জন্মদাতা পর্ব-০১

0
7

#জন্মদাতা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_১

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়। বাংলাতে সম্ভবত পৌষ মাস চলছে। চারদিকে হাড় কাঁপানো শীত। এই শীতকালেও কদিন ধরে আকাশে মেঘ মেঘ করছে। আজ সকালের দিকেও আবহাওয়া তেমন একটা ভালো ছিল না। ঝিরিঝিরি বাতাস আর শীতল ভাব ছিলো পুরো প্রকৃতি জুড়ে। আমি তৃপ্তি। একজন এমবিবিএস ডাক্তার৷ এই মুহুর্তে বসে আছি চেম্বারে। রোগীদের নিয়েই আমার পুরো দিন কাটে। সিরিয়ালের পর সিরিয়াল থাকে। প্রায় সময় হিমশিম খাই সামাল দিতে। কিন্তু আজকে ঝামেলা টা কম৷ তার কারণ হয়তো অসময়ে এই বৃষ্টি!

বৃষ্টির গতিটা খানিক কমে আসলে আমিও বের হয়ে যাব। বাকিটা দিন বাসায় কাটাবো। মাকে বলব, খিচুড়ি করতে আর আলাদা করে গরুর মাংস রান্না করতে। ঝুমবৃষ্টির দিনে যেমন খিচুড়ির তুলনা হয় না। তেমন আমার মায়ের হাতের রান্নার ও কোন তুলনা হয় না৷ মা আর মেয়ের আজ জমবে বেশ! সাথে গল্প!

রিফাত! আমার এসিস্ট্যান্ট। সে হঠাৎ এসে বলল, “ম্যাডাম একজন রোগী এসেছেন। পাঠিয়ে দেবো কী?”
মাথা নাড়িয়ে বললাম, “হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।”

একজন ভদ্রলোক গুটিশুটি পায়ে আমার চেম্বারে ডুকলেন। ভিজে জবজবে উনার শরীর। দেখেই বুজা যাচ্ছে, উনি ছাতা ছাড়া আসছিলেন আর হঠাৎ বৃষ্টিতে এই অবস্থা। আমি বসতে বলে একটা তোয়ালে এগিয়ে দিলাম। বললাম, “মুছে নিন মাথা।”

উনি মলিন হেসে মাথা মুছে বসলেন।
ভদ্রতার খাতিরে জিজ্ঞেস করলাম, “এমন ভিজে গেলেন কি করে? বৃষ্টি দেখে কোথাও দাড়াতে পারতেন।”
উনি কিছুটা অস্বস্তি ভাবে বললেন, “আসলে মাঝরাস্তায় হুট করে বৃষ্টি চলে আসলো। দাড়াবো কোথায় আর ছাতাই বা পাবো কোথায়!”

“ঠিক আছে। আপনার সমস্যা কি এবার বলুন?”

নড়েচড়ে বসলেন উনি। বললেন, “মুখে কোন রুচি নেই। খেতে ইচ্ছে করে না। এজন্য শরীর খুব দূর্বল। মাথা ধরা থাকে। কোমরের ব্যাথায় রাতে ঘুমাতে পারিনা।”

উনার বিপি চেক করে বললাম, “আপনার প্রেসার একদম ল। ভিটামিনের বড্ড অভাব। বয়স্ক হলে একটু আধটু কোমর ব্যাথা থাকে কিন্তু এর প্রধান কারণ হলোঃ ক্যালসিয়ামের অভাব। আমি আপনাকে কিছু ভিটামিন, ক্যালসিয়াম আর ব্যাথার ঔষধ লিখে দিচ্ছি। নিয়মিত খাবেন। ইনশাআল্লাহ আরাম পাবেন। শাক, কচু, ফলমূল, ডিম, দুধ এক কথায় পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার চেষ্টা করবেন।

উনি প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে সহজভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, “এতে কত টাকার ঔষধ হবে, মা? ”
“পনেরো শত এর মতো।”
“না, মা। আপনি আমাকে পাঁচশত টাকার মধ্যে ঔষধ দিন।”
আমি বেশ কৌতূহলী হলাম।
উনি ফের বললেন, “আসলে আমার পায়ের ব্যাথাটা বেশ বেড়ে গেছে তাই জন্য আপনার কাছে এসেছি নয়তো আসতাম না। আপাতত একটু ঔষধ হলে চলবে।”
“কিন্তু আপনার তো কোর্স ফুল করতে হবে। নয়তো কমেও কমবে না।”
ভদ্রলোক তো নাছোড় বান্দা। পাঁচশত টাকার ভেতরেই প্রেসক্রিপশনে ঔষধ লিখে দিতে হবে।
বললাম, “ঔষধের দোকানে বলবেন, উনারাই দিয়ে দেবেন। কিন্তু পরবর্তীতে সব ঔষধ রেগুলার চালানের চেষ্টা করবেন।”

উনি চলে যাচ্ছেন। কি যেন মনে করে হঠাৎ বললাম, “শুনুন!”
উনি ঘুরলেন। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কাছে কি টাকা নেই?”
মলিন হাসলেন, “আছে মা। দুই হাজার টাকা। এর মধ্যে থেকে পাঁচশত টাকার ঔষধ নেবো। মেয়েটা গর্ভবতী। তার খুব ইচ্ছে করছে, গরুর মাংস খেতে। কোন কাজ কাম নেই। বাড়ির একটা গাছ বিক্রি করে এই টাকাটা যোগাড় করেছি। বাকি টাকা দিয়ে খরচপাতি আর মাংস নেবো।”

রোজ কতশত গল্প শুনি আমরা।তবুও যেন নিজের চোখের সামনে এমন একজন বাবার কথা শুনে ব্যাথিত হলাম। বেশ আশ্চর্য্য ও হলাম। ভদ্রলোককে দেখতে এতটা দরিদ্র মনে হচ্ছে না। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। আজ আমার কোন তাড়াহুড়ো নেই সেজন্য উনার সাথে বেশ গল্প পাতালাম। এমনিতেই মানুষের সাথে কথা জমাতে আমার বেশ লাগে। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কিছু করেন না, তাহলে সংসার কেমনে চলে?”

“এই তো কোনরকমে চলে। বাড়ির ফসলাদি বিক্রি করে। মাঝেমধ্যে দিনমজুরের কাজ পেলে করি।”
“এই বয়সে আপনি কাজ করেন! আপনার কোনও ছেলে নেই?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক। মনে হলো বহুদিনের নীরব ব্যাথা এই দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে বের করলেন। বললেন, “আমার একটা ছেলে আছে।ঢাকায় থাকে। বড় চাকরি করে। আমাদের খোঁজ খবর তেমন একটা নেয় না। মাঝেমধ্যে মন চাইলে কিছু টাকা পাঠায়।”

উনার কথা শুনে আমার ভেতরে খুব লাগলো। আমার বিবেক বলল মানুষটাকে সাহায্য করতে। রিফাতকে বললাম, “আজ আর কোন রোগী দেখব না। চেম্বার লক করে দাও।”

ভদ্রলোক কে বললাম, “আমার সাথে আসুন।”
“কোথায় যাবো?”
স্মিথ হাসলাম, “ভয় পাবেন না। কিডন্যাপ করব না।”

গাাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ভদ্রলোককে বেশ অস্বস্তি দেখালো। মাংসের দোকানে গিয়ে গাড়ি থামালাম। দুই কেজি গরুর মাংস নিলাম। উনার হাতে দিয়ে বললাম, “শুধু আপনার মেয়ে না আপনিও মন ভরে মাংস খাবেন।

উনি নিতে নারাজ। হয়তো আত্মসম্মানে লাগছে। আমি মুচকি হেসে বললাম, ” আমাকে আপনার মেয়ে ভাবুন। আর এগুলো নিন প্লীজ।”

উনি কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মাঝেমধ্যে এমন হয়, আমরা মাত্রারিক্ত অবাক হলে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।

ফের গাড়িতে উঠে ফার্মেসির সামনে গিয়ে গাড়ি থামালাম। উনার প্রেসক্রিপশনের সব ঔষধ কিনে উনার হাতে দিলাম। বললাম, আপনার কাছে যা আছে তা দিয়ে আপনি ফলমূল কিনে খাবেন।

উনি আবেগে আমার দুহাত জড়িয়ে ধরলেন, “তোমার মতো মানুষ আজকাল খুব কম আছে মা। নিঃসন্দেহে তোমার মা-বাবা তোমাকে খুব ভালো শিক্ষা দিয়েছেন।”
বিনিময়ে আমি নীরব নিস্তব্ধ হাসি টানলাম মুখে।
সন্ধ্যা হতে বেশি সময় নেই। বাসায় ফিরতে হবে নয়তো উনাকে উনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতাম।

উনি চলে যাচ্ছেন। কি মনে করে হঠাৎ ফিরে আসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার বাড়ি কোথায় মা?”
“আমার বাড়ি ঢাকায়। এ হসপিটালে পোস্টিং হয়েছি বছর তিনেক আগে। এখন এখানেই থাকি।”
“আপনার কার্ড টা দেওয়া যাবে মা? মাঝেমাঝে খোজ নেবো আপনার। আমি এলাকার সবাইরে আপনার কথা বলব। আমার বাড়ি পাশেই। যদি একদিন এই বাপের বাড়িতে পা রাখতেন, আমি খুব খুশি হতাম।”
ঠোঁটে হাসির রেখা টানলাম, “আমার তো সময় থাকে না।”
“সময় চাইলেই বের করা যায়। আপনার বাবা এরকম করে বললে আপনি কি না করতে পারতেন?” আমি আপনার বাবার বয়সী। একদিন চলে আসেন, আমি খুব খুশি হবো।”

“মেয়ে বলছেন আবার আপনি ডাকছেন! এটা বেমানান লাগছে। আপনি আমায় তুমি করেই বলবেন।”
তারপর উনার হাতে আমার কার্ড দিয়ে বললাম, “এখানে আমার নাম্বার আছে।”

বাসায় ফিরে চেন্জ করে ফ্রেশ হলাম। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে দেখলাম, মা আমার জন্য খাবার নিয়ে বসে আছেন। ঢাকনা সরাতেই দেখলাম, মা খিচুড়ি আর গরুর গোশত রান্না করছেন৷ অবাক হয়ে বললাম, “জানো মা! আমি ভাবছিলাম বাসায় ফিরে তোমাকে এটা রান্না করতে বলব, তুমি বলার আগেই করে ফেললে। কি করে জানলে মা?”
মা হেসে বললেন, “মেয়ের ৃমনের কথাই যদি না বুঝতে পারি, তাহলে কীসের মা হলাম!”

কথা বলতে বলতে খেতে বসলাম। মা খাচ্ছেন। আমি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মায়ের দিকে তাকাচ্ছি। আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে মায়ের মতো স্ট্রাগল করা মানুষ খুব কম দেখেছি। মায়ের কাছে আমার হাজারও প্রশ্নের উত্তর জানার আছে। অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু বলার সাহস হয় না আর বলেও লাভ নেই।

বেশ জমে ঠান্ডা পড়ছে। মা হুমায়ুন আহমেদের “কোথাও কেউ নাই” উপন্যাসটা পড়ছেন৷ আমি বেলকনিতে গিয়ে দাড়ালাম। সন্ধ্যার পরপরই বৃষ্টি কমে গেছে। আকাশ এখন স্বচ্ছ আর ঝকঝকে। সাদা আর নীল আকাশের মাঝখানে এক ফালি সোনালী চাঁদ চকচক করছে। তুলোর মতো গুড়ি গুড়ি মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে অজানা উদ্দেশ্যে।এমন সুন্দর আকাশ দেখে মনেই হবে না, সারাদিন বৃষ্টি ছিলো। আমি রাতের এই সৌন্দর্য দেখছি ঠিকই কিন্তু আমার মনে প্রানে এক অদ্ভুত শূন্যতা বিরাজ করছে।বাসায় আসার পর থেকে একবারের জন্যেও আমি ওই ভদ্রলোকের কথা মাথা থেকে সরাতে পারিনি। উনি নিজের অসুস্থতা এক পাশে রেখে মেয়ে কি খাবে তাতেই টাকাটা খরচ করবেন। কত ভালোবাসেন উনি উনার মেয়েকে। আমার উদাসী মনে প্রশ্ন জাগলো, সব বাবারাই কি তাদের মেয়েদেরকে এভাবেই ভালোবাসে? মেয়ের সুখেই তাদের সুখ হয়? তাহলে আমার বাবা! জন্মের পর থেকে আজ অব্দি আমি আমার বাবাকে দেখিনি। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, একটা ঝামেলায় মা নানুবাড়ি চলে আসেন। তখন মা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা ছিলেন। তারপর কেউ নাকি যোগাযোগ রাখেনি। মেয়ে হয়েছে জেনে আমার দাদা দাদী, বাবা কেউ নাকি মাকে ফিরিয়ে নিতে চায় নি। কত জঘন্য ছিলো আমার পরিবার।

যখন পুচকে ছিলাম। তখন নাকি মাকে বারবার জিজ্ঞেস করতাম বাবার কথা। বাবাকে দেখতে চাইতাম। মা তখন আগুন চোখে আমার দিকে তাকাতেন। পরে আর কিছু বলার সাহস হতো না।

বড় হলাম। মা সবটা আমায় বললেন। বুঝলাম। তারপর থেকে এমন বাবার কথা আমি আজ অব্দি মুখেও আনিনি। বাবার বাড়ি কোথায় সেটাও জানি। চাইলে খোজ নিতে পারতাম কিন্তু নেইনি৷ আগ্রহ নেই। মা বলেন, যারা আমাদের জীবনকে বিষিয়ে দেয়, তাদের ফের জীবনে ডেকে আনতে নেই। তাছাড়া যে বা যারা আমাকে আর মাকে ছেড়ে দিয়েছে তাদের কোন অস্তিত্ব আমাদের জীবনে নেই।

আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছেন। লেখাপড়া করিয়ে ডাক্তার বানিয়েছেন। নিজে চাকরি করতেন। নিজের ইনকামের টাকা দিয়ে তিলতিল করে আমাকে এই স্থানে দাড় করিয়েছেন। কখনও কারও কাছে মাথা নুয়ান নি। মা যেমন স্পষ্টবাদী তেমন প্রতিবাদী। আত্মসম্মানী আর একগুঁয়ে মেয়ে। উনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

এতদিন আমার জন্মদাতার কথা মনে না পড়লেও আজকে এক বাবার মেয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে আমাকে ভাবাচ্ছে। কেউ মেয়ের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয় আর কেউ মেয়ে সন্তান জেনে স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়। কী আজব দুনিয়া! আর কী আজব মানুষ!

আমার খুব ইচ্ছে করছে, মায়ের সাথে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা শেয়ার করতে। কিন্তু সেই সাহস হচ্ছে না আমার।

চলমান…..!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে