জনম জনমে পর্ব-০৬

0
496

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_৬
#ইসরাত_ইতি

দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখতেই জাহিদা আনামের নজর চলে যায় জারিফের দিকে। জারিফ মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে,ছেলের চোখের দৃষ্টি দেখে তার অনুভূতি পড়তে পারছেনা জাহিদা।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় সে। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে ছোটোবোনের বাড়িতে গিয়েছিলো,সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে রাত বেজেছে আটটা। কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগটা নামিয়ে হাতে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই জারিফ বলে ওঠে,“দোলাকে অপমান করলে!”

জাহিদা আনাম দাঁড়িয়ে পরে। মাথা ঘুরিয়ে ছেলের দিকে, ছেলের চোখের দিকে দৃষ্টি রাখে। জারিফের দৃষ্টি শান্ত। শান্ত,নিচু কিন্তু দৃঢ় কন্ঠস্বর, পুনরায় জিজ্ঞেস করে,“অপমান করে কি শান্তি পেলে? কতটা?”

জাহিদা আনাম শুকনো হাসি হাসে,বলে,“নালিশ করাটাও খুব ভালোই জানে দেখছি মায়ের মতো।”

জারিফ দাঁতে দাঁত চেপে ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে একটা গ্লাস উঠিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারে। জাহিদা নির্বিকার। জারিফ চেঁ’চি’য়ে ওঠে,“ও নালিশ করেনি,ওর বান্ধবীদের থেকে জেনেছি। বলো কি শান্তি পেলে!”

_অপমান করিনি। শুধু বলেছি ওর গাঁয়ে আমার ছেলের দেওয়া বেনারসী উঠলে কিছু টাকা যেন বাঁচিয়ে রাখে আমার কাফনের কাপড় কেনার জন্য।
খুবই শান্ত জাহিদার কন্ঠস্বর।

জারিফ আহত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। জাহিদা জারিফের সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।

★★★

আফ্রা আর তৃপ্তি ছুটতে ছুটতে এসে দোলার কামরার জানালা দিয়ে উকি দেয় ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলিতে। জারিফের কানে ফোন,অত উঁচু থেকেও তৃপ্তির নজরে আসে জারিফের বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি। সে তাকিয়ে আছে দোলার কামরার জানালার দিকে। হঠাৎ চেঁ’চি’য়ে ওঠে,“ওকে আনো। টেনে ওঠাও বিছানা থেকে। আমি ওকে দেখতে চাই।”

তৃপ্তির হাতে ফোন। কলটা লাউড স্পিকারে দেয়া। আফ্রা আর তৃপ্তি বিচলিত হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। আফ্রা আমতা আমতা করে বলে,“ভাইয়া এভাবে চেচাবেন না। ও অসুস্থ। আসতে পারবে না। আপনি যান। টহল পুলিশ আসলে ঝামেলায় পড়বেন ভাইয়া।”

_আই সেইড আই ওয়ান্ট টু সি হার।
ক্ষিপ্ত কন্ঠে জবাব দেয় জারিফ। দোলার কর্নকুহরে তা পৌঁছেছে। তবে সে নির্লিপ্ত হয়ে শুয়ে আছে।

আফ্রা জারিফকে বলে,“ভাইয়া। বোঝার চেষ্টা করুন। ইনহেলারে কাজ হয়নি। পরে প্রেসক্রিপশন নিয়ে গিয়ে ফার্মেসী থেকে হাই ডোজের ট্যাবলেট টা এনে খাইয়েছি। শান্ত হোন আপনি।”

জারিফ এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে মানুষ জন তাকেই দেখছে। রাত খুব বেশি গভীর নয়,পশ্চিমে টংয়ের দোকানে পরিচিত কিছু ছোটো ভাই চায়ের কাপ হাতে তার দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে আছে,য়যাদের জারিফ উঠতে বসতে মেয়েদেরকে বিরক্ত না করার জ্ঞান দেয়। তাকে এভাবে রাত বিরেতে ছাত্রী হোস্টেলের পেছনে দাঁড়িয়ে উগ্রদের মতো চেঁচাতে দেখে তারা বেশ অবাকই হচ্ছে।

জারিফ নিজের কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে আফ্রাকে বলে,“শোনো আফ্রা! ওকে সকাল নয়টায় হোস্টেল থেকে বের করবে। যেভাবে হোক। মাইন্ড ইট।”

আফ্রা আর তৃপ্তি অবাক হয়ে বলে,“কেনো ভাইয়া?”

_ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। আরো কাজ আছে। তুমি আর তৃপ্তি তৈরি থেকো।

ফোন কাটে, আওয়াজ তুলে এপাচি আরটিআর চলে যায় ছাত্রী নিবাসের পেছনের গলি থেকে। আফ্রা আর তৃপ্তি জানালা বন্ধ করে ঘুরে দোলার দিকে তাকায়। আধো অন্ধকারে দোলা সিলিংয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে, ওরা দুজন ওর কাছে এগিয়ে যায়। তৃপ্তি আফ্রাকে বলে,“তুই আজ রাতটা ওর কাছে থাক।”

_নাহ।
ক্ষীণ স্বরে বলে দোলা। তৃপ্তি কিছু বলার আগেই পুনরায় বলে ওঠে,“তোরা আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে চলে যা।”

★★★

অভিভাবক মিটিং রুমে হোস্টেলের ওয়ার্ডেন খালেকুজ্জামান স্যার ও রোজি ম্যাম দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সাথে দোলার ছোটো ফুপু আর বড় চাচা বেশ রসিয়ে কষিয়ে আলাপ জুড়ে দিয়েছে দোলার বিয়ের ব্যাপারে। পাত্রের নাম বলতে গিয়ে যেনো তাদের বুকের ছাতি ফুলে উঠছে গর্বে,অহংকারে। হোস্টেলের মেয়েরা সবাই অবাক হয়েছে দোলার বিয়ের কথা শুনে, বিশেষ করে পাত্রের নাম যখন শুনেছে শেখ তৌসিফ আহমেদ। খুব একটা দোলাকে লক্ষ্য না করা মেয়েটিও আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে দোলাকে। রূপ ব্যতীত দোলার মতো সাদামাটা মেয়ের আর কি যোগ্যতা আছে শেখ বাড়ির বৌ হওয়ার সেটাই ভাবাচ্ছে তাদের। তিনশো পনেরো নাম্বার কামরায় থাকে প্রথম বর্ষের নীড়া, সে রীতিমতো হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে কারন তার ফুপাতো বোন,যে মেডিকেলের স্টুডেন্ট,তার প্রস্তাব নাকচ হয়েছিলো শেখ বাড়ি থেকে। তার কাজিনের থেকে কম যোগ্যতা সম্পন্ন একটা মেয়ে কিভাবে ঐ বাড়ির বৌ হচ্ছে সেটা সে বুঝে উঠছে না!

দবির রহমান মুখ হাসি হাসি করে সবার সাথে কথা বলছে, মুখে সবাইকে দাওয়াত জানিয়েছে দোলার বিয়ের, সবাইকে আশ্বাস দিয়েছে আগামী কাল পরশু কার্ডও পেয়ে যাবে সবাই। বিয়েটা তার বাড়িতে হলেও বিয়ের রিসিপশন হবে বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্সে।

তৃপ্তি আর আফ্রা দোলাকে ধরে ধরে নিচ তলায় অভিভাবক মিটিং রুমে নিয়ে যায়। দোলার গোছানো ব্যাগ দুটো নিয়ে আরো দুজন মেয়ে সেই রুমে ঢোকে। দোলার ফুপু শাহিদা বিরক্ত হওয়ার ভান করে অহংকার মিশিয়ে বলে,“আরে এতো ব্যাগপত্র নিতে হবে না। ওখানে,ও বাড়িতে দোলার জন্য ইতিমধ্যে রাজ্যের পয়নামা (উপহার সামগ্রী) পাঠিয়ে দিয়েছে শেখ বাড়ি থেকে।”

দোলা নির্বিকার। তৃপ্তি বিরক্ত হয়ে যায় দোলার ফুপির অতিরঞ্জিত কথায়,সে বলে,“ব্যাগ গুলো তো নিতেই হবে ফুপু। এগুলো এখানে রেখে কি হবে!”

দবির রহমান দোলাকে স্যার আর ম্যামের থেকে দোয়া চাইতে বলে। দোলা নিশ্চুপ, চোখ তুলে তাকায়ও না অবধি।

দোলার স্যার আর ম্যাম দোলাকে আন্তরিকতার সাথে দোয়া করে দেয়, তাদের খুব পছন্দের এবং প্রিয় ছাত্রী ছিলো ফোর্থ ইয়ারের দোলা রহমান। সবশেষে তারা বিয়ে হলেও কখনও পড়াশোনা না ছাড়ার উপদেশ দিয়ে দোলাকে বিদায় জানান।

ফজিলাতুন্নেসা ছাত্রী নিবাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দোলা তার ফুপু এবং চাচার সাথে। দবির রহমান একটু সামনে গিয়েছেন একটা অটো রিকশা ঠিক করতে। পরিচিত সিনিয়র এবং জুনিয়র বোনেরা দোলাকে বিদায় জানিয়ে গেট থেকে ফিরে গিয়েছে। দাঁড়িয়ে আছে শুধু তৃপ্তি আর আফ্রা। দু’জনে শুকনো মুখে দেখছে তাদের বান্ধবীকে। কিছু সময় পরে দোলাকে টেনে কিছুটা পেছনে নিয়ে তৃপ্তি অনুরোধের সুরে ফিসফিসিয়ে বলে,“দোলা সাহস কর। ভাইয়া সবটা সামলে নেবে। হাল ছাড়িস না প্লিজ!”

দোলা জবাব দেয়না,শুধু চোখ তুলে তৃপ্তির মুখের দিকে তাকায়। তখনই সেখানে জারিফের বাইক এসে থামে। দোলা পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। তৃপ্তি আর আফ্রা দোলাকে দুপাশ থেকে ধরে রেখেছে।

জারিফকে দেখে দোলার ফুপু আর চাচা শুকনো হাসি হাসে। জারিফ তাদের দু’জনকে সালাম দিয়ে দোলার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিচু স্বরে বলে,“কোথায় যাচ্ছিস!”

_বাড়িতে। বিয়ে আমার।
দোলাও ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়।

জারিফ ম্লান হেসে দোলার একটা হাত শক্ত করে ধরে। দোলার ফুপু আর চাঁচার ভ্রু কুঞ্চিত হয় এই দৃশ্য দেখে। জারিফ কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,“চল আমার সাথে।”

_কোথায়?

_কাজী অফিসে।

“আল্লাহ গো!”
হতভম্ব শাহিদা বোরখার ও’ড়না মুখে চেপে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে। দোলার বড় চাচা খসরু মাহমুদ এগিয়ে এসে জারিফকে বলে,“কি সমস্যা জারিফ?”

জারিফ কোনোদিকেই দৃষ্টি ফেরায় না,না কারো কথায় জবাব দেয়। তার দৃষ্টি দোলার মায়াভরা মুখটার দিকে স্থির। দোলা জারিফের থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,“এটা হয়না জারিফ।”

_হয়। দোলা চল আমরা বিয়ে করি। মা ঠিক মানবে দোলা। আমি তোকে কথা দিচ্ছি!

দোলা চোখ তুলে জারিফের দিকে তাকায়,তার টানা টানা চোখ দু’টো ভরে উঠেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,“মামীর থেকে অনুমতি না নিয়েই? তাহলে তো গতকাল বলা মামীর কথাটা সত্যি হয়ে যাবে,আমাকে আমার খারাপ মা জন্ম দিয়ে রেখে গিয়েছে তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।”

“দুলি।”
দোলার দুই বাহু ধরে জারিফ ঝাঁকুনি দিয়ে চেঁ’চি’য়ে ওঠে। দম নিয়ে আবার বলে,“দুলি ওসব মা এখন বলছে। ঠিক হয়ে যাবে সব দুলি। প্লিজ। প্লিজ চল কাজী অফিস।”

দোলা চুপচাপ নিজের বাহু থেকে জারিফের হাত দু’টো সরিয়ে দেয়। দবির রহমান অটো নিয়ে এসে ছাত্রী নিবাসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ঐ দৃশ্য দেখে থ’ম’কে যায়। সে দ্বিতীয় দফায় চ’ম’কে ওঠে দোলার সাথে জারিফের প্রনয়ের সম্পর্ক এই সত্যিটা জেনে।

দ্রুত পায়ে এসে দোলা আর জারিফের মধ্যে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে দবির জারিফের দিকে কঠিন দৃষ্টি দেয়,গর্জে উঠে বলে,“এসব কোন ধরনের অ’স’ভ্যতামি জারিফ!”

_আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি ফুপা। আমাদের চার বছরের সম্পর্ক।
অসহায়ের মতো বলে জারিফ।

দবির হতভম্ব হয়ে জারিফের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকায়। দোলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দবির জারিফের দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় বলে ওঠে,“মুখ সামলে কথা বলো জারিফ। দোলার সামনে বিয়ে।”

জারিফ নির্বিকার। পুনরায় দোলার হাতটা খপ করে ধরে বলে,“চল কাজী অফিস।”

দোলা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে,“মামীকে কষ্ট দিতে পারবো না, বেচারী অনেক কষ্ট পেয়েছে।”

_আর তুই? আমি? আমাদের কি হবে দোলা?

_কিছুই হবে না জারিফ ছাড়ো আমার হাত।

_মাকে মানিয়ে নেবো দুলি। না মানলে নাই। মা আলাদা বাড়িতে থাকবে তুই আলাদা বাড়িতে থাকবি, দু’জনকেই ভালো রাখবো আমি।

_সহজ হবে না জারিফ।

_কঠিন কিছুও না দুলি চল কাজী অফিস।

_অনেক বড়ো আঘাত পাবে মামী।

_আর আমরা দুজন ম’রে যাবো।

চেঁচামেচিতে লোকজন জড়ো হচ্ছে। দবির আতঙ্কিত হয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। এসব কথা শেখ বাড়ির লোকের কানে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখন তবে উপায়!

সে ক্ষিপ্ত হয়ে দোলার হাত জারিফের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জারিফকে ধ’ম’কে বলে,“তুমি ভাবলে কি করে তোমার কাছে আমার মেয়ে দেবো। আর তোমার ঐ শিক্ষিত অহংকারী মা,আমার সমন্ধি মরার পরে একবেলা দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায়নি তাকে বলে দিও আমার বয়েই গিয়েছে তার বেকার নিষ্কর্মা ছেলের কাছে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে, আমার মেয়ে রাজরানী হবে। যাও এখান থেকে।”

_আব্বু চুপ করো! একেবারে চুপ করো। চেঁচিও না। চলো আমি যাচ্ছি। ওকে এভাবে বেকার বলবে না। বলবে না বেকার ,খবরদার!

চেঁচিয়ে কথাগুলো বলে দোলা দবিরকে জারিফের সামনে থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয়।
জারিফ দোলার হাতদুটো ধরে, আকুল হয়ে বলে,“দুলি পাগলামি করিস না। ”

_এমনটা হবে জানা ছিলো শুরুতেই, কোন আশায় বুক বেঁধেছিলাম!

_দুলি চল কাজী অফিস। চলনা একটু স্বার্থপর হই।

শাহিদা এসে ভাইঝিকে আড়াল করে নেয়। লোকজন কৌতুহলী হয়ে তাদের দেখছে। তৃপ্তি আর আফ্রা ছলোছলো নয়নে একবার দোলা আর একবার জারিফকে দেখছে।

দবির মেয়ের দুর্নাম হওয়ার ভয়ে বড়ো ভাইকে চোখ দিয়ে ইশারা করে। খসরু মাহমুদ দোলাকে টানতে টানতে নিয়ে অটোতে তুলে বসিয়ে অটো ছাড়ার নির্দেশ দেয়।

জারিফ চেঁ’চি’য়ে যাচ্ছে,“দুলি! দুলি এটা ঠিকনা। এমন কিছু আশা করি না তোর থেকে। দুলি এমন হবার কথা ছিলো না।”

অটো চলে যায় দৃষ্টি সীমার বাইরে। দবির জারিফের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, কন্ঠে তেজ নিয়ে জারিফকে বলে,“উগ্রদের মতো করবে না। এখান থেকে থানায় যেতে দুমিনিট লাগবে।”

জারিফ অনূভুতিহীন দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে দবিরের দিকে। দবির একটা রিকশা থামিয়ে স্থান ত্যাগ করে, বাড়ি পৌঁছে তার অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে। শেখ তৌকির আহমেদকে কিছু একটা বলে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বিয়েটা আজ রাতের মধ্যে পড়াতে হবে। নয়তো মেয়ের মত ঘুরতে কতক্ষন? এমনিতেই মেয়েটিকে দেখে তার সুবিধার মনে হচ্ছে না, দেখেই মনে হচ্ছে জারিফের প্রতি দুর্বল। একবার বেঁকে বসলে দবিরের স্বপ্ন চুড়মার হয়ে যাবে। তাছাড়া জারিফের থেকে পাত্র হিসেবে তৌসিফ দশগুণ ভালো। আর এমনটা নয় যে দবির শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবছে, সে মেয়ের ভবিষ্যতের কথাও ভাবছে। ঐ মৃধা বাড়ির ছেলেরা মা ভক্ত, মা বোনের কথায় বৌকে মারে এটা তো দবিরের অজানা নয়, এমন কিছু ভবিষ্যতে দোলার সাথে হোক তা তিনি কখনোই চায়না।

দবিরের রিকশা আড়াল হতেই লোকজন আরো কিছু মুহূর্ত জারিফকে দেখে সেখান থেকে চলে যায়। মা বাবার অবাধ্য,বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানো এক জোড়া প্রেমীর দুরাবস্থা দেখে একটু বিনোদন পেয়ে তারা খুশি, তারা আবারও ব্যস্ত হয়ে পরে নিজের জীবন নিয়ে।

জারিফ রাস্তায় ধপ করে বসে পরে। আফ্রা আর তৃপ্তি ছুটে এসে জারিফের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। জারিফ চোখ তুলে আফ্রাকে দেখে বলে,“কেমন ভীতু দেখলে। এখন আমি কি করবো আফ্রা? আমার পাগল পাগল লাগছে!”

তৃপ্তি কেঁদে ফেলে, ঝুঁকে জারিফের সামনে বসে বলে,“আন্টিকে একটু বুঝিয়ে যদি পারতেন ভাইয়া।”

জারিফ কোনো জবাব দেয়না। তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠছে সে না চাইতেও। সে তার সামনের দুজন মেয়ের থেকে তা আড়াল করেনা। ভাগ্যিস এখানে দুলি নেই, তাহলে সে জারিফকে এই অবস্থায় দেখে বলতো,“অপদার্থ প্রেমিক!”

★★★

নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে দবির। সে তার ভগ্নিপতিদের এবং ভাইদের চোখ কান খোলা রাখতে বলেছে। এমন অনেক হয়েছে এই মফস্বলে, শেষমেশ বিয়ের পাত্রী প্রেমিকের উষ্কানিতে পালিয়ে গিয়েছে। দোলাকে পালাতে দেওয়া যাবে না। দোলার চাচীদের কড়া নজরদারি দোলার উপর। বারবার এসে তারা চেক করছে দোলার কাছে কোনো মোবাইল ফোন আছে কিনা! কোনো মোবাইল ফোন তারা পায়নি, শুধুমাত্র পেয়েছে একটা কাঠের পুতুলকে। যাকে তারা বিয়ের একটা বেনারসী পরিয়ে বসিয়ে রেখেছে দুপুর থেকে। কাঠের পুতুলটা চুপ করে বসেও আছে,তার দৃষ্টি পশ্চিমের জানালার বাইরে। বাড়ির পশ্চিম আঙিনায় পাত্রপক্ষকে খাওয়ানোর জন্য একটা খাসি জবাই করা হচ্ছে। প্রতিবেশী চাচীরা উনুন ঘরে হাতে হাতে সাহায্য করছে দোলার বাড়ির মহিলাদের। রান্না বান্না আগেভাগেই সেরে ফেলতে চায় তারা। বাদ মাগরিব দোলার বিয়ে পড়ানো হবে।

গায়ে হলুদ হবে না।গায়ে হলুদ হওয়াটা আবশ্যকীয় নয়, মুসলিম বিয়ের রীতি নয় এই প্রথা, দবির সবাইকে এই কথা বলে চুপ করিয়ে দিয়েছে, সবাইকে মাথা ঘামাতে বলেছে শুধু বিয়েটা নিয়ে।

দবির বাড়িতে গিয়েই একটা অভিনব চাল চেলেছে। দুপুরে তৌফিকুল আহমেদকে ফোন করে কান্নার ভান করে জানিয়েছে দোলার দাদীর শ্বাস টান উঠেছে। আর বোধহয় বেশিক্ষণ বাঁচবে না। বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা এসে ভিড় করেছে। এমতাবস্থায় দোলার দাদী চাইছেন বংশের বড় নাতনির বিয়ে দেখে যেতে, দোলা যে বড় অভাগী! মা মরা। তাই দবির তৌকির আর তৌফিকুল আহমেদের কাছে অনুরোধ করেছে সব অনুষ্ঠান পরে না হয় করা যাবে। যদি আজকের ভেতরে বিয়েটা পড়ানো যায় তাহলে খুব ভালো হয়।

একজন মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধার কথা শুনে রাজি হয়েছে শেখ বাড়ির সবাই। তারা জানিয়েছে বাদ মাগরিব কাজী নিয়ে আসবে, ঠিক যোহরের ওয়াক্তে তানিয়া শেখ এসে বড় বড় দুটো লাগেজ দিয়ে গিয়েছে,যাতে আছে দোলার জন্য কেনা উপহার সামগ্রী। দোলার গাঁয়ের টকটকে লাল বেনারসী শাড়িটাও সেই লাগেজ থেকে বের করা হয়েছে।

মাগরিবের আজান হতে এখনও ঢের দেরী, পরিশ্রম বেশী করছে বাড়ির মহিলারা তবে সেই তুলনায় বাড়ির পুরুষদের হাক ডাক বেশি শোনা যাচ্ছে। তার সাথে যোগ হয়েছে বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি। কিন্তু তার মাঝেই সব ধরণের শব্দ ছাপিয়ে দোলার কানে এসে পৌঁছায় একটা অতি পরিচিত শব্দ।
বাড়ির আঙিনায় বাইক থেমেছে। দোলার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। সে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলো, বাইক থামার আওয়াজ মাথা তুলে তাকায়। সামনের বারান্দায় দোলার বাবা চাচাদের হাঁক ডাক শুরু হয়, দবির রহমান ক্ষ্যাপা গলায় কাউকে বলে,“তুমি! তোমার সাহস তো কম না! পুলিশ ডাকবো নাকি!”

ওপাশের ব্যাক্তি কোনো জবাব দেয়না। শুধু দোলা শুনতে পায় কারো পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ, কেউ তার ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে। দোলা শাড়ির আঁচল খামচে ধরে বসে থাকে, সাথে সাথে দু’চোখ বন্ধ করে নেয়, সে দেখবে না। দেখবে না ঐ লোকটাকে আর। জারিফ দরজা ঠেলে হুরমুর করে ঢুকে পরে দোলার ঘরে। ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে ঘুরে তাকায় দোলার দিকে। দবির আর তার ভাইয়েরা এসে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। চাপা স্বরে চেঁচিয়ে জারিফকে পুলিশ ডাকার হুমকি দিতে থাকে।

দোলার দু’চোখ বন্ধ । জারিফ দোলার দিকে এগিয়ে এসে বলে,“চল সময় আছে এখনও,কাজী অফিসে যাই।”

_মামীকে মানিয়েছো?
দু’চোখ বন্ধ করেই ঠান্ডা গলায় জানতে চায় দোলা।

জারিফ দোলার দুই বাহু ধরে বলে,“না পারিনি। তুই চল। কারো মানতে হবে না। চল দুলি।”

_চলে যাও জারিফ। জেদ করো না,আমার দুর্নাম হবে।

জারিফ হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পরে, দোলার দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো করে বলে,“এতো ইগো তোর? এতো ইগো?”

দোলা নীরব। জারিফ অনুনয় করতে থাকে,“মা মেনে যাবে দুলি। একদিন না একদিন মা মেনে যাবে। একটু সাহস কর না দুলি! হাতজোড় করছি আমি।”

দুলি নিশ্চুপ। জারিফ দোলার থুতনি ধরে বলে,“চোখ খোল বলছি দুলি। চোখ খোল!”

দোলা চোখ খোলে না,সে খুলবে না কিছুতেই। ঐ মানুষটার দিকে সে তাকাতে পারবে না।

মাগরিবের আজান দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। ঠিক সময়েই বাড়ির আঙিনায় শেখ বাড়ির গাড়ি এসে থামে।

দবির রহমান আর তার ভাইয়েরা আতঙ্কিত হয়ে পরে। বুদ্ধি করে একদল চলে যায় বরপক্ষকে সাদরে গ্রহণ করতে। আরেকদল লাথি মেরে বন্ধ দরজার সিটকিনি ভাঙার চেষ্টায়। তবে মুখে কেউ টু টা শব্দ করে না, পাছে লোকে জেনে যায় সবটা।

দোলা নিশ্চুপ হয়ে দু’চোখ বন্ধ করেই বসে থাকে, দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে উষ্ণ জল গড়িয়ে পরে তার। জারিফ উঠে দাঁড়ায়। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,“সাহস করলি না তো? আজ আমিও দেখতে চাই তুই কিভাবে কবুল বলিস। আমি এখানেই থাকবো, দেখতে চাই তুই আমার সামনে কি করে কবুল বলিস দুলি।”

চলমান….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে