‘আমিও কিন্তু ভুতপ্রেতে বিশ্বাস করতাম না’, বলে গল্প বলা শুরু করলেন ভুবন পাল। আমি, জেবাপ্পু, সাবিত্রী, আর বড়দা অধীর আগ্রহে বসে আছি তার গল্প শোনার জন্য। বড়দা এবার আইন পাশ করে বেরিয়েছে। জেবাপ্পু ডাক্তারী নিয়ে পড়ছে। আমি আর সাবিত্রী পিঠাপিঠি, এবার ম্যাট্রিক দেবো। আমাদের আদি বাড়ি সাতক্ষীরাতে হলেও বাবার চাকরির জন্য ছোটবেলা থেকেই আমরা ঢাকায় থাকি। বছরে দু একবার ছুটিতে যখন বাসায় যাই, তখন সব চাচাতো মামাতো ভাইবোনেরা মিলে ভুবন পালকে জাপটে ধরি গল্প বলার জন্য। ভুবন পালও বেশ রসিক মানুষ। আমরা আসার খবর পেলেই আড়াই মাইল মাটির রাস্তা হেটে আমাদের বাসায় চলে আসে। বয়স নব্বই এর কোটায় হলেও এখনো বেশ শক্তসমর্থ। চুল দাড়ি সব ধবধবে সাদা, দাত উপরের পাটির ডানদিকের দুইটা নেই। এজন্য গল্প বলার সময় কিছু কিছু শব্দের উচ্চারণ বড্ড উদ্ভট লাগে।
‘কিন্তু জংলা বাড়ির ঘটনা টা ঘটার পরে আমার ধারণা পাল্টে গেছে।’
‘কোন ঘটনা ভুবুন্দু?’ প্রশ্ন করলো সাবিত্রী। ভুবন পালকে আমরা সবাই ভুবুন্দু বলে ডাকি।
‘হুম বলছি বলছি। ঘটনাটা মনে পড়লে এখনো আমার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। আমি তখন সবে এক বাচ্চার বাপ হয়েছি। সেবার চাষ ভালো না হওয়ায় ঠিক করলাম জংলা বাড়ি থেকে বড়ো দেখে কয়েকটা গাছ বিক্রি করে ব্যবসা শুরু করবো। যেই ভাবা সেই কাজ। তারেক মুন্সীর কাছে চারটা গাছ বিক্রি করলাম। কিন্তু আপদটা শুরু হয় গাছ কাটার আগের রাতে। স্বপ্নে দেখলাম তোদের কাকাকে আমার কোল থেকে কারা যেন ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও তাদের সাথে ধস্তাধস্তি করছি। একসময় আমার ঘুম ভেঙে গেলে দেখি আমাদের মাথার ধারের জানালার পিছনে কি যেন একটা দাড়িয়ে আছে। আমি চেচিয়ে উঠি, কে ওখানে কে ওখানে?’
‘ওর মুখটা কেমন ছিলো?’ বললো জেবাপ্পু।
‘মুখতো দেখতে পাইনি, শুধু সাদা একটা অবয়ব দেখছিলাম। তোরা বললে বিশ্বাস করবি না, আমার চিতকার শুনে ওটা আমার চোখের সামনেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।’
‘তারপর কি হলো?’ কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো বড়দা।
‘তারপর আর কি, ওই রাতটা না ঘুমিয়ে ভয়ে ভয়ে কেটে গেলো। পরদিন সকালে তারেক মুন্সী লোকজন নিয়ে এসে গাছ কেটে নিয়ে যায়। সেদিন রাতে আমরা আর কেউ ঘুমাতে পারিনি।’
‘কেন ভুবুন্দু, কি হয়েছিল সেদিন?’ সাবিত্রী বললো।
‘সারারাত আমাদের টিনের চালে কারা যেন ঢিল ছুড়ছে। আবার মাঝে মাঝে মানুষ হেটে গেলে যেমন মচমচ করে, তেমন শব্দ হচ্ছে। আমাদের দক্ষিনের পুকুর টাতে হঠাৎ হঠাৎই ঝপ করে আওয়াজ হচ্ছিল। আর ঘরের পাশের গাছ গুলো প্রচন্ড বেগে দুলছিল, যেন বাহিরে খুব ঝড় হচ্ছে। অথচ সেদিন কোনো বাতাস পর্যন্ত হয়নি, আকাশ একদম পরিস্কার ছিলো।’
বড়দা বললো, ‘তোমরা তখন কি করছিলে?’
‘তখন আমি আর তোর দিদিমা তোর কাকাকে কোলে নিয়ে সারারাত হারিকেন জালিয়ে বসে ছিলাম। তোর দিদিমা তো ভয়ে অস্থির। আমারও যে ভয় করছিলো না তা না, তবে ভয় কে মনের মধ্যে চাপা দিয়ে দোয়া দুরুদ পড়ছিলাম। সকালে উঠেই ছুটে গেলাম কাসন্দিবাড়ি ইমাম সাহেবের কাছে। ইমাম সাহেব জিন ভুতের তাবিজ কবজ দেয়। তাকে নিয়ে আসলাম আমাদের জংলা বাড়িতে। তিনি সবকিছু শোনার পর কি সব যেন পড়লেন বিড়বিড় করে। আমার হাতে আটটা তাবিজ দিয়ে বললেন প্রথম চারটা ঘরের চার কোনায় পুতে দিতে, আর পরের চারটা জংলা বাড়ির চার কোনায় পুতে দিতে। একটা লোহার শিক দিয়ে আমাদের ঘরের চারপাশে গন্ডি আঁকলেন। এরপর কি সব পড়তে পড়তে পুরো জংলা বাড়ির চারপাশে হেটে আসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে হুজুর?
তিনি যা বললেন তা শুনে তো আমার মাথা ঘুরে গেলো।’
সাবিত্রী আর কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বললো, ‘তিনি কি বলছিলেন ভুবুন্দু?’
‘বলছি বলছি, কিন্তু তার আগে তুই যা তো, আমার জন্য একটু তামাক নিয়ে আয়।’
সাবিত্রী দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে তামাকের কৌটাটা আনলো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমরা বসেছি ঊঠনে, বারান্দার লাইটটা জ্বালালে এখানে আলো আসে, কিন্তু আজকে এখনো বারান্দায় লাইট জ্বালানো হয়নি। চারিদিকে আবছা অন্ধকারে কেমন যেন ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভুবন পাল হুকোয় তামাক নিয়ে আগুন লাগিয়ে আরাম করে টান দিতে দিতে আবার গল্প বলা শুরু করলেন, ‘তখন ছিলো ব্রিটিশ শাসনামল। কোনো এক জমিদারের বাড়ি ছিলো এই জংলা বাড়িতে। জমিদারের একমাত্র মেয়ে একদিন আগুনে পুড়ে মারা যায়। এরপর থেকে তার আত্না এই জমিদার বাড়িতে ঘোরাঘুরি করতো। অনেকেই দেখেছে তার আত্মাকে। যে তার আত্মাকে দেখতো, তার কোনো না কোনো ক্ষতি হয়ে যেতো। একসময় ব্যাপার টা সবার মধ্যেই জানাজানি হয়ে যায়। চাকর বাকরেরা সবাই পালিয়ে যেতে লাগলো। উপায় না দেখে জমিদার সেই সময়ের ধুরন্ধর এক গুনিনকে আনলেন। গুনিন এসে সেই আত্নাকে বন্দী করে এক গাছের মধ্যে আটকে রাখে। এরপর অনেক বছর কেটে গেছে, দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরে আমি জংলা বাড়িতে এসে বাড়ি করি। এতবছর ধরে সে আত্না গাছের ভিতরেই বন্দী ছিলো। যখন গাছ কেটে ফেলি তখন সেই আত্মা মুক্তি পেয়ে যায়। এরপর এতো সব কান্ড। ইমাম সাহেব বলে যায়, এইবারের মতো বাড়িটা বন্দী করে রেখেছেন, কিন্তু কতক্ষণ রাখতে পারবেন জানেন না।’
জেবাপ্পু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তারপর কি হলো ভুবুন্দু?’
‘এরপর সপ্তাহ খানেক ভালোই কাটছিলো। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি তোর কাকা ঘরে নেই। অথচ ঘরের দরজা ছিলো ভিতর থেকে বন্ধ। অনেক খোজাখুজির পর ওর লাশ পাই জংলা বাড়ির উত্তর ধারে পুরাতন জমিদার বাড়ির একটা ইটের ভিতের মতো আছে, ওইটার উপর। কিন্তু তার পুরো শরীর ছিলো কালো। মনে হচ্ছিল যেন কেউ একে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিছে। এটা দেখে তোদের দিদিমা পাগল হয়ে যায়। তিন দিন পরে তোর দিদিমাও মারা যায়। বললে বিশ্বাস করবি না, যখন তোর দিদিমা কে গোসল করাচ্ছিলাম, তখন দেখি তার শরীরের ভিতরের অংশ টা পুড়ে ছাই হয়ে আছে। এরপর থেকে ওই বাড়ি ছেড়ে আমি কাসন্দি বাড়িতে আমার ছোট ভাইয়ের বাড়িতে থাকি।’
অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশে। সাবিত্রী আমার হাত জড়িয়ে ধরে আছে। বুঝতে পারছি, আমার মতো সেও ভয় পাচ্ছে।
বড়দা বললো, ‘তারপর ওই জংলা বাড়ির কি হলো?’
‘জংলা বাড়ি ওভাবেই আছে। কেউ যায় না ওখানে। মাঝে মাঝে ওর মধ্যে ছাগল গরু ঘাস খেতে ঢুকলে আর বের হয় না। এখনো নাকি মাঝরাত্রিতে জংলা বাড়ির ভিতর থেকে একটা কুমারী মেয়ের কান্নার শব্দ পাওয়া যায়।’
~জংলা বাড়ির ভূত’
~ইমামুল হাসান’