জীবনের গোপন ডাকবাক্স পর্ব-০৪

0
13

#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

সাথী নিচে আসার সাথে সাথে দিতির শ্বশুর আকরাম সাহেব বললেন,
—-আসো,তোমার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম।
সাথী আহ্লাদে গদগদ হয়ে বাড়ির সবার সাথে চা পর্বে অংশ নেয়। দিতির ফুফু শাশুড়ী সাথীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-তুমি সকালে ফজরের নামাজ পড়ো না?
সাথী থতমত খেয়ে বললো,
—-পড়ি তো ফুফু। নতুন জায়গা তো তাই—–
—–নতুন জায়গা হলেও এবাড়িতে বাথরুম নামাজের জায়গা, জায়নামাজ সবই আছে। অতো ভোরে উঠলে,নামাজটা পড়ে নিতে পারতে।
সাথীর মুখটা সাথে সাথে কালো হয়ে গেল। মনে মনে ভাবছে,বুড়িটার সমস্যা কি? আমার পিছনে কেন পড়ে আছে? আমি তো ওর বাড়াভাতে ছাই দিতে আসেনি। তাহলে আমাকে নিয়ে ওর কি সমস্যা?
আকরাম সাহেব সাথীর দিকে তাকিয়ে নিজের বোনকে বললেন,
—-আপা,আমার বন্ধু সোলেমান তার মেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞান ভালোই দিয়েছে। তুমি ও নিয়ে এতো প্যারা নিও না।
ফাহিম মুচকি হেসে সাথীর দিকে তাকিয়ে বললো,
—-পারতপক্ষে ফুফুর সামনে খুব একটা এসো না। তোমাকে তাহলে একদিনেই মাওলানা বানিয়ে ছাড়বে।
এবার ফাহিম আর দিতির দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-তোমরা দুজন নামাজ পড়েছো?
ফাহিম সাথে সাথে বললো,
—-তুমি তো জানো,আমি কখনও নামাজ ক্বাজা করি না। আর দিতিও নামাজ পড়েছে।
দিতির দিকে তাকিয়ে ফাহিমের ফুফু বললেন,
—-ওরে তো দেখলেই আমার দিলটা ঠান্ডা হয়ে যায়।
দিতির ফুফুশাশুড়ীর কথা শুনে সাথী মনে মনে বলে, বুড়ির আদিখ্যেতা দেখলে শরীরটা আমার জ্বলে যায়। এমনসময় বাড়ির গেটের সামনে ওরা সবাই একটা সিএনজি থামার শব্দ শুনতে পায়। আকরাম সাহেবের ততক্ষনে চা খাওয়া শেষ হয়েছে। উনি গেটের বাইরে এসে হাঁক দিয়ে বলেন,
—-ফাহিম দেখো, কে এসেছে?
ফাহিম বের হয়ে দেখে ওর শ্বশুর সোলেমান সাহেব হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সিএনজি থেকে নামছে। দিতি আর সাথীও ফাহিমের পিছুপিছু বের হয়ে আসলো। আকরাম সাহেব সোলেমান সাহেবকে দেখে বললেন,
—-আসসালামু আলাইকুম বন্ধু।
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
দুই বন্ধু নিজেদের বুকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন। দিতিও ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—বাসার সবার শরীর ভালো আছে বাবা?
—-আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছে।
এরপর আকরাম সাহেব বললেন,
—কি ব্যাপার বন্ধু! মেয়েদের না দেখে আর থাকতে পারলে না?
—-মানে, আমি ছোটো মেয়েটাকে নিতে এসেছি। দুই বোন চলে আসাতে আমাদের বাড়ীটা একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তাই সাথীকে নিতে এলাম।
ফাহিম সালাম দিয়ে শ্বশুরের হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বললো,
—-বাবা ভিতরে আসেন।
বাবাকে দেখে সাথীর মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো, ঠিক বুড়িটা বাবাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাথীকে নিরব দেখে সোলেমান সাহেব বললো,
—-কিরে মা,তুই এতো চুপচাপ কেন?
সাথী একটু ঝাঁঝ নিয়ে বললো,
—আপুর বিয়ে এমনিতেই তোমার উপর অনেক ধকল গিয়েছে। কষ্ট করে তোমার আসার দরকার ছিলো না। আমাকে মিস করছো সেটা জানালেই হতো। ফাহিমভাইয়া আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতো।
ফাহিমের ফুফু সাথীর উপর বিরক্ত হয়ে বললেন,
—-বিয়ের পর বরবউকে জোরে বের হতে হয়। তাই ফাহিম তো তোমার সাথে যেতে পারতো না।
—-এটা কোন হাদিসে লেখা আছে ফুফু।(তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সাথী বললো)
—আমি তো বলিনি হাদিসে লেখা আছে। এটা মুরুব্বিদের কথা। বরং তোমার আব্বা অনেক বুদ্ধিমান মানুষ। নিজের সোমত্ত মেয়েকে নিতে এসে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।
সাথীকে এভাবে কথা বলতে দেখে সোলেমান সাহেব বললেন,
—-সাথী, উনি তোমার মুরুব্বি হোন। মুরুব্বিদের সাথে এভাবে কথা বলতে হয় না। শুধু তোমার কেন উনি আমারও মুরুব্বি হোন। আমার কোনো ভাইবোন নেই। তবে এই আসমা আপুকে আমি আমার বড় বোনের জায়গাটা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দিয়ে রেখেছি।
সাথী মনে মনে বললো, বলেছি ঠিক করেছি। মাই ফুট বড়বোন। আর তোমার বিচক্ষণতার ও খেতাপুরি। পাঠিয়েছে তো দাদী। ঐ বুড়িকে আমার ভালোই চেনা আছে। বাড়ি গিয়ে বুড়ি আমি তোমার মজা বুঝাবো।

ছোটোবেলায় ওর বাবা দিতির জন্য খেলনা কিংবা পছন্দের জিনিস কিনে আনলে ওর দাদী সেটা সাথীর চোখ এড়িয়ে যত্নে নিজের কাছে তুলে রাখতেন। এটা ওর দাদীর আজীবনের অভ্যাস। যদিও সাথী দিতির জিনিসগুলো নষ্ট করার সুযোগ খুঁজতো। এবং তক্কে তক্কে থাকতো। বুড়ি আর কতোদিন লুকিয়ে রাখবে। বুড়ি বাথরুমে যাবে, গোসলে যাবে,নামাজ পড়বে। একদিন না একদিন তো সুযোগ আসবেই। যেদিন সত্যি সুযোগ এসে যায় সাথী আর একমুহুর্ত অপেক্ষা করে না। তোষকের তলা থেকে চাবি বের করে আলমারী খুলে দিতির খেলনাটা বের করে ভেঙ্গে আবার ঠিক জায়গায় রেখে দিতো। যতদিন সাথী একাজটা করতে পারতো না একধরনের অশান্তি ওকে তাড়া করে ফিরতো। আর যেদিন ওর উদ্দেশ্য সফল হয়ে যেতো ওর অন্তরটাতে এক ধরনের শান্তি বিরাজ করতো। দিতি আর ওর দাদীর কষ্ট দেখে সাথীর মনে এক ধরনের আনন্দ অনুভব হতো। সাথীর এই চরিত্রের সাথে ওর দাদীর ভালো পরিচয় আছে। একারনে উনি আর দেরী মা করে সাতসকালে ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এই যেমন এখন সাথীকে এক ধরনের অশান্তি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। দিতির সুখী সুখী চেহারা আর ফাহিম এর দিতির প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টি ওকে এখন পুড়িয়ে মারছে। আর দাদীর উপর ওর ভীষণ রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাড়ী গিয়ে সবার আগে দাদীর চুলগুলো টেনে ছিঁড়তে হবে।
নাস্তা করেই সোলেমান সাহেব সাথীকে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন।
দিতি যদিও যাবার সময় ওর বাবাকে বলেছিলো,
—-আব্বু কালকেই তো আমি আর ফাহিম ও বাড়িতে যাবো। তখন সাথী আমাদের সাথে যেতো। এখন ওকে বাড়ি না নিয়ে গেলে হতো না?
—-নারে, বাড়িটা বড্ড খালি খালি লাগছে।
সাথী ওদের কথোপকথন শুনে মনে মনে বললো,
—খালি বাড়ি না ছাই। জানি তো তুমি তোমার বড় মেয়েকেই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসো।
সবার কাছে বিদায় নিয়ে সাথী আর সোলেমান সাহেব বাড়ির পথে রওয়ানা দিলেন। ফাহিমও ওদেরকে এগিয়ে দিতে বের হয়ে গেল।
সোলেমান সাহেব আগে আগে হাঁটছেন। সাথী আর ফাহিম পিছু পিছু হাঁটছে। দুজনেই চুপচাপ। নিরবতা ভেঙ্গে ফাহিম বললো,
—তোমার সাথে ভালো করে আলাপই হলো না।
সাথী ফাহিমকে বেকায়দায় ফেলতে বলে উঠলো
—-আপনি আলাপ পরিচয় করতে চাননি তাই হয়নি। আপনি তো আব্বুকে একবারও আমাকে রেখে যেতে বললেন না।
—-না,না তা হবে কেন? বাবা তোমাকে নিয়ে যেতে আসছেন নিশ্চয় কিছু প্রয়োজন আছে। তাই আমি আর কিছু বলিনি। ঠিক আছে এখন বাবাকে বলি।
ফাহিম যদিও ভদ্রতা করে কিংবা নিজের ছোটো শালীকে নিজের ছোটো বোনের দৃষ্টিতে দেখে কথাগুলো বলেছে। কিন্তু সাথী মনে মনে ভীষণ পুলকিত হলো। তাই আনন্দের আতিশয্যে ফাহিমকে বললো,
—-আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে ফাহিম ভাই।
ফাহিমও ভদ্রতা দেখিয়ে বলে,
—-তুমি খুবই মিষ্টি একটা মেয়ে।
সাথী ফাহিমকে কথাগুলো যদিও ঠাট্টা করে বলেনি কিন্তু ফাহিম ঠাট্রা মশকরা হিসাবেই ধরে নিয়েছে। সেসময় পাশদিয়ে একটা সিএনজি যাচ্ছিলো। সেটাকে থামিয়ে ফাহিম সোলেমান সাহেব আর সাথীকে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে আসলো।

সাথী চলে যাওয়াতে দিতির ফুফুশাশুড়ী মনে মনে ভীষণ খুশী হলেন। উনি সাথীকে খুব একটা পছন্দ করেন না। উনি দিতির মাকেও চিনতেন। কারণ সোলেমান আর আকরামরা কালকিনি থানায় একই গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন। সোলেমান আর আকরাম বাল্যকালের বন্ধু। সোলেমানের বউটা পাশের গ্রামের মিয়া পরিবারের মেয়ে। দেখতে অনেকটা দিতির মতোই ছিলো। দিতির জন্মের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে নিহার বানু মারা যায়। এরপর সোলেমান আর বিয়ে করতে চায়নি। বউটাকে সোলেমান
খুব ভালবাসতো। যাই হোক দিতির জন্য সোলেমান পরে আবার বিয়ে করে। কিন্তু বাস্তবে মেয়েটার কপালে মায়ের আদর জুটেনি। অপরদিকে সাথী আর ওর মা সবসময় এই অসহায় মেয়েটার পিছনে লেগে থাকে। এগুলো সবই উনি জানেন।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে