জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০৫

0
1321

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৫ম পর্ব
~মিহি

শুভ্র ড্রাইভ করছে। রুদ্ধ অনেকক্ষণ ড্রাইভ করে ক্লান্ত। পেছনের সীটে ঘুমোচ্ছে সে। এখনো অর্ধেক রাস্তা পার করা বাকি। এত দূরে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? মাঝেমধ্যেই দ্বন্দ্বে পড়ে যাচ্ছে শুভ্র। তনয়া আর প্রেমাকে নিয়ে চিন্তাটা একটু বেশিই। তনয়ার মা শুভ্রকে অনেক বেশি ভরসা করেন। নিজের ছেলের মতো যত্ন করেন তাকে। শুভ্রও তনয়াকে নিজের আপন বোনের মতো দেখে। তাই তনয়া আর প্রেমার সাবধানতাই মুখ্য। প্রেমা একমনে ফোন স্ক্রল করছে।

-“এত ফোন টিপিস না। সাতদিনের জন্য চার্জ জমায়ে রাখ।”

-“কেন? ওখানে কি চার্জিং পয়েন্ট নাই?”

-“ইলেকট্রিসিটিই আছে কিনা সন্দেহ। তার চেয়ে বড় কথা নেটওয়ার্কও পাবি বলে মনে হয় না। সেজন্য ফোনটা সাতদিনের জন্য জীবিত রাখ।”

-“দেশে আসার পর থেকে বাবার সাথে কথা হয়নি। একবার কথা বলে নিই।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

প্রেমার মা মারা গেছে বছর তিনেক আগে। মূলত মা মারা যাওয়ার পরপরই তার এই শহরের উপর থেকে মন উঠে যায়। সেজন্যই সে পাড়ি জমায় বাবার কাছে, দূর অজানা শহরে। বাবার নম্বরে পরপর দু’বার কল করলো প্রেমা। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হলো না। বাধ্য হয়ে ফোন রেখে বসলো সে। অনেকটা সময় ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখায় এখন চোখ জ্বালা করছে তার। একটু না ঘুমালে হয়তো চোখ খুলতেই পারবে না।

-“এই শুভ্র, গাড়ি থামা। আমি একটু পেছনের সীটে যাবো। খুব ঘুম পাচ্ছে।”

-“আচ্ছা যা। রেহানকে বল সামনে আসতে।”

-“এই রেহান, সামনে আয় তো।”

শুভ্র গাড়ি থামালো। রেহান বসেছিল একেবারে সাইডে, মাঝখানে তনয়া আর অপর সাইডে রুদ্ধ। রেহান গাড়ি থেকে নামতেই তনয়াও নেমে পড়ে। তনয়াকে নামতে দেখে অবাক হয় প্রেমা।

-“কীরে তুই নামলি কেন?”

-“অনেকক্ষণ ধরে মাঝখানে বসে আছি। দমবন্ধ হয়ে আছে। আমি একটু জানালার ধারে বসবো।”

-“বাহ বাহ! আমি আসলাম আর জানালার ধারে বসতে ইচ্ছে হলো? এতক্ষণ কেন ইচ্ছে হয়নি? তোরা যে কী শুরু করছিস আমার সাথে! সবাই মিলে আমাকে পর করে দিছিস।”

-“ওরে ড্রামাকুইন রে! তুই তো আমাদের পর করে চলে গেছিস। তোর জন্য যে একজনের হৃদয় জমে জমে পাথর হয়ে গেছে তা যদি বুঝতি।”

-“এই এই! শেষের দিকে কী বিড়বিড় করলি? তোরা এত বিড়বিড় করিস কেন এখন? আগে তো এই বাজে অভ্যেস ছিল না।”

-“চুপচাপ বস, যা।”

প্রেমা মাঝখানে বসলো। রুদ্ধ জানালার সাথে হেলান দিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। শুভ্র সামনে থেকে মুচকি মুচকি হাসছে। প্রেমা পাশে বসতেই রুদ্ধ একবার চোখ টিপটিপ করে প্রেমাকে দেখে নিল। অতঃপর জানালার পরিবর্তে প্রেমার কাঁধে হেলান দিলো। প্রেমা ভেবেছে রুদ্ধ ঘুমের ঘোরে আছে। সে বকবক করতে লাগল,” আশি কিলোর বস্তা একটা! হেলান দেওয়ার জন্য আমার কাঁধটাই পাইলি রে ষাঁড়? উফফ! ঘাড়টা শেষ আমার। কোন চালের ভাত খায় আল্লাহ মালুম।” প্রেমার বকবক থামছেই না। রুদ্ধ সবটাই শুনছে আর মনে মনে ফুঁসছে। মনে মনে বলছে,”একবার খালি হাতের নাগালে আইসো বান্ধবী, তোমারে দিয়া দশ ডজন কাপড় ধুয়ে নিব।” তবে রুদ্ধর যে খুব খারাপ লাগছে তা না। বন্ধু হিসেবে হয়তো এই কাঁধে বহুবার মাথা রেখেছে সে কিন্তু একতরফা প্রেমিক হিসেবে এই অনুভূতিটা মারাত্মক। হৃদস্পন্দনের গতিটা যেন ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। রুদ্ধ আবছাভাবে শুনতে পারছে নিজের হৃদস্পন্দনের ধুকধুক শব্দটা। আচ্ছা, প্রেমা কি অনুভব করছে তার হৃদস্পন্দনের এই ঊর্ধ্বগতি? রুদ্ধর বন্ধ চোখে প্রেমার মায়াবী মুখটা ভাসছে। বন্ধুত্বটা দীর্ঘদিনের অথচ ভালোবাসার অনুভূতিগুলো মাত্র কয়েক বছরের। রুদ্ধর ভালোবাসার ভাগ্যটা বড্ড খারাপ। যখনই সে প্রেমাকে একটু একটু করে ভালোবাসতে শুরু করলো ঠিক সে সময়টাতেই প্রেমা উড়াল দিল, তাও হঠাৎ করে। প্রেমার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে বড্ড সময় লেগেছিল তার কিন্তু সে কি আদৌ মানতে পেরেছিল? পারেনি। প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্ত প্রেমার স্মৃতিতে ডুব-সাঁতার কেটেছে সে।

_______________________________________________________________________________________________

-“ভাই ওবায়দুর, অনেকক্ষণ তো ড্রাইভ করলা, এখন আমারে চালাইতে দেও।”

-“সামনের হাইওয়েটা পার করেই দিচ্ছি। সম্ভবত আর আড়াই-তিন ঘণ্টার পথ বাকি।”

-“তোমার মেয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না?”

-“মেয়ের কথা মনে পড়ে বলেই তো এসব করছি।”

-“মানে?”

-“আমার মেয়ের বয়স বারো যখন আমার স্ত্রী আমাকে ফেলে চলে যায়। ছোটখাটো কাজ করতাম। মেয়ে সারাদিন বাসায় একা। একদিন বাড়িতে ঢুকে দেখি সারা মেঝে রক্তাক্ত। ঘরের ভেতর ঢুকতেই দেখি আমার বাচ্চা মেয়েটার মাথা একপাশে, শরীর অন্যপাশে। সারা মেঝে রক্ত লাল। পাগল হয়ে গেছিলাম। কত সময় পাগল ছিলাম জানা নাই। গুরুর সাথে দেখা। তিনি জানালেন আমি আমার মেয়েকে ফিরে পেতে পারি। সেজন্য এসব করছি। অশুভ শক্তি আমার চাই না, শুধু নিজের মেয়েটারে নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে চাই।”

-“আপনার লাইগা মন খারাপ করবো কিনা বুঝতেছি না। তবে গুরুর যথেষ্ট ক্ষমতা আছে বলে আমরা মানি। অবশ্য গুরুর ক্ষমতা আমরা স্বচক্ষে দেখি নাই। যাই হোক, গুরু হয়তো পারবেন তোমায় তোমার মেয়ে ফিরিয়ে দিতে।”

রাজন চুপ হয়ে যায়। তার এখন আর নিজেকে স্বাভাবিক মানুষ মনে হয় না। কোনো স্বাভাবিক মানুষ এত ঘৃণ্য কাজ করতেই পারে না। একটা মেয়ের বাবা হয়ে অন্য মেয়েকে বলির পাঠা বানানো কি কারো পক্ষে সম্ভব? এত নিচে কী করে নেমে গেল সে? নাহ! এসব ভাবলে চলবে না। মেয়েটা যত দ্রুত চিকন কালার বনের দিকে এগোবে,তত রাজনের সুবিধা। সহজেই মেয়েটাকে ধরাশায়ী করে ফেলা যাবে কিন্তু সমস্যা হলো মেয়েটার চার বন্ধু। ছেলে তিনটাকে কোনোভাবে অন্যদিকে সরানো গেলে চিন্তা থাকতো না। চিকন কালার বনে পৌঁছে সে ব্যবস্থাও করা যাবে। আপাতত এগোনো যাক।

-“রুদ্ধ, এই রুদ্ধ! উঠ না। কী মরার মতো ঘুমোচ্ছিস! আমার কাঁধ ব্যথা হয়ে গেল।”

-“আহ হা! জ্বালাস না তো, একটু আর।”

-“তুই উঠবি নাকি ঘুষি মারবো?”

-“দজ্জাল রে দজ্জাল! এমন মেয়ে যার ঘরের বউ হবে, তার কপাল তো পুড়ছে।”

-“তোর ঘরের বউ তো হচ্ছি না। উঠ!”

প্রেমার কথায় রুদ্ধ মুচকি হাসে। মনে মনে বলে,”হবে তো আমারই বউ। দরকার পড়লে এবার কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো।” রুদ্ধ উঠতে নিতেই হঠাৎ শার্টে টান লাগে। প্রেমার চুল রুদ্ধর শার্টের বাটনে আটকে আছে।

-“দেখ! তোর চুল অবধি আমাকে ছাড়তে চাইছে না আর তোর আমাকে দূরে সরানোর তাড়া!”

-“তোর শার্ট বেহায়া।”

প্রেমা চুল ছাড়াতে গিয়ে আরো প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে কিন্তু তাও সে রুদ্ধকে হাত লাগাতে দেবে না। এসব দেখে তনয়া, রেহান আর শুভ্র যে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেদিকেও খেয়াল নেই তার। সে একমনে চুল খুলতে ব্যস্ত। একসময় হাঁপিয়ে উঠে রাগ করে চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলে।

-“এই! প্রেমা, তুই আসলেই পাগল। পারছিস না যখন আমায় বললেই পারতি। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না।”

-“আমি কি করবো না করবো সেটা তোর থেকে কেন শোনা লাগবে?”

প্রেমা কথাটা মজা করে বললেও তা মোটেও ভাল্লাগেনি রুদ্ধর। প্রেমার মুখে কথাটা শোনার পর তার মুখ অনেকটাই মলিন হয়ে যায়। মলিন কণ্ঠে শুভ্রকে ডাকে সে।

-“এই শুভ্র, আমি ড্রাইভ করি এখন। তুই রেস্ট নে।”

-“আরে দরকার নেই।”

-“থামাতে বলছি, থামা।”

শুভ্রও বুঝতে পেরেছে ব্যপারটা। তর্কে না গিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিল সে। গাড়ি থেকে নেমে রুদ্ধকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বললো, “দেখ রুদ্ধ, প্রেমা মছা করে বলেছে। অন্যভাবে নিস না। সুযোগটা এভাবে ছেড়ে দিস না। ভেবে দেখ কিছুক্ষণ।”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে