#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
সাথী দিতির ফুফু শাশুড়ীর সাথেই শুয়েছে। বুড়িতো শোয়া মাত্রই নাক ডাকতে শুরু করেছে। ভেবেছিলো দিতির মামে কিছু কথা উনার কাছে বলবে। কিন্তু সেই সুযোগটা আর হলো না। অবশ্য দিতির টেনশনে ওর চোখেও ঘুম আসছিলো না। হোক বোনের জামাই তাতে কি? ওর তো প্রথম ক্রাশ। ভালোলাগার পুরুষ। কি জানি দিতি কি করছে ওর প্রেমিক পুরুষের সাথে? এই ভাবনায় দুচোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছে। বোনের স্বামীর উপর চোখ পড়েছে বলে সমাজ সংসারে নানাজনে নানা কথা বলবে। এটা নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যথা নেই। এখানে ও এক ঢিলে দুটো পাখি মারবে। দিতির ঘর ভাঙ্গবে আর ভালোবাসার মানুষটাকে সম্পূর্ণ নিজের করে নিবে। কেনই বা নিবে না।জন্মের পর থেকে দেখেছে বাবা দিতিকে সবসময় চোখে হারায়। দাদীমা ওকে আগলে রাখে। এজন্য ও দিতিকে একদম সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া দিতি ওর মায়ের মতো হয়েছে। পাঁচ ফুট ছ’ ইঞ্চি লম্বা, ছিপছিপে গড়ন ফর্সা গায়ের রং,ভাসা ভাসা দুটি চোখ আর কোমর ছাপানো চুল। ও জানে, দিতি ওর থেকে সুন্দর। তারপরও কিছু আত্মীয় স্বজন বাসায় এসে ওর রুপের প্রশংসায় মত্ত থাকবে। অপরদিকে সাথীর গড়ন মাঝারি,গায়ের রং শ্যামলা, ওর চুলগুলো কোঁকড়া দেখতে যে ও খুব খারাপ তা নয়। কিন্তু ওর বডিলয়াঙ্গুয়েজের ধরণটা ভালো না। তারউপর কূটনামীর স্বভাব তো আছে। ছোটোবেলা থেকে দিতির পিছনে লেগে থেকে কূটনামী বুদ্ধি ভালোই রপ্ত করেছে। ওর এসব স্বভাবের কথা ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজনরা ভালোই জানে। সেই কারনে ওরাও সাথীকে এড়িয়ে চলে। আর সাথীরও সেই সব আত্মীয় স্বজনদের দেখলে খারাপ ব্যবহার করে। পাশাপাশি ও দিতিকেও সহ্য করতে পারে না।
ভোরের দিকে সাথীর দু,চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসলো। হঠাৎ ফোনটা আর্তনাদ করে বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রীনে দাদী নামটা দেখে ওর মাথার চাঁদি গরম হয়ে গেল। মনে মনে বললো,বুড়িটা আমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিবে না। পাশে তাকিয়ে দেখে দিতির ফুফু শাশুড়ী বিছানায় নেই। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই দিতির ফুফু শাশুড়ী ওয়াশরুম থেকে ওজু করে বের হয়ে আসলো। সাথী রুমের ভিতর কথা না বলে দরজা খুলে নীচের হলরুমে চলে এসে চারপাশটা ভালো করে দেখে বললো,
—বুড়ি তুমি আমাকে শান্তিতে একটু ঘুমাতেও দিবে না? কি ভাবছো আমি এখানে বসে তোমার পেয়ারে নাতনির সংসার ভাঙ্গছি? আর যদি ভাঙ্গতে চাই তুমি কি বাঁধা দিয়ে রাখতে পারবা?
—-এ তোর কেমন কথার ছিরি! বোন হয়ে কেন তুই বোনের সংসার ভাঙ্গতে যাবি। দেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে যে বোনের স্বামী নিয়ে টানাটানি করবি। নাকি কোনো ছেলে তোরে বউ করে নিতে চায় না?
সাথীর মেজাজটা বিগড়ে গেল। ফোনে ধমক দিতে গিয়ে তাকিয়ে দেখে আকরাম সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। নিজেকে সামলে আকরাম সাহেবকে শুনিয়ে খুব মিষ্টি করে বললো,
—-এখন ফোন রাখলাম দাদীমা।
আকরাম সাহেবকে দেখে সাথী বললো,
—-আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তোমার বুঝি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস।
—–জ্বী আঙ্কেল। সকালে উঠে নামাজ পড়ে বাড়ির সবাইকে চা দেওয়া আমার রোজকার অভ্যাস। এই দাদী ফোন দিয়ে বললো,আমি বাসায় নেই দেখে দাদীকে এখন কে চা বানিয়ে দিবে? ফজরের নামাজ পড়ার পর আমার আর বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় না।
—-বাহ্ এই বয়সে এটা আয়ত্ব করে নিয়েছো। খুব পূন্যের কাজ। এখনকার ছেলেমেয়েরা রাত জেগে কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে ওদিকে দেরী করে ঘুম থেকে উঠে। দাদী বুঝি খুব আদর করে তাই না? অনেক ভাগ্যবতী তোমরা দু,বোন, দাদীর আদর পাও।
—দাদী অবশ্য আপুর থেকে আমাকেই বেশী ভালোবাসেন।
—-তুমি ছোটো সে কারনে তোমাকে তো একটু বেশী ভালোবাসবে।
এমনসময় এ বাড়ির অ্যাসিসটেন্ট মিনা খালা এসে আকরাম সাহেবকে বলে,
—-খালু আপনারে চা দিবো?
—-নাহ্ ফাহিম আর বউমা ঘুম থেকে উঠুক তারপর একসাথে চা খাবো।
আকরাম সাহেবের কথা শুনে সাথী মনে মনে বললো,” বুড়ো আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। এতোদিন তো বউমা ছাড়াই চা খেয়েছো। আজ বউমার আগে আমার সাথে চা খেলে সমস্যা কি। বলা যায় না আমিও তো আপনার বউমার জায়গাটা দখল করে নিতে পারি।”
সাথীকে মিনা খালার খুব একটা ভালো লাগেনি। উনি জানেন সাথী দিতির সৎবোন। ফাহিমের বউটাকে উনার ভালোই লেগেছে। জন্মের পর মাকে হারিয়েছে। সৎ মা তো সৎ মাই। তাছাড়া এরকম সমত্ত মেয়ে বউয়ের সাথে আসাটা উনার খুব একটা ভালো লাগেনি। উনি যতটুকু জানেন বউয়ের সাথে খাটের বুড়ি হিসাবে দাদী নানীরাই আসে। উনার আবার একটা খারাপ অভ্যাস আছে। আড়ি পেতে উনি সবার কথা শোনেন। তাই ফার্ণিচার মোছার ছুতায় সাথীর কথাগুলো কর্ণ কুহরে নিতে লাগলেন।
—-আঙ্কেল শোনেন ছোটো বলে নয়, আমি বাড়ির সবার কথা শুনি বলে সবাই আমাকে আপুর থেকে বেশী ভালোবাসে। আপুতো বরাবর নিজের মতো চলে। লেখাপড়াটাও ঠিকমতো করতো না। এইজন্য তো সাতসকালে আব্বু বিয়ে দিয়ে দিলো। তাছাড়া আপুর কিছু সমস্যাও আছে। সারারাত ফোনে ছেলে বন্ধুদের সাথে গল্প করে এদিকে সকালে দেরী করে ঘুম থেকে উঠে। এটা নিয়ে বাসায় নিত্য ক্যাঁচাল লেগেই থাকতো। তাছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ানো তার একটা স্বভাব।আঙ্কেল আপনি আব্বুর ছোটোবেলার বন্ধু। তাই আপন ভেবে ঘরের কথা কিছু বলে ফেললাম। আপনি আবার কিছু মনে করলেন নাতো?
আকরাম সাহেব কি বলবেন বুঝে পেলেন না। মনে মনে ভাবলেন,মা,মরা মেয়েটাকে মায়া দেখাতে গিয়ে নিজের ছেলের আবার ক্ষতি করে বসলেন নাতো? এমনসময় মিনা খালার দিকে চোখ পড়তেই উনি একটু চমকে উঠলেন। কারণ এতোক্ষণ যা কথা হয়েছে সব নিশ্চয় উনার অন্তরে গেঁথে গিয়েছে। একটু বিরক্ত হয়ে মিনা খালাকে বললেন,
—-এতো সকালে তোমাকে ফার্ণিচার মুছতে কে বলেছে?যাও কিচেনে গিয়ে চায়ের পানি চুলায় চাপিয়ে দাও।
এমনসময় দিতি আর ফাহিম সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো। দিতি আকরাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,
—বাবা, আসসালামু আলাইকুম।
—-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুমিও তো দেখি বেশ সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েছো।
—হা বাবা,আমি প্রতিদিন খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠি। দাদীর সাথে একরুমে থাকি। সেকারনে ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে দাদী আর আব্বুকে চা বানিয়ে দেই।আমি কিচেনে গিয়ে আপনাদের সবার জন্য চা বানিয়ে আনছি।
এরপর দিতি সাথীর দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হেসে বললো,
—-কিরে সাথী, সুর্য আজকে কোনদিকে উঠলো? তুই আজ এতো সকালে উঠে পড়েছিস?
দিতির কথা শুনে ও একটু থতমত খেলো। এতোক্ষণ তো সব মিথ্যা কথা আকরাম সাহেবকে বানিয়ে বলেছে। এঝন ধরা পড়ার ভয়ে বললো,
—-আঙ্কেল,আমি আপনাদের ছাদটা একটু ঘুরে আসি।
একথা বলে সাথী ছাদে চলে গেল।
আকরাম সাহেব দু’বোনের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। ভাবতে লাগলেন, ছেলের বিয়ে দিতে গিয়ে এ কোন গোলক ধাঁধায় উনি পড়লেন। দিতি কিচেনে চা বানাতে চলে গেল। এর মাঝে দিতির ফুফু শাশুড়ীও নীচে চলে আসলেন। ফাহিম পাশে বসে মোবাইলে মেইলগুলো চেক করতে লাগলো। বোনের যেহেতু জহুরীর চোখ তাই নিজের ভিতরের অস্বস্তি কমাতে বোনকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—-বউ তোমার কেমন লাগলো?
একগাল হেসে বললেন,
—-বউ খুব ভালো হয়েছে। তবে ওর বোনটা সুবিধাজনক নয়। সারারাত মোবাইলে খুটখাট করলো। সেই আলোতে আমার ঘুমটা ভালো হয়নি। আবার সাত সকালে কে যেন ফোন দিয়েছে? ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
এরমাঝে দিতি চা আর পাকোড়া নিয়ে আসলো। বিয়ের পরদিন কিচেনে ঢুকতে দেখে ফুফু শাশুড়ী বললেন,
—-তুমি কেন আজ কিচেনে ঢুকতে গেলে? মিনাতো ভালোই চা বানায়।
—-আপা সব বাবা বানিয়েছে। আমি শুধু নিয়ে আসলাম।
দিতির ব্যবহারে মিনা খালা খুব খুশী। মনে মনে বললো, “আহা বউটা আমারে কি সম্মান দিয়া কথা কইলো,চোখে আমার পানি আইসা গেল। আমারে নিতে দিলো না। নিজেই সব রেডী করে নিয়া গেল।”
সবার হাতে চা তুলে দিয়ে বোনকে ডাকতে দিতি ছাদে চলে গেল। সাথী তখন ছাদে বসে ফেসবুক ক্রল করছে। দিতি ওর সামনে গিয়ে বললো,
—-সাথী, নীচে চল,চা খাবি না?
সাথী ওর আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখলো। চুলগুলো ভেজা। এখনো চুলের গোড়া দিয়ে পানি পড়ছে। পিঠের কাছে আঁচলটা ভিজে রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
—-সারারাত বুঝি ফাহিমভাই তোকে খুব আদর করেছে। একা একাই বরের আদর খেলি।
সাথী ওকে হিংসা করে এটা দিতি জানে। কিন্তু ও প্রকাশ করে না। কারণ হিংসেটা ছাইচাপা আগুন হয়ে আপাতত থাক। প্রকাশ করলে যদি দাঁউ দাঁউ করে জ্বলতে থাকে। তখন হয়তো সবকিছু পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে। তাই বলে বোনের স্বামীকে নিয়ে সাথী এ ধরনের কথা বলবে এটা দিতির মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সাথীকে বুঝতে না দিয়ে বললো,
—আমি তো ফাহিমের কলেমা পড়া বউ। সেকারনে ওর আদর তো আমার একার খাওয়ার কথা তাই না? নীচে চল,সবাই অপেক্ষা করছে।
দিতির কথা শুনে সাথী মনে মনে বললো,
“তোমাকে তো সুখে শান্তিতে সংসার করতে দিবো না।”
চলবে