জীবনের গোপন ডাকবাক্স পর্ব-০৬

0
16

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

আজ শ্বশুর বাড়িতে ফাহিমের দ্বিতীয় দিন। আজকের রাতটা থেকেই কাল সকালে দিতি আর ফাহিম চলে যাবে। পরশু রাতেই ওরা হানিমুনের উদ্দেশ্যে সাজেক রওয়ানা হবে। তিনদিন থেকে অর্থাৎ শনিবার ওরা রাতের বাসে ঢাকার পথে রওয়ানা দিবে। রবিবার ফাহিমকে আবার মুন্সিগঞ্জে গিয়ে অফিস করতে হবে।
আকাশে আজ পূর্ণশশীর জোৎস্না। রাতে ডিনার করার পর দিতির দাদী ফাহিমকে মজা করে বলছে,
—-ভাইয়া আজ আকাশে ফকাফকা জোৎস্নার আলো ঝরছে। চাঁদ ওর সবটুকু রুপের সুধা পূর্ণিমার রাতে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিয়ে মাতাল করে তোলে। এমনরাতে তোমার দাদাজান আমাকে নিয়ে উঠোনে মাদুর বিছিয়ে বসে থাকতো। আর ভাওয়াইয়া গান শোনাতো। তুমি ও আমার নাতনীটাকে নিয়ে ছাদে গিয়ে বসো। এখনি তো দুজন দুজনকে বোঝার সময়।
ফাহিম মুচকি হেসে বললো,
—-দাদী,দাদাজান অনেক রোমান্টিক ছিলেন তাই না?
—–সেদিনগুলোর কথা মনে হলে আজও বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে। মানুষটা আমাকে খুব ভালোবাসতো। যাও ভাই তোমরা ছাদে গিয়ে বসো।
একথা বলে এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিতির দাদী নিজের ঘরে চলে যান।
দাদীর কথা শুনে সাথী মনে মনে বললো,”বুড়ির ঢং দেখলে শরীরটা জ্বালা করে।” সাথীও দুপদাপ করে নিজের ঘরে চলে গেল।
ফাহিমের জোৎস্না খুব ভালো লাগে। ওর ইচ্ছে করছিলো দিতিকে নিয়ে ছাদে যেতে। কিন্তু বলতে পারছিলো না। দাদী বলাতে ওর সুবিধাই হলো।
দিতিকে নিয়ে ফাহিম ছাদে চলে গেল। মুক্ত বাতাসে ওরা দু’জন বসে আছে। সাথী ওর ঘর থেকেই দিতি আর ফাহিমের হাসির শব্দ শুনতে পারছে। মনে মনে সাথী বলছে দিতিটা কি বেহায়া! এভাবে বাজারের মেয়েদের মতো করে কেউ হাসে? ঐ হাসির শব্দ ওর শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। সেই আগুনে দিতির স্বামী আর সংসারকে ওর পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ও একা কেন জ্বলবে? দিতিকেও জ্বালিয়ে মারবে।
ফাহিম অপলক দিতির দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদের আলো দিতির মুখের উপর এসে পড়েছে। সে আলোতে দিতিকে যেন ফাহিমের কাছে স্বপ্নে দেখা রাজকুমারীর মতো লাগছে। চাঁদের আলোতে দিতি স্পষ্ট দেখতে পারছে ফাহিমের দুচোখে মুগ্ধতার দৃষ্টি। দিতি বেশীক্ষণ সেই দৃষ্টির পানে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। ফাহিম দিতির পাশে একটু ঘনিষ্ট হয়ে বসে। দিতির খুব লজ্জা লাগছে। ফাহিম আস্তে আস্তে ওর ঠোঁটটা দিতির কানের লতির কাছে নিতেই ও বলে উঠলো,
—-চা খাবে? আমারও একটু চায়ের তেষ্টা পেয়েছে।
ফাহিম কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
—তুমি এত বেরসিক কেন? কোথায় কোন কথা বলতে হয় তাও শিখোনি।
দিতি মুচকি হেসে বলে,
—-এভাবে খোলা ছাদে রোমান্স করা ঠিক না?
—-আমি তো তোমার সাথে কিছুই করিনি।
—-তবুও হঠাৎ কেউ যদি ছাদে এসে আমাদের এভাবে ঘনিষ্ট অবস্থায় দেখে ফেলে তাহলে আমার খুব লজ্জা লাগবে।
—রোমান্স যদি করেও থাকো পর পুরুষের সাথে তো করছো না। এতে লজ্জা কিসের? নিজের স্বামীর সাথে করছো।
—-আচ্ছা, আমার বড্ড অপরাধ হয়েছে। এবার মশলা দিয়ে খুব সুন্দর করে তোমার জন্য চা বানিয়ে আনছি। তারপর সারারাত ছাদে বসে তোমার সাথে প্রেম করবো।
—-তোমার যাওয়ার কি দরকার? সাথীকে একটু বলোনা আমাদের দুজনের জন্য দু’কাপ চা দিয়ে যেতে? নতুন দুলাভাইয়ের জন্য ও এটুকু করতে পারবে না।
—-ও মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বানিয়ে আনছি। খুব বেশী সময় লাগবে না।
দিতি জানে, সাথীকে বলাই বৃথা। এরচেয়ে নীচে গিয়ে ও চা বানিয়ে আনবে। চা বানানোটা জরুরী নয় আসলে ফাহিমের দুষ্টুমী থেকে বাঁচতেই নীচে চলে আসলো। পাশাপাশি সাথীটাকেও ডেকে আনবে। বেচারা নীচে একা রয়েছে। হাজারও হোক সাথী ওর বোন। কোনোদিন সাথীকে ও সৎ বোনের চোখে দেখেনি। সাথী ওকে কি চোখে দেখেছে, এটা নিয়ে ওর কোনো ভাবনা নেই। দিতি কিচেনে গিয়ে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়ে সাথীর রুমে এসে দেখে ও চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দিতি ভাবছে ও ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আর ডাকলো না। দিতি রুমের দরজার কাছে যেতেই সাথী বলে উঠলো,
—-আপু তোর কি লাজ শরম নেই। এভাবে বেহায়ার মতো এতো জোরে হাসছিস কেন? আশে পাশের মানুষ শুনলে কি ভাববে? বিয়ে কি আর কারো হয় না? নাকি জগতে তুই একাই বিয়ে করেছিস?
সাথীর কথা শুনে দিতি অবাক হয়ে বলে,
—-তুই আমার সাথে এভাবে কেন কথা বলছিস ? তুই যেভাবে বলছিস আমি কিন্তু অতো জোরে হাসিনি। আমার লিমিট আমি জানি। তাছাড়া যদি হেসেও থাকি আমি আমার স্বামীর সাথে হেসেছি।
বলে দিতি আর একমুহুর্ত অপেক্ষা করলো না। চা বানিয়ে ছাদে চলে গেল। তবে ওর মুডটা সাথী নষ্ট করে দিলো। সাথী মনে মনে এটাই চেয়েছিলো। ঘরে শুয়ে সাথী সিঁড়ি দিয়ে ওদের দুজনের নামার শব্দ পেলো। ওদেরকে নামতে দেখে সাথী নিজের মনে হেসে বলতে লাগলো,
—-তোকে তো আমি সুখী হতে দিবো না। তুই আমার শান্তি কেড়ে নিয়েছিস আমি তোর সুখ কেড়ে নিবো।
রাতের দ্বিপ্রহর পার হলো। সাথীর চোখে কোনো ঘুম নেই। ও কল্পনায় দেখতে পারছে ফাহিম দিতিকে প্রাণ ভরে আদর করছে। আর ও অশান্তিতে ভুগছে।এমনিতেই এই দু’দিন সারাক্ষণ চোখের সামনে ফাহিমকে দিতির সাথে থাকতে দেখে ওর অন্তরে এক অদ্ভূত দাহন তৈরী হয়েছে। এই দাহনে দিতিকে পুড়িয়ে মারতে ইচ্ছা করছে।

সকালবেলা ঘরের ভিতর খসখস শব্দে সাথীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাকিয়ে দেখে দিতি আলমারী থেকে কিছু কাপড় বের করছে। ওদিকে তাকিয়ে সাথী একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
—-তুই আমাকে একটু শান্তি করে ঘুমাতেও দিবি না?
—-সরি বোন, কাল রাতে আমরা হানিমুনে রওয়ানা দিবো। সেজন্য আমার কিছু থ্রীপিচ বের করছি। ওখানে শাড়ি পরতে চাইছি না।
হানিমুনে যাওয়ার কথা শুনে সাথীর অন্তরটা হিংসায় জ্বলে উঠলো। কন্ঠে তাচ্ছিল্যের ভাব এনে বললো,
—তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
দিতি খুশীতে ঝলমল করে উঠে বললো,
—-আমার না পাহাড় খুব ভালো লাগে। তাই সাজেকে যাওয়ার প্লান করেছি।
—-তোর ভাব দেখে মনে হচ্ছে সিমলা,মানালী কিংবা থাইল্যান্ড যাচ্ছিস। সেই তো ব্যাঙের লাফ। আমি দেশের ভিতরে কোথাও হানিমুনে যাবো না। আমি সুইজারল্যান্ড কিংবা দুবাই অথবা ইউরোপের কোনো একটা দেশে হানিমুনে যাবো।
—-সে তো অনেক টাকার ধাক্কা।
—তাতো হবেই। ব্যাটা হাতি পালবে কিন্তু হাতির খোরাকী দিবে না তা কি করে হবে? সম্রাট শাহজাহান যদি উনার বউয়ের জন্য তাজমহল গড়ে দিতে পারে তাহলে আমার বর আমার জন্য কেন এটুকু করতে পারবে না। তোকে এসব সস্তা জায়গায় ফাহিমভাই নিতে পেরেছে কারণ উনার কাছে তোর তেমন একটা মুল্য নেই। অবশ্য তুইও এটুকু পেয়েই বর্তে গেছিস।
সাথীর কথাগুলো শুনে দিতি খুব কষ্ট পায়। সেদিকে তাকিয়ে সাথী নিজের মনের প্রশান্তি অনুভব করে। ও খাট থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেল। আর মনে মনে ভাবলো,”কি করে তুমি হানিমুনে যাও সেটাই এখন দেখার বিষয়।”
দিতির মনটা খারাপ হলেও বাইরে থেকে কারো কাছে কিছু প্রকাশ করলো না। কারণ বিয়ের এই কয়দিনে ও বুঝেছে ফাহিমের ভালোবাসায় কোনো ফাঁক নেই। যাইহোক ব্যাগ গুছিয়ে সবার কাছে বিদায় নিয়ে ফাহিমের সাথে শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা দিলো। পুরোটা পথ ওর মুখটা ভার ছিলো। ফাহিমও খেয়াল করলো। কিন্তু ও মুখে কিছু বললো না। ভাবছে,বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাবে মনতো একটু খারাপ হবে। আজ যেহেতু ওয়ার্কিং ডে। সে কারনে রাস্তায় ভালোই জ্যাম আছে। উবারে করে যেখানে বিশমিনিটে যাওয়া যায় সেখানে একঘন্টা লাগলো। ফাহিম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা বারোটা বাজে। বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই ওর ফুফুশাশুড়ী এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
—তুই আসা মাত্রই আমার ভাইয়ের বাড়ীটা যেন আনন্দে ঝলমল করছে।
দিতি ফুফুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-আপনার শরীর ভালো আছে ফুফু?
—+তোর মিষ্টিমুখটা দেখার সাথে সাথে আমার শরীর মন দুটোই ভালো হয়ে গেল।
আশরাফ সাহেবও এসে দিতিকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—+তোমাদের বাড়ির সবাই ভালে আছে মা?
—+আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছে।
এরপর আশরাফ সাহেব ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—+হোটেল কক্স টুডে তে তোদের জন্য রুম বুক করা হয়েছে। তুই কি গ্রীনলাইনের টিকিট কেটেছিস?
—হুম,
ফাহিম নিজের ঘরে চলে গেল। দিতির ফুফুশাশুড়ীও ওকে ঘরে গিয়ে ফ্রেস হতে বললেন।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে