#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
সাথী চলে যাবার পর দিতির একটু ভয় ভয় করছিলো। আসলে ফাহিমের সাথে ওর অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছে। যদিও আজকাল বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে লাভ ম্যারেজে বিশ্বাসী। কিন্তু দিতির কাছে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজটাকেই ভালো লাগে। তবে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে ফাহিম ওকে ফোন দেয়নি বলে ও একটু অবাক হয়েছে। দিতির একবার ফোন দিতে ইচ্ছা হয়েছিলো। কিন্তু মায়ের জন্য দেয়নি। সাথী জানতে পারলে মাকে জানিয়ে দিতো। তখন এটা নিয়ে বাড়িতে মা নানা অশান্তির সৃষ্টি করতো। দিতির এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু মা ওকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে চাইছে। দিতির কারনে মেয়ে সাথীর ভবিষ্যত নিয়ে মা খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। অথচ দিতির বাবা সোলেমান সাহেব দুই মেয়েকে সমান ভালোবাসেন। সেই ছোটোবেলা থেকে খেলনা, জামা, গল্পের বই থেকে শুরু করে যা কিছুই কিনেন না কেন দুজনের জন্যই কিনে আনেন। জন্মের পর থেকে মায়ের আদর পায়নি বলে বড়মেয়েটাকে একটু বেশী চোখে হারান। এটাই সাথীর মা সহ্য করতে পারেন না। মুখে হয়তো কিছু বলেন না তবে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে বুঝিয়ে দেন।
বছরখানিক আগের কথা। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে।ভর্তি কোচিং শুরু করেছে। কোচিং সেন্টারটা বাসার কাছেই ছিলো। ও হেঁটেই আসা যাওয়া করতো। একদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে কিছু ছেলে ওর পিছনে হেঁটে আসে আর নানা রকম নোংরা মন্তব্য করে। বেসুরো গলায় হিন্দী গান গাইতে থাকে। তখন ওর মা রিকশা করে বাড়ি ফিরছিলো। পথে এই দৃশ্য দেখে ওর মা সেদিন দিতির বাবাকে বলেছিলো,
—-তুমি দিতিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দাও। তা,না হলে কবে যে তোমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিবে তার কোনো ঠিক নাই।
বাবা রেগে গিয়ে সালেহা বেগমকে বলেছিলো,
—-আর যাই করো সালেহা,আমার দিতি মায়ের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করবে না।
দিতি ভাবে,মানুষের মন কিভাবে এতো নোংরা হয়। ওর মা তখন মোবাইল বের করে ওর বাবাকে ছবি দেখিয়েছিলো। ছবিটা এমনভাবে তুলেছিলো দেখে মনে হচ্ছে দিতি ঐ ছেলেগুলোর সাথে হাঁটছে। মা,বাবার পাশের রুমেই দিতি আর সাথী থাকতো। তাই নিজের ঘর থেকেই ওর বাবা মায়ের সব কথাই শুনতে পেলো। অথচ এতে দিতির কোনো দোষ ছিলো না। দেখতে সুন্দরী ছিলো বলে প্রায়ই ওকে এ ধরনের ঘটনার স্বীকার হতে হতো। এসব নানা কথা ভেবে বাবাকে নিশ্চিন্ত রাখতে দিতি অবশেষে বিয়েতে রাজী হয়। দাদীমাও ওকে বলেছিলো,
—-যতো তাড়াতাড়ি পারিস বিয়ে করে স্বামীর সংসারটাকে আপন করে নে। এভাবে হিংসার অনলে নিজেকে আর পোড়াস নে। আমার বয়স হয়েছে। কবে দুম করে মরে যাবো তার কোনো ঠিক নেই। তখন কে তোকে চোখে চোখে রাখবে?
ফাহিম নাকি ওকে না দেখেই বিয়েতে রাজী হয়েছে। তবুও দিতির বাবা বন্ধু আকরামকে বলেছিলো,
—–বন্ধু তোমার ছেলেকে নিয়ে এসো। ওরা দুজনা দুজনকে দেখুক। আজকালকার যুগের ছেলেমেয়ে দেখেশুনে বিয়ে করুক। যাতে তুমি আর আমি কোনো দোষের ভাগিদার না হই।
ফাহিম যেদিন দেখতে আসে দিতি একপলক ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলো। সেকারনে চেহারাটাও আবছা মনে আছে। বিয়ের আসরে ওদের আবার দেখা হলো। লজ্জা সঙ্কোচের আড়ষ্টতায় ভালো করে ফাহিমের দিকে তাকাতে পারছিলো না। দিতি ভাবছে ফাহিম যদি বিয়ের আগে ওর সাথে ফোনে কথা বলতো তাহলে আজকে দুজনের রসায়নটা একটু স্বাভাবিক হতো।
অনেকক্ষণ বসে থেকে পা দুটো ব্যথা হয়ে আছে। আসলে বউ হতে গেলেও অনেক কষ্ট করতে হয়। সারাদিন সেজেগুজে বসে থাকা, সমস্ত আত্মীয়স্বজনের সাথে হাসিমুখে কথা বলা,ফটোশুট করা এসব করতে গিয়ে দিতির খুব ক্লান্ত লাগছে। ও বিছানা থেকে নেমে পুরো রুমটাতে চোখ বুলাতে লাগলো। বেশ পরিপাটি করে গুছানো। রুমের সাথে একটা এটাচ বাথ আছে। একটা বড় খাট,ড্রেসিং টেবিল একটা ডিভান আর একটা আলমারী রয়েছে। খাটের পাশে একটা সাইট টেবিল রয়েছে। ফার্ণিচার গুলো মনে হয় সেট করে কেনা হয়েছে। রুমের ভিতরে একটা দরজা আছে। দিতি দরজাটা খুলে দেখে ওপাশে একটা বিশাল ব্যলকনি রয়েছে। ওখানে নানা ধরনের ফুলের গাছ রয়েছে। ওর নাকে একটা পরিচিত ফুলের মিষ্টি সুবাস এসে লাগলো। পরে মনে হলো এতো হাসনাহেনার সুবাস। ব্যালকনিতে একটা দোলনা রয়েছে। দিতি গিয়ে দোলনাটায় বসে আস্তে আস্তে দোল খেতে লাগলো। হঠাৎ বারান্দার স্পট লাইটটা জ্বলে উঠলো। সামনে শেরওয়ানি আর পাগড়ী পরে একজন তামিল নায়ক দাঁড়িয়ে আছে। পুরো মুখে তার ছড়িয়ে আছে অপরুপ স্নিগ্ধতা। এখানে তো কেউ নেই যে ওকে বেহায়া বলবে। তাই ও ওর বরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
—আপনি এখানে,আর আমি আপনাকে সারা ঘর খুঁজে বেড়াতে লাগলাম।
—-আমি তো ব্যালকনিতে ছিলাম।
—-তা বুঝবো কি করে? দরজাটাতো ভিজিয়ে রেখেছিলেন। ভাবলাম বউয়ের বুঝি জামাই পছন্দ হয়নি। তাই বাসর না করেই মনে হয় পালিয়ে গেল।
দিতি মনে মনে ভাবলো মানুষটার বেশ রসবোধ আছে। ও নিজের দৃষ্টিটা নামিয়ে নিলো। লোকটা ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে তা ও ভালোই বুঝতে পারছে। লোকটাকে একটু বেকায়দায় ফেলতে মজা করে ও বললো,
—অমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখছেন?
—-আমার লালপরীটাকে দেখছি। যে আমাকে আমৃত্যু ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখবে।
দিতি মনে মনে ভাবছে মানুষটা বড্ড নির্লজ্জ। তাই প্রসঙ্গ এড়াতে বললো,
—-আপনার বারান্দাটা বেশ সুন্দর। তবে একটা ময়না পাখি পুষে খাঁচায় রাখলে আরো ভালো লাগতো। বারান্দায় বসে ময়না পাখিটার সাথে গল্প করা যেতো।
ফাহিম হেঁটে হেঁটে দিতির একদম কাছে চলে আসলো। ওর বুকের ধুকপুকানি বাড়তে লাগলো। দিতির কানের কাছে মুখটা এনে বললো
—-ভালোবেসে একটা ময়না পাখি আজ আমার ঘরে এনেছি। আপনি দেখেননি? দিবানিশি শয়নে স্বপনে তার সাথে গল্প করবো। সুখ দুঃখকে ভাগাভাগি করে নিবো।
এইকথাগুলো বলে ফাহিম মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। কথাগুলো শুনতে দিতির খুব ভালো লাগলো। কিন্তু একরাশ লজ্জার অবগুন্ঠনে নিজেকে ঢেকে দিতে মন চাইলো। মাথা নিচু করে দোলনায় বসে রইলো। দিতির অবস্থা ফাহিম হয়তো বুঝতে পেরেছে। সে কারনে ওকে বললো,
—- ব্যালকনিতে দোলনায় বসে কি বাসর রাত পার করবেন? এতো সুন্দর করে সাজানো বাসর খাটটা তো কষ্ট পাবে। এখন তো অক্টোবর মাস। আর একটু রাত বাড়লে ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করবে। তখন আবার ঠান্ডা লাগলে আমার দোষ হবে। ঘরে চলুন।
দিতি ফাহিমের পিছু পিছু ঘরে এসে খাটের কোনায় বসলো। ফাহিম ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
—-লেহেঙ্গা চেইঞ্জ করে একটা আরামদায়ক পোশাক পরে নিন। ঐ আলমারীতে শাড়ি সালোয়ার কামিজ ম্যাক্সি সব রাখা আছে। আপনার যেটা ভালো লাগে সেটা নিয়ে নিন।
দিতি একটা সালোয়ার কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। দিতির দাদী বলে দিয়েছিলো বাসর রাতে ওরা দুজনে মিলে একসাথে যেন দুরাকআত নফল নামাজ পড়ে নেয়। তাই ড্রেস চেইঞ্জ করে দিতি ওজু করে আসলো। ফাহিমকে বললো ওজু করে আসতে।
দুজনে এশার নামাজ আদায় করে নিয়ে একসাথে দুরাকআত নফল নামাজ আদায় করলো। একবিছানায় ফাহিমের সাথে ঘুমাতে দিতির খুব অস্বস্তি হচ্ছে। ফাহিম হয়তো দিতির সমস্যা কিছুটা আঁচ করছিলো। সে কারনে ওকে বললো,
—-আপনার সমস্যা হলে আমি ডিভানে শুয়ে পড়বো। আমার সমস্যা হবে না।
ছ’ফুটের মতো লম্বা মানুষটা ডিভানে কিভাবে ঘুমাবে? তাই দিতি আস্তে করে বললো,
—না,আমার সমস্যা হবে না।
দুজনে খাটের দুই পাশে এমনভাবে শুয়ে পড়লো মাঝখানে অনায়াসে আর একজন ঘুমাতে পারবে। খুব ভোরে দিতির ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলতেই দেখে ফাহিম ওর মুখপানে তাকিয়ে আছে। দিতির চোখে চোখ পড়তেই ফাহিম মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
—-এরকম মুখের দিকে তাকিয়ে শতবর্ষ অনায়াসে পার করে দেওয়া যায়।
চলবে