ছোটোগল্প: প্রহার | লেখিকা: ইশরাত জাহান সুপ্তি

0
1895

#গল্পপোকা_ছোটোগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
ছোটোগল্প: প্রহার
লেখিকা: ইশরাত জাহান সুপ্তি

বারান্দায় লোহার গিল গলিয়ে অনধিকারে প্রবেশ করে চলেছে শীতের হিমেল হাওয়া।টবে থাকা ক্যামেলিয়া ফুলের পাতা সেই হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে মৃদু মৃদু নড়ে উঠেছে।বিছানায় কম্বলটা অগোছালো হয়ে খোলা পড়ে রয়েছে।এই পৌষের মাঝ রাত্রিতে যার এই মুহুর্তে তার ভেতরে থাকার কথা সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।গায়ে একটা পাতলা চাদর অব্দিও নেই।হাঁড় কাপিয়ে তোলা ঠান্ডা হাওয়ার দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।সে শুধু অনবরত ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফোনের একটি নাম্বারে ডায়াল করে যাচ্ছে।কানের কাছে ফোন নিয়ে বারবার নিরাশ হচ্ছে আর ভাবছে,এই এই বুঝি ফোনটা ধরলো!
কিন্তু না হলো না।জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটযুগলকে ভিজিয়ে সোমা আবারো চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো,হাল ছাড়লো না।অসংখ্য মিসডকলের পরে অবশেষে ওপার থেকে হয়তো একটু দয়া হলো।ফোনটা রিসিভ করেই ঝাঝ মাখানো গলায় বললো,

‘কি শুরু করেছো বলো তো সোমা!এই শীতের মধ্যে কি একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দেবে না।’

‘আরিফ,আমি কতক্ষণ ধরে ফোন করে যাচ্ছি।তুমি ফোনটা ধরছো না কেনো?’

‘বললাম তো ঘুমাচ্ছিলাম।এখন কি ঘুম বাদ দিয়ে তোমার ফোনের জন্য বসে থাকবো?’

‘আগে তো বসে থাকতে।বলতে আমার সাথে কথা না বললে তোমার ঘুম আসে না।ঘুমিয়ে গেলেও আমার নাম্বার থেকে কল বাজতে না বাজতেই রিসিভ করে ফেলতে।’

‘এখন এই ফাও প্যাঁচাল বন্ধ করো তো!কি বলার জন্য ফোন করেছিলে তা বলো।’

‘আরিফ,কাল কি আমরা একটু দেখা করতে পারি,খুব প্রয়োজন।প্লিজ!’

‘আচ্ছা ঠিকাছে।কাল বিকেলে এসো।এই বারই কিন্তু লাস্ট,আমি এখন খুব ব্যস্ত।এমন হুটহাট এতো দেখা করতে পারবো না।’

কথাটা বলে আরিফ ফোন কেটে দিলো।আস্তে করে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে সোমা ফিরে এলো বিছানায়।কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে দিলো।পায়ের নিচের কম্বলটা টেনে গায়ে দেওয়ার কথা তার আর মনে রইলো না।

পরেরদিন বিকেলে অনেক আগেই চলে গেলো সোমা সেই পুরনো জায়গায়।যেখানে কখনো আরিফের সাথে প্রায়ই আসতো সে।কাঠের বেঞ্চিতে বসে আরিফের হাতে হাত রেখে কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে সামনের স্বচ্ছ দীঘির জল দেখতো।পাশের গাছ থেকে ঝড়ে পড়া শিউলি ফুল দীঘির জলে ভাসতে থাকতো।তাই মুগ্ধ চোখে নীরিক্ষণ করে গভীর সুখে আরিফের মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনতো সোমা।সেসব আজ পুরনো।অনেক আগের কথা।প্রায় এক বছর হলো আরিফের চাকরি পাওয়ার কয়েক মাস পর থেকে সোমা আর এমন দিন দেখেনি।ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সোমার মুখ থেকে।নির্ধারিত সময়ের আরো পঁচাত্তর মিনিট পর অবশেষে আরিফ এলো।এসে সোমার পাশে না বসেই দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

‘কি বলতে চাও বলো।’

সোমা উঠে দাঁড়িয়ে সামনের অবাধ্য চুলগুলোকে কানে গুঁজে দিয়ে আরিফের একটা হাত ধরে বলল,
‘আরিফ তুমি একটু তোমার বাসায় কথা বলো না।আমার বাসা থেকে বিয়ের জন্য খুব প্রেশার দিচ্ছে।আমি সামলাতে পারছি না।তোমার তো এখন জব হয়ে গেছে,তুমি তো আর বেকার নেই।এখন তো আর আমার বাসায় বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে অসুবিধা নেই।পাঁচ বছর ধরে বাসায় আসা সব বিয়ের প্রপোজালগুলো আমি রিজেক্ট করে গেছি।এখন তারা আর কতো মানবে বলো!’

সোমার হাতটা নিজের থেকে ছাড়িয়ে আরিফ বললো,
‘দেখো সোমা,আমি তোমাকে এখন একটা কথা বলি তুমি খুব ঠান্ডা মাথায় মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ঠিকাছে!’

সোমা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।সে খুব মনোযোগ দিয়েই শুনবে।আরিফ বলতে লাগলো,
‘সোমা আমি অনেক ভেবে দেখেছি।আমাদের সম্পর্কের কোনো মানে হয় না।আমি চাইলেও আমার পরিবার তোমাকে মেনে নিবে না।আমি আর কিছুদিন পরই একমাসের জন্য দুবাই যাচ্ছি।আমার প্রমোশন হয়েছে।বুঝতেই পারছো।আমার মনে হয় যেখানে আমার পরিবারই তোমাকে মানবে না তাই শুধু শুধু এই অনর্থক সম্পর্কটাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।আমাদের এখানেই থেমে যাওয়া উচিত।’

কথাটা বলে আরিফ চলে গেলো।একবারও পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করলো না।সোমা আর কিছু বলতে পারলো না।স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।ভগ্ন হৃদয়ের এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ও’র চোখ বেঁয়ে।কি সহজে বলে দিলো আরিফ তাদের পাঁচ বছরের সম্পর্কটা অনর্থক।তাদের এখানেই থেমে যাওয়া উচিত।কথাটা বলতে গিয়ে কি একবারো তার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো না তবে সোমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো?বুকটাতে কেউ যেনো অবিরত ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে।আরিফ চোখের আড়াল হতেই ধপ করে মাটিতে বসে দু হাতে মুখ ঢেকে ঝর ঝর করে কেঁদে দিলো সোমা।

বাসায় ফিরে গিয়েও সোমা সারারাত দিন দরজা বন্ধ করে অবিরাম কেঁদে গেলো।প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলো সোমা।ডিপ্রেশনে চলে গেলো আবার একা একা কারো সহায় ছাড়াই বেরিয়েও এলো।তবুও কষ্টটা যেনো কমার নামই নিচ্ছে না।সেই কষ্ট বুকে নিয়েই সোমাকে বিয়ে করতে হলো।এবারে আর তার কোনো কথা খাটলো না।ছেলে ইঞ্জিনায়ার,দেখতে সুদর্শন,আর্থিক অবস্থা ভালো।এমন ছেলে আর কোন পরিবারই বা হাত ছাড়া করতে চায়।আর সোমাও কার কারণেই বা না বলতো!না বলার কারণটাই যে তাকে না বলে চলে গেছে।অতঃপর পাঁচ বছরের সম্পর্ক ভঙ্গনের এক বুক কষ্ট নিয়েই সোমাকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হলো।

সোমার বরের নাম আয়াত।আজ আয়াত আর সোমা হানিমুনে কাশ্মিরে যাবে।আয়াতের ছুটি অল্প।তাই বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যেই এতো তাড়াহুড়া।সকাল থেকে সেই গোছগাছই চলছে।নতুন বউ হিসেবে সোমাকে কেউ কোনো কাজ করতে দিচ্ছে না।গোছগাছের সবটাও আয়াত সামলে নিচ্ছে।ছেলেটা সোমার খেয়াল রাখায় কোনো কমতি রাখছে না।বাড়িতে মেহমান এখনো ভরা।একটি গোলাপি রঙের কাতান শাড়িতে সোমাকে হলরুমের সোফায় বসিয়ে রাখা হয়েছে।তার গলায় একটি সুন্দর সোনার হার।তাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।একে একে সবার থেকেই বিদায় নেওয়া হলো এখন শুধু বেরোবার অপেক্ষা।আয়াত হুট করে আবার কোথায় যেনো হাওয়া হয়ে গেলো।আয়াতের দুষ্ট ছোটো বোন টা সোমার কাছে এসে বলল,

‘ভাবী,তোমাকে দেখতে আজ যা লাগছে না!এই জন্যই তো বলি আমার ভাই এতো পাগল হয়েছিলো কেনো!জানো ভাবী,তোমাকে ভাইয়া একবার শুধু রাস্তায় দেখেই শেষ।বাসায় এসে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিয়ে বলেছিলো এই মেয়েকেই সে বিয়ে করবে।বাবা মাও তাই তো তড়িঘড়ি করে তোমার বাসায় প্রস্তাব নিয়ে গেলো।’

আয়াত এসে তার ছোটো বোন তুলির মাথায় একটা আস্তে করে বারি দিয়ে বলল,
‘হয়েছে বক বক করা?এবার এখান থেকে যা।’

তুলি মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলে আয়াত একটু খুকখুক করে কাশি দিয়ে সোমাকে নরম গলায় ডেকে বলল,
‘সোমা,আমার ছোট ভাই এসেছে বিদেশ থেকে এই মাত্রই।বিয়ের সময় জরুরি কাজের চাপে আসতে পারে নি।আর এখন আবার আমরা চলে যাচ্ছি।এই যে,তুমি কথা বলো।’

কথাটা বলে আয়াত সামনে থেকে সরে যেতেই তার ছোটো ভাই এক কদম এগিয়ে এলো।যাকে দেখে সোমা প্রচন্ড চমকে উঠলো।নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিলো না তার।একই অবস্থা সামনে থাকা আরিফেরও।তার এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথেই কি তবে তার বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে!আয়াত সেখান থেকে চলে গেলো।কিছুক্ষণ পরই তাদের ফ্লাইট।সে ব্যাগপত্র গাড়িতে উঠাতে ব্যস্ত।সোমা আর আরিফ দুজনের মধ্যেই নিরবতা বিরাজ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ আরিফের দিকে অবাক অপলক হয়ে তাকিয়ে থেকে সোমা অন্যদিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

‘ভালো আছো আরিফ?কত বড় একটা সারপ্রাইজ পেলাম আমরা দুজন তাই না!তুমি বলেছিলে তোমার পরিবার আমাকে মেনে নিবে না আর আজ সেই পরিবারের বড় বউ হয়েই আমি এ বাড়িতে এলাম।কি অদ্ভুত তাই না!’

আরিফ আহত মুখে সোমার দিকে তাকিয়ে রইলো।গোলাপি রঙের কাতান শাড়ি,টুকটাক সোনার গয়না,নাকফুল,গাঢ় লাল রঙের মেহেদী পরানো দু হাত ভরা চুড়ি তে সোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে।নতুন রূপে সোমার সৌন্দর্য্য যেন আজ হুট করেই বেড়ে গেছে।সে শুধু অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
‘সোমা!’
সোমা আর কিছু বলতে দিলো না।হাত দিয়ে থামিয়ে ধরা গলায় বলল,
‘আর কিছু বলো না।সেদিন তো শুধু তুমিই বলেছিলে আজ আমাকে বলতে দাও।আরিফ,তোমার জন্য আমি পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছিলাম।বাসায় আসা একটার পর একটা ভালো সম্বন্ধ আমি ফিরিয়ে দিয়েছি,শুধু তোমার জন্য।তখন তুমি বলতে, ‘সোমা একটু অপেক্ষা করো,আর একটু।আমার চাকরিটা হয়ে গেলেই তোমার যোগ্য হয়ে আমি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো।’সেই আশায় আমি দিনের পর দিন বসে থেকেছি।বাসায় সবার বিপক্ষে গিয়েছি। আর আজ যখন তুমি যোগ্য হয়ে গেলে তখন আমি হয়ে গেলাম তোমার অযোগ্য।পরিবার মানবে না অযুহাত দিয়ে তুমি সব দায়সারা করে নিলে।আর আজ সেই পরিবারই আমাকে মেনে নিলো কেনো বলো তো?আসলে কি জানো আরিফ,ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাইলেই অসংখ্য কারণ দেখানো যায় কিন্তু হাতটা শক্ত করে ধরে রাখার জন্য একটা কারণই যথেষ্ট।ভালোবাসা!’

আরিফ নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।সোমার দিকে চোখে চোখ রেখে কথা বলার ক্ষমতাও আজ তার নেই।যেই সোমাকে সেদিন নিজ থেকে সে ছেড়ে দিয়েছিলো আজ সেই সোমাকেই নিজের বড় ভাইয়ের বউ হিসেবে আরিফ কিছুতেই মানতে পারছে না।বুকের ভেতরটা বারবার কেমন যেনো করছে।সোমা আর সেখানে দাঁড়ালো না।বাইরে এসে দেখলো আয়াত সব ব্যাগগুলো গাড়িতে তুলে ফেলেছে।সোমা দ্রুত গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো।
আয়াতও এসে পাশে বসতেই মাথা নিচু করে বলল,

‘আপনি নাকি আমাকে বিয়ে করার জন্য বাসায় ঝড় উঠিয়ে ফেলেছিলেন?’
আয়াত মাথায় হাত দিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো।সোমা তাকিয়ে বলল,
‘সিনেমার মতো প্রথম দেখাতেই কি ভালোবেসে ফেলেছিলেন?’
‘না।তখন ভালো লেগেছিল।আর এখন ভালো লাগতে লাগতে ভালোবেসে ফেলেছি।’
সোমার চোখে পানি এসে পড়লো।আয়াত উদ্বিগ্ন মুখে বলল,
‘ভালো লেগেছে বলেছি বলে কি কষ্ট পেলে?’

আয়াতের একটি হাতে সোমা হাত রেখে মৃদু হেঁসে বলল,
‘না।শুনে ভালো লাগলো,ভীষণ ভালো লাগলো।যে ভালো লাগার জন্য হাত এতো শক্ত করে ধরতে পারে সে ভালোবাসলে নিশ্চয়ই সেই হাত আর কখনোই ছাড়বে না।’

একটি বিশ্বস্ত ভরা হাসি দিয়ে শক্ত করে সোমার হাতটি আগলে ধরে আয়াত গাড়ি স্টার্ট দিলো।পেছনের সবকিছু ফেলে তারা এগিয়ে গেলো সামনে,তাদের জন্য অপেক্ষা করা একটি নতুন অধ্যায়ের দিকে।হয়তো সেখানেই শুরু হবে তাদের একটি নতুন গল্প।একটি সুন্দর ভালোবাসার গল্প।

★★সমাপ্ত★★

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে