#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী
মোহাম্মদপুর থেকে মিরপুর এক নাম্বারে আসতে ওদের খুব একটা সময় লাগেনি। আজকে আবার ছুটির দিন শনিবার। সে কারনে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে রাস্তা বেশ ফাঁকা ছিলো। বাড়ি আসতে সাথীর দুপুর বারোটা বেজে যায়। সোলেমান সাহেব বাড়িতে এসেই ওয়াশরুমে চলে যান। একটু পরেই যোহরের আযান দিবে। সোলেমান সাহেব মসজিদে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করেন। তাই গোসল করে মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাড়িতে পৌঁছে সাথী ওর মায়ের ঘরে গিয়ে বললো,
—বাবাকে আটকাতে পারলে না?
—তোর বাবাকে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু আমার কথা শোনেনি। তোর দাদী ডেকে নিয়ে কি যেন বললো? আর অমনি সাত সকালে তোকে আনতে ছুটে গেল। আর আমিও বুঝে পাই না ঐ ফাহিমকে তোর লাগবে কেন? দুনিয়াতে কি ছেলের আকাল পড়েছে?
—+বুড়িকে আমি এমন শাস্তি দিবো যেন বাপের নাম পর্যন্ত ভুলে যাবে।
—-তোকে তার বাপের নাম ভোলাতে হবে না। আমি ফাহিমের থেকে ভালো ছেলে দেখে তোর বিয়ে দিবো।
মায়ের কথাশুনে সাথীর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। তাই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে বললো,
—কেন আজ ভালো সাজার চেষ্টা করছো মা? বিয়ে দেওয়ার আগে একটু খোঁজ নিয়ে দেখলে না ছেলে রাজপুত্র নাকি কামার পুত্র। সৎ মেয়েকে বিয়ে দিলে রাজপুত্রের সাথে। আর নিজের মেয়ের বিয়ে দিবে কি ঘুটে পুত্রের সাথে? বিশাল তিনতলা বাড়ি আমলার চাকরি তোমার সৎ মেয়ের তো অহঙ্কারে মাটিতে পা পরবে না। আমি সেটা মেনে নিতে পারবো না। ওর সুখের সংসার আমি ভাঙ্গবোই। ছোটোবেলায় তুমি তো আমাকে আপুর পিছনে লাগিয়ে দিতে? আপুর খেলনা ভেঙ্গে ফেলা, গল্পের বই গুলো পুড়িয়ে ফেলা, আপুর পছন্দের জামাগুলোকে ছিঁড়ে ফেলা এগুলো তো তুমি আমাকে শিখিয়েছো। আমিও এই কাজগুলো করতে খুব আনন্দ পাই। আপুর সব কিছু নষ্ট করে দেওয়ার পর ও যখন দুঃখ পেয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে তখন আমার যন্ত্রণাগুলো কমতে থাকে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছি বাবা আর দাদী ওকে আগলে রাখে। ঐ আগলে রাখাটা আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
—-এ বিয়ে ঠেকানো যেতো না। খুব ছোটো বেলায় দিতি আর ফাহিমের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। ওসব ভেবে মাথা গরম করে লাভ নেই। আমাদের মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হবে।
যোহরের নামাজ আদায় করে দিতির দাদী সাথীর মায়ের ঘরে এসে সাথীকে বললো,
—-এখনও সময় আছে নিজেকে শুধরে নে। যে অন্যের ঘরে আগুন দেয় আল্লাহপাক তার ঘরটাই আগে আগুন লাগিয়ে দেন। সুতরাং সাবধান।
সাথী কিছু বলার আগেই সালেহা বেগম তেতে উঠে বললেন,
—-এসব হয়েছে আপনার জন্য। আপনার ছেলে আমার স্বামী হলেও মনে মনে এখনও দিতির মরা মাকে ভালোবাসে। এমনকি উনি আর সন্তানও নিতে চাননি। আমি জোর করেছি বলে জন্মের পর থেকে আমার মেয়েটাকে অবহেলা করে। একমাত্র আপনার জন্য আমার মেয়ে আর আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেল।
—+এসব তুমি ওর সামনে কি বলতেছো সালেহা? তোমার মাথা ঠিক আছে। তুমি যদি এসব কথা ওর কানের কাছে বলতে থাকো তাহলে ও কোনোদিন ভালো মানুষ হতে পারবে না। আজ আমার জন্য তুমি চৌধুরী বাড়ির বউ হতে পেরেছো। বাপের বাড়িতে কি অবস্থায় থাকতে সেটা ভুলে যেও না। আমি তোমাকে এসব কথা বলতে চাইনি। কিন্তু তোমার আচরনে বলতে বাধ্য হয়েছি। তোমাকে বউ করে আনার আগে একটা অনুরোধ করেছিলাম। মাতৃহারা মেয়েটাকে একটু মায়ের ভালোবাসা দিও। আর তুমি কি করেছো ভুলে গেছো? যদি সত্যি কথা বলি তাহলে এটাই বলতে হয় তুমি চাওনি মেয়েটা বেঁচে থাকুক। একবার মেলায় ঘুরতে নিয়ে গিয়ে ওকে মেলাতে রেখে এসে বললে,
“ও নাকি হারিয়ে গিয়েছে।”
আল্লাহর রহমতে তোমার ভাই আবার ওকে মেলা থেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো। ভাগ্যিস তোমার ভাই সেদিন মেলাতে ঘুরতে গিয়েছিলো। তুমি ইচ্ছে করেই মা মরা মেয়েটাকে মেলাতে রেখে এসেছিলে।
—-আপনি আর আপনার ছেলে সবসময় আমাকে সন্দেহ করেন। তাহলে দিতিকে আমি কিভাবে মায়ের আদর দিবো। আমি যদি আমার কলজেটা কেটে নিয়ে ওকে আদর করে খাওয়াতাম তারপরও আপনারা বলতেন আমি দিতিকে বিষ খাওয়াচ্ছি।
—+এখনও সময় আছে মেয়েকে সুবুদ্ধি দিয়ে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলো। না হলে আখেরে তোমাকে পস্তাতে হবে। কথাটা মনে রেখো। আর একটা কথা কাল দিতি আর ফাহিম আসবে, ওদের যেন আদর যত্নের ত্রুটি না হয়।
এ কথা বলেই দাদী আমেনা খাতুন ঘর থেকে বের হয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। দিতির কষ্টের জন্য উনার সবসময় নিজেকে দায়ী মনে হয়। সে কারনে মেয়েটার দিকে নজর রাখতে চেষ্টা করেন। সালেহাকে বড় আশা করে ছেলের বউ করে এনেছিলেন। নিজের দুরসম্পর্কের চাচাতে বোনের মেয়ে। ওর বাবার বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না। নদী ভাঙ্গা পরিবারের মেয়ে। একসময় ওদের অনেক জমি জমা ছিলো। সব এখন আঁড়িয়াল খাঁর পেটের ভিতর। মেয়েটা যেন একটু ভালো থাকে বিনিময়ে মা মরা মেয়েটাকে যেন একটু ভালোবাসে। কিন্তু বিয়ের পরেই পুরো ভোল পাল্টে ফেললো। নিজে তো দেখতোই না বরং দিতির জন্য যে কাজের লোক রাখা হতো তাকে নিজের কাজে ব্যস্ত রাখতো। আর দিতিটা সারাদিন মাটিতে গড়াগড়ি খেতো। উনার বাতের ব্যথার কারনে উনিও দিতিকে কোলে রাখতে পারতেন না।
পরদিন দিতি আর ফাহিমের আসতে বিকেল হয়ে যায়। সালেহা বেগম মেয়ে দিতি আর জামাই ফাহিমকে শরবত আর মিষ্টি খাইয়ে বরণ করে নেন। সাথীকে বলেছিলো দিতির খাটটা ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিতে। কিন্তু সাথীর বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আর জোর করেনি। সালেহা বেগম মেয়ে আর জামাইয়ের জন্য পিঠে পায়েশ কেক মিষ্টি নানা পদের ফল দিয়ে বিকালের নাস্তা পরিবেশন করেন। একটু বেশী করার চেষ্টা করেন। স্বার্থ তো আছে। নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। তখন ছেলে খুঁজে আনার দায়িত্ব হয়তো দিতি আর ফাহিমকে দিতে হতে পারে। তাই সম্পর্কটাকে মিষ্টি করতে সালেহা বেগম আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যাই হোক পুরো বাড়িতে আজ আনন্দ বিরাজ করছে। সোলেমান সাহেবও ভীষণ খুশী। ফাহিম শ্বশুরের সাথে গল্প করছে। দিতি আর সাথী ওদের বাসার ছাদে চলে গেল। মিরপুর এক নম্বরে জোনাকী রোডে সোলেমান সাহেব তিনকাঠা জমি করে পাঁচতলা বিল্ডিং এর ফাউন্ডেশন দিয়ে আপাতত একতলা করেছেন। সাথী দিতিকে ছাদে সিঁড়িতে পৌঁছে দিয়ে বললো,
—–আপু তুই ছাদে গিয়ে অপেক্ষা কর আমি দুলাভাইকে ডেকে আনছি।
দিতি ছাদে চলে যায়। ও হাঁটতে ছাদের কিনারে চলে আসে। ওখানে টবে করে বিভিন্ন ধরনের ফুলগাছ লাগানো হয়েছে। সাথী আস্তে আস্তে পা টিপে ছাদে আসলো। আর দিতিকে যখনি ধাক্কা মারতে যাবে অমনি ফাহিম এসে বললো,
—সাথী তুমি কি করছো?
সাথে সাথে ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,
—-,তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম।
ফাহিমের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলো এ কি রকম পরীক্ষা!
—-আমি তোমার পরীক্ষার ধরণটা বুঝলাম না।
—-আমি তো আপু ফেলে দেইনি। কেবল ফেলে দেওয়ার ভাণ করছিলাম, আর অমনি আপনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন। ঠিক আমার বোনের জন্য আপনার এই চিৎকারটাই দেখতে চেয়েছিলাম।
দিতি ওদের দুজনের কথোপকথন শুনে ফাহিমকে বললো,
—-আমি তোমাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। ওতো তোমাকে ডেকে আনতে গেল।
—–হ্যা, ওতো আমাকে ডেকে আনলো। আমি বাবার সাথে গল্প করছিলাম।
—-শালী হয়ে একটু ঠাট্টামশকরা তোমার সাথে করতেই পারে। এতে তুমি এতো রিঅ্যাক্ট করছো কেন?
ফাহিম একদম দিতির কাছে চলে আসলো। তারপর সাথীর দিকে তাকিয়ে বললো,
—আর কখনও আমার সাথে এ ধরনের ঠাট্টা মশকরা করবে না।
সাথী ধরা পড়ার ভয়ে ওখান থেকে কেটে পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে ভাবলো ব্যাটা আর এক সেকেন্ড দেরী করে আসলে তোর কি এমন অসুবিধা হতো। বউটাকে হয়তো চিরতরে হারিয়ে যেতো। তাতে কি? পুরুষমানুষের আবার বউয়ের অভাব হয় নাকি?
চলবে