#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৭.
অহনাকে চিৎকার করতে দেখে লোকটি সরে যায়। রোস্তম এসে মেয়েকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়।
‘ কি হয়েছিল মা? মাথা ঘুরে গেল নাকি?’
‘ না বাবা।’
অহনা কিছু বলে না রোস্তমকে। যদি চিন্তা করে সে।
রাতের খাবার খেয়ে যখন সবাই ঘুমাতে যায়, তখন জানালায় খটখট শব্দ শুনতে পায়। অহনার পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ময়না। শব্দ শুনে অহনা উঠে যায়। শব্দের গতি অনুমান করে জানালায় চোখ দেয়। অহনা জানালা খুলে দিতেই তাকে কেউ ছিটকে ফেলে দেয়। বুঝতে পারে, এটা মাহতিম। পরক্ষণেই খেয়াল করে, কেউ তাকে ছু/রি দিয়ে আঘাত করতে চেয়েছিল। অহনা মাটি থেকে উঠেই দৃষ্টি দেয় সামনে। সন্ধ্যার সেই লোকটাকে দেখতে পায়। অহনা তেড়ে আসে তার দিকে। মাহতিম তাকে থামিয়ে দেয়।
লোকটা দাঁত কেলিয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। অহনার দিকে এগিয়ে এসে ছু/রি ধরতেই সেটাকে একটি খেলনা বন্দুক বানিয়ে দেয় মাহতিম। লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে ছু/রিটাকে। কাজ করছে না দেখে এটাকে ফেলে দিয়ে এগিয়ে আসে অহনার দিকে। আবার পেছনে ফিরে যায়। ঘুমন্ত ময়নার মাথার কাছে গিয়ে তাকে আঘাত করতে যেতেই তার হাত শূন্যে ভেসে থাকে। সে কোনোমতেই হাত টেনে নিচে নামাতে পারছে না। এটা দেখে অহনা উচ্চস্বরে হেসে উঠে। জেগে যায় ময়না। সামনে এমন অদ্ভুত একটা মানুষকে দেখে ভয়ে সে দৌড়ে এসে অহনার পেছনে লুকায়।
পাশের ঘর থেকে রোস্তম উঠে আসে। দরজা খুলতে বলে অহনাকে। অহনা ভয় পেয়ে যায়। বাবাকে কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। মাহতিম লোকটাকে ঠিক করে দেয়। লোকটা ভয়ে তড়িঘড়ি হয়ে জানালা দিয়ে লাফ দেয়। বেগোছে পড়ে পায়ে ব্যথা পায়। তবুও ভূতের ভয় সাঙ্গ করে পালিয়ে যায়।
অহনা দরজা খুলে দেয়। রোস্তম সারা ঘর খুঁজে বলল,’ ঘরে কেউ ছিল মনে হয়? কে দিল?’
‘ কেউ না বাবা। আমি ছিলাম আর ময়না ছিল শুধু।’
‘ কেউ চিৎকার করেছে। আর তুই এতো রাতে হাসছিলি কেন?’
অহনা ঠোঁট কামড়ে ভাবে কি বলবে। মাথা চুলকে বলল,’ আমি একটা হাস্যরসিক স্বপ্ন দেখেছি, যেখানে তুমি মাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে রেজিনা আন্টিকে জড়িয়ে ধরেছিলে সেটাই দেখলাম।’
‘ ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।’
রোস্তম কিছুটা ভারী গলায় বেরিয়ে যায়। অহনাও গিয়ে শুয়ে পড়ে। ময়না ভয় পেয়ে আছে তাই অহনা তাকে বোনের মতো জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে ঘুম ভাঙতেই ময়নাকে বিছানায় দেখতে পায় না অহনা। দৌড়ে বাইরে যায়, দেখতে পাচ্ছে না। তন্নতন্ন করে পুরো বাড়ি খুঁজে কিন্তু পায় না। হতাশ হয়ে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ে। রোস্তম এলাকা খুঁজেও পায় না। হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টা কারো হজম হচ্ছে না। রোস্তম অহনাকে বলল,’ মেয়েটা সকালে খুব তারাতাড়ি উঠেছিল।’
অহনা সচকিত হয়,’ বাবা, তুমি সেটা আমাকে আগে বললে না কেন? তারপর কোথায় গেল?’
‘ সকাল ভোরে উঠেই বাইরের চালতা গাছটার নিচে বসে ছিল। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলল না। আমি ঘরে চলে আসলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আর দেখতে পেলাম না। কোথাও উধাও হয়ে গেছে। এরপর তুইও উঠে গেলি।’
‘ কোথায় গেল বাবা? ওর পরিচয়টাও এখনো জানা হলো না।’
অহনা ঠিক করে নদীর পাড়ে যাবে। সেখান থেকে যদি কোনো ক্লু পেয়ে যায় তাহলে খুঁজতে সুবিধা হবে। তৎক্ষণাৎ দেরী না করে অহনা নদীর পাড়ে রওনা দেয়।
গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা হয় মতির সাথে। গ্রামের মোড়লের ছেলে মতি। অহনা তাকে দেখেই কপাল কুঁচকায়। পাশ কেটে চলে যেতে চাইলেই মতি তাকে ডাক দেয়,’ অহনা না?’
অহনা দাঁড়ায়, ছোট করে উত্তর দেয়,’ হু।’
‘ বেচারা, মাকে হারিয়ে ফেললাম। কি আর করার, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।’
রেগে উঠে অহনা,’ আর কিছু বলার আছে?’
‘ রেগে যাচ্ছিস কেনো? মেলা দিন পর তোরে দেখলাম, একটু কথা বলি ভালো করে।’
‘ আমার তাড়া আছে, যেতে হবে।’
‘ সে আমারও রাজ্যের তাড়া থাকে, তাই বলে তোর সাথে দেখা হলো, কথা বলবো না, তা কি হয়?’
‘ আমি আপনার মতো বেকার মানুষ নই।’
‘ তাইলে কি, কয়টা রাজ্য চালাস তুই?’
‘ আপনার কথা শেষ হলে আসতে পারেন। আমাকে যেতে হবে।’
অহনা পাশ কেটে চলে যায়। মতি ছোট ছোট দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে নিজেকেই বিড়বিড় করে বলে,’সেই ছোট্ট ছোট্ট মেয়েগুলা কবে এতো বড় হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। বিষয়টা দেখতে হবে।’
অহনা নদীর পাড়ে হন্যি হয়ে খুঁজে ময়নাকে। কিছুই পায় না। আশাহত হয়ে যখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তখনি তার চোখ যায় পড়ে থাকা একটা লকেটের দিকে। বালির নিচ থেকে খুব অল্প পরিমাণ অংশ দেখা যাচ্ছে। অহনা বালির ভেতর থেকে বের করে লকেটটি। পরিষ্কার করে ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে। লকেটটি খুলতেই অবাক হয়। সেখানে ময়নার সাথে অন্য একটি ছবি। অহনা সেটি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। রোস্তমকে দেখাতেই সে চিনতে পারে। বলল, পাশের এলাকায় তার বাড়ি। অহনা ঠিক করে, সে যাবে ঐ বাড়িতে। রোস্তম যেতে না করে, কিন্তু অহনা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, সে যাবেই।
লোকটির ঠিকানা বের করে অহনা রওনা দেয়। একটা অটো নিয়ে তার বাড়ি পৌঁছায়। কয়েকজন লোককে জিজ্ঞেস করে বাড়ির খবর নিয়ে নেয়।
একটা বহু পুরনো বাড়িতে থাকে লোকটা, নাম বশির। দরজা ধাক্কাতেই বশির ঘুমঘুম চোখে বেরিয়ে আসে। অহনাকে দেখেই জিজ্ঞেস করে,’ কাকে খুঁজছেন আপনি?’
অহনা লকেটটা বশিরের হাতে দেয়। লকেট দেখেই বশির হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। মুহুর্তেই ভেঙে পড়ে। এমনিতেই সারারাত কান্না করে কাটিয়েছে। ভোর রাতের ঘুমটাই চোখে ছিল। অহনার দিকে দৃষ্টি দেয় বশির,’ এটা তুমি কোথায় পেলে মামনি?’
‘ আপনি কি চিনেন এই মেয়েটাকে?’
‘ আমি তার অভাগা বাবা।’
‘ তাহলে আপনি কাঁদছেন কেন?’
‘ আমি জানি না তুমি কে? তুমি হয়তো জানো না কালকেই আমার মেয়েটা এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।’ বলেই বশির অঝোরে কাঁদতে লাগল।
অহনার পা দুটো অসাড় হয়ে আসে। কিছুই বুঝতে পারছে না। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে, অহনার মাথায় ঢুকছে না কিছুই। অহনা কাঁধে কারো স্পর্শ পায়। বুঝতে পারে মাহতিম কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। অহনা নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,’ আপনি কিছু ভুল বলছেন নাতো?’
‘ আমি কেন নিজের মেয়েকে নিয়ে মিথ্যা বলব? বাবা হয়ে আমি মেয়ের মৃ/ত্যুর সংবাদ দিচ্ছি, তোমার কি মনে হয় আমি মিথ্যা বলছি?’
‘ না আঙ্কেল। কিন্তু….’
অহনা থেমে যায়। লোকটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে, এখন তাকে প্রশ্ন না করে সঙ্গ দেওয়াই উত্তম। একটু পর ধীরস্থির হয়ে সব জানতে চাইবে।
অনেকগুলো প্রশ্ন অহনার মাথায় ঘুরপাক খায়। যদি ময়না কালকেই মারা যায়, তাহলে আজ সকাল পর্যন্ত তার সাথে কে ছিল? দেখে তো মনে হয়নি সে মৃ/ত! মাথা ধরে এসেছে অহনার। ময়নাকে সে মৃ/ত ঘোষণা দিতে পারে না…..
চলবে……
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৮.
অহনা মাথা ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠে। নিজেকে সামলে নেয়। বশিরকে জিজ্ঞেস করে,’ আপনি কি আপনার মেয়ের ডেড বডি দেখেছেন?’
বশির ঝংকার মেরে উঠে,’ আমি নিজে হাতে দাফন করেছি আমার মেয়েকে।’
অহনা আরেকটা ঝটকা খায়। লোকটা তার মেয়েকে নিজের হাতে দাফন করলে, কাল যার সাথে দেখা হয়েছে, সে কে?
অহনা পুনরায় বলল,’ দয়া করে আপনি পুরো ঘটনাটা বলেন। কি করে আপনার মেয়ে মারা গেল।’
‘ মেয়ের জামাই কয়দিন আগে মরছে। রাগে দুঃখে মেয়েও গলায় দড়ি দিল।’
‘ এই বাড়িতেই নাকি শশুর বাড়িতে?’
‘ মেয়ের শশুর বাড়িতে।’
অহনা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল,’ আপনি কি তার ঘরটা দেখাবেন আমাকে?’
‘ নিশ্চয়! আমার মেয়ে খুব শৌখিন ছিল। তার ঘর সবসময় আয়নার মতো ঝকঝকে করতো। বাহারী জিনিসে ভরপুর। আসো আমার সাথে!’
অহনা বশিরের পেছন পেছন যায়। দেখল, ঠিকই বলেছে লোকটা। বাহারী সাজে ঘরটা। অহনার নিজের ঘরের কথা মনে পড়ল। একবার যখন টিকু ওর ঘরে এসেছিল, তখন অহনা ওয়াশরুমে ছিল। বের হতেই টিকু নাক সিঁটকে বলল,’ গরুর গোয়ালটাও তোর ঘরের থেকে বেশি সুন্দর। আমার মনে হয় না গরু ছাগলও এখানে এক রাত্রি থাকতে চাইবে না।’
অহনা তখন ভেঙচি কেটে বলেছিল,’ ভাগ্যিস তুই গরু বা ছাগল না, তাহলে তুইও থাকতে পারতিনা’
বশির অহনাকে পুরো ঘর দেখায়। অহনা দেখে মন ভরে। ওর চোখ যায় একটি রোমালের দিকে। নকশা করা। অহনা অবাক হয় সেই নকশা দেখে। কোন ফুল, লতাপাতা না। এটায় কিছু চিহ্ন আঁকা। অহনা বশিরের অগোচরে সেটা লুকিয়ে নেয়। দেখা শেষে বের হয়ে যায় সে। বশিরের থেকে বিদায় নিতেই সে প্রশ্ন করে,’ আমার মেয়েকে নিয়ে তুমি এতো কিছু জানতে চাইলে, কিন্তু আমি জানি না তুমি কে? যদি পরিচয়টা দিতে!’
অহনা বলল,’ আমি তার সিনিয়র ছিলাম স্কুলে।’
‘ কিন্তু আমার মেয়েতো ক্লাস সিক্সের পর আর পড়েনি। এতোদিন পর তুমি তাকে কেন খুঁজতে আসলে।’
অহনা ঘাবরে যায়, বলল,’ অনেক আগেই তার সাথে কথা হয়েছিল। কিছুদিন আগে বলতে পারেন। তাই খবর নিতে এসেছিলাম।’
কোনো রকমে বিদায় নিয়ে অহনা চলে যায়। অনেক প্রশ্ন জমা হয়েছে মনে, কিন্তু উত্তর জানা নেই।
অনেক সময় উত্তর আমাদের সামনেই থাকে। আমরা দেখতে পাই না।
অহনা বশিরের থেকে ময়নার শশুর বাড়ির ঠিকানা নিয়েছিল। গন্তব্য এখন ময়নার শশুর বাড়ি।
দুপুরের খাবার খেয়েই অহনা রওনা দেয় ময়নার শশুর বাড়ি। চাকরের সমাগম মানুষের থেকেও বেশি। অহনা গেইট পাড় হতে চাইলেই দারোয়ান তাকে আটকে দেয়। অহনা লম্বা ঘোমটা টেনে বলল,’ আমি ভেতরে যেতে চাই।’
দারোয়ান বলল,’ ভেতরে বাইরের লোক যাওয়া নিষেধ।’
‘ আমি তাদের আত্মীয় হই।’
‘ কেমন আত্মীয়? এই বাড়িতে ত্রিশ বছর আছি আমি। কোনো আত্মীয় আমার অচেনা না।’
‘ তাদের বাড়ির বউয়ের সব আত্মীয়কে চেনেন?’
‘ না।’
‘ তাহলে? এই বাড়ির মালিকের বাবার ভাইয়ের চাচাতো বোনের ছেলের মেয়েকে চিনেন?’
দারোয়ান কিছুক্ষণ ভেবে নেয়,’ না, চিনি না।’
‘ চিনবেন কি করে, বুড়ো হয়ে গেছেনতো তাই। আমাকে যদি এখন ভেতরে ঢুকতে না দেন, তাহলে আমি গিয়ে বড়বাবুর কাছে নালিশ করব। আপনার চাকরি যাবে।’
‘ না, ঠিক আছে, আপনি ভেতরে যান। কিছু বলবেন মালিককে।’
অহনা ভেতরে চলে যায়।একজন চাকরানীকে দেখতে পেয়ে অহনা জিজ্ঞেস করে,’ তুমি কি এই বাড়িতেই থাক?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ তাহলে বলো, এই বাড়ির বউ নাকি মা/রা গেছে?’
‘ কোনডা? ছোডডা না বড়ডা।’
অহনা অবাক হয়ে যায়। বড় বউ না ছোট বউ সে সেটা জানে না। বলল,’ দুইজনই।’
‘ খাঁড়ান আপা। আমি গামলাটা রাইখ্খা আসি।’
মেয়েটা গামলা রেখেই অহনার কাছে আসে।
‘তয় আপা কন, আম্নে কি কইছিলেন?’
‘ এই বাড়ির দুই বউয়ের কথা।’
‘ বড় বউতো দুই মাস আগে মরছে শ্বাসকষ্ট উইঠা। আর ছোডডা গলায় দড়ি দিছে।’
‘ কেন দিয়েছে তুমি কি জানো?’
‘ হের জামাইর লাইগ্গা। মাইয়া ভালাই আছিল, জামাইডাও ভালা।’ তারপর মেয়েটা অহনার কানের কাছে এসে বলল,’ তয় আপা, শশুর বাড়ির লোকজনডি ভালা না। মাইয়াডারে অত্যাচার করত। বড় বউডারেও করছে। এরা এমনিতেও মরতো।’
ভেতর থেকে একজন লোকের আগমন দেখে মেয়েটি সরে যায়। অহনাও পিলারের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। অহনা ফুল হাতা শার্ট গায়ে দিয়েছে, হাত কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা। গলায় একখানা কালো উড়না জড়ানো। বাতাসের কারণে সেটার কিছু অংশ উড়তে লাগল। ঘর থেকে বের হওয়া মানুষটি সেটার দিকে চোখ দেয়।
লোকটি এগিয়ে আসে অহনার দিকে,
‘ ঠিক ধরেছিলাম। এখানে কেউ ছিল। কে তুমি মেয়ে?’
অহনা বের হয়ে আসে। ভয় হচ্ছে তার খুব।
‘ আমি আমার বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসছি।’
‘ কে তোমার বান্ধবী?’
‘ ময়না।’
‘ ময়না নামের কেউ এখানে থাকে না। ফিরে যাও।’
‘ এটা তার শশুর বাড়ি।’
‘ কালকেই সে মরে গেছে, তুমি হয়তো জানো না।’
‘ আমি জানি। আর এটাও জানি, সে এখনো জীবিত।’
‘ এসব উল্টা পাল্টা কি বলছ? সবাই সাক্ষী আছে, জিজ্ঞেস করো।’
‘ আমি বিশ্বাস করি না। নিজের চোখে না দেখলে কিছুই বিশ্বাস হয় না আমার।’
‘ তোমার বিশ্বাসের জন্য কি আরেকবার কাউকে মেরে দেখাব?’
‘ কি বললেন আপনি? কাকে মেরেছেন?’
‘ কথা বাড়িও না। তোমার মতো মেয়ে কিছুই করতে পারবে না। এখান থেকে চলে যাও ভালোয় ভালোয়, না হয় ময়নার মতোই তোমার অবস্থা হবে।’
‘ আমি যাব না। কি করবেন করে নিন।’
‘ কাউকে ছাড় দেই না আমি। তোমার ভালোর জন্য বলছি চলে যাও না হয় খারাপ হবে। সুন্দরী মেয়ে বলে ছেড়ে দিচ্ছি, কারণ আবার দেখা হবে।’
লোকটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। অহনা বিরক্ত হয়,
‘ আপনার হাসি ঠিক আপনার সেই পাকা চুলের মতো বাজে।’
হাসি থামিয়ে লোকটি বলল,’ সুন্দরী মেয়েদের গালিতেও শান্তি পাওয়া যায়। তোমার দিকে নজর পড়েছে আমার। এখন চলে যাও, পরে আবার দেখা হবেই হবে। কারণ আমার নজরে পড়েছে। বিদায় সুন্দরী।’
অহনা নাক সিঁটকায়,
‘ আপনার থেকে গন্ধ আসছে, সরে দাঁড়ান।’
লোকটি চলে যায়। একজন চাকরানী এসে বলল,’ এই বাড়িত্তে যেই একবার ঢুকে তারে আর বাইর হইতে দেখি না। তারা সবাই কই যায় কেউ জানে না। বিশেষ করে মাইয়ারা।’
‘ এসব কি বলছো? মানে কি? আর ঐ লোকটা কে?’
‘ বাড়ির ছোড ছেলে। গাউড়া পুরা। আপা, আম্নে চইলা যান। বিপদে পড়বেন।’
‘ আমার চিন্তা করো না। এটা বলো তুমি, ময়নার লাশের চেহারা কি তুমি দেখেছো?’
‘ না আপা। তারেতো তারাতাড়ি দাফন করা হইছিলো। তার বাপরেও একবার দেখতে দেয়নাই।’
‘ ঠিক আছে তুমি যাও।’
মেয়েটি চলে যেতেই অহনা গেইটের দিকে পা বাড়ায়। মুহুর্তেই তার পা থেমে যায়। গাছের আড়ালে চলে যায়। একজন লোক ভেতরে ঢুকছে, তাকে চেনে অহনা। কালকে যে লোকটা ছুরি নিয়ে আক্রমন করেছে, এটাই সেই লোক……
চলবে……
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৯.
অহনা লুকিয়ে লুকিয়ে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। লোকটা চলে গেলেই অহনা গেইটে যায়। বের হয়ে বাড়ি যায়।
বিছানায় বসে মুখে এক হাত রেখে অহনা ভাবতে থাকে, কি করা যায়। রোস্তম আসে,’ কিছু পেলি?’
অহনার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে,’ নাগো বাবা, পাইনি কিছু। তবে পেয়ে যাব। ও আমাকে আপা বলে ডেকেছে যেহেতু, আমি ওকে খুঁজে বের করবোই।’
‘ তবে আর খুঁজে কাজ নেই। কিছু পাসনি যেহেতু আর পাবিও না। তুই আর ভাবিস না মেয়েটাকে নিয়ে।’
‘ এটা কেমন কথা বলছ বাবা? ও আমার বোন। আমি কি আমার বোনকে খুঁজব না? বের করবোই, যেখানেই থাকুক। পারলে পাতাল থেকেও খুঁজে বের করব।’
অহনা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাড়ির পেছনের পরিত্যক্ত জায়গায় গাছের আড়ালে বসে থাকে। সাথে নিয়ে এসেছে ময়নার ঘর থেকে নিয়ে আসা রুমালটা। অহনা চোখ বুলায় রুমালের উপর। কিছু চিহ্ন আর আঁকাআঁকি করে রেখেছে। খুব সূক্ষ্ম নজরে দেখল, ছোট ছোট ঘরগুলোতে বাংলা বর্ণমালার কয়েকটা অক্ষর, তা আ হে ব সো ফ ল। অহনা অক্ষরগুলো একে একে সাজানোর চেষ্টা করে। অনেকক্ষণ পর বের করে এর আসল মানে। একটা নাম সোহেল এবং অপরটি আফতাব। রুমালের শেষাংশে ছোট একটি মেয়ের চেহারা ফুটে উঠেছে, চোখে পানি, তার কাঁধে হাত রেখে আছে আরো কিছু মেয়ে।
নাম দুটো অহনার অচেনা মনে হলো। ঘরে গিয়ে রোস্তমকে জিজ্ঞেস করে,’ বাবা, আফতাব বা সোহেল নামের কাউকে চেনো?’
‘ হ, পাশের এলাকার, বড় বাড়ির মালিক আর তার ছেলে।’
‘ বড় বাড়ি কোনটা বাবা?’
‘ ময়নার শশুর বাড়ি বললি না। সেটাকেই সবাই বড় বাড়ি বলে।’
অহনার কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে গেল যে কিছু একটা বিষয় নিশ্চয় আছে। কিন্তু এখন কি করা উচিত। অহনা বসে বসে ভাবে, প্রথমে সে ঐ বাড়িতে যাবে, গিয়ে দেখবে ময়না আছে কিনা। তারপর পদক্ষেপ নেবে।
কল আসে ইরার। অহনার ভাবনায় ছেদ পড়ল। কল ধরে,
‘ হ্যালো।’
‘ হ্যালো পরে বলিস। আগে বল ঐদিন দেখা করলি না কেন?’
‘ বাবা কল করেছিল, তাই গ্রামের বাড়ি এসেছি।’
‘ আমাদের কিছু বললি না। হঠাৎ কেন গেলি?’
‘ আমার মা….’ অহনার গলা নরম হয়ে আসে। বলতে পারছে না। হঠাৎ মায়ের কথা মনে হতেই বুক চিঁড়ে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।
‘ কিরে পানসা, কিছু বল।’
‘ আমার মা আর নেই। চলে গেছে আমাকে একা রেখে।’
‘ যা হয় ভালোর জন্য হয়। তুই কাঁদিস না, তোকে ভেঙে পড়লে হবে না। তোর বাবা কত কষ্ট করে ক্ষেতে-খামারে, তুই ভেঙে পড়লে তাকে কে সামলাবে? তোকে কিছু করতে হবে তোর বাবার জন্য।’
অহনা কান্না থামায়,’ ঠিক বলেছিস। আমিতো স্ট্রং, আমি কাঁদবো না।’
‘ এখন বল, কেমন আছিস?’
‘ এইতো ভালো। সবাই কেমন আছে?’
‘ একদম পাক্কা আছে সবাই। তবে তুই ছাড়া ভালো লাগছে না। যদিও তোকে অল টাইম পানসা বলি, তবুও তুই না থাকলে আমাদের আনন্দ আরো পানসে হয়ে যায়।’
‘ থাক আর বলতে হবে না। তোদের কাছে তো আমার দামটাই নেই।’
‘ একদম না। তুই আমাদের গুলুমুলু, সুন্দরী বান্ধবী। তবে রাগ করেছি আমি তোর সাথে! এক বালতি রাগ করেছি!’
‘ এতো রাগ কেন আমার উপর? নাকি বয়ফ্রেন্ডের সব রাগ আমার উপর ঝাঁড়বি?’
‘ না। রাগ করেছি তোর বোকামি দেখে। ঠিক আছে তুই বিপদের সময় চলে গেছিস। কিন্তু এরপর কি হলো? আমাদের একবার কল করে বলতে পারতি, আমরাও দেখতে যেতাম। এমনকি দুইদিন হয়ে গেল কোনো কল করলি না, আমার কলটাও ব্যাক করলি না।’
‘ গ্রামে কারেন্টের সমস্যা খুব। চার্জ দিতে পারিনি।’
‘ আচ্ছা বুঝলাম। আমরা সবাই কি তোকে দেখতে আসব?’
‘ না লাগবে না। আমি ময়নাকে পেলেই চলে যাব।’
‘ ময়না কে?’
‘ আমার বোন।’
‘ তোর তো কোনো বোন ছিল না। কোথা থেকে আমদানি করলি?’
‘ সে অনেক কথা। পরে সময় করে বলব, এখন রাখছি।’
ইরা তবুও মানল না। সে সব বন্ধুদের জানিয়ে দিল বিষয়টা। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা অহনার গ্রামের বাড়ি যাবে। পরদিনই রওনা হবে।
রাত হয়ে এসেছে অহনার মনটা খুব খারাপ। এখনো সে ময়নাকে খুঁজে পায়নি। ক্ষতি হবে ভেবে আরো চিন্তায় পড়ে।
রাত হয়ে এসেছে। অহনা টি শার্ট আর প্লাজু পড়ে নেয়। বই হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ভীষণ হাঁসফাঁস করতে থাকে। ঘরের দরজার দিকে তাকাতেই একটি ছায়া দেখতে পায়।
‘চ’ সূচক শব্দ করে বলল,’ তুমিতো আমাকে একদম ভয় পাইয়ে দিলে।’
মাহতিম ওর পাশে এসে বসে। কোনো কথা বলে না। অহনা আবার বলল,’ সবসময় এতো চুপচাপ থাক কেন? ভাল্লাগেনা।’
কিছুই বলে না মাহতিম। জ্বলজ্বল চোখে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে অহনার দিকে। অহনা আবারো বলল,’ সবসময় এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কি আর কিছুই করতে পারো না?’
এবারও কোনো উত্তর না পেয়ে বালিশ ছুঁড়ে মারে মাহতিমের দিকে। বালিশটা তার দেহ ভেদ করে বেরিয়ে যায়।
‘ তুমি খুব বোকা।’ মাহতিম মুখ খুলল।
‘ তোমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বোকা। না হয় এভাবে তাকিয়ে না থেকে এতোক্ষণ কিছু না কিছু বলতে।’
‘ অপ্রয়োজনে কথা বলো তুমি, ঠিক আগের মতো!’
‘ আমি অপ্রয়োজনে কথা বলি না তুমি প্রয়োজনে কথা বলো না।’
‘ ঝগড়া করো না। কোথাও যাবে? তোমার মন খারাপ বুঝতে পেরেছি।’
‘ আমি কাল কি করব সেটাও জানো কিন্তু ময়নাকে খুঁজতে কোনো সাহায্য করতে পারছ না কেন? আগে এই উত্তর দাও।’
কিছু বলে না মাহতিম। চুপ হয়ে যায় একদম। অহনা আবার বলে,’ ইচ্ছে করছে তোমার মাথায় কয়েক হাজার পাথর ভাঙ্গি। কাজের সময় তুমি চুপ।’
‘ আমি তোমার জন্য ফিরে এসেছি আবার অন্য কারো জন্যে নয়।’
‘ যাই হোক। জানি না তুমি কোথা থেকে, কেন এসেছো। কিন্তু তবুও মনে হয় তোমাকে যুগ যুগ ধরে চিনি।’
‘ যাবে?’
‘ কোথায়।’
‘চলো আগে।’
মাহতিম ওকে নিয়ে যায় নিরিবিলি একটা জায়গায়। অহনা আশ্চর্য হয়। ওরা একটি পাহাড়ের উপর। জোনাকিদের মেলা, নিচে নদী, পাখিদের ছন্দ, আকাশের নীলাভ আভা, চারিদিকে পূর্ণিমার প্রখর আলো, এক অপরূপ দৃশ্য। অহনা খুশিতে নেচে উঠে,
‘ এটা কোন জায়গা?’
মাহতিম উত্তর দেয় না। অহনা খুশি মনে ঝর্ণা ছুঁয়ে দেখে। জোনাকিদের সাথে মজা করে। মাহতিম অবাক হয়ে দেখে। তার চোখ থেকে আগুনের তেজটা কমে এসেছে।
‘ তোমার চোখদুটো ভয়ঙ্কর। যে কেউ দেখলে ভয়ে জ্ঞান হারাবে। আবার বলো না আমি কেন ভয় পাচ্ছি না! আসলে আমি কোনো কিছুকেই ভয় পাই না। ভয় আমাকে ভয় পায়, তাই আমার কাছে এসেও দূরে যায়।’
অহনার কথা মাহতিম বুঝতে পারে না। তবে তার চোখ মুখের ভাষাটা বুঝে নেয়। এই মুহূর্তে অহনা খুশি।
অনেকক্ষণ হয়ে এসেছে। মাহতিম বলল,’ এবার তোমার যাওয়া উচিত।’
‘ না, আমি যাব না। আমি এখানেই আজ রাত কাটিয়ে দেব।’
মাহতিম কিছু না বলেই চোখের পলকে অহনাকে বাড়ি নিয়ে আসে।
রাগে ফুঁসতে থাকে অহনা,
‘ কেন নিয়ে এলে আমায়? আমি ওখানে শান্তিতে ছিলাম। জানে আমার কেমন সুনসান লাগে।’
‘ অনেকক্ষণ না দেখে তোমার বাবা এসেছিল ঘরে।’
‘ তাতে কি হয়েছে? তুমি নিয়ে এলে কেন? এখন তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে।’
অহনা মাহতিমকে ধরতে গিয়েও পারে না। কারণ সে অদৃশ্য, তার কোনো অস্তিত্ব নেই। অহনা রাগের বশে বলেই ফেলল,’ এখন থেকে তিন ঘন্টা তুমি আমার কাছেও আসবে না, কথা বলবে না, একদম আমার ঘরের বাইরে থাকবে। যদি আসো তো…..’
তার আগেই মাহতিম চলে যায়। কষ্ট পেয়েছে হয়তো বা অভিমান।
রোস্তম ঘরে প্রবেশ করে,’ ঘরের কি অবস্থা করেছিস, মনে হচ্ছে কাউকে পিটি*য়েছিস।’
অহনা কিছু বলল না। রোস্তম ওর পাশে এসে বসল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। রাতের খাবার খেতে বলল তাকে। অহনা খাবে না বলল। রোস্তম বলল,’ তবে আমিও আজ উপোস করলাম।’
বাবার এমন জেদ দেখে অহনাও আর রাগ করে থাকতে পারল না। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। তবে মনে অনুশোচনা হতে থাকে মাহতিমের জন্য। ভাবতে ভাবতে এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত গভীর হতেই মুখোশধারী একজন লোক প্রবেশ করে অহনার ঘরে। অজ্ঞান করে তাকে কাঁধে তুলে নেয়…..
চলবে…..