#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী
দিতি ধীর পায়ে উপরে উঠে এলো। মেয়েটার মুখটা বিষন্ন দেখে মোমেনা খাতুনের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আসলে এটাই জীবনের বাস্তবতা। প্রতিটি নারীকে যখন তার চেনা পৃথিবীটা ছেড়ে আসতে হয় তখন তার বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। ঐ বেদনা শুধু নারীরাই বুঝতে পারবে। হয়তো এই কারনে দিতির মনটা খারাপ। কিন্তু দিতির ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম। আর দশটা মেয়ের মতো ওর জীবন তরীটা বয়ে চলেনি। বাবার বাড়িতে দাদীই ছিলো ওর একমাত্র আদর ভালোবাসার জায়গা। বাবা তো সেই সকালে বেরিয়ে যেতো আসতো রাত দশটায়। বাবার ছিলো অডিটের চাকরি। যদিও ছুটির দিনগুলোতে বাসায় থাকলে উনি দিতিকে একটু সময় দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু অডিটের চাকরি করাতে মাঝে মাঝে আবার ট্যুরে যেতে হতো। কখনও চিটাগাং কখনও বা রংপুর। মধ্যবিত্ত পরিবারের সবার সুখ স্বাচ্ছন্দের কথা চিন্তা করে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সেই কারনে কোনোদিন বাবাকে দিতি তার কষ্টের কথাগুলো বলতে পারেনি। ইদানিং দাদী একটা কথা প্রায় বলতো,” দ্রুত বিয়ে করে নিজের একটা আপন মানুষ গড়ে নে। যে তোকে সারাজীবন বুক দিয়ে আগলে রাখবে। এ বাড়িতে আর বেশিদিন থাকিস না। আমার বয়স হয়েছে। কবে দুম করে মরে যাই তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। তখন তোকে কে আগলে রাখবে?”
ফাহিমকে ওর ভালোই লেগেছে। মানুষটার আচার আচরনে কোনো মেকীভাব চোখে পড়েনি। তারপরও সাথীর কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো। ফাহিম নাকি ওকে সস্তা ভেবেছে। তাই সস্তার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। নিজের ঘরে এসে দিতি খাটের এক কোনে বসে পড়লো। ফাহিম তখন ওয়াশরুমে ছিলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দিতির বেদনা ভারাক্রান্ত মুখটা দেখে ফাহিমের খুব কষ্ট হলো। ওকে একটু নিবিড়ভাবে কাছে পাবার তরে দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিলো। ফাহিমকে এ কাজ করতে দেখে দিতি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—-দিনে দুপুরে দরজায় ছিটকিনি দিলে কেন?
—-একজন বিবাহিত পুরুষ কখন দরজায় ছিটকিনি তুলে দেয় তাও জানো না?
—-দিনে দুপুরে এসব দুষ্টুমি করা চলবে না।
একথা বলে মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। ফাহিম দিতির মুখে বিষাদের ছায়া দেখতে পায়। ওর পাশে বসে কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। ফাহিমের হাতের স্পর্শে দিতি যেন একটু কেঁপে উঠে। ফাহিম দিতির কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলে,
—-তোমার মনটা খারাপ আমি তা বুঝতে পারছি। আপনজনদের ছেড়ে আসলে কষ্ট হবে। এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিবো।
ফাহিমের কথাগুলো শুনে দিতি মনে মনে বলে,”আমার মন খারাপ তো আমার ভাগ্যকে নিয়ে। জন্মের পর মায়ের ভালোবাসা পাইনি। বাবাকে কোনোদিন নিজের কষ্টের কথা বলিনি। মায়ের আদর পাওয়ার জন্য বাবা যাকে এনে দিলেন সে কোনোদিন আমার দিকে ভালোবাসার হাত বাড়ায়নি। আজকে সেই ভালোবাসাটুকু পাওয়ার জন্য তোমার কাছে এসেছি। তুমিও যদি অবহেলা করো তাহলে আমার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই।”
দিতিকে নিরব দেখে ফাহিম ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
—-তুমি আমার উপর ভরসা করতে পারো। আমি জানি, তুমি মেন্টালি আপসেট। তাই তুমি সময় নিতে চাইছো নাও। আমাকে চিনো জানো তারপর না হয় আমরা আমাদের দাম্পত্যকে সুন্দরভাবে ভালোবাসার ছোঁয়ায় শুরু করবো। এরপর ফাহিম কিছুক্ষণ নিরব থাকে। দিতির মুখটার পানে অপলক তাকিয়ে থাকে। দিতি ওর দিকে নস তাকিয়ে বুঝতে পারে ফাহিম ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দিতি ওর লাজরাঙ্গা মুখটা তুলে একবার ফাহিমের দিকে তাকায়। ফাহিম দিতির চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে বলে,
—-তোমার কাছে একটা কথা জানতে মন চাইছে।
—বলো,
—-হানিমুনটা কি আমাদের পানসে হবে?
দিতি একটু আড়ষ্ট হয়ে বলে,
—-সেটা সময়ই বলে দিবে।
নক করার শব্দে দিতি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে মিনারা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে দেখে দিতি বলে,
—-কিছু বলবেন মিনারা খালা?
—ফাহিম ভাইজান কই? নীচে টেবিলে ভাত বেড়ে দেওয়া হয়েছে। আফা আপনাদের ভাত খাইতে ডাকছে। মিনারা বেগম চলে যাবার পর দিতি দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ফাহিমকে বললো,
—-বাবা আর ফুফু টেবিলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চলো খেতে যাই।
ফাহিম শোয়া থেকে উঠে দিতিকে বললো,
—-আজ বিকেলে একটু শপিং এ বের হই। তোমার যদি টুকটাক কিছু কেনা লাগে কিনে নিও।
দিতিও মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে ফাহিমের সাথে রুম থেকে বের হলো। দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে এসে বিশ্রাম নিয়ে শপিং এ বের হলো। ফাহিম দিতিকে নিয়ে আগে দিয়াবাড়ি ঘুরতে গেল। এখন অক্টোবর মাস। কাশ ফুলের মেলা বসেছে। সে সৌন্দর্য দেখতে অপরুপ লাগে। নৌকায় চড়ে দিতির ঘুরে বেড়াতে খুব ইচ্ছে হলো। ফাহিমও সানন্দে রাজী হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো মেয়েটার মনটা এতে যদি একটু ফুরফুরে হয়। গোধুলীর আবীর রাঙ্গানো আলো এসে পড়েছে দিতির মুখের পরে। মেয়েটাকে অপূর্ব লাগছে। লেকটার দুপাশে ফুটে আছে কাশফুল। মাঝখান দিয়ে এক মায়াবতী কন্যাকে নিয়ে ফাহিম ভেসে চলছে। নিজেকে রুপকথার রাজকুমারের মতো মনে হচ্ছে। নৌকা ভ্রমন শেষে বাইরে ডিনার সেরে কিছু শপিং সেরে ওরা দু’জন বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
রাত গভীর হতে চললো। সাথীর দুচোখে ঘুম নেই। নির্ঘুম থাকার কারনে চোখদুটো জ্বালা করছে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দুর আকাশের তারাগুলোর পানে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,দিতি তোমার অবস্থান হবে খসে পড়া নক্ষত্রের মতোন। তোমার সংসারটাকে আমি তছনছ করে দিবো। হয় তোমার বরকে আমার করে নিবো নয়ত তোমাদের দুজনকে আলাদা করে দিবো। এই আমার শপথ। আগামীকাল তোমাদের হানিমুনে যাওয়া আমি ভেস্তে দিবো। জন্মের পর থেকেই যে দিতিকে ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে করেছে আজ তাকে রাজরানী হতে দেখে সাথী কিছুতেই মানতে পারছিলো না। মায়ের কাছে শুনেছে বাবা চায়নি সাথীর জন্ম হোক। কারণ দিতির যেন কোনো অবহেলা না হয়। এটা শোনার পর থেকে দুবছরের বড় হলেও সাথী সব সময় দিতিকে অবহেলা আর অপমান করে গিয়েছে। এতে সাথী নিজের ভিতরে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে।
খুব সকালেই ফাহিমের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ও দিতির ঘুমন্ত নিস্পাপ মুখটার দিকে অপলক তাকিয়ে রয়। হঠাৎ দিতিরও ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখে ফাহিম ওর মুখের পরে মুগ্ধতার দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। দিতি চোখ কছলে জিজ্ঞাসা করে,
—-এভাবে কি দেখছো?
—-,আমার স্বপ্নে দেখা রাজকুমারীকে।
—-আর দেখতে হবে না। এবার ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ওজু করে আসো। একটু পরেই সুর্য উঠে যাবে। নামাজ শেষ করে নীচে গিয়ে সবাই মিলে একসাথে চা খাবো।
ওরা দুজন ফজরের নামাজ আদায় করে নীচে চলে যায়। আকরাম সাহেব খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। আজ একটু সকালে অফিসে যেতে হবে। বিদেশ থেকে বায়াররা আসছে। তাদের সাথে মিটিং এ বসতে হবে। ছেলেটাকে কিছুতেই নিজের ব্যবসার কাজে লাগাতে পারলো না। সে সরকারী চাকরি করবে। তার আমলা হওয়ার ইচ্ছা। উনি ভেবেছিলেন ছেলের কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে শেষ বয়সে নিশ্চিন্তে সময় কাটাবেন। তা আর হলো কই? তবে তিনি আশাহত হননি। মনে মনে ভাবছেন দিতিকেই তার ব্যবসার হাল ধরার উত্তরসুরী হিসাবে তৈরী করে নিবেন। নীচে এসে দিতি শ্বশুরকে সালাম দিয়ে কিচেনে চলে গেল। ফাহিমও সালাম দিয়ে বাবার পাশে বসে পত্রিকার একটা পেইজ নিজের দিকে টেনে নিলো। একটু পরে ফাহিমের ফুফুও চলে আসলো। মিনারা খালা ট্রেতে করে চা আর বিস্কুট দিয়ে গেল। দিতি সবার কাপে চা টিপট থেকে চা ঢেলে এগিয়ে দিলো।
পুরোটা দিন ওদের দুজনের বেশ ব্যস্ততায় কাটলো। ফাহিমের কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছিলো। এরমাঝে এক ফাঁকে দিতি ওর সুটকেস গুছিয়ে নিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত আটটা বাজে। দিতির ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে ওর বাবা ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওর বাবা কাঁদ কাঁদ স্বরে বললো,
—-সাথীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর ফোন বন্ধ। সেই সকালে কোচিং এর কথা বলে বেড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত বাসায় ফিরেনি। আমি ওর পরিচিত সব জায়গায় খোঁজ করেছি। কেউ ওর খোঁজ দিতে পারেনি। আমি এখন কি করবো মা। ফাহিমকে বলে দেখ না, ও যদি কিছু একটা করতে পারে। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে।
বাবার এরকম আকুতি শুনে দিতি সান্তনা দিয়ে বললো,
—-তুমি এতো টেনশন করো না। তোমার শরীর খারাপ করবে। ফাহিমকে বলে দেখি ও কিছু করতে পারে কিনা।
চলবে