#ধারাবাহিক গল্প
#জীবনের গোপন ডাকবাক্স।
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী
দিতি আর সাথী দুবোন। তবে একই মায়ের পেটের নয়। দিতির জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। সেই থেকে দাদী আর বাবা ওকে আগলে রাখতো। কিন্তু দিতির বয়স যখন একবছর সবে তখন হাঁটতে শিখেছে। সারাদিন এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াতো। পাশাপাশি ও খুব চঞ্চল ছিলো। তাই ওর দাদীর পক্ষে ওকে সামলে রাখা কঠিন হয়ে যায়। উনার আবার আর্থারাইটিসের সমস্যা আছে। দিতির পিছনে সারাক্ষণ ছুটতে গিয়ে ব্যথাটা বেড়ে যায়। ওদিকে দিতির বাবাও খুব একটা সময় দিতে পারে না। তাই এক ছুটিরদিন সকালে নাস্তা করার সময় দিতির দাদী ছেলেকে বলেন,
—-বাবা,বুড়ো মাকে আর কতোদিন কষ্ট দিবি? আমার পক্ষে এই বয়সে তোর মেয়েটাকে সামলানো কঠিন হয়ে যায়।
—-,তা,আমাকে কি করতে বলো। অফিস ফেলে এখন ওকে আমাকেই দেখাশোনা করতে হবে?
—-বাবা আমি কি তোকে তাই বলেছি?
—-একটা ফুলটাইম কাজের খালা রেখে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।
—-তা যায়। তবে সেতো ঐ কাজের খালাই হবে তাই না? মা তো হতে পারবে না। দিতির জন্য একজন মায়ের খুব দরকার।
—–এই কাজটা আমাকে করতে বলো না মা। তাছাড়া এক গাছের ছাল আর এক গাছে কখনও জোড়া লাগে না। বরং জটিলতা বাড়ে।
—-বাবা, তুই আমার উপর এ বিষয়টা ছেড়ে দে। দেখে শুনে এমন মেয়ে আনবো যে আমার দিদি ভাইকে মাথায় করে রাখবে। তাছাড়া এভাবে তো জীবন চলতে পারে না। তোর ও তো পুরোটা জীবন পড়ে আছে।
মায়ের পিড়াপীড়িতে দিতির বাবা সোলেমান সাহেব আর না,করতে পারলেন না। অবশেষে বিয়েতে মত দিলেন।
দিতির দাদী নিজের দূরসম্পর্কের খালাতো বোনের মেয়ে সালেহাকে নিজের ছেলের বউ করে আনলেন। দিতির নতুন মা সালেহা বেগম এ বাড়িতে বউ হয়ে এসে সানন্দে দিতিকে কোলে তুলে নিলেন। সন্তান স্নেহে মেয়েটাকে লালন পালন করতে লাগলেন। এটা দেখে সোলেমান সাহেব দিতির নতুন মাকে ভালোবাসতে শুরু করলেন।কিন্ত বছরখানিক পর যখন সাথীর জন্ম হয় সেই থেকে দিতির প্রতি একটু একটু করে সালেহা বেগম অবহেলা শুরু করলো। সোলেমান সাহেব কর্পোরেট সেক্টরে জব করেন। সকালে যান সন্ধায় আসেন। সে কারনে দিতির প্রতি ওর নতুন মায়ের অবহেলা উনার চোখে পড়েনি। দিতির দাদী চোখে বিষয়টা ধরা পড়েছে। কিন্তু ছেলের কানে তোলার সাহস হয়নি। কারণ ছেলে তো আগেই বলেছিলো,এক গাছের ছাল কখনও আর এক গাছে জোড়া লাগে না। তাই দিতিকে উনি নিজের কাছেই রাখেন। দিতি দেখতে ওর মায়ের মতো হয়েছে। অপূর্ব সুন্দরী। আর তেমনি মেধাবী। বাবার কাছ থেকে মেধাটা পেয়েছে। অপরদিকে সাথী দেখতে ওর মায়ের মতো হয়েছে। মুখের গড়ন খারাপ না তবে গায়ের রঙ শ্যামলা। আর লেখাপড়াতে মোটামুটি। দিতির মতো অতটা মেধাবী নয়।
মা না থাকাতে দাদীর আদর পুরোটাই দিতির কপালে জোটে। ছোটোবেলা থেকে সাথী এই বিষয়টা লক্ষ্য করেছে। এমনকি ওর এটাও মনে হতো বাবাও দিতিকে বেশী ভালোবাসে। সেই কারনে বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দিতিকে হিংসা করতে শুরু করে। তবে দিতি ওকে খুব ভালোবাসতো। দিতির জন্য কোনোকিছু ওর বাবা হাতে করে আনলে সেটা সাথী দিতিকে দিতো না। যেমন দুজনের জন্য হয়তো দুটো জামা এনেছে। সাথী নিজের জামাটা রেখে দিতিরটাই পছন্দ করতো। দিতিও হাসিমুখে দিয়ে দিতো। এভাবে পাশাপাশি দুবোন বড় হতে থাকে। দিতি যখন অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে তখন সোলেমান সাহেবের বন্ধু আকরাম খাঁ দিতিকে নিজের ছেলের পুত্রবধু হিসাবে পছন্দ করে। কিন্তু দিতি বিয়ে করতে চায় না। ও পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু বাবা সোলেমান সাহেব দিতিকে বুঝিয়ে বলেন,
—-দিতি মা আমার,আমি আকরামের সাথে কথা বলেছি। তুই বিয়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবি। তোর যতদূর পড়তে মন চায় ওরা তোকে ততদূর পড়াবে। আর একটা কথা, ফাহিমের মতো ছেলে হয় না। বাবা মায়ের বাধ্যগত সন্তান। এবছর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ম্যাজিস্টেট হিসাবে মুন্সিগঞ্জে জয়েন করেছে। তুই আর অমত করিস না মা।
দিতির আর অমত করেনি। অবশেষে ফাহিমের সাথে দিতির বিয়ে হয়ে যায়। সালেহা বেগমও চেয়েছিলেন এই বোঝা দ্রুত ঘাড় থেকে নেমে যাক। উনার ধারনা দিতির কারনে সাথী পরিপূর্ণভাবে বাবার আদর পায় না। কিন্তু সাথীর হলো সমস্যা। বিয়ের আসরে বর ফাহিমকে দেখে ওর মনে হয় এই মানুষটাকেই ওর জীবনে খুব প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে পথের কাঁটা দিতিকে সরিয়ে দিতে ও দ্বিধা বোধ করবে না।
বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতস শেষ করে দিতি যখন ফাহিমের সাথে শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা দেয় তখন সাথী অনেক কান্নাকাটি করে। যদিও পুরোটা ওর অভিনয় ছিলো। হাপুস নয়নে ওকে কাঁদতে দেখে দিতির শ্বশুর আকরাম বন্ধু সোলেমানকে বললেন,
—-তোর যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে সাথীও আমাদের সাথে গিয়ে ক’টাদিন থেকে আসুক। এতে দিতিরও সময়টা ভালো কাটবে।
এতে দিতির দাদী বাঁধা দেয়। কিন্তু সাথীর ও বাড়িতে যাওয়ার আগ্রহের কারনে এ বাঁধা আর ধোপে টিকে না। তবে সাথীর মা সালেহা বেগমের নিরবতা দেখে দিতির দাদী অস্বস্তি বেড়ে যায়। মা মেয়েতে কি ফন্দি আঁটছে কে জানে? মাতৃহারা মেয়েটা যেন বরে ঘরে সুখে থাকে দিতির বিদায় বেলায় পরমকরুণাময় আল্লাহপাকের কাছে উনি এই দোয়া করতে থাকেন।
দিতিট শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে সাথী চোখ আরো বেশী টাটাতে থাকে। অনেকটা জায়গা জুড়ে তিনতলা বাড়ি। সামনে বিশাল বড় গেট। সাভারের গেন্ডা এলাকায় দিতির শ্বশুর বাড়ি। গেটের কাছে গাড়ির হর্ণ শোনা মাত্রই দারোয়ান এসে গেট খুলে দেয়। দিতির শাশুড়ী মা বেঁচে নেই। বছরখানিক আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। ফাহিম ওর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বউকে বরণ করে ঘরে তোলার জন্য আকরাম সাহেব তার বড় বোনকে নিয়ে এসেছেন। উনি বিয়ে বাড়িতে যাননি। কারণ ঘর দোর গুছানো, ফাহিমের বাসর খাট সাজানো, রাতের রান্না এসব নানাবিধ দায়িত্বের কারনে উনি বিয়ে বাড়িতে যাননি। বউকে বরণ করার জন্য উনি অপেক্ষা করছেন। দিতি আর ফাহিম হেঁটে এসে নীচের হলঘরের সামনে দাঁড়ালে উনি মিষ্টি আর শরবত খাইয়ে নতুন বর বউকে ঘরে তুলে নেন। এরপর দিতির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে বলেন,
—আকরাম তোর পছন্দ আছে বলতে হবে। দেখেশুনে একটা পরীকে তুই তোর ছেলের বউ করে এনেছিস।
দিতির শ্বশুর খুশীতে ডগমগ হয়ে বোনকে বললেন,
—-বউ তোমার পছন্দ হয়েছে আপা?
—-কি বলিস এমন মায়াকাড়া চেহারার মানুষটাকে পছন্দ না করে কি থাকা যায়।
দিতির প্রতি এতো প্রশংসা বাক্য শুনে সাথীর শরীরটা জ্বলতে থাকে। তাই সামনে এসে দিতির ফুফু শাশুড়ীকে সালাম দিয়ে বলে,
—-ফুফী আমি সাথী। আপনার বউমার ছোটো বোন।
সালামের উত্তর দিয়ে দিতির ফুফু শাশুড়ী অবাক হয়ে মনে মনে ভাবছেন,
—-দিতির বাবা মায়ের এ কেমন আক্কেলবুদ্ধি। এরকম একজন সোমত্ত মেয়েকে কি করে ওরা পাঠালো।
মনে মনে অসন্তষ্ট হলেও দিতির ফুফুশাশুড়ী বর বউকে বরণ করে ঘরে তুলেন। সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে দিতিকে বাসর ঘরে পৌঁছে দেন। সাথীও এসে দিতির সাথে বাসর খাটে বসে। ঐ রুমেই বসে দিতি আর সাথী ডিনার করপ নেয়। এদিকে ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা ছুয়েছে। সাথীর ঐরুম থেকে বের হওয়ার কোনো নামগন্ধ নেই। সেদিকে তাকিয়ে দিতির ফুফু শাশুড়ী প্রচন্ড বলে বিরক্ত হন। এবং সাথীকে ডেকে পাঠান। অনিচ্ছা সত্বেও সাথী দিতির বাসর ঘর থেকে বের হয়ে ফুফুশাশুড়ীর কাছে এসে বলে,
—-ফুফু আমায় ডেকেছেন?
চলবে