#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী
সাথী ফোনটা রাখার পর ফাহিম আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে কোনো রকমে গায়ে প্যান্ট শার্ট পরে নিয়ে একটা সিএনজি নিয়ে পদ্মা রিসোর্টের দিকে রওয়ানা হলো। পরে মনে হলো পুলিশ সাথে নিয়ে রওয়ানা দিলে ভালো হতো। কিন্তু ওসব ফর্মালিটিস করতে গেলে দেরী হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। এতে সাথীর অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এর থেকে বরং আগে ঘটনাস্থলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে। কিন্তু ফোন তো করাই যায়। পকেটে হাত দিয়ে দেখে ফোনটা আনা হয়নি।কি আর করা। ভাবছে আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছে সাথীকে উদ্ধার করতে হবে। ঘন্টাখানিকের মধ্যে ফাহিম রিসোর্টে পৌঁছে যায়। সাথীর নির্দেশিত কটেজের সামনে গিয়ে ও কোনো হট্টগোল কিংবা মাস্তানটাইপের কাউকে দেখতে পায়নি। ও একটু অবাক হলো। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। ফাহিম একটু ভয় পেয়ে গেল। ভাবলো,ওকে আবার ওরা তুলে নিয়ে গেলো নাতো? সাথী যেভাবে ফোনে ওকে বললো তাতে এখানে বেশ ঝামেলা হওয়ার কথা। কটেজের সামনে গিয়ে দরজা নক করতেই সাথী দরজা খুলে হাসিমুখে ফাহিমকে আমন্ত্রণ জানালো। তখনও ফাহিম জানে না ওর জন্য আজকে কি দিন অপেক্ষা করছে। ফাহিম রুমে ঢুকে সাথীকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-তুমি ফোনে যা বললে তার কিছুই তো আমি দেখতে পেলাম না?এদিকে দিতি রওয়ানা দিয়েছে। ডরমেটরীতে এসে আমাকে না পেলে চিন্তা করবে।
সাথী ফিঁচেল হাসি দিয়ে বললো,
—+ডরমেটরীতে যাওয়ার দরকার নেই। ওকে এখানে আসতে বলে দেই। একটু পরেই একটা নাটক মঞ্চস্থ হবে।
—-কি বলছো এসব? এতো রহস্য করে কথা বলা আমার পছন্দ না। সবকিছু খুলে বলো।
—–এতো তাড়া কিসের! আস্তে আস্তে সবই বলবো।
একথা বলে সাথী মিটমিট করে হাসতে লাগলো। এরমাঝে দিতিকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে পদ্মা রিসোর্টে আসতে বলে দিলো। সাথে সাথে এটাও জানিয়ে দিলো রিসোর্টে না আসলে ও ফাহিমের খারাপ চরিত্রের মুখোশটা দেখতে পারবে না। ফাহিমের কাছে সাথীর আচরণ একদম স্বাভাবিক লাগছে না।এরমধ্যে সাথী দরজা লাগিয়ে দিয়ে ফাহিমকে শক্ত জড়িয়ে ধরে বললো,
—+আপনি আপুকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করুন। আমি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না। তাই কৌশল করে আপনাকে ডেকে আনলাম।
ফাহিম ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
—+এসব তুমি কি বলছো? আমার দ্বারা কোনোদিন একাজ করা সম্ভব নয়। আমি দিতিকে ভালোবাসি।
সাথী আহত বাঘিনীর মতো ক্ষেপে গিয়ে বললো,
—মাই ফুট ভালোবাসা। আপুর মাঝে যা আছে আমার মাঝেও তাই আছে। বরং আমি একদম কচি ডাবের শাঁস। আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে দেখেন আপনার আর আমাকে ছাড়তে মন চাইবে না।
একথা বলেই সাথী টান দিয়ে ওর জামার বুকের অংশ ছিঁড়ে ফেললো। ফাহিম ওর পাগলামী দেখে রেগে গিয়ে বললো,
—-তুমি একটা সাইকোপ্যাথ। তা,না হলে কেউ নিজের বোনের স্বামীর সাথে এমন আচরণ করতে পারে না।
ফাহিমের কথা শুনে সাথী তেঁতে উঠে বললো,
—-এখনও সময় আছে আপনি আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যান। তা,না হলে আপনার জন্য খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। আর একটা অপশন আপনার জন্য বরাদ্দ আছে।
—-কি,
—-আমাকে বিয়ে করতে হবে না। শুধু আপনার বউকে তালাক দিলেই হবে।
—এ অন্যায় আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়।
—+তাহলে আর কি?জেলের ভাত খাওয়ার জন্য তৈরী হোন। তখন এমনিতেই আপনার বউ আপনাকে ডিভোর্স দিবে। আর যাই হোক একজন চরিত্রহীন লম্পট চরিত্রের মানুষের সাথে আমার বোন ঘর করবে না।
ফাহিম ওর কান্ডকারখানা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
—তুমি পাগলের মতো আচরণ কেন করছো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি শান্ত হও।
আবারও খ্যাক খ্যাক করে বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো,
—-আমাকে শান্ত হতে হবে না। আমার প্রস্তাবে রাজি না হলে আপনিই চিরজনমের মতো শান্ত হয়ে যাবেন।
ফাহিম রেগে গিয়ে বললো,
—-আমার পক্ষে তোমার এ প্রস্তাব মানা কিছুতেই সম্ভব নয়। এতে তোমার যা খুশি করতে পারো।
এরপর সাথী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে লাগলো। হোটেলের বয় বেয়াড়া ছুটে এসে দরজা নক করতে লাগলো। সাথী ওদের সাড়া পেয়ে চিৎকার করে বললো,
—-আপনি দুলাভাই হয়ে আমার এতোবড় সর্বনাশ করবেন না। আমি আপনার পায়ে পড়ছি।
এরপর নিজের চুলটা এলোমেলো করে দৌঁড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো। ততক্ষনে রিসোর্টের ম্যানেজার চলে এসেছে। সাথীকে দেখে বললো,
—আপনি তো আজ সকালে এসেছেন?এখানে তো জন্মদিনের পার্টি হওয়ার কথা?
সাথী কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—-জ্বী,
এরপর ফাহিমের দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার বললো,
—-উনি কে?
—-আমার বোনের হাজব্যান্ড।
—-উনি এখানে কেন?
—-উনি আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে একজন। আমার বোনও পথে আছে। কিন্তু উনি রুমে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বেডে শুইয়ে দিলো। আমি বাঁধা দেওয়াতে দেখেন আমার জামা কাপড় সব ছিঁড়ে ফেলেছে। এর আগেও আরো দু’বার চেষ্টা করেছিলো। কপাল গুনে বেঁচে গিয়েছিলাম।
এরপর হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে সাথী বললো,
—-আপনারা পুলিশে খবর দেন। এই রেপিস্টটাকে ধরে নিয়ে উচিত শিক্ষা দেওয়া উচিত।
একথা বলে আবারও কাঁদতে শুরু করলো। সাথীর আচরনে ফাহিম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। সাথীর সাথে তো ওর কোনো শত্রুতার সম্পর্ক তৈরী হয়নি। তাহলে ও এমন কেন করলো? ও কি করবে বুঝে পাচ্ছে না। ম্যানেজারকে কিছু বলতে চাইলে উনি বলেন,
—-আপনার যা বলা দরকার সেটা পুলিশের সামনেই বলবেন।
সাথীর ব্যবহারে ফাহিম প্রচন্ড ধাক্কা খেলো। আজ অবধি ওর জীবনে এতো বড় ধাক্কা আসেনি। বিপদ যখন আসে সবদিক থেকে আসে। আজ ফোনটাও আনতে ভুলে গেছে। ওর মনে হচ্ছে পায়ের তলার মাটিটা সরে যাচ্ছে। ও যতটুকু দিতিকে দেখেছে, সাথীকে ও খুব ভালোবাসে। সেক্ষেত্রে ওর কথা বিশ্বাস না করে যদি সাথীর কথা বিশ্বাস করে ভুল বুঝে দূরে সরে যায় তাহলে এতো অপমান নিয়ে ওর পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। অপরদিকে নারী নির্যাতন আর শিশু আইনে মামলা হলে জামিন তো হবেই না বরং চাকরি থেকে ওকে আপাতত সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। এরপর ডিপার্টমেন্টাল মামলা রজু করা হবে। ও জানে সামনে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে। ওদিকে ওর আব্বা এই ধাক্কা কিভাবে সামলাবেন ফাহিমের জানা নেই। ও ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। এবং হাত পা ছড়িয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে অপ্রকৃস্থিতের মতো বসে রইলো।
সাথী এর মাঝে ওর বাবাকে এখবর জানিয়ে দিলো। ওর বাবার এতোক্ষনে চলে আসার কথা। ফাহিমের অবস্থা দেখে মনে মনে কুটিল হাসি হেসে বললো,
—-বললাম বউটাকে ছেড়ে দে। আমার কথা শুনতে ভালো লাগলো না। এখন বুঝ ঠ্যালা।
এরমাঝে দিতি আর পুলিশ চলে আসলো। দিতিকে দেখা মাত্রই সাথী দৌড়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আর বললো,
—-আর একটু সময় পেলে ঐ রেপিস্টটা আমার সর্বনাশ করে ফেলতো।
সাথীর কথা শুনে দিতি ফাহিমের দিকে তাকালো। ফাহিম ও দিতির চোখের পানে তাকিয়ে ইশারায় বুঝাতে চাইলো, সাথী যা বলছে সব মিথ্যা বলছে। দিতিও ফাহিমের চোখে কোনো পাপ দেখতে পায়নি। কারণ ফাহিম ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো। পাপ করলে মানুষ কারো চোখের দিকে তাকাতে পারে না। লৌহজং থানার ওসি ফাহিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আপনাকে তো ভালো মানুষ বলেই জানতাম।
ফাহিম রেগে গিয়ে ওসিকে বললো,
—-আপনি পুরো ঘটনা না জেনে এসব কি বলছেন?
—-জ্বি ঠিকই বলছি। যাদের ভিতরটা নোংরা তারাই উপরে উপরে খুব ভালো মানুষি দেখায়।
ফাহিম বুঝতে পারছে, এই ওসি তার পুরোনো শোধ তুলবে। একবার ওর কাছে এক সন্ত্রাসীর জামিনের জন্য সুপারিশ করেছিলো। ফাহিম যেন জামিন দেয় সেজন্য কিছু টাকাও অফার করেছিলো। ফাহিম তো টাকা নেয়নি উল্টো ঐ সন্ত্রাসীর জামিনও দেয়নি। আজ যখন ফাহিমকে বাগে পেয়েছে তখনতো ওকে নাকানি চুবানি খাইয়ে তারপর ছাড়বে।
চলবে