জনম জনমে পর্ব-০২

0
584

#জনম_জনমে
#পর্বসংখ্যা_২
#ইসরাত_ইতি

“আমরা বিয়েটা কবে করছি জারিফ?”

সরাসরি এই প্রশ্নটিতে জারিফ কিছুটা হকচকায়। এমনিতে দোলা কখনও সরাসরি বিয়ের কথা তোলে না। আজই প্রথম এমন হলো,কন্ঠে ছিলো অধীরতা।

জারিফের থেকে দোলা কোনো উত্তর না পেয়ে হাত ধুয়ে ফেলে। তার খাওয়া হয়ে গিয়েছে। জারিফ নিস্প্রভ বসেই ছিলো,দোলাকে হাত ধুতে দেখে সে টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু বের করে দোলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বরাবরের মতো বলে,”পেট ভরেছে?”

বরাবরের মতো দোলারও চোখ ভিজে উঠতে চায়। এবং সে বরাবরের মতো তা পাত্তা না দিয়ে উপর নিচে মাথা ঝাঁকায়। মুখে বলে,”চলো ওঠো। আড়াইটা বেজে গিয়েছে। তুমি বাড়িতে যাবে, খাবে!”

ওয়েটার এসে বিল নিয়ে যায়। জারিফ চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। দোলা নিজের ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয়।

রেস্তোরাঁর বাইরে এসে জারিফের বাইকের কাছে এসে দাঁড়ায় দোলা।জারিফ বাইকে উঠে আশেপাশে তাকিয়ে উঁচু গলায় ডেকে একটা রিক্সা দাড় করায়।

দোলাকে ইশারা করে রিক্সাতে উঠতে। দোলা রিক্সায় উঠে বসতেই জারিফ রিক্সাওয়ালাকে বলে,”সার্কিট হাউস মাঠে নিয়ে যান।”

দোলা জারিফের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। জারিফ উত্তর দেয়না। রিক্সা চলতে শুরু করলে বাইক নিয়ে রিক্সার পিছু পিছু যেতে থাকে।

বরগুনা সদরের সার্কিট হাউস মাঠটা দুপুর সময়টাতে বরাবর শান্ত, নিড়িবিলি এবং নিস্তব্ধ একটা স্থান, শুধুমাত্র বিকেল এবং সকালের সময়টায় ভিন্ন রূপ থাকে, বিকেল সময়টায় লোকসমাগম বাড়ে। ফুচকার ভ্যান আসে, আসে তরুণ-তরুণীরা, আসে মধ্যবয়সী অভিভাবকের দল তাদের বাচ্চাদের নিয়ে,বৈকালিক ভ্রমণে। সকালেও সরকারি কর্মকর্তারা জগিং করতে আসে এই স্থানে।

এখন সময় তিনটা সাতাশ মিনিট। আশেপাশে তাকালে কাকপক্ষীও দেখা যাচ্ছে না। শুধু মহিলা কলেজ থেকে সদর হাসপাতাল বরাবর রাস্তা টাতে দুয়েকটা পায়ে চালিত রিকশা দেখা যাচ্ছে।
আকাশটাও কেমন গুমোট হয়ে যাচ্ছে,তবে মেঘের দলা এতো তাড়াতাড়ি যে এই মফস্বলে ঝাঁপিয়ে পরবে না তা নিশ্চিত। জারিফের ফোনের ওয়েদার ট্র্যাকার তাই বলছে। সে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে চুপচাপ, নির্বিকার চিত্তে। তার ডানপাশে বসেছে দোলা। মাঝখানে এক হাত দূরত্ব। সেখানে রাখা দোলার ব্যাগ আর একটা বই। জারিফের বাম পাশে একটা শপিং ব্যাগ।

দোলা নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে,”তুমিও রেস্তোরাঁয় খেয়ে নিলেই পারতে!”

_আসলে খিদে নেই। ব্রেকফাস্ট করেছি সাড়ে বারোটার সময়। তাই ভাবলাম যখন খিদে পাবে তখনই বাড়িতে যাবো।

_খাওয়া দাওয়া নিয়ে বড্ড অনিয়ম করো তুমি।

_হ্যা,অনিয়ম আমি করি আর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ মাসভর তুই খাস।

দোলা মুখ শুকনো করে বসে আছে। জারিফ তার বাম পাশ থেকে একটা প্যাকেট উঠিয়ে দোলার ব্যাগের ওপর রাখে।

দোলা বলে,”কি এটা?”

_ওষুধ।

_আবার! আমার প্রেসক্রিপশন কই পেলে তুমি!

_সেটা বড় কথা না,বড় কথা হচ্ছে এখানে একমাসের ওষুধ আছে। শেষ হলে আমাকে বলবি।

দোলা চুপ করে থাকে। মানুষটাকে নিষেধ করেও লাভ নেই। সে এসব করবেই। সে নিচু স্বরে বলে,”তুমি প্লিজ তুই তোকারি করাটা বন্ধ করবে?”

জারিফ হেসে ফেলে, বলে,”কি সমস্যা বললে? তোর মান কমবে?তুই বলতেই বেশি ভালো লাগে।”

দোলা মাথা ঘুরিয়ে নেয়। জারিফ খানিক বাদে বলে ওঠে,”বিয়ের কথা তুলছে বাড়ি থেকে তোমার?”

দোলা তাকায় না জারিফের দিকে,শুধু মুখে বলে,”হু।”

জারিফ পুনরায় চুপ হয়ে যায়। কেউ আর কোনো কথা বলে না। বেলা গড়িয়ে পরেছে। সার্কিট হাউস মাঠে দু একজন লোকের টিকি দেখা যাচ্ছে। একটা ফুচকার ভ্যান চলে এসেছে। জারিফ সেদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আর ছ’মাস সময় দিতে পারবি না?”

_তারপর কি হবে?

_শিরদারায় জোর আসবে। কারো দায়িত্ব নেয়ার মতো জোর।

_এখন কিভাবে নিচ্ছো তবে!

_এগুলো খুচরা দায়িত্ব। বেকাররা এসব নিতে পারে।

_কথা সাজাতে হবে না, মামী আমাকে মানবে না তা আমি জানি। সেসব জেনেই তো আগুনে ঝাঁপ দিয়েছি,পুড়বো বলে। তবে তুমি যদি ভেবে থাকো মামীকে মানাতে না পারলে চাকরি টা পেয়েই আমাকে নিয়ে আলাদা হবে, এমন পরিকল্পনা করলে জেনে নাও,অমন বিয়েতে আমার সম্মতি নেই।

_তাহলে কি চাস তুই?
সরাসরি দোলার মুখের পানে চেয়ে প্রশ্ন করে বসে জারিফ।

_তোমার মতো কেউ জানে না জারিফ আমি কি চাই!

_চাকরিটা পেয়ে মাকেও মানিয়ে নেবো।

_ঠিকাছে তবে, বললাম তো অপেক্ষায় আছি।

দু’জনই নীরবতা পালন করতে ব্যস্ত। অদ্ভুত এক জোড়া প্রেমীর অদ্ভুত নীরব প্রেমবিনিময়। না কেউ মুখে বললো দু’টো প্রেমময় কথা, না আঙুলে আঙুল ছুঁলো তাদের। যেভাবে চুপিচুপি নীরবে সবটা শুরু হয়েছিলো বছর চারেক আগে। সেভাবেই দুজন বসে আছে,নীরব হয়ে।

দোলার ব্যাগের পাশ থেকে শরৎচন্দ্রের “দেবদাস” উপন্যাসটা তুলে নিয়ে জারিফ দোলার দিকে তাকিয়ে বলে,“এটা সাথে নিয়ে ঘুরছিস কেনো?”

_এশা চেয়েছে, নাথপট্টি ওর বাড়িতে দিয়ে যাবো যাওয়ার সময়।

কিছুক্ষণ বইটা উল্টেপাল্টে জারিফ স্মিত হাসি হাসে,বলে,”দেবদাস…তোর আর মায়ের ইগোর চক্করে কোনদিন না জানি আমার অবস্থা এমন হয়।”

দোলা না চ’মকালো,না ঘাব’ড়ালো,সে শুধু একপলক জারিফের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

জারিফ বললো,“আচ্ছা একটু মজা করছি,রেগে যাসনা! একটা দৃশ্য কল্পনা কর। ধর তুই পারু। আমি তোর দেবদা। পারিবারিক দ্বন্দ্বে তোর অমন করে অন্য আরেকজনের সাথে বিয়ে হলো। আমি ওভাবে মাতাল হয়ে তোর দুয়ারে গিয়ে চেগিয়ে পরে থাকলাম। তুই শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দৌড়ে দৌড়ে এলি, কাঁদতে কাঁদতে। ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা বিষাদের সুর বাজতে থাকবে আর তুই আমার কাছে পৌঁছানোর আগেই…….”

দোলা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে জারিফের দিকে,তবুও জারিফ দমে যায়। কথা থামিয়ে বোকা বোকা হেসে বলে,“সরি!”

দোলার নাকের পেশী প্রসারিত-সংকুচিত হচ্ছে। জারিফ উচ্চশব্দে হেসে উঠতে চেয়েও ওঠে না। নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে, বলে,”বললাম সরি!”

_এতো অনিশ্চয়তার ডর লাগছে এখন? হাঁটু কাঁপছে? ম’রলে কেনো আমার মাঝে তবে! ম’রতে এসেছিলে কেনো?

_তুই তো তোর কপালে স্ট্যাম্প মে’রে লিখে রাখিস নি,এখানে ম’রা যাবে না!

_সংযত হওয়া উচিত ছিলো।

_সামান্য মজা করেছি দুলি! তুই টেনে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস! আচ্ছা সরি। প্লিজ বাদ দে!

_হু,বাদ।

একজন দুজন করে লোকজন আসতে শুরু করেছে সার্কিট হাউস মাঠে,কেউ বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে,কেউ তাদের পোষ্য,কেউ কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে আসছে, সম্ভবত কোচিং সেন্টার থেকে বন্ধুদের সাথে হাওয়া খেতে এসেছে।

জারিফ আশেপাশে তাকিয়ে দেখে উঠে দাঁড়ায়,উঠে দাঁড়ায় দোলাও,বেলা গড়িয়ে গিয়েছে বেশ,বিকেল পাঁচটার আগে হোস্টেলে ফিরতে হবে। মাঠের একপাশে এক ফুলওয়ালি কিছু গোলাপ বিক্রি করছিলো। দোলা সেদিকে তাকিয়ে, জারিফ কখনো তাকে একটা গোলাপ তো দূরে থাক,কখনও একটা পাপড়িও দেয়নি। নিজের অপদার্থ প্রেমিকের কথা ভেবে সে মুচকি হাসে। জারিফের তা দৃষ্টিগোচর হয়না, সে খুব স্বাভাবিক ভাবে বেঞ্চের ওপর থেকে অবশিষ্ট প্যাকেটটা উঠিয়ে দোলার হাত থেকে ব্যাগ কে’ড়ে নিয়ে প্যাকেটটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বলে,“তাজের কাচ্চি। সন্ধ্যে নাগাদ গরম গরম খেয়ে নিস!”

দোলা অন্যদিকে ঘুরে ঠোঁট টিপে হাসে,স্বস্তি মাখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে আওড়ায়,“অপদার্থ প্রেমিক!”

★★★

চারদিন হলো বিষয়টি মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। কোনো এক বস্তু দোলার নাড়ির ভেতর পাক খেতে খেতে ওপরে উঠছে ‌। ব্যাথাটা সমস্ত বক্ষপটে ছড়িয়ে যায়। গ্যাস্ট্রিকের জন্য দোলা নিয়মিত ওষুধ সেবন করে। এই সমস্যাটা নতুন। হাতে কিছু টাকা চলে আসলেই ডাক্তারের কাছে যাবে বলে ঠিক করলো দোলা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই স্টুডেন্টের টাকাটা এখন অবধি সে পায়নি, কখনো দেরী করে না ওনারা। মাস হতে না হতেই দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে বোনাসও পায় দোলা। এবারই এই প্রথম হলো। দোলা মুখ ফুটে কখনো চায়না,তাই এবারও পারলো না। তার চক্ষু লজ্জা আছে, সবসময় আগেভাগে তার বেতন এবং মাঝে মাঝে বোনাস দেয়,তাদের কাছে চাওয়াটা খারাপ দেখায়। হয়তো এ মাসে একটু অসুবিধা হয়েছে, এদের মতো উচ্চবিত্তদের অর্থসমস্যা হয়না দোলা জানে,হয়তো ভুলে গিয়েছে। মনে পরলেই দিয়ে দেবে।

“ম্যাম। আমার ছুটি?”

সাত বছর বয়সী ইউরার কথায় দোলার ঘোর কাটে। তাকিয়ে তার দিকে হেসে বলে,”জি না। শুধু পড়া ফাঁকি দেওয়া তাই না? চুপচাপ যা লিখতে দিয়েছি,লিখে দাও।”

ফোনটা বিপবিপ আওয়াজ করে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখতে পায় “জন্মদাতা” নামে সেভ করা নাম্বারটা থেকে ফোন এসেছে। দোলা তপ্ত শ্বাস ফেলে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে দবির রহমান রাশভারী গলায় বলল,”বাড়ি আসছো শিগগিরই?”

_না, কেন?

_পুকুর থেকে মাছ তুলেছি। চিংড়ি গুলো ফ্রিজে রেখেছি।

_তোমরা খেয়ে ফেলো। আমার চিংড়িতে এলার্জি।

_কবে থেকে?

দোলার ইচ্ছে করলো চেঁচিয়ে বলতে,“জন্ম থেকে। জন্ম থেকেই এলার্জি। শুধু চিংড়িতে না। আমার জীবনে এলার্জি,আমার বাবাতে এলার্জি,আমার মা’তে এলার্জি,আমার সৎ মা’তে এলার্জি।”

কিন্তু বললো না,শুধু বললো,“কিছুদিন হলো।”

ওপাশ থেকে দবির কোনো কথা বলে না। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ পেলো দোলা। পর পর বললো,”টাকা পাঠাতে হবে না। বোনকে জুতো কিনে দিও ঐ টাকায়। আমার চলছে বেশ।”

ফোন রেখে দোলা ভেজা দু’চোখ মুছে নেয় ওড়নার কোণা দিয়ে। ইউরা ম্যামকে দেখে আবারও লেখায় মনোনিবেশ করে। একবাটি কাস্টার্ড হাতে ঘরে ঢোকে ইউরার মা ফারিন। দোলা নিজেকে সামলে নিয়ে মেকি হাসে।

ফারিনের ঠোঁট জুরে আন্তরিক হাসি। দোলার হাতে কাস্টার্ডের পেয়ালা তুলে দিয়ে বলে,”খাও। শুরুটা তুমিই করো।”

দোলা পরে খাবে বলে রেখে দিতে চায় পাশে,ফারিন বাধা দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে,”বলছি খাও।”

দোলা বাধ্য মেয়ের মতো খেতে থাকে। ফারিন মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে দোলাকে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মেয়েটা ভারি মিষ্টি, আকর্ষণীয় মুখশ্রী, গাঁয়ের রং টাও নজরকাড়া। কেউ একবার তাকালে দুবার মুগ্ধ হয়ে তাকাতে ভুলবে না।

খাওয়া শেষ করে দোলা ইউরার পড়া বুঝিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ফারিন তার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলে,”নাও।”

দোলা এভাবে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে ভীষণ খুশি হলেও শুকনো হাসি হেসে ধন্যবাদ জানায় ফারিনকে। ফারিন মনমরা হয়ে বলে,”এমাসে যে কি হলো দোলা। দুই ননদের বিয়ে, দেবরের এখানে ফেরা, সবকিছু মিলিয়ে এতো অন্যমনস্ক ছিলাম যে তোমার বেতনের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আর তোমাকেও বলি, সাতদিন হয়ে গেলো,একটু মনে করিয়ে দেবে না? গতকাল রাতে ইউরার বাবা মনে করালো। যাই হোক খামটা খোলো।”

দোলা অবাক হলেও বাধ্য মেয়ের মতো খামটা খোলে। খাম খুলে দেখে তার বেতনের চার হাজার টাকার সাথে আরো দু হাজার টাকা বাড়তি। দোলার চোখে মুখে বিস্ময়। ফারিন হেসে বলে,”তোমাকে ইউরার বাবা দিলো খুশি হয়ে।”

দোলা খুবই স্বাভাবিক থাকে। তার এভাবে জারিফ ব্যতীত অন্য কারো থেকে বাড়তি নেওয়ার অভ্যাস নেই তবে এখানে ফারিন আর তার স্বামী তৌকির যথেষ্ট আন্তরিক দোলার প্রতি। এর আগেও এমন হয়েছে। দোলা ফেরাতে পারে না এই আন্তরিকতাটুকু।

ফারিন গিয়ে ইউরার কম্পিউটার টেবিলের ওপরে রাখা একটা শপিং ব্যাগ এনে দোলার হাতে দেয়।

দোলা দ্বিতীয় দফায় বিস্মিত হয়ে বলে,”এটা কি ভাবী!”

_তারানা আর তানিয়ার বিয়েতে সবার জন্য এনেছিলাম ঢাকা থেকে। তোমার জন্যও নিয়েছিলাম ফোর পিস টা। তুমি তো বিয়েতে এলে না,তাই দেওয়াও হলো না। এটা নাও। তোমার ভাইয়া নিজে পছন্দ করেছে তোমার জন্য রং টা।

দোলা বেশ কিছুক্ষণ দোনামোনা করে ফারিনের কাছ হার মানে,নিতে হয় উপহার টাকেও।

ফারিনের স্বামী শেখ তৌকির আহমেদ বরগুনা উপজেলার নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান। আল্লাহ দিয়েছেন তাই বিত্তবৈভবের কোনো অভাব নেই তার। তার বাবা শেখ তৌফিকুল আহমেদের জেষ্ঠ সন্তান সে। সামাজিক গণমাধ্যমে একটা গ্রুপে দোলা বছরখানেক আগে টিউশনির খোজ পেতে একটা পোস্ট করেছিলো সেখান থেকেই ফারিনের সাথে দোলার পরিচয়। ইউরাকে পড়ানোর জন্য ফারিন আর তৌকির ঠিক করে দোলাকে। তারপর থেকেই দোলার নিয়মিত যাতায়াত এই শেখ বাড়িতে।

বাড়িটা বেশ পুরনো। ১৯৯১ সালের দিকে বাড়িটা তুলেছিলো শেখ তৌফিকুল আহমেদ। তখনকার দিনেই দু দু’টো ইটের ভাটার মালিক ছিলেন সে। দুই হাজার তেইশে ধনসম্পদ বেড়েছে দশগুণ। মফস্বলের বড়লোকদের অস্থিমজ্জায় অহংকার মিশে থাকে। এ বাড়ির কারো মধ্যেই এসব কিছু দেখেনি দোলা। পরিবারটাকে বেশ হাসিখুশিই মনে হয়।

ফারিনের থেকে বিদায় নিয়ে দোলা ইউরার পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে বসার ঘর পর্যন্ত আসে, ফারিনও আসে পিছু পিছু। এটা ফারিনের অভ্যাস। রোজ দোলাকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়।

হঠাৎ করেই “ঘেউ ঘেউ” আওয়াজে দোলা চ’ম’কে ওঠে। বরাবর কুকুর ভীতি তার। এ বাড়িতে নতুন একটা আপদ উদয় হয়েছে “বোজো” নামের। কুকুরটার জাত কি দোলা জানে না, বিদেশি। কিন্তু অতি ভয়ংকর দেখতে। বাড়ির আঙিনায় আউটহাউজে থাকে। এতদিন ছিলো না এই আপদটা, মাসখানেক হয় এসেছে,যবে থেকে ইউরার ছোটো চাচ্চু ঢাকা থেকে এসেছে। বোজো ইউরার ঐ ছোটোচাচ্চুর পোষ্য। যেই লোকটা দোলার কাছে বোজোর মতোই স্রেফ একটা অস্বস্তি।

অস্বস্তি থেকে পালাতে দোলা ওড়না তুলে গা-মাথা ঢেকে নেয় পুরোপুরি।

বাড়ির সদরদরজা পর্যন্ত নিজেকে আড়াল করে নিয়ে এগোতে পারলো না দোলা। বোজো ছুটে আসলো তার দিকে। এমনটা রোজ হয়। দোলা আঁ’তকে উঠে ফারিনকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। বোজো ঠিক দোলা নয়,দোলার পেছনে কয়েক গজ দূরে তার মালিকের কাছে ছুটে যায়।

শেখ তৌসিফ আহমেদ,এবাড়ির সর্বকনিষ্ঠ পুত্র,গম্ভীর কণ্ঠে বোজোকে বাড়ির বাইরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিতেই বোজো বাধ্যতা দেখিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়।
দোলা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেও অত্যল্পকাল যেতেই তার চেহারার কানায় কানায় ছেয়ে যায় অস্বস্তি। আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফারিনের পেছনে।

তৌসিফ দোলার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়, গম্ভীর স্বরে ফারিনকে বলে,”ভাবি আমার গ্রে জ্যাকেট কোথায়।”

_ওয়্যারড্রোবে রেখেছি। পেয়ে যাবে।

_তুমি দিয়ে যাও।

দোলা আর দাঁড়ালো না,বোজো যখন চলে গিয়েছেই সেও দেরী না করে ফারিনকে আস্তে করে,”আসি” বলে বেরিয়ে যায়। তার পায়ের গতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার তার বড্ড তাড়া।

শেখ বাড়ি থেকে দোলার প্রস্থান ঘটলে ফারিন নিজের দেবরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় তৌসিফ ফিচেল হাসলো। হঠাৎ করে সে হাসি মিলিয়েও গেলো, কন্ঠস্বরে গাম্ভীর্য বজায় রেখে ভাবীকে প্রশ্ন করলো,”উপহার টা নিলো?”

_হু নিলো।

তৌসিফ চুপ। ফারিন বলে ওঠে,”ধৈর্য ধরো। আমার শশুর তামিলনাডু থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরলেই প্রস্তাব পাঠাবো। যেভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকো! মেয়েটা কেমন ঘা’ব’ড়ে যায়। কোন দিন না জানি বলে ওঠে ইউরাকে পড়াবো না আর!”

_আমি কখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছি?

_যেটুকুই তাকাও। তোমাকে দেখলেই হাসিখুশি মেয়েটা কেমন গুটিয়ে যায়। মেয়েরা পুরুষের দৃষ্টি খুব ভালো করে বোঝে।

তৌসিফ না কথা বাড়ায়,না ভাবীকে এই ব্যাপারে আর এক শব্দ বলার আস্কারা দেয়। ডান হাতটা ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে বলিষ্ঠ শরীর হেলিয়ে দুলিয়ে সদর দরজার দিকে যেতে যেতে বলে,”ব্যাকইয়ার্ডে যাচ্ছি, মিতুকে দিয়ে গ্রীন টি পাঠিয়ে দাও। আর প্লিজ চাপকলের পানি দিও না।”

চলমান….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে