ছোটগল্প: নারী কথন | লেখা:জেসিয়া জান্নাত রিম

0
2107

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০

ছোটগল্প: নারী কথন
লেখা:জেসিয়া জান্নাত রিম

কিরে রাত বাজে ১:৪৫ এখনো জেগে আছিস কেন?
মানুষের রাত জেগে থাকার অনেক কারণই তো থাকে।
তোর কি কারণ শুনি?
সেগুলোই খোঁজার চেষ্টা করছি কিন্তু কোনো কারণই পাচ্ছিনা তাই আরো ঘুম আসছে না।
তোর কারণ খুঁজতে হবে না তুই ঘুমা।
কারণ না খুঁজলে যে কৌতুহল মরেনা আর কৌতুহল নিয়ে ঘুমানো সম্ভব না।
কিসের কৌতুহল?
এইযে রাত জেগে থাকি কেন?
উফ তোকে নিয়ে যে কি করি। তুই দিনদিন এত পাগলামি করছিস কেন বলতো?
হয়তো আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা এটা কি আব্বুকে বলবে?
কোনটা?
এইযে আমি রাত জেগে থাকি আর পাগলামি করি।
হ্যাঁ বলবোই তো। বলতে তো হবেই। তোকে একটা ডাক্তার তো দেখাতে হবে। কদিন বাদে তোর বিয়ে আর এখনই যদি মাথা খারাপ হয়ে যায় তাহলে হবে তোর বিয়ে?
আচ্ছা দেখিও। এখন ঘুমাতে যাও আমার না হয় ঘুম নাই তোমার তো আছে।
হ্যা আমিই ঘুমাই। নাহলে তোর সাথে বকবক করতে করতে আমিও পাগল হয়ে যাবো।
আম্মু যাওয়ার পরও একই ভাবে বারান্দার দোলনায় বসে আছি। আর ভাবছি আম্মু কত বোকা। আচ্ছা আম্মু এতো বোকা কেন? সবার আম্মুই কি এমন? নাকি শুধু আমার আম্মুই। বোধহয় শুধু আমার আম্মুই। নাহলে রোজ রাতে এসে একই কথা বার বার কেউ বলে নাকি। কে যেনো বলেছিল মায়েরা সব বোঝে। কই আমার আম্মু তো বুঝতে পারে না। নাহলে তার করা প্রশ্নে যে আমি রোজই মিথ্যা উত্তর দেই কবেই ধরে ফেলতো। আমার রাত জাগার কারণ গুলো অনেক আগেই বের করে ফেলেছি আমি। তাই রাত জাগায় কোনো সমস্যা হয় না আমার। আসলে শুধু আম্মু না আমিও বোকা। না হলে দিনেরপর দিন এভাবে রাত জেগে কাটাই। আর বোকা আম্মুর কথামতো চলি।

আচ্ছা মেয়ে হয়ে জন্মানো কি অপরাধ? হয়তো। নিজের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা হয় আমার। সৃষ্টিকর্তা আমাকে মেয়ে বানিয়েই কেনো দুনিয়াতে পাঠালেন। আজ মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে কত কথাই না শুনতে হয়েছে। আগে আব্বুর কত ক্লোজ ছিলাম। যাই হোক না কেন সবার আগে আব্বুকে বলতাম। কিন্তু এখন আমাদের মাঝে কত দুরত্ব। আগে আব্বু আসলেই আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কোলে উঠতাম গল্প করতাম। আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো‌ “মাই লিটিল প্রিন্সেস।” তখন মনে হোতো আমি অনেক লাকি একটা মেয়ে। নিজেকে খুব ভালোবাসতাম। রাতে শান্তিতে একটা ঘুম দিতাম। কিন্তু জীবনের কিছু ঘটনা আমার কাছে প্রমান করে দিয়েছে মেয়ে হয়ে জন্মানোটা কত বড় অপরাধ। আমার এখনো মনে আছে। তখন ছয় বছর বয়স। বাসায় একটা আংকেল আসতো। আংকেলটা আমাকে খুব আদর করতো। কিন্তু আমার ওনার আদর ভালো লাগতো না। তখন এতসব বোঝার বয়স আমার হয়নি তবুও ভালো লাগতো না। এখন ব্যাপারটা বুঝি। আংকেলটা কিছুদিন পর শহর ছেড়ে চলে গেছিলো। আমিও আমার জীবনে স্বাভাবিক হয়ে এসেছিলাম। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে ভালোই ছিলাম আম্মুর বোকামো গুলো ও ততদিনে প্রকাশ পায়নি। অন্য বাচ্চারা কাদলে নাকি আম্মু আম্মু বলে কাদেঁ কিন্তু আমি সবসময় আব্বু আব্বু বলেই কাদঁতাম। কিন্তু এক পর্যায়ে আমার ‌জীবন পুরোপুরি বদলে গেল। আমার ১৩ বছর পুর্ণ হওয়ার কিছুদিন পরের কথা। নারী হিসেবে জন্ম নেওয়াতে সবথেকে অভিশপ্ত দিন ছিল ঐ দিনটি। আজও সেই অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। কারণ আমি নারী। আমার তেরো বছর পূর্ণ হওয়ার পরদিন থেকেই আম্মু আমাকে চোখে চোখে রাখতে লাগলো। প্রথমে আজব লাগতো কিন্তু কিছু বুঝতাম না। তো সেদিন সকালের ঘটনা। তখন আনুমানিক ৮ টা বাজে। ছুটির দিন বলে ঘুমুচ্ছিলাম। হঠাৎই আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙে আমার। উঠে চোখ কচলে তাকাতেই দেখি গায়ের চাদরে রক্ত।চাদর সরাতেই বিছানায় আরো রক্ত দেখে ঘাবড়ে গিয়ে কাদঁতে কাদঁতে আব্বুকে ডাকতে থাকি। আম্মু আমার মুখ চেপে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেলেন। আম্মুর এমন আচরণে আমি কাদঁতে ভুলে গিয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখন আম্মু মুচকি হেসে আমাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন। আর সবশেষে বললেন আব্বুকে এ ব্যাপারে কিছু না বলতে। কেন এমনটা বলল বুঝিনি তখন। কিন্তু মনে হয়েছিল আমার জীবনে বড় রকমের একটা পরিবর্তন এসেছে যার সমন্ধে কিছু না জানায় আম্মু যেভাবে বলে সেভাবেই চলতে হবে।সেই থেকেই আব্বুর সাথে দুরত্ব বাড়লো আমার। আর সেখান থেকেই বাইরের জগৎের রূঢ় সত্যতা সম্পর্কে জানতে পারলাম। বাসায় একজন প্রাইভেট টিউটর ছিল আমার। হঠাৎ ই একদিন আমার পায়ে তার পা ঘষতে শুরু করল তিনি। প্রথম কয়দিন পাত্তা দিই নি। কিন্তু ক্রমেই তার পা উপরে উঠতে লাগলো একটু একটু করে। আর সহ্য করলাম না। আম্মুকে বলে দিলাম সব। আম্মু টিউটর চেন্জ করে দিলেন। আর বললেন আব্বুকে কিছু বলো না। দ্বিতীয় জন আরো ভয়ংকর কথায় কথায় টাচ করার চেষ্টা করে। আম্মুকে বলতেই পড়ানোর সময় আম্মু বসে থাকতে শুরু করল। এবারও আম্মু বলল আব্বুকে বলো না। আমি স্কুলে যেতাম গাড়ি করে। আমার জন্য আলাদা ড্রাইভার ছিল। সে কেমন করে যেনো তাকাতো আমার দিকে। আম্মুকে বলতেই ড্রাইভার চেন্জ করে বৃদ্ধএকজন কে রাখলো। কিন্তু এসবের কিছুই আব্বু জানতে পারলো না। আমি তখন ক্লাস নাইনে। এখন মোটামুটি সব বুঝতে পারি। একদিন ক্লাস টিচার ফয়েজ স্যার আমাকে অফিস রুমে ডেকে পাঠালেন। উনি খুব রাগি ছিলেন। তাই ভয়ে ভয়ে আমি অফিস রুমে গেলাম। অফিস রুমে তখন কেউ ছিল না। স্যার চেয়ার ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। প্রথমে আমার পিঠে হাত রাখলেন। পর মূহুর্তেই ওনার হাত আমার পিঠ জুড়ে নাড়তে লাগলেন। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভয়ে কিছুই বলতে পারলাম না। তাই দেখে হয়তো ওনার সাহস কিছুটা বেড়ে গেল। উনি কিছু না ভেবে সরাসরি আমার বুকের উপর হাত রাখলেন। কিন্তু বেশিদুর অগ্রসর হতে পারলেন না সুপ্তি ম্যাম এসে যাওয়ায়। আমি সোজা ছুটি নিয়ে বাসায় চলে এলাম। এসেই বাথরুমে ঢুকে পুরো একটা সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে অনেক্ষন গোসল করলাম। তবুও মনে হলো গায়ে নোংরা লেগে আছে। আবর্জনার স্তুপে ডুবে আছি আমি। আম্মুকে বলতেই স্কুল চেন্জ করে দিলেন। আর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। শুধু ইমপর্টেন্ট দিন গুলোতে স্কুলে যেতাম সঙ্গে যেত আম্মু। আর ক্লাস নোট বাকিদের কাছ থেকে নিয়ে নিতাম। কিন্তু ক্লাস টেনে ওঠার পর বাধলো বিপত্তি। এভাবে ক্লাস করে এস এস সি দেয়া যায় না। তখন স্কুলের বাকি মেয়েদের সাথে সাদমান স্যারের ব্যাচ এ ভর্তি করে দিল আম্মু। দুপুরের দিকে যেতাম বিকালে আসতাম। উনি নিজের বাসায় ব্যাচ করাতেন। একদিন দুপুরে ওনার বাসায় পড়তে গেলাম। সেদিন কোনো জ্যাম না থাকায় আগেই পৌছে গেলাম। হঠাৎ আকাশটা মেঘলা হয়ে বৃষ্টি নামতে লাগলো। তখন আমি একা ওনার বাসায়। কেউ তখনো আসেনি। আমি বই বের করে পড়ছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে স্যার আমাকে জরিয়ে ধরলো। আমি চিৎকার দিতে ভুলে গেছি অনেক আগেই। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছিলো খুব। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম খুব কিন্তু ওনার সাথে পেরে উঠছিলাম না। ধস্তাধস্তির এক পর্যায় উনি আমার জামার কিছু অংশ ছিঁড়ে ফেললেন। জোর করে আমার শরীরের বিভিন্ন আপত্তিকর স্থানে হাত দিলেন। সেসময় হুট করে ওনার বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। উনি বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই আমার ড্রাইভার চাচাকে দেখে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলেন। আমি দ্রুত ওড়না দিয়ে নিজেকে পেঁচিয়ে নিলাম। চাচা আমার দিকে তাকিয়ে হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছিলেন। তাই স্যারের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে বললেন, মামনি ভাবি তোমারে নিয়া বাসায় যাইতে কইছে বাইরে বৃষ্টি হইতাছে হের লাইগা। সেদিন গাড়িতে বসে অনেক কাদঁলাম। বাসায় এসে আম্মুকে বললাম কেনো আমাকে চিৎকার করা শেখালে না। উত্তরে আম্মু বলল, চিৎকার করলে লোক জানাজানি হতো। তোর বিয়ের সময় ও অনেক সমস্যা হতে পারে। সেদিন থেকে বুঝলাম আমার আম্মু পৃথিবীর সবথেকে বোকা আম্মু। ভিষণ অভিমানে দুদিন কথা বলিনি আম্মুর সাথে। সেদিনের পর থেকে রাত জাগা একটা অভ্যাসে পরিণত হলো আমার। এখন অনেকটা বড় আমি। বিয়েও ঠিক হয়ে গেছে। কাল এংগেজমেন্ট আমার। আবিদকে মানে আমার হবু হাসবেন্ড কে বলতে চেয়েছিলাম আমার এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা গুলো। কিন্তু ওর দৃষ্টিও আমার কাছে কেমন যেনো লাগে। তাই আর বলতে ইচ্ছা করে নি। হয়তো বাকি জীবনটাও এই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে এভাবেই রাত পার করতে হবে আমাকে।

একটু আগে আবিদের সাথে আমার এংগেজমেন্ট শেষ হলো। অর্থাৎ হাফ বিয়ে সম্পন্ন। এরপর থেকেই ও কেমন যেনো করছে। কথায় কথায় গায়ে হাত দিচ্ছে। কোমড় জড়িয়ে ধরছে। সত্যি বলতে ওর ছোয়া আমার ভালো লাগছে না। মনের মাঝে পুরোনো কথা গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার। সেজন্য অনেক কষ্টে নিজেকে আড়াল করে আমার রুমের বারান্দায় দাড়াঁলাম এসে। হঠাৎ আবিদ এসে আমার রুমের দরজা বন্ধ করে দিল। আমি কিছু বলার আগেই আমার ঠোঁট দখল করে নিল। আমি হাত পা ছুড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। যখন হাল পুরো ছেড়ে দিলাম। কোথা থেকে যেনো আব্বু এসে আবিদকে টেনে নিয়ে মারতে শুরু করলো। পুরো ঘটনাটা বুঝতে কিছু সময় লাগলো আমার। আমার আর আব্বুদের বারান্দা প্রায় পাশাপাশি। আব্বু ফোনে কথা বলতে বারান্দায় এলে আবিদকে দেখেছে। আর তারপর এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেছে। আবিদের সাথে সেদিনই বিয়ে ভেঙে গেলো আমার। তাতে একটুও কষ্ট হয়নি বরং খুশি হয়েছিলাম খুব। সেদিন আব্বুকে জড়িয়ে ধরে সবকিছু বলে দিয়েছিলাম। আব্বু সব শুনে বলেছিল সবাইকে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছেন তিনি। আমি কিছু না বললেও আম্মু ঠিকই বলতো আব্বুকে সব। সেদিন পুরোপুরিই বুঝতে পেরেছিলাম আম্মু আসলে কতটা বোকা। তারপর আর নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়নি আমার। কারণ এখন মনে হয় সব পুরুষ খারাপ হলেও কোনো বাবা খারাপ হতে পারেনা।

সমাপ্ত।।

যদিও গল্প এবং গল্পের চরিত্রগুলো কাল্পনিক কিন্তু এটা এক একটা মেয়ের জীবনের হিডেন এবং ভয়ংকর কিছু স্মৃতি। আমার জানামতে এমন কোনো মেয়ে নেই যে একবারের জন্যও কোনো সেক্সুয়াল হ্যারেসমেন্টের শিকার হয়নি। ??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে