‘আম্মু, আয়ান ভাত খায়।’
দু চুলায় দুটো রান্না বসানো অন্যমনস্ক আমি মনের ভুলে শোনা কথা ভেবে রান্নায় আবার মনোযোগ দেই। আমার পাঁচ বছরের ছেলে আয়ান আর আমি ছাড়া বাসায় এখন কেউ নেই। কাজেই এটা অবশ্যই আমার মনের ভুল। কারণ এতোগুলো বছরেও আয়ান আমাকে আম্মু বলে ডাকেনি। আর আমি শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধু ঐ একটা কথাই ভাবি আর সৃষ্টিকর্তাকে বলি আমার এক জীবনের করা সব পুণ্যের বিনিময়েও যেন আমার ছেলেটা একবার আমায় আম্মু বলে ডাকে। যেদিন প্রথম জানি আমার একমাত্র ছেলে আয়ানের মাথায় কোথাও একটা ঝামেলা আছে সেদিন থেকে অন্যমনস্কতা আমার সঙ্গী। কিন্তু আরো একবার ঐ বাক্য পেছন থেকে শোনার সাথে সাথে আমি চমকে ঘুরে তাকাই।
– কি বললি বাবা, আরেকবার বল? আর একবার।
পেটে হাত দেখিয়ে আমার আয়ান বলে উঠে, ‘আম্মু আয়ান ভাত খায়।’
আয়ানকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠি আমি আর পাগলের মতো বলতে থাকি, আরেকবার বল বাবা, আরেকবার বল।
………………..
স্কুল কলেজে আমার অবস্থান সবসময়ই ছিল প্রথম সারিতে। এমনকি মেডিকেল কলেজেও। আমি ছিলাম আমার অনেক বন্ধুর ঈর্ষার কারণ। পড়ালেখা এতো সহজ বা এতো সহজেই পরীক্ষায় বসলেই ভালো ফলাফল করা যায় তার একটা জীবন্ত উদাহরণ ছিলাম আমি। ইন্টার্নশীপের পরপর এক চান্সে এফসিপিএস পার্ট ওয়ান আর বিসিএস হয়ে যাওয়া যেন তারই অবধারিত ফলাফল। কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় আমি এতোটা কঠিনভাবে আটকে যাবো তা যে ছিল আমার কল্পনারও অতীত।
সার্জন হবো এমনই ছিল আমার জীবনের স্বপ্ন। সার্জারী ট্রেনিংয়ের কঠিন সময় শেষ করে এনে মাত্রই এফসিপিএস দ্বিতীয় পত্রের জন্য পড়তে বসার ভাবনা চলছিলো, আমার জীবনে আয়ানের উপস্থিতি ঠিক সে সময়ে। পরীক্ষার আছে ছয় মাস, কি করবো এই ভেবে যখন আমি দিশেহারা আমার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকে পাশে এসে দাঁড়ায় তারা আমার বাচ্চার যত্ন নেবে। আমি যেন শুধু সামনে আসা পরীক্ষাটা বাদ দেই নয়তো বাচ্চা হওয়ার সময় আর পরীক্ষা যে একেবারে মুখোমুখি। একটা জীবন নিজের হাতে নষ্ট করবো? তাছাড়া একটা বাচ্চা হওয়াও যে এখন জরুরী, বয়সও তো হয়ে যাচ্ছে।
অন্য কেউ বা নিজের কাছের কেউ আমার বাচ্চা পেলে দেবে এর মতো হাস্যকর ভাবনা আমাদের সমাজে প্রচলিত থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ কতটা সম্ভব তা বোধ করি কোন মায়েরই অজানা নয়। আমিই বা তার থেকে বাদ পরি কি করে? বাচ্চা হলো, নিজের যত্ন, দেড় বছর পর্যন্ত বাচ্চার যত্ন নিতে নিতে কিভাবে যেন সময়টাই পেরিয়ে গেলো আর আমার পরীক্ষা আমার ক্যারিয়ার সব কেবল অধরাই রয়ে গেল। আয়ান যখন একটু একটু করে হাঁটতে শুরু করে তখন আবার আমি বইখাতা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া শুরু করি। দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে বইয়েরা, আমার ছুরি কাঁচিরাও যেন আমাকে ভুলে গিয়েছিল।তবু একটু একটু করে নিজেকে অনেকটাই মানিয়ে নিচ্ছিলাম।
মানুষের স্বভাব হচ্ছে নিজের কাছাকাছি অন্যদের সাথে কখনো মনে মনে কখনো বা প্রকাশ্যে নিজের সাথে তুলনা করা। একদিন এক কলিগের দু বছরের বাচ্চাকে দেখে ভীষণ খটকা লাগে আমার মাথায়। সেই বাচ্চা কি সুন্দর করে নিজের মা কে ডাকছে, এটা ওটা চাইছে। কই আমার আয়ানতো কিছু বিচ্ছিন্ন শব্দ ছাড়া কোন কথাই বলেনা আমাদের সাথে। এমন কি আমাকে এখন পর্যন্ত একবার মা বলেও ডাকেনি। আমার বরকে আমার মনের কথা বলাতে সে হেসেই উড়িয়ে দেয় আয়ান এখনো অনেক ছোট বলে। কিন্তু নিজে ডাক্তার বলেই হয়তো নিজের মনের খটকা দূর হয়না। অন্যান্য কলিগদের বাচ্চাদের কথা জানতে চাই, নিজেও কিছু পড়াশোনা করতে শুরু করি। আর দিনে দিনে বুঝতে পারি আমার ধারনাই সত্যি। আমার দিনদিন করে লালন করা নিজের সত্ত্বার অংশটুকু আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতো নয়। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরে।
আমার পড়ালেখা, ক্যারিয়ার, বড় সার্জন হওয়ার স্বপ্ন সব, সব কিছু বড় তুচ্ছ মনে হয় আমার ছেলের মুখ থেকে শুধু মা ডাকটুকু শোনার জন্য। আমি নিজে কখনো কোন পরীক্ষাকে ভয় পাইনি। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম পরীক্ষায় আমার নিত্য হেরে যাবার ভয় আমাকে ভেতরে ভেতরে পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিতে থাকে দিন দিন। শিশু বিশেষজ্ঞ, মনোবিদ, স্পিচ থেরাপিস্ট এদের পেছনে দৌড়ে কাটে আমার দিন আর রাত কাটে জায়নামাজে প্রার্থনায়, হে আমার রব আমার ছেলেটাকে অন্তত এই কঠিন পৃথিবীতে টিকে থাকার মতো শব্দগুলো বলার সুযোগ দিন। আয়ানের কোন যথোপযুক্ত ডায়াগনোসিস করতে না পেরে ডাক্তার ওর সমস্যার গালভরা একটা নাম দেয়, স্পেসিফিক লার্নিং ডিফিকাল্টি।
দিন যায়, মাস যায় আমার ছেলে একটু একটু করে শব্দ শেখে। কিন্তু কোন বাক্য বানাতে পারেনা। মনের ভাব প্রকাশ করতে যেয়ে উল্টোপাল্টা শব্দের প্রয়োগে গড়া সে বাক্য কোন অর্থ বহন করেনা। বরং বাড়িয়ে দেয় আমার ভেতরের উৎকন্ঠা। বাইরের পৃথিবী যে বড় কঠিন। ঐ পৃথিবীতে নিত্য লোকের হাসির খোরাক হয়ে কিভাবে টিকে থাকবে আমার ছোট্ট বাচ্চাটা? ডাক্তারী চিকিৎসার পাশাপাশি ঝাঁড় ফুঁক, তাবিজ কবচ কিছুই বাদ পরেনা।
আয়ানের এমন অবস্থা দেখে কাছের দূরের কত লোকে কত কি বলে? বাচ্চাকে সময় দেইনি, বেশী বয়সে বাচ্চা তাই এমন, আগের কোন পাপের কারণে এমন হয়েছে আরো কত কথা। অথচ লোকে একবারও ভেবে দেখেনা একটা স্পেশাল শিশুর মা হওয়ার কষ্টের ওপরে তাদের কথাগুলো আরো কত ভারী বোঝা হয়ে যায় ঐ মা মতান্তরে ঐ পুরো পরিবারটির জন্য। দিনে দিনে গুটিয়ে নেই সবকিছু থেকে নিজেকে। লোকের না বুঝে বলা কথার ভার যে সময়ে সময়ে ছেলের কথা না বলার চেয়েও বড় বেশী মনে হতো।
তারপর একদিন নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করি। আমি জীবনে কখনো কোন পরীক্ষায় হেরে যাইনি জীবনের এই কঠিনতম পরীক্ষারও আমি শেষ দেখে ছাড়বো। নিজের সমস্ত প্রয়োজন, আকাঙ্খা, স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে ছেলের পেছনে সময় দিতে শুরু করি যতোটা সম্ভব। প্রতিদিন একটু একটু করে একটা দুটো শব্দ, পুরো সপ্তাহ ধরে একটা করে বাক্য আর তার বারবার চর্চা করাতে থাকি নিজে নিজে।পাশাপাশি ফলো করি শিশুবিদ আর মনোবিদের দেয়া সব পরামর্শ।
আজ আমার ছেলে যখন তার প্রয়োজনটুকু এলোমেলো শব্দে করা বাক্যে আর হাতের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে আমায় বুঝিয়ে দিতে পারে আমার মনে হয় এই কঠিন পৃথিবীতে টিকে থাকার প্রথম পদক্ষেপটুকু সে যেন এইমাত্র আমার সামনে দিয়ে ফেলল। আর সাথে বলা আম্মু শব্দটা, আমার গত দুটো বছরের পরিশ্রমের ফলটুকু যেন হাতেনাতে দিয়ে দিল। আজ যে আমার তাই হারিযে ফেলা নিজেকে খুঁজে পাওয়ার দিন। কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলতে পারলাম, তুই জিতে গেলেই যে মা ও জিতে যাই বাবা। আজ আমাদের দুজনেরই যে জিতে যাওয়ার দিনের শুরু।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস