাথীর মাথায় আগুন ধরে গেল। টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসটা মাটিতে ছুড়ে মারলো। মুহুর্তেই গ্লাসটা ভেঙ্গে কাঁচগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়লো। এরপর নিজেই নিজের মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেললো। ওর দাদী তাকিয়ে দেখে সাথীর মাথায় কোনো ক্ষত নাই। দাদী রেগে গিয়ে ওকে বললো,
—-তারমানে,তুই দিতিকে হানিমুনে যেতে দিবি না সেই কারনে এই শয়তানী করেছিস তাই না? কি লাভ হলো? পারলি আটকাতে,পারলি না। এসব শয়তানী বাদ দিয়ে মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর। আজ সকাল সাতটার ফ্লাইটে ওরা কক্সবাজার গিয়েছে।
—-বুড়ি আমি তোর নাতনীকে সুখী হতে দিবো না। ছোটো বেলার যেমন ওর পুতুলগুলো ভেঙ্গে দিতাম তেমনি আজ ওর সংসার আমি ঠিকই একদিন ভেঙ্গে দিবো।
ওদের চিৎকার চেঁচামেচিতে সালেহা বেগম সাথীর রুমে দৌড়ে চলে আসতেই কাঁচের টুকরো দিয়ে পা কাটলো। এসব দেখে আমেনাখাতুন ঐ ঘর থেকে চলে গেল। সালেহা বেগমের পা দিয়ে প্রচুর রক্ত ঝরছে। সাথী ওর মাকে রিকশা করে তাড়াতাড়ি পাড়ার ক্লিনিকে নিয়ে গেল। কাঁটা জায়গায় চারটা স্টিচ পড়েছে। খুব সাবধানে ওর মাকে ঘরে নিয়ে আসলো। টিটেনাসের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। সালেহা বেগমের জ্বর জ্বর লাগছে। মাকে একগ্লাস গরম দুধ খাইয়ে শুয়ে দিলো। এরপর নিজের ঘরের কাঁচের টুকরোগুলো পরিস্কার করে ফেললো। দুপুরের রান্না ওকেই করতে হলো। আমেনা খাতুন ঘরে বসে মনে মনে বললেন,”শয়তানী করলে এভাবেই তার ফল ভোগ করতে হয়।” তবে এই মেয়েকে ঘরে রাখা যাবে না। শীঘ্রই ওর বিয়ে দিতে হবে। নইলে দিতিটার জীবনটাকে ও নষ্ট করে দিবে।
চলবে