জন্মদাতা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
80

#জন্মদাতা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_২(শেষ)

কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। সেই ভদ্রলোক আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে উনার বাড়ি যেতে বলতেন। ব্যস্ততায় সেটা সম্ভব হয়নি। গতকাল আমার চেম্বারে এসে এমনভাবে অনুরোধ করলেন সেই কথা আর ফেরাতে পারিনি। উনার মা-বাবা আর মৃতদের উপর উনি মিলাদ পড়াবেন, আমাকে যেতেই হবে। মাকে না জানিয়ে কিছু মিষ্টি আর ফলমূল কিনে উনার বাড়ি চলে আসলাম। দালান বাড়ি তবে বেশ পুরনো মনে হচ্ছে। রুমগুলো ও গোছানো। উনার মেয়ে স্ত্রী সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমায়। এমনভাবে সবাই আমায় আপ্যায়ন করল মনে হচ্ছে, আমি কোন মন্ত্রী।

সবাই যার যার কাছে ব্যস্ত। ভদ্রলোক আমার কাছে এসে বসলেন। গল্প করছেন। এক ফাঁকে আক্ষেপ করে বললেন, “যে ছেলের জন্য সব টাকা পয়সা খরচ করলাম। বড় চাকরি ধরিয়ে দিলাম। সে তার দাদা-দাদীর মিলাদ মাহফিলেও উপস্থিত হলো না৷ এমন অবাধ্য ছেলে যেন আর কারও ঘরে না হয়।” এইটুকুন বলে উনি উঠে দাড়ালেন। ওয়ারড্রবের ড্রয়ার থেকে একটা অ্যালবাম নিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন। খুব আগ্রহ করে প্রথমে উনার ছেলের ছবি দেখালেন। উনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসেন। এভাবে উনি উনার মা-বাবাসহ পরিবারের সবার ছবি একের পর এক দেখাতে লাগলেন। সবশেষে বহু পুরনো একটি ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল। ছবিটা পুরনো হলেও খুব যত্ন করে রাখা হয়েছে। ছবির চোখগুলো চকচক করছে এখনও। ছবিটা দেখামাত্র আমার ভেতর আত্মা শুকিয়ে আসছে একদম। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার মতো অবস্থা। ভদ্রলোক পলকহীন ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার কন্ঠস্বর ভারী হয়ে আসছে। কিছু বলার শক্তি পাচ্ছি না। নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইনি কে?”
আমতা আমতা করে জবাব দিলেন, “ও কিছু না মা। ছাড়ো।”
“বলুন না। সবার সাথে তো পরিচয় করালেন তাহলে ইনি বাধ যাবেন কেন! প্লিজ বলুন না ইনি কে?”

লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গম্ভীর হয়ে বললেন, “আসলে মা আমাদের কারও কারও জীবনে এমন ঘটনা ঘটে যায়, যা আমাদের বুকের জমিনে বড় পাথর হয়ে জমাট বেঁধে থাকে বছরের পর বছর। সেটা কাউকে বলতে পারি না আর বলার মতো নির্ভরযোগ্য মানুষ ও পাওয়া যায় না। আজ তুমি যখন জানতে চাইছো তোমাকে বলব। ভেতরে জমে থাকা পাথরটা আমি হালকা করতে চাই। জানিনা কেন মনে হচ্ছে তোমাকে সব বলা যায়। তোমাকে কেমন আপন আপন লাগছে।

আমি আমার জীবনের শুরুতে বড় একটা পাপ করে ফেলছি। যার মাশুল আজও দিয়ে যাচ্ছি তিলেতিলে।”
ধীর কন্ঠে করলাম, “ভুল কেন?”
“এই ছবিতে যাকে দেখতে পাচ্ছো, ইনি আমার প্রথম স্ত্রী।”
কথাটা আমার কানে বজ্রপাতের মতো শুনালো। আমি টের পাচ্ছি, আমার হাত পা কাঁপছে। উনাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “উনি এখন কোথায়? আপনার প্রথম স্ত্রী! ”
“জানিনা মা। অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোন খোজ পাইনি। তার সাথে আমার সংসার ছিলো তিন বছরের। প্রথমে আমরা খুব সুখেই ছিলাম। তারপর শুরু হলো নানান ঝামেলা। ঝামেলার মূল কারণ আমার মা-বাবা। তারা তাকে পছন্দ করতেন না। তার একমাত্র কারণ আমি নিজে তাকে পছন্দ করে বিয়ে করছিলাম। সবাই নানান ভাবে তার নামে বিভিন্ন কথা আমার কানে তুলতে লাগলো। একসময় তাদের কথা কানে তুলি। তখনই আমার স্ত্রীর সাথে বাধে ঝগড়া। একদিনও তার সাথে আমার ভালো কাটতো না। সে ছিল অন্যরকম। স্পষ্টবাদী আর প্রতিবাদী। কখনও কেউ অন্যায় কিছু বলে পার পেতো না। চট করেই তার প্রতিবাদ করতো। এইজন্য বেশিরভাগ মানুষ তাকে পছন্দ করতো না। একসময় আমার কাছেও এসব খারাপ লাগতে শুরু করল। ঝগড়া লাগলেই তাকে অপমান করতাম। তার আত্মসম্মান ছিলো প্রখর৷ তাতে আঘাত লাগলে সে সেটা সহ্য করে না। অপারগ হয়ে চলে গেল বাপের বাড়ি। তখন সে ছিলো পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা। আমার উচিত ছিলো তাকে দেখতে যাওয়া, খবর রাখা। কিন্তু আমি সেটা করিনি। আমার একটা মেয়ে হয়। মা-বাবা এই খবর শুনেই বলল, খবরদার আনতে যাবি না। ছেলে হলে এখনি আমরা নিয়ে আসতাম গিয়ে। মেয়ে দিয়ে করব কি! ঝুড়ি ঝুড়ি টাকা খরচ! আমিও ছেলের লোভে তাদের আর নিয়ে আসিনি।
তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়। দ্বিতীয় বিয়ে করি। একটা ছেলেও হয়। কত আদর যত্নে তারে মানুষ করি। কিন্তু সেই ছেলে বড় হয়ে চাকরি করে আমাদের মুখে লাথি ৃমারল। আমার মা মারা যাবার আগে বারবার আমার ছেলেকে দেখতে চাইতেন কিন্তু সে আসেনি। এসব আমার ছেলের দোষ না। একটুও না। সব আমার পাপের ফল। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ ঠিকই নেয়, আমারও নিয়েছে। আমি আমার ভুল বুঝতে পারি কয়েক বছর পর। তখন আমার মেয়ের খোজ নিতে প্রথম স্ত্রীর বাড়ি যাই। কিন্তু পাইনি। তারা নাকি অন্য জায়গায় চলে গেছে। মা-বাবা মারা যাওয়ার আগে অনেকবার তার সাথে দেখা করে মাফ চাইতে চাইছিলেন কিন্তু তার খুজোই পাইনি।

জানো মা! আমি নিজেও একবার অন্তত একবার দুনিয়া ছাড়ার আগে তার কাছে মাফ চাইতে চাই। মেয়েটারে একটু চোখের দেখা দেখতে চাই। জানিনা সেটা সম্ভব হবে কি না!”

এই অব্দি বলে উনি থামলেন। আমি স্পষ্ট উনার চোখ বেয়ে জ্বল গড়িয়ে পড়তে দেখছি। মানুষ কেন যে তার জীবনে এত বড় বড় ভুল করে, যার মাশুল সারাজীবন দিতে থাকে।
জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার আসল বাড়ি কোথায়? ”
বললেন, “ঢাকায় ছিলো। পরে একটা কারণে এ জায়গায় এসে বাড়ি বানাতে হলো।”

একটু কাঠ কাঠ গলায় এবার বললাম,
“আচ্ছা আপনার বিবেক ছিলো না? আপনি কেন আপনার মা-বাবার কথা শুনতে গেলেন। মা বাবার কথা ততক্ষণ শোনা উচিত যতক্ষণ সেটা ন্যায়ের পক্ষে থাকে। তারা আপনাকে মেয়ে হয়েছে বলে বাধা দিলো আর আপনিও কাপুরুষের মতো তাই করলেন। আপনি একজন মুসলিম হয়ে জানেন না! ইসলাম মেয়েদের কতটা সম্মান দিয়েছে। যার ঘরে প্রথম সন্তান মেয়ে সে বাবা মা খুবই ভাগ্যবতী। তাছাড়া সাইন্স অনুযায়ী ছেলে হোক কিংবা মেয়ে দুটোই নির্ভর করে একজন পিতার উপর৷
প্রকৃতি কি সুন্দর প্রতিশোধ নিলো আপনার উপর।ছেলে না হওয়াতে যে স্ত্রীকে আর মেয়েকে একলা ছাড়লেন। আল্লাহ আপনাকে ছেলে ঠিকই দিলেন কিন্তু তার মাধ্যমে শিক্ষা ও দিয়েছেন।”

এখানে বসে থাকতে আমার অস্বস্তি লাগছে। আমি বিশেষ দরকার বলে উনার কাছ থেকে উঠলাম। আসার আগে বলে আসলাম, “আপনার যখন যা লাগে দয়া করে নিজের মেয়ে ভেবে আমাকে জানাবেন। আমি আপনার পাশে থাকতে চাই। উনি না চাইলেও আজ থেকে মাসে মাসে আমি উনার খরচাপাতি করে দেবো। এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
আমার হঠাৎ চলে আসা দেখে উনি হা করে তাকিয়ে আছেন, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না।

বের হয়ে গাড়ির ড্রাইভিং ছিটে বসলাম। বোতল থেকে পানি নিয়ে ভালো করে চোখ মুখে ছিটালাম। একটা কথা মানতেই হবে, আমার মায়ের মতো আমিও ভীষণ স্ট্রং। নয়তো নিজের জন্মদাতার মুখ থেকে আমার আর আমার মায়ের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা শুনে কেই বা স্থির থাকতে পারে। হ্যাঁ ওই অ্যালবামের পুরনো ছবিটা আমার মায়েরই। আর ওই ভদ্রলোক আমার জন্মদাতা। যা আমি এখনি জানতে পারলাম। আমি ইচ্ছে করলে উনাকে আমার পরিচয় দিতে পারতাম কিন্তু দেইনি। পরিচয় দিলে উনি আমার মায়ের সাথে দেখা করতে চাইবেন। মাফ চাইতে চাইবেন। আমি সেটা হতে দিতে পারি না। মা সব ভুলে এখন ভালো আছেন। আমার জন্য উনি দ্বিতীয়বার বিয়েও করেননি। কি করে সেই পুরনো ব্যাথা আমি আবার নতুন করে মাকে দিতে পারি। এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি কখনোই পারব না৷ আমি আমার পরিচয় ও জন্মদাতাকে দেবো না। কিন্তু উনার সবকিছুতে সর্বোচ্চ সাহায্য করব।

কিছু কিছু ভুলের কোন ক্ষমা হয় না। জন্মদাতা তার মাশুল দিতে থাকুক।

শেষ বিকেলের শেষ সময়। সূর্যাস্ত যায় যায় অবস্থা। এক্ষুনি সন্ধ্যা নামবে। অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে আমার। আমি গাড়ি স্টার্ট দিলাম। সন্ধ্যার আগেই বাসায় পৌঁছাতে হবে।

সমাপ্ত||

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে