ছোটগল্প
আস্তিনের সাপ
ঘটনা এক
রুবিনা আর রাজিব প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করল।ধীরে ধীরে মেনে নিল দুই পরিবার।বিবাহিত জীবনের চৌদ্দ পনের বছর পেরিয়ে তৃতীয়বারের মতো মা হতে চলেছে রুবিনা।আগের দুটো ছেলে তাই এবার মেয়ের শখে সন্তান নেয়া।
রুবিনা কোন কালেই সুন্দরী ছিল না কিন্তু্ু প্রেম ও বিয়ের সময়টাতে সে ছিল পাতলা ফিনফিনে আকর্ষণীয় শারিরিক গঠনের চপলা তরুনি।তার সুন্দর সাজগোজ,কাজল টানাচোখের চাহুনি,হাইহিল পরা মোহনীয় ফিগার আর একরাশ মেঘকালো চুলের প্রেমে পাগলপারা ছিল তখন ভার্সিটির সিনিয়র ছাত্র রাজিবসহ আরও অনেকেই।
একে তো দিন মাস বছরের পালাক্রম তারওপর বাচ্চাকাচ্চা,ঘরবাড়ি সামলাতেই কোনদিক দিয়ে যেন রুবিনার আকর্ষণগুলো উবে গেল।এখন তার ভারী শরীর,বেশ খানিকটা উঁচু চর্বিময় পেট আর মেঘকালো চুলের জায়গায় পাতলা আগাছার মত অল্প কিছু চুল।রাজিবেরও মেদ জমেছে তবে সৌন্দর্য্য না কমে বরং যোগ হয়েছে পুরুষালি ব্যক্তিত্বের নতুন মাত্রা।
“মহিলা ছাড়া পুরুষ কারো কাছে আমি আলট্রাসনোগ্রাম করাব না।ঐ মোতিন ডাক্তার একটা চরিত্রহীন লম্পট এর আগের দুবার আমার সাথে অসভ্যতা করেছে।”
বলল রুবিনা।
উত্তরে রাজিব বলে বসল,
কি যে বল না!তুমি কি নিজেকে আমার বোনদের মতো সুন্দরী মনে করো না কি?মোতিন আমার ন্যাংটাকালের বন্ধু তাছাড়া ডাক্তারদের কত সুন্দরী সুন্দরী পেসেন্টদের নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়,না ছুঁয়ে তো আর ট্রিটমেন্ট করা যায় না।
ঘটনা দুই
তিন্নির বয়স বার বছর।ভিষন চন্ঞ্চল আর ছটফটে স্বভাব তার।মা তানিয়া সবসময় চেষ্টা করেন একমাত্র মেয়েকে এখন থেকেই একটু একটু করে ঘরের কাজটাজ শেখাতে।মেয়েটাকে মেয়েলি শান্ত স্বভাবসুলভ গড়ে তুলতে।
সেদিন অনেক দিন পর তার মামাতো ভাই নিরব এলো বেড়াতে।তানিয়ার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট নিরব।ছোটবেলায় দৌড়দৌড়ি ছুটোছুটি করে মানুষ তারা।ভিষন খুশি হলো তানিয়া নিরবকে দেখে। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় এসেছে নিরব।ফুফাতো বোন তানিয়ার বাসায় থাকবে কিছুদিন।
তিন্নিকে দেখেই আদোর করে বুকে জড়িয়ে নিল নিরব। পরদিন একগাদা চকলেট কিনে আনল নিরব ভাগনির জন্য।রোজ সকালে তানিয়া নাস্তা বানানোর সময় তিন্নি যখন স্কুলে যাবার জন্য রেডি হয়।তানিয়া জোরে জোরে রান্নাঘর থেকে হাঁকডাক করতে থাকেন।কই রে তিন্নি তোর বাবাকে ডেকে দে।কই রে তোর মামাকে ডেকে তোল,বল নাস্তা রেডি।
দুদিন পরই তিন্নি বলল, মামাকে আমি আর ডাকতে যেতে পারব না।
কেন রে তোর আবার কি হোল?
এরপর শুক্রবারদিন তিন্নির মা বাবা বাইরে গেল ডাক্তার দেখাবে,বাজার করবে।তিন্নি তাদের সাথে যেতে চাইলে তানিয়া বললেন,
তোমার না কত পড়া আছে তিন্নি আর বাজারে অনেক আজেবাজে লোকের ভিড়।তুমি বাসাতেই থাকবে।তোমার নিরব মামা আছেন কোন সমস্যা হলে তাকে খুলে বলবে।
ঘটনা তিন
দিয়ার ছোট খালার সাথে তার অনেকটা বান্ধবীর মতই ঘনিষ্ঠতা ছিল।তাই ছোট খালার বিয়ের দিন বিদায়ের সময় দিয়া অনেক কান্নাকাটি করছিল।দিয়ার মা বললেন যাবি দিয়া তোর খালার সাথে শ্বশুরবাড়ি।তুই সাথে গেলে তোর মিনু খালা অনেক খুশি হবে।অবশেষে বরের গাড়িতে একপাশে মিনুর বর মাঝখানে মিনু আরেক পাশে দিয়া শক্ত করে তার খালার হাত ধরে থাকল।
মিনুর শ্বশুরবাড়িতে সবাই দিয়াকে অনেক আদোর যত্ন করল।গ্রামের বাড়ি তাই গোসলখানা আর বাথরুম মুলবাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে।পরদিন মাঝরাত্তিরে দিয়া বাথরুমে যাবে বলে ওর ঘর থেকে বের হল একা।বাথরুম সেরে ফেরার পথে দেখল কে একজন দাঁড়িয়ে।অন্ধকারে মুখ ভালো মতো দেখতে না পারলেও দিয়ার ছোট খালুকে সেদিন আবিষ্কার করল অন্যরূপে।ওর খালু ওকে মুখ চেপে জাপটে ধরে নিয়ে গেল কোনার দিকের অন্ধকার ঘরটায় যেখানে বস্তা ভরে আলু,পেঁয়াজ,চাল,ডাল ইত্যাদি গুদমজাত করা আছে।
ঘটনা চার
“খালাম্মা আফনে নিচ্চিন্তে আপিস করুন যে।খালুজান রে আমি পাই আমার বাফের মতোন।”
এমন সুন্দর কথা আর খুবই কাজের সাহায্যকারি মেয়েটা সখিনা।
নীলা একটা কর্পোরেট যব করে, খুবই কাজের চাপ তার।বিয়ের দুবছর হলো।টোনাটুনির সংসারে নীলা আর তার স্বামী আসিফ।নীলার অফিস দূরে তাই তাকে বেরুতে হয় আগে।আর আসিফের অফিস বাসার সামনের দুটো গলি পেরোলেই হলো। আসিফের টিফিন,সকালের নাস্তা,বাসার রান্নাবান্না,ঘরের গোছগাছ পয় পরিষ্কার,গৃহস্থালীর এটাসেটা কত্তরকম কাজ!নীলা হিমসিম খাচ্ছিল বিয়ের পর থেকেই।অথচ এখন সবকিছুই কেমন টিপটপ ফিটফাট।অফিসেও পৌছে যায় সময়মতো তাই আর আগের মতো বসের বকুনি খেতে হয় না।এর সবই সম্ভব হয়েছে সখিনার জন্য।
আজ অফিস থেকে প্রমোশন লেটার পেয়েছে নীলা।নীলার কাজের অগ্রগতি,নিষ্ঠা আর সময়ানুবর্তিতায় ভিষন খুশি তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।তারা তো জানে না এই প্রমোশনের আসল দাবিদার নীলার সাহায্যকারী সখিনা বেগম।আজ নির্ধারিত সময়ের আগেই ছুটি পেয়ে নীলা মিষ্টি কিনল।আসিফের জন্য একটা সুন্দর শার্ট আর সখিনার জন্য একটা থ্রিপিসও নিল।
বাসায় এসে ব্যগে রাখা ডুব্লিকেট চাবিটা দিয়ে মেইন দরজাটা খুলে ফেলল সে।যদিও অন্যদিন কলিং বেল চাপ দেয়। নীলা তো আর জানত না যে সারপ্রাইজ দিতে যেয়ে বরং নিজেই সারপ্রাইজড হবে!
সখিনা আর আসিফকে নীলা আবিষ্কার করল তারই বেডরুমে,তারই বিছানায় অত্যন্ত আপত্তিকর অবস্থায়।
ঘটনা পাঁচ
ভিষন খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছেলে রায়হান।বিগত পাঁচবছর থেকে মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছে পরিবার পরিজনের সাথে।পাত্রী প্রতাখ্যাত হলো তার বরাদ দিয়ে সে প্রায় দুশো হবে।তার চাই সুন্দরী,শিক্ষিতা,বিনয়ী,নিজ এলাকার একান্ত বাধ্য টাইপের একটা মেয়ে।সবকিছু মিলিয়ে মনের মত পাত্রী পাওয়া ভিষন মুশকিল!কেউ বেশি শিক্ষিতা কম সুন্দরী ।আবার কেউ বেশি সুন্দরী হলেও পড়ালেখায় ডাব্বা!
অনেক কষ্ট সাধ্যসাধনার পর মেয়ে পাওয়া গেল ঠিকই,বিয়েও হলো।কিন্তুু ততোদিনে আমাদের রায়হানের চল্লিশ পেরিয়ে বয়সের কোঠা হাফ সেঞ্চুরি ছুঁই ছুঁই ।মাথার টাকখানা মাঝনদীর চড়ের মত চকচকে।কোমরে গোঁজা বেল্টটা শতবার টাইট করলেও থলের বেড়ালের মতো ভুঁড়িটা উঁকি মারে বিশ্রীভাবে।এদিকে উনিশ কুড়ির রায়হানের ডগমগে বউ মহূয়াকে পাগলের মতো ভালোবাসতে শুরু করেছে রায়হান।প্রেম ভালোবাসা না কি অন্ধ সেই বাক্যকে অকাট্ট প্রমাণ করতেই বিয়ের পর থেকেই রায়হান হয়েছে জন্মান্ধ।পাড়াপ্রতিবেশি থেকে কমপ্লেন আসতে থাকে রায়হানের কাছে হরহামেশাই।তোমার বউকে দেখলাম ওমুকের সাথে,তমুক রেস্টুরেন্টে!সেদিন এক কলিগ ফোন দিয়ে বলল ভাবীর দিকে একটু মনে হয় খেয়াল করা দরকার।এই কোথায় যায়,কার সাথে মিশে, কি করে বেড়ায় আড়ালে আবডালে এইসব আরকি।রায়হান তো রেগেই আগুন।যতসব হিংসুটের দলেরা হিংসা করে মরছে তাই আসে তার সুখের সংসারে আগুন ধরাতে!আসল কথা আমার বউ সবচেয়ে সুন্দরী,শিক্ষিতা আবার তোদের বউদের থেকে কমবয়সি,মনে মনে ভাবে রায়হান।
বিয়ের মাসছয়েক পর একদিন ভোরবেলা মহূয়ারানী বিয়ের সমস্ত গয়নাগাটি,বাসার ক্যাশটাকাসহ উধাও।পরে জানা গেল পাড়ার সমবয়সি এক ছেলের সাথে ভেগেছে সে।
ছোটবেলায় সাপুড়ের সাপখেলা দেখতাম।পরে বড় হয়ে জানতে পারলাম ওগুলো আসলে বিষদাঁত উপড়ানো সাপ।ওই সাপগুলো সাপুড়েদের একটা নির্দিষ্ট বাক্সে বন্দী থাকত।আর ওদের ক্ষমতার দৌড় জানা ছিল ওদের কাছের মানুষদের।বড় হয়ে জানতে পারলাম একদল মানুষরুপি সাপদের কথা।যারা আপনার ও আমার খুবই কাছাকাছি পাশাপাশি অবস্থান করলেও আমাদের জানা নেই তাদের একটা ছোবল আমাদের জীবনকে করে তুলতে পারে কি বিষাক্ত নীল!
তাই আসুন আস্তিনের এই ভয়ংকর বিষাক্ত সাপগুলোকে চিহ্নিত করি। এদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে সচেষ্ট হই আর নিশ্চিন্ত নিরাপদ করতে চেষ্টা করি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে।গড়ে তুলি কঠর প্রতিরোধ।
#রেজওয়ানা_ফেরদৌস।