#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব- এগারো
মাহবুবা বিথী
ওসির কথা শুনে দিতি সাথীকে ছেড়ে ফাহিমের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
—-ওসি সাহেব এখনও কিন্তু প্রমানিত হয় নাই আমার স্বামীই অপরাধী। সুতরাং আপনি আমার স্বামীকে দোষী সাবাস্ত করতে পারেন না।
ওসি সাহেব চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
—+দরজা বন্ধ করে আপনার স্বামী কি সতী সাদ্ধি হিসাবে আপনার বোনকে সাজিয়ে রেখেছেন? এসব কথা আমার সামনে বলতে আসবেন না। যেখানে আপনার বোন স্বাক্ষী দিলো আপনার স্বামী ওকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। সেখানে একজন রেপিস্টের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে আপনার লজ্জা করে না?
—+না করে না। কারণ একজন স্ত্রী একমাত্র বলতে পারে তার স্বামী কেমন চরিত্রের মানুষ। আর আমার বোনের কথা বলছেন তো? ও হচ্ছে মানসিক রোগী। সুতরাং ওর কথা বিশ্বাস করে একজন নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দিলে হাশরের ময়দানে আল্লাহপাকের কাছে আপনি কি জবাব দিবেন?
—+থাক, আপনাকে আর মানুষ চেনাতে হবে না। এই সব চোর ছ্যাচ্ছড় আর গুন্ডা বদমাশ নিয়ে আমরা সর্বক্ষণ কাজ করি। সুতরাং মানুষ আমরা ভালোই চিনি। কথায় আছে না চোরের মায়ের গলা বড়। আপনার অবস্থা হয়েছে ঐরকম।
ওসির কথা শেষ হওয়া মাত্রই সাথী চিৎকার দিয়ে বললো,
—-তোমার স্বামী আমাকে অসম্মান করা সত্বেও তুমি তোমার স্বামীর হয়ে কথা বলছো। বলবেই তো,কারণ সৎ কখনও আপন হয় না।
—এটা তোর ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য।
—-আপনারা চুপ করুন। আমাদেরকে কাজ করতে দিন।
ওসির ধমক শুনে ওরা দু’জন আপাতত চুপ করলো। তবে
দিতির কথাগুলো শোনার পর ফাহিম প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলো। এতোক্ষণ ও যেন একটা দমবন্ধ পরিবেশে ছিলো। ওর মনে হয়েছিলো দিতি মনে হয় ওকে সাপোর্টে করবে না। ওর কথাগুলো শোনার পর ফাহিম নিজেকে খুব হালকা অনুভব করলো। এবং একটু একটু করে সাহস বাড়তে শুরু করলো। সেই সাহসে ভর দিয়ে ও দিতিকে বললো,
—-তোমার ফোন থেকে আব্বুকে একটা কল দাও না। প্লিজ,
—-কি বলবো?
—+এখানে আসতে বলো।
—-আমার বোনের এরকম কর্মকান্ডে আমি বাবাকে কিভাবে মুখ দেখাবো?
—-সময়ের উপর ছেড়ে দাও।
দিতিকে ফাহিমের সাথে স্বাভাবিক কথা বলতে দেখে সাথী দৌড়ে এসে বললো,
—-আমি বুঝে পাই না ঐ রেপিস্টের সাথে তোমার কি এমন কথা থাকতে পারে? ওকে তোমার এখনিই ডিভোর্স দেওয়া উচিত।
সাথীর কথা শুনে দিতি কষে ওর গালে থাপ্পর বসিয়ে দিলো। দিতির এক থাপ্পড়ে ও ডিগবাজী খেয়ে পড়ে যেতেই ওর বাবা এসে সাথীকে ধরে ফেললো। সোলেমান সাহেবের সাথে দিতির দাদীও চলে এসেছে। মা মরা নাতনীটার এই বিপদে উনি আর বাসায় থাকতে পারলেন না। সাথীকে ধরে সোলেমান সাহেব দিতির দিকে তাকিয়ে বললো,
—-নিজের ছোটো বোনের উপর এ তোমার কেমন ব্যবহার?
—–তোমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করো ও আমার কতো বড় ক্ষতি করেছে। আমারতো ওকে খুন করতে ইচ্ছা করছে। ও ফাহিমের নামে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে আমার সংসারটা ভাঙ্গতে চাইছে।
দিতির দাদী সাথীর দিকে তেড়ে গিয়ে বললো,
—-ফোনে কিছুটা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম এই শয়তানী কিছু একটা ঘাপলা পাকিয়েছে। আজ তোকে বাড়ি নিয়ে শয়তানের আছর আমি তাড়াবো।
দিতির থাপ্পড়ের চাপটা কোনো রকমে সয়ে নিয়ে সাথী ওর বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে নিজের গালে হাত বুলিয়ে ভাবলো,আপুটার এতো পরিবর্তন কবে হলো। জন্মের পর থেকে আজ অবধি ওর গায়ে একটা ফুলের টোকাও দেয় নাই। সেই বোন আজকে ওকে আঘাত করলো। তবে ও ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। মিথ্যা স্বাক্ষী দিয়ে হলেও ফাহিমকে ও জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে।
ওসি সাহেব উনাদের সবার বক্তব্য শুনে বললো,
—-কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যা বলছে সেটা আদালতে প্রমান হবে। এখন আপনারা আপনাদের মজলিশ বন্ধ করুন। আমাকে আসামীকে নিয়ে যেতে দিন।
ওসি কনস্টেবলকে ফাহিমের হাতে হাতকড়া পড়াতে বললো। দিতি দৌড়ে এসে ওসি সাহেবকে বললো,
—ওসি সাহেব ওকে থানায় নিবেন না। এটা আমাদের পরিবারের বিষয়। আমরা নিজেরা মিটিয়ে নিবো।
—-তা হয় না। আপনি আমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করবেন না। আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দিন।
এরপর দিতিও কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-তাহলে আমার স্বামীর সাথে আমাকেও নিয়ে যান।
সাথী দিতির কথাগুলো শুনে মনে মনে বললো,
—+ঢঙ্গির ঢং দেখে আর বাঁচি না। আর জামাইয়ের সুখ পেতে হবে না। এবার তোর স্বামী জেলের ভিতর পঁচে মরবে। তুই দেখবি আর হাহুতাশ করবি। আর কিছুই করতে পারবি না। এতোদিনে আমার মনের জ্বালাটা জুড়ালো।
আমেনা বেগম এসে দিতির পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
—–আল্লাহর রহমতে তোর কিছুই হবে না। তবে ওর কি হাল হবে সেটা শীঘ্রই বুঝতে পারবি।
সোলেমানসাহেব মা আর দুই মেয়ের কাহিনী দেখে তব্দা খেয়ে গেলেন। উনার কার পাশে দাঁড়ানো উচিত উনি বুঝতে পারছেন না।
ওসি সাহেব ফাহিমের হাতে হাতকড়া পরিয়ে উনাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। দিতিও কান্নাকাটি করে একটা সিএনজি ঠিক করে থানার দিকে রওয়ানা দিলো। দিতির সাথে ওর দাদীও রওয়ানা দিলো। সোলেমান সাহেব আরো একটা সিএনজি ভাড়া করে সাথীকে নিয়ে থানার পথে রওয়ানা দিলেন। দিতি এর মধ্যে ওর শ্বশুরকে ফোনে কিছুটা বললো। এবং উনাকে থানায় আসতে বললো। থানায় পৌঁছে সাথী ওসির কাছে মিথ্যা জবানবন্দী দিলো। আকরাম সাহেব বিদ্ধস্ত অবস্থায় থানায় আসলেন। দিতি ওর শ্বশুরকে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-বাবা আপনি যেভাবেই হোক ওর জামিন করানোর ব্যবস্থা করুন।
আকরাম সাহেব দিতিকে বললেন,
—- বিপদে ধৈর্য ধরতে হয়। তাহলে খুব সহজে বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এরপর বন্ধু সোলেমানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-আমার ছেলেকে আমি খুব ভালো করে চিনি। কিন্তু সাথী আজ যে কাজটা করলো এটা পরবর্তীতে ওর জীবনের উপর খারাপ প্রভাব ফেলবে।
সোলেমান সাহেবের আসলে বন্ধুকে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলেন না। নীরবে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কারণ ফাহিম বলেছে সাথী ওকে ডেকে এনেছে। আর সাথী বলেছে ও এখানে বেড়াতে আসছে বলে এমনি কুশলাদি জিজ্ঞাসা করার জন্য ফাহিমকে ফোন দিয়েছিলো। আর অমনি ফাহিম এসে ওর সাথে এই আচরণ করেছে। জন্মদিনের পার্টি করার কথা বলে সাথীর দু’জন বন্ধু এসে শেষ মুহুর্তে স্বাক্ষী দিলো। ওদের একজনের নাম রোশান আর একজনের নাম জারা। এতে ফাহিমের বিপদ আরো একটু বাড়লো। যদিও এদের দু’জনকে দিতি আজই প্রথম দেখলো। এও শুনলো কোচিং সেন্টারেই ওদের সাথে সাথীর বন্ধুত্ব হয়েছে।
এসব কথা শুনে আকরাম সাহেবের তার বন্ধু সোলেমানের জন্য খুব মন খারাপ হলো। সংসারের শাম্তির জন্য দিন রাত এক করে অর্থ উপার্জন করে গেছে। কিন্তু এদিকে সংসারে যে ঘুণ পোকা লেগে গিয়েছে তা ওর নজরে আসেনি। দিতির বিয়ের পরদিন সাথীর সাথে কথা বলে আকরাম সাহেবের সাথীকে খুব একটা পছন্দ হয়নি। তবে দিতির দাদী এসে আকরাম সাহেবকে বললেন,
—-চিন্তা করোনা বাবা,তোমার ছেলের কিছুই হবে না। বরং হিংসার বশবর্তী হয়ে বোনের সংসার ডুবাতে গিয়ে ঐ মেয়ে নিজের চরিত্রে কলঙ্ক লাগিয়ে ফেলেছে। সেই হুশ তো ওর এখন নাই। যখন হুশ ফিরবে তখন দেখবে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। আর এই কলঙ্কের দাগ ওকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
সাথী ওর মনের জ্বালা জুড়িয়ে ওর বাবা আর দাদীর সাথে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো। এদিকে রাত হয়ে যাওয়াতে কোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে আজকে আর জামিনের ব্যবস্থা করা গেল না। তবে আকরাম সাহেব জানেন এই মামলায় সহজে ফাহিমের জামিন হবে না। মনে মনে ভাবলেন নিজের শখ মেটাতে গিয়ে ছেলেটাকে উনি বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন। এই বিপদ থেকে ছেলেটা কবে উদ্ধার পাবে কে জানে? দিতি কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরের সাথে বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।
নিয়ম অনুযায়ী ফাহিমকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। অপরাধ প্রমানিত না হলে তাকে সসম্মানে চাকরিটা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এদিকে দিতির বাবার বাড়ির সাথে খুব একটা সম্পর্ক নেই। আদালতে মামলা চলছে। সোলেমান সাহেব সাথীকে মামলাটা উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু সাথীর মা সালেহা বেগম বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সাথীও ওর আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আকরাম সাহেব মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তবে দিতির মা হওয়ার খবর পেয়ে মানসিক শক্তি মনে হয় কিছুটা ফিরে পেলেন।
এরমাঝে ছ’মাস পার হয়ে যায়। সাথী পাবলিক কোনো ভার্সিটিতে চান্স না পেয়ে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। রোশান আগে থেকেই ব্রাকে পড়তো। সাথীর থেকে দু’বছরের সিনিয়র। জারার মাধ্যমে রোশানের সাথে সাথীর বন্ধুত্ব হয়। রোশানের বাবা একজন নামিদামী বিজনেসম্যান। ওরা অনেক বড়লোক। আর রোশানও হচ্ছে প্লেবয় টাইপের ছেলে। ও সাথীকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো। সাথী তখন ওকে একটা শর্ত দেয়। শর্ত অনুযায়ী রোশান ফাহিমকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়। এখন শর্ত অনুযায়ী ও সাথীর সাথে সম্পর্কে জড়াতে চায়। কিন্তু সাথী এক্ষেত্রে বুদ্ধি খাটায়। রোশানকে হাতছাড়া করতে চায় না। ওর ধারণা প্রেম করে যদি রোশান ওকে ছ্যাঁকা দিয়ে চলে যায়। সে কারনে ওকে বিয়ে করতে বলে। এতে রোশান একটু বিরক্ত হয়। কেননা ওতো সেই ধরনের ছেলেই নয়। কারণ ও পোশাক বদলানোর মতো করে প্রেমিকা বদলায়।
চলবে