#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৭৭.
ঘরভর্তি মহিলা, একদন্ড ফাঁক নেই কোনো দিকে। বউয়ের রুপের বর্ননা শুনে অনেকে দেখতে এসেছে। এক দেখায় তাদের চক্ষু তৃষ্ণা মিটছে না। তারা কেউ নিজের আসন ছাড়তে নারাজ, কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। আয়শা এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ কয়জন মেয়ে ছাড়া বাকি সবাই বাহিরে গেলে ভালো হয়। বউকেতো এখনো তৈরি করা হয়নি। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, কাজী এখনই এসে পড়ল বলে।’
আয়শার কথায় সবাই একটু নড়ে বসে। অগত্যা বাইরে যেতেই হলো। কয়জন মেয়ে মিলে অহনা এবং রুমিকে সাজাতে থাকে। এতক্ষণ সাধারণ একটা শাড়ি পড়ে বসে ছিল। সাজ ছিল না তবে চোখে মুখে লাবণ্য ছিল। এই রুপেই সবাই কুপোকাত। না জানি বউয়ের বেশে আরো কতটা মোহনীয় লাগবে!
মতি বিয়ের খুশিতে ডান্স করছে। আরিশ একপাশে বসে আড্ডা দিচ্ছে ভাইদের সাথে। আরিশের থেকে ছোট, ইন্টার পড়া খালাতো ভাই বলল,’ ভাই, তুমি খুব ভাগ্যবান।’
আরিশ ব্রু উঁচিয়ে তাকায় তার দিকে,’ এটা কেন বললি?’
‘ভাবী দেখতে নাইকাদের থেকেও বেশি সুন্দরী। তোমার সাথে অনেক ভালো মানাবে। আচ্ছা এটা বলো, ভাবীর কি কোনো ছোট বোন আছে?’
‘ তার বোন দিয়ে তুই কি করবি?’
‘ ভাবীর বোনতো ভাবির মতোই সুন্দরী হবে তাই না? আছে নাকি?’
‘ না নেই। তার মতো সুন্দরীও আর কেউ নেই। সে একাই সব সৌন্দর্যের রানী। তার সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না। যতবার দেখি, আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। সময় পেড়িয়ে যাক, আমার তাতে কোনো আগ্রহ নেই, আমি শুধু তাকে দেখে কাটিয়ে দিতে চাই সমস্ত সময়। থামিয়ে দিতে চাই সমস্ত হাকিকত।’
‘ এ্যাহেম, এ্যাহেম। ভাই মনে হয় কল্পনার রাজ্যে চলে গেছে!’
আরিশের হুঁশ ফিরে। কিছু্ক্ষণের জন্য সে কল্পনায়ই ছিল বটে। তবে তার বাঁধা নেই অহনাকে নিয়ে বলতে। আসলেই তার হবু বউ সবার সেরা। এটা বলতে লজ্জা কিসের? সেতো সত্যিটাই বলছে। নিজের অজান্তেই আরিশ এসব ভেবে হেসে উঠে।
মোড়ল বাড়ির পেছনে একটি পুকুর রয়েছে। কিছুক্ষণ আগে হ্যারি ঘর থেকে বেরিয়ে বাহিরটা দেখতে গিয়ে পুকুরটা আবিষ্কার করল। মনটা তার ভীষণ খারাপ। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে সে পুকুর পাড়ে গাছের শিকড়ের উপর বসে। গাছের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। মা কল করেছে। কথা বলে ফোনটা পকেটে গুঁজে আবারো চোখ বন্ধ করে রাখে।
আদ্রিতা সাজগোজ আপাতত শেষ করে মোবাইল নিয়ে বসে। তার বন্ধু বান্ধবীদের আসতে বলেছিল, এখনো আসেনি। সে জানালার কপাট খোলে দেখতে থাকে আসছে কিনা। এক পর্যায়ে তার চোখ যায় পুকুরপাড়ে। গাছের নিচে কিছু আছে বলে মনে হয়। যেহেতু তার ঘরটা অনেকটাই সামনে তাই আন্দাজ করতে পারছে না। দেখার কৌতুহলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বাড়ির পেছনে যায়। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে গিয়ে দেখল হ্যারি বসে আছে। আদ্রিতা ঠোঁট বাঁকিয়ে চলে যেতেই আবার লক্ষ্য করল। কেন জানি না তার খুব মায়া হলো। হ্যারির চোখ বোঁজা অবস্থায় খুব সূক্ষ্মভাবে পরখ করল। শ্যামবর্ণের এক মায়াবী পুরুষ। ঠোঁটজোড়া মৃদু নড়ছে, একদম গোলাপী। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কখনো সিগারেট ছুঁয়েও দেখেনি। আদ্রিতা তার কাছে যায়। ইচ্ছে করছে একবার ছুঁয়ে দিতে তার কোমল ঠোঁট। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। আগে খেয়াল করেনি এমনটা, ঝগড়া করতেই উভয়পক্ষ ব্যস্ত ছিল। আজ অন্যরকম লাগছে।
কিছুটা ঝুঁকে হ্যারির মুখের সামনে নিচু হয়ে বসল। পরপরই গোলাপী ঠোঁটের দিকে চোখ যেতেই আগ্রহ বশত স্পর্শ করে।
ঠোঁটে কারো স্পর্শ পেয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ মেলে হ্যারি। একদম মুখের সামনে আদ্রিতাকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠে পড়ে,’ তুমি এখানে?’
আদ্রিতা নিজেও তার থেকে জোরে চিৎকার দেয়। হ্যারির রাগ হয়। সে কোনো কথা না বলে চলে যেতে চাইলেই আদ্রিতা বলল,’ আরে দাঁড়াও!’
হ্যারি থমকে দাঁড়ায়,’ আমার ঝগড়া করার মোড নেই।’
‘ আমি ঝগড়া করতে আসিনি।’
‘, তাহলে কেন এসেছ?’
‘ এটা আমার বাড়ি। আমি যেখানে খুশি যাব, আসব।’
‘ ঠিক আছে, নিজের বাড়ি আগলে বসে থাকো।’
হ্যারি আবার চলে যেতে চাইলেই আদ্রিতা তার হাত টেনে ধরে,’ আমি স্যরি!’
‘ স্যরি কেন?’
‘ আমার রুড বিহ্যাভ করা উচিত হয়নি। তোমার মুখে মেহেদীও লাগিয়ে দিয়েছি। আমাকে এবারের মত মাফ করে দাও। আমি সত্যি সত্যি স্যরি!’
‘ তুমি স্যরিও বলতে পারো? বাহ, ভালো তো।’
‘ দেখো, আমি ঝগড়া করছি না। মিটিয়ে নিতে চাইছি। আর তুমি আবার ঝগড়া করতে চাইছ! আমিতো ভাব করতে চাইছি, বুঝো না নাকি?’
‘ মেয়েরা নাকি গিরগিটির মত মুহূর্তে রং পাল্টাতে পারে, তোমাকে দেখে সিউর হলাম।’
‘ আমি রাগ করছি না তোমার কথায়। কারণ আমি ভাব জমাতে এসেছি।’
‘ আমি চাই না তোমার সাথে আমার আবার দেখা হোক। আমাদের রাস্তা আলাদা হলেই ভালো হয়।’
‘, উঁহুম! তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। তোমার ঠোঁটজোড়া খুব সুন্দর। তাইতো স্যরি বললাম, না হয় বলতাম না জীবৎকালেও।’
হ্যারির ব্রু জোড়া কুঁচকে আসে। ঠোঁট সুন্দর বলে কেউ স্যরি বলতে আসে? কি বলছে এই মেয়ে?
‘ তোমার কি মাথা ঠিক আছে?’
‘ একদম ঠিক আছে। আরো ঠিক হয়ে যাবে যদি তুমি আমাকে বন্ধু বানিয়ে নাও।’
‘ না, একটা ছাগ’লকে বন্ধু বানালেও তোমাকে বানাব না।’
‘ তাহলে গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে নাও।’
‘ কিইই! আসলেই তোমার মাথা গেছে। অদ্ভুত কথা বলছ সব।’
‘ আমি মোটেও অদ্ভুত বলছি না। তোমার ঠোঁট সুন্দর তাই আমার তোমাকে ভালো লেগেছে। আমি কি তোমাকে প্রপোজ করব?’
‘ তুমি ঘরে যাও। হয়তো কিছু খেয়েছ। সমস্যা হবে খুব, ঘরে যাও।’
‘ তুমি কি আর্মি অফিসার?’
‘ না, কিছুদিন আগেই জয়েন করেছি।’
আদ্রিতা আনন্দে নেচে উঠে। হ্যারিকে টেনে নিয়ে নাচতে থাকে। আনন্দে ফেটে পড়ছে। হ্যারি থামাতে পারছে না তাকে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কিনা। মেয়েটার পাগলামী দেখে হ্যারির তাকে মানসিক রোগী মনে হয়। আদ্রিতা হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,’ এ তো জল না চাইতেই মেঘ। তুমিই আমার বয়ফ্রেন্ড। বিয়ে করলে তোমাকেই করব!’
হ্যারি এক ঝটকায় আদ্রিতার থেকে নিজের হাত সরিয়ে নেয়,’ মাথা গেছে তোমার। আগে ভাবতাম বুদ্ধি নেই এখন দেখছি ল’জ্জাও নেই।’
হ্যারি তড়িঘড়ি হয়ে চলে যেতেই আদ্রিতা বলে উঠল,
‘রাতে মশা, দিনে মাছি-
আমি তোমাকে ভালোবাসি!’
হ্যারি কান না দিয়ে চলে যায়। তাতে কি আদ্রিতা মহা খুশি। মনের মত কাউকে পেয়ে গেল। যেভাবেই হোক তাকে নিজের করেই ছাড়বে, এই হলো প্রতিজ্ঞা। মুখ ভার করে আবার হেসে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
অহনা, রুমিকে সাজানো হলো। লাল বেনারসী, লাল লিপস্টিকে তাকে হাজারগুন সুন্দর লাগছে।
সাজিয়ে দিয়ে মেয়েগুলো চলে গেল। সময় মত কেউ এসে বউ নিয়ে যাবে।
মাহতিম এতক্ষণ ছিল না। সাজগোজ শেষে সে অহনাকে দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলক একবারের জন্যও পড়ছে না। অহনা রুমিকে রেখে বারান্দায় চলে আসে। ঘরে কথা বললে রুমি দেখে যাবে বলে।
অহনা শাড়ির আঁচল ঠিক করে বলল,’ দেখো মাহতিম আমাকে কেমন লাগছে?’
মাহতিমের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। চোখের সামনে অহনাকে দেখে তার মুখের কথা ফুরিয়ে গেছে। এক হাত দিয়ে অহনার গাল স্পর্শ করে। অহনা মাহতিমের হাত ধরে চোখ বন্ধ করে নেয়।
মাহতিম অহনার ঘোমটাটা আরো কিছুটা টেনে দেয়,
‘ঠিক সেদিনের মতো লাগছে তোমাকে! আমাদের প্রথম বিয়ের সময়টা যেন এখন। আমার কি ভাগ্য দেখো, সব অপূর্ণ থেকে যায়।’
‘ আর কিছুই অপূর্ণ থাকবে না। কিছুটা সময় পরেই আমরা এখন হয়ে যাব। আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না। অবশেষে আমি তোমাকে পেয়ে যাব। খুশিতে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।’
‘ এই খুশি সারাজনম থাকুক।’
মাহতিম চোখের জল লুকিয়ে নেয়। ঢোক গিলে ভেতরের কষ্টটাকেও হজম করে নেয়। অহনা বুঝতে পারে, মাহতিম কাঁদছে,
‘ তুমি কাঁদছ?’
‘ এটা খুশির কান্না।’
অহনা মাহতিমের চোখের জল মুছে দেয়,
‘ এভাবে কেঁদো না।’
‘ একবার জড়িয়ে ধরো।’
আজ প্রথম মাহতিম নিজে থেকে বলল তাকে জড়িয়ে ধরতে। পুনরায় হাত বাড়িয়ে দেয়,’ আমি তোমাকে অনুভব করতে চাই।’
অহনা ঝাপটে ধরে মাহতিমকে। শক্ত করে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। কেঁদে উঠে মাহতিম। ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে আসছে তার। বুকের ভেতরটা চিনচিন করছে। তীব্র ব্যথায় হৃদ কেঁপে উঠে। আর পারছে না সহ্য করতে। ভেতর থেকে নির্বাক শব্দ আসছে,’ আমি সহ্য করতে পারছি না আমার আহি। আমি পারছি না সহ্য করতে। আমার এসব সহ্য হচ্ছে না একদম।’
অহনা বলল,’ এভাবে বাচ্চাদের মত কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। এখন উপযুক্ত সময়। চলো, আমরা জানালা দিয়ে বাইরে চলে যাই। লাবণী ঠিক মেনেজ করে নেবে। রুমিকে বের করার ব্যবস্থা করছি আমি।’
‘ আর একটু পর। তুমি বিয়ের আসরে গিয়ে বসো আগে।’
‘ সেখান থেকে সবার সামনে কিভাবে কি করব?’
‘ কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করব। তুমি যাও।’
অহনা আর রুমিকে নিতে আসে মেয়েরা। লাবণী এসে অহনাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। কানে কানে এসে বলে,’ তোমারতো চলে যাওয়ার কথা ছিল। গেলে না কেন? তুমি আবার আরিশকে বিয়ে করতে চাও নাতো?’
অহনা আশ্বাস দেয়,’ আরে না। মাহতিম এখানেই আছে। সে সব ব্যবস্থা করে নেবে। আমাকে যেতে বলেছে। জানি না কি করবে। আমার খুব ভয় হচ্ছে। কিন্তু তবুও, আমি তাকে বিশ্বাস করি। হয়তো অন্য কোনো প্ল্যান আছে।’
অহনাকে নিয়ে যাওয়া হয়। মাহতিম শুধু ভাঙা হৃদয় নিয়ে দেখে তাকে।
সহ্য করতে পারছে না। ঘুরে দাঁড়ায়, পশ্চিমে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভেতর থেকে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। ভালোবাসা না পাওয়ার আর্তনাদ। পেয়েও না পাওয়ার আর্তনাদ। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। বসে পড়ে মাটিতে,’ আমার সহ্য হচ্ছে না আহি। আমি পারছি না সহ্য করতে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার, খুব।’
মাহতিম ছুটে যায় অহনার কাছে। সে পারবে না অহনাকে অন্য কারো হতে দিতে। কখনোই না। ভালোবাসাকে কখনোই অন্যের হাতে সে তুলে দেবে না।
চলবে….
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৭৮.
অহনা, আরিশ পাশাপাশি বসে আছে। অহনা হাঁসফাঁস করছে। চারিদিকে দেখছে শুধু। মাহতিম কখন আসবে! আরিশ মহাখুশি। সে কাজীকে বিয়ে পড়াতে বলল। অহনা আঁতকে উঠে,
‘নাহ!’
সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। আরিশ অহনার কাছ ঘেঁষে বলল,’ তোমার কি সমস্যা হচ্ছে?’
অহনা গরম চোখে তাকায় আরিশের দিকে। মুহুর্তে চোখ নামিয়ে ফেলে আরিশ। অহনা বলল,’ আপনি কিছু করুন। থামান এই বিয়ে। মাহতিম এখনো আসেনি।’
‘ সে আসবে না।’
অহনার নাকের পাটা লাল হয়ে আসে,’ আপনি বন্ধ করুন। না হয় আমি এখান থেকে উঠে যাব এখন।’
আরিশ চুপ করে থাকে। কি করবে এখন? কোনো উপায় না পেয়ে বলল,’ আমি চাই মতির বিয়েটা আগে হোক। ভাইয়ের পর আমি করব।’
মোড়ল বলল,’ হঠাৎ এমন কথা কেন?’
‘ বাবা আমার ইচ্ছে ছিল আমি মতির পরেই বিয়ের নিয়ম মানব।’
‘ আচ্ছা, কোনো ব্যাপার না। তোমার যা ইচ্ছা।’
এমন অদ্ভুত ইচ্ছে জেনে মোড়লসহ বাকিদেরও কিছুটা ভাবনা হয়।
মাহতিম ছুটে আসে অহনার কাছে। কিন্তু বিবেক তাকে বাঁধা দিচ্ছে। সে আড়াল থেকে অহনাকে দেখে। কাছে যেতে চায় না। চোখ বেয়ে নোনা পানির স্রোত বেয়ে নামছে।
রুমি আর মতির বিয়ে হয়ে যায়। অহনা হাঁসফাঁস করতে থাকে। এখনো মাহতিম আসেনি। চোখের কার্নিশে পানি জমা হয়। হন্যি হয়ে খুঁজছে মাহতিমকে। কিন্তু কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। বুকটা ধ্বক করে ওঠে অহনার। কেন আসছে না? কোথায় আছে? হাজারো প্রশ্ন নিয়ে মাথাটা ধরে আসে।
কাজী অহনা আর আরিশের বিয়ে পড়াতে আসলে আরিশ শুরু করতে বলে। অহনা অবাক হয়ে যায়। আরিশ কোন বাঁধা দিচ্ছে না। অহনার কলিজা কেঁপে উঠল। সে সোজা উঠে দাঁড়ায়। গটগট করে বিয়ের আসর থেকে চলে যেতেই আয়শা সামনে এসে দাঁড়ায়,’ কোথায় যাচ্ছ এভাবে? বিয়ে এখনো শেষ হয়নি।’
অহনা আয়শার দিকে নজর না দিয়েই নিজের ঘরে চলে যায়। আরিশ উঠে পড়ে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ অহনা ওয়াশরুমে যাবে আমাকে বলেছিল। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ওকে নিয়ে আসছি।’
আরিশ মৃদু হেসে অহনার কাছে চলে যায়। সবাই তাদের এমন আচরণে ক্রুদ্ধ হয়েছে খুব। মোড়ল হাতের লাঠিটা নামিয়ে আসর থেকে উঠে চলে যায়। বর বউয়ের এমন উধাও হওয়ার বিষয়টা কারো হজম হচ্ছে না। অহনার সমস্যা হলে সে অনায়াসেই বলতে পারত। কিন্তু এভাবে বিয়ের আসর থেকে কিছু না বলে উঠে যাওয়াকে কেউ ভালো চোখে নিল না। সকলের মাঝে কানাকানি শুরু হয়।
অহনা নিজের ঘরে গিয়ে হন্যি হয়ে মাহতিমকে খুঁজে। সমস্ত জায়গায়। ঘরের সব উল্টে ফেলে দেয়। কোথাও পাচ্ছে না মাহতিমকে।
আরিশ অহনার ঘরে প্রবেশ করে। অহনাকে সে প্রচুর ভয় পায়। সাহস করে কিছুই বলতে পারছিল না এত সময় যাওয়ার পরেও। এভাবে তাকে উত্তেজিত দেখে আর সামলাতে পারল না। সত্যিটা বললে সে হয়তো কখনোই বিয়ে করতে চাইবে না। কিন্তু না বললে করবে এটাও মানা যায় না।
আরিশ অহনাকে সামলানোর জন্য তার দুই কাঁধ স্পর্শ করে শান্ত করার চেষ্টা করে। অহনা এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দেয়। আরিশ পুনরায় তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করে,
‘ এমন করো না। মাহতিম আর আসবে না।’
অহনা ফুলদানি ছুঁড়ে মারে আরিশকে,
‘ ও আসবেই। আমাকে কথা দিয়েছিল। ওকে আসতেই হবে।’
‘ আসবে না। আর কখনোই ফিরে আসবে না। এটাই তার ভাগ্যের লিখন ছিল। তুমি শান্ত হও। আমি সবটা বুঝিয়ে বলছি তোমাকে।’
‘ আমি কিছু শুনতে চাইনা। আমার মাহতিমকে এনে দিন আপনি। ওকে পেলেই আমি শান্ত হয়ে যাব।’
‘ ওনি ইভিল স্পিরিটের ব্যবহার করেননি।’
অহনা আঁতকে উঠে। অশ্রুসজল চোখে আরিশের মুখপানে দেখে,’ মানে?’
‘ ওনি প্রকৃতির বিরোধীতা করে ইভিল স্পিরিটের ব্যবহার করেনি। তুমি বোকা, তাই বলেছ তাকে এটা করতে। কিন্তু তুমি তার পরিণতি জানতে না।’
‘ কিছু হত না। আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনি সবটা জানতেন, তবুও কেন বললেন না কিছু?’
অহনা আরিশের কলার চেপে ধরে,
‘ আপনি সবটা প্ল্যান করে করেছেন তাই না? আপনি প্রথম থেকেই মাহতিমকে সহ্য করতে পারতেন না। তাই তাকে ভুলভাল বুঝিয়ে আমার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন তাই না? আমি আপনাকে ছাড়ব না।’
‘ পাগলামো করো না। এটাই সত্যি! ইভিল স্পিরিটের ব্যবহার সাধারণ কেউ করে না। খারাপ লোকদের কাজ এটা। এই শক্তি ব্যবহার করে তারা অন্যের ক্ষতি করে, এটা আমাদের সমাজের অহরহ সমস্যার মধ্যে একটি।’
‘ আমি এত কিছু শুনতে চাইনি। আমি শুধু মাহতিমকে পেতে চাই। সেটা যেভাবেই হোক।’
‘ আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাই! যদি সে ইভিল স্পিরিটের দ্বারা প্রাণ ফিরে পেত তাহলে তার শরীরে শয়তানি আ’ত্মা ভর করত। তখন সে নিজেই হয়তো পৃথিবী ধ্বংস করার জন্য নেমে পড়ত। যদি তার মধ্যে শয়তানি সে প্রাণ ফিরে আসত তাহলে সে হয়তো তোমার জন্য স্পেশাল হত, কিন্তু দুনিয়ার জন্য হুমকি হয়ে যেত। আবার এটাও হত, সে পুরোপুরি তোমাকে ভুলে যেত।’
অহনা আরিশকে ধাক্কা দেয়। একদম উন্মাদ হয়ে গেছে সে। কিছুই শুনতে নারাজ। চিৎকার করে মাহতিমকে ডাকে।
‘ আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই না? তাহলে আমার জন্য মাহতিমকে এনে দিন। আমি ওকে ছাড়া পাগল হয়ে যাব। সব শেষ করে দেব। আমার মাহতিমকে এনে দিন আপনি।’
অহনা ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে ফ্লোরে। ডুকরে কেঁদে ওঠে,
‘ আমি এখন কোথায় খুঁজব তোমাকে মাহতিম? তুমি আমাকে না বলে কোথায় চলে গেলে? আমার দম আটকে আসছে। দয়া করে আমার কাছে আসো।’
আরিশ অহনার কাঁধে হাত রাখতেই অহনা ছ্যাঁত করে ওঠে,
‘ ছুঁবেন না আপনি আমাকে। সব আপনার পরিকল্পনা। আপনি ইচ্ছে করে এমনটা করেছেন। ভেবেছেন মাহতিম চলে গেলে আমি আপনাকে বিয়ে করব, কারণ আপনি আমাকে অসহায় মনে করেন। কান খুলে শুনে রাখুন, আমি অসহায় নই। আমার মাহতিম আছে। সে ফিরে আসবেই। চলে যান আপনি। আমি আপনাকে ঘেন্না করি। লাগবে না আমার আপনার সাহায্য।’
অহনা হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। বুকটা চৌচির হয়ে গেছে। উদাসীন লাগছে তার।
লাবণী, আদ্রিতা আসে অহনাকে নিতে। সবাই অপেক্ষা করছে তার জন্য। লাবণী অবস্থা নত দেখে আরিশকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে! আরিশ অগ্নিরুপে তার দিকে তাকায়। লাবণী কোনো কথা না বলে অহনাকে তোলে। সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে। অহনা বলল,’ মাহতিম আসেনি। ও আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল। আমাকে ছেড়ে চলে গেছে সে। আমি এখন কি করব?’
‘ সবাই নিচে অপেক্ষা করছে, চলো।’
‘ না, আমি যাব না। আমি আরিশকে কখনোই ভালোবাসিনি। আমি পারব না তাকে বিয়ে করতে। মাহতিম না আসলে, আমি ম’রে যাব।’
‘ নিচে চলো। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি চাই না তুমি এ পরিবারের সম্মানে আ’ঘাত করো। বিয়েটা করে নাও।’
আরিশ বলল,’ আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি তেমন কিছুই করিনি। আমি শুধু মাহতিমকে ইভিল স্পিরিটের খারাপ দিকটা বলেছি। সেই তার মত বলেছে। আমি কখনোই ওর বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে পেতে চাইনি। ভালোবাসাকে আমিও সম্মান করি। আমি কখনোই চাইনি তোমরা আলাদা হয়ে যাও। কিন্তু এটা প্রকৃতির নিয়ম। তাকে যেতেই হত। কেউ মৃ’ত্যুর পর থাকতে পারে না ইহজগতে।’
‘ তাহলে কেন এসেছিলে আমার কাছে? আমিতো তাকে চিনতাম না। কেন সে এভাবে এসে আবার চলে গেল?’
‘ তুমি ভুল করছিলে। তাই বাঁচাতে এসেছিল। এটা কি তার দোষ? হয়তো সে না আসলে এতদিনে তুমি বেঁচে থাকতে না। আমি তোমাদের সম্পর্কে সব জানি। আর তার প্রাণটা কিছুক্ষণের জন্য থামানো হয়েছিল বলা যেতে পারে। জ্বীনের শক্তিতে তার দেহটা টিকেছিল। কেননা তাকে আ’ঘাত করার পরও তার প্রাণ ছিল। সে কোমায় চলে গিয়েছিল। যার দরুন একজন জ্বীন তার দেহটাকে আয়ত্ত করতে পেরেছে। কিন্তু প্রকৃতির বিরোধীতা করে সে কখনোই কাউকে বাঁচিয়ে দিতে পারবে না। মাহতিম এখন পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে যাবে। তার দেহ থেকে প্রাণ চলে যাচ্ছে ক্রমশ। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না।’
‘ তার মানে ও সত্যি আসবে না? আমি আর দেখতে পাব না।’
‘ না!’
অহনা শীতল হয়ে যায়। নিজের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দেয়। বোবা হয়ে গেছে একদম। মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।
লাবণী, আদ্রিতা ওকে বিয়ের আসরে নিয়ে যায়। আরিশ কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে কি বিয়েটা করে অহনাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলবে? কিছুই তার মাথায় আসছে না। সে অহনার পাশে গিয়ে বসে।
অহনা এবং আরিশকে দেখে সবাই শান্ত হয়। কাজী বিয়ে পড়াতে শুরু করে। অহনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম! এক লক্ষ এক টাকা দেনমোহরে জনাব হাসমত মোড়লের বড় ছেলে আরিশ মোড়লের সাথে জনাব রোস্তম আলীর একমাত্র কন্যা অহনা তামিয়ার শুভ বিবাহ ধার্য করা হয়েছে। রাজী থাকলে বলো মা, আলহামদুলিল্লাহ।’
অহনা একদম চুপ। নিজের ধ্যানে নেই সে। তার খেয়ালই নেই সে বিয়ের আসরে আছে। নিভু নিভু চোখে সে সামনে তাকায়।
কাজী সাহেব পুনরায় বলল,’ বলো, আলহামদুলিল্লাহ, কবুল করলাম।’
অহনা কোনো উত্তর দিল না। সবাই ওকে জোর করছে। কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ নেই।
অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেলেও অহনা কিছু বলল না। হঠাৎ ডুকরে উঠে,’ আমি পারব না।’
বলেই অহনা সামনে তাকায়। দেখতে পায় মাহতিম অশ্রু সজল চোখে তাকিয়ে আছে। অহনার হৃদয়টা মুহূর্তেই পুলকিত হয়ে উঠে।
মাহতিম আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বাইরে চলে যায়। অহনা সহ্য করতে পারল না। বসা থেকে উঠে যায়। লাবণী তার হাত ধরে আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু অহনা তা অবজ্ঞা করে মাহতিমের কাছে ছুটে যায়।
আরিশ এখনো বসেই আছে। সে এটাই চেয়েছিল। সে চায়নি অহনা আর মাহতিম আলাদা হয়ে যাক। জোর করে সে কখনোই অহনাকে পেতে চায়না।
আয়শা, লাবণী, আদ্রিতা অহনার পিছু যেতে চাইলে আরিশ বাঁধা দেয়,’ কেউ ওর পিছু নেবে না।’
অহনা দৌড়ে যায় মাহতিমের কাছে। চিৎকার করে ডাকে। কোনো সাড়া দেয় না মাহতিম। সে গন্তব্যহীন পথে হেঁটে চলে। অহনার দিকে তাকিয়েও দেখল না।
পায়ে কাঁটা বিঁধে যায় অহনার। খালি পায়েই ছুটে এসেছে। এই মুহূর্তে এই কষ্টের থেকেও বেশি কষ্ট পাচ্ছে হৃদয়ে।
চলবে….
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৭৯.
মোড়ল বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড। বউ পালিয়েছে বিষয়টা সবার কানে যেতেই কানাকানি শুরু হয়। মোড়ল আর স্থির থাকতে পারল না। আরিশকে ডেকে নেয় নিজের ঘরে। কিছুক্ষণ স্থির থেকেই আরিশকে কষে চ’ড় মারল।
আরিশ বিরতিহীন তাকিয়ে থাকে মোড়লের দিকে। এই প্রথম বাবা তার গায়ে হাত তুলেছে। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না বাবার এই রুপ। ঠোঁট নড়ে ওঠে আরিশের। কান্না করতে ইচ্ছে করছিল। মোড়ল ঝাঁঝালো কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে,’ সব জানতি তুই তাই না? কেন আগে বললি না?’
আরিশ কান্না করেই দেয়। এতক্ষণ জমিয়ে রেখেছিল কান্না সব। এখন ভেতর থেকে সবটা বেরিয়ে আসে। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। আচমকা মোড়লকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে। মোড়ল কিছুই বুঝতে পারে না। সেও আরিশের পিঠে চাপড় দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে।
আরিশ বলল,’ বাবা, তুমিইতো বলেছিলে ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়া জরুরী। তাহলে কেন আজ তার বিরোধিতা করছ?’
‘ আমি তোর কথা বুঝতে পারছি না। কি হয়েছে বল আমাকে? সত্যিটা বল।’
‘ বাবা, আমার আগেই অহনার জীবনে আর্মি অফিসার মাহতিম ছিল। তারা দুজন দুজনকে ভালবাসে খুব। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আমিও ভালোবেসেছি অহনাকে কিন্তু সে বাসেনি। তুমিই বলো বাবা, আমি কি করে তাদের আলাদা করি? আমি অনেক চেষ্টা করেছি তাদের মেলানোর, কিন্তু সম্ভব হয়নি। প্রকৃতি তার বিরোধিতা করেছে। মাহতিমকে মেরে ফেলেছে। অহনা এখনো তাকে ভুলতে পারেনি। আমি কি করে তার মন পাব? এটা কখনোই সম্ভব না। আমি কি করব এখন বলে দাও?’
মোড়লের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সমস্তটা জেনে তিনি কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। কি বলে ছেলেকে সান্ত্বনা দেবেন, তেমন ভাষা তার কাছে সঞ্চিত নেই।
মোড়ল ছেলের হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসে। আয়শার সাথে শলা পরামর্শ করে কিছুক্ষণ। তারপর লাবণীর মা রাভিনাকে ডেকে বলল,’ আপা, আপনার মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাই এই আসরেই, আপনি কি রাজি?’
রাভিনা বলল,’ এই সময় এটা কিভাবে মেনে নিই? সম্ভব না। তবে লাবণী যদি রাজি থাকে তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি আমার মেয়ের সম্মতিই মেনে নেব।’
মোড়ল লাবণীকে বলতে যেতেই আরিশ বাঁধা দেয়,’ না বাবা, আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় লাবণীকে বিয়ে করা। আমি একজনকেই ভালোবেসেছি আর তাকেই চাই। অহনাকে বিয়ে করব আমি, না হয় আর কখনোই বিয়ে নামক বন্ধনে যাব না। দয়া করে আমাকে জোর করো না। এমনিতেও আমি ভালো নেই। কষ্ট হচ্ছে আমার।’
আরিশ দপাদপ পা ফেলে বেরিয়ে যায়। লাবণী মুখ লুকিয়ে চলে যায়। পুরো বাড়িতে যেন অশান্তি নেমে আসে। কারো মুখে হাসি নেই। বিয়ে বাড়ির আমেজটাও নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আয়শা সব সামলে নেয়। মতি এবং রুমির সব নিয়মের ব্যবস্থা করে।
অহনা দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাহতিমকে। হৃদয়ের ব্যকুলতা আবারো প্রখর হয় মাহতিমের মনে। অহনার স্পর্শে তার শরীর জ্বালা করতে থাকে। খেয়াল করে দেখল হাতের কিছুটা অংশ হাওয়ায় মিশে গেছে। অহনা সেটা খেয়াল করে আঁতকে উঠে। ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠে,’ তোমার কিচ্ছু হবে না মাহতিম। আমি এসে গেছি।’
অহনার কান্না দেখে মাহতিম নিজেকে আঁটকে রাখতে পারল না। বুকের ভেতরটা চিঁড়ে যাচ্ছে। অনর্গল অশ্রু বেয়ে নামছে চোখজোড়া থেকে। কিন্তু কি করবে সে? তাকে যেতেই হবে। সে চলে গেলেই সব শান্ত হয়ে যাবে। আর কিছুক্ষণেই তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। আর কখনো হয়তো অহনার সাথে দেখা হবে না। পৃথিবীর আলো বাতাস দেখা হবে না। অহনা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাহতিমকে। অহনার ধা’রালো স্পর্শে মাহতিমের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। তীব্র থেকে তীব্রতর যন্ত্রণা হতে থাকে। মনে হচ্ছে হাজারো খাদকেরা তার শরীর খুবলে খুবলে খাচ্ছে। মাহতিম সহ্য করতে পারছে না। ব্যথায়, বিচ্ছেদের কষ্টে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে চিৎকার দেয়।
অহনা দু’হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল,’ তুমি যেও না। চলো আমরা পালিয়ে যাই। আমরা সমুদ্রের পাড়ে থাকব নিরালায়।’
মাহতিম অহনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এই নিষ্পাপ চাহনি তাকে ভেতর থেকে আরো পঙ্গু করে দেয়। দু হাতে অহনাকে চেপে ধরে,’ আমি চাই না যেতে। আমি তোমার সাথেই আজীবন থাকতে চাই। দেখো, এই প্রকৃতিটাও আমার পক্ষে নেই। একমাত্র তুমি ছাড়া এই পৃথিবীর আর কিছু আমার পক্ষে নেই। সবাই আমাকে চলে যেতে বলছে। আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। আমি তোমায় ছাড়া কি করে যাই? আমি পারছি না। আমার সহ্য হচ্ছে না এত কষ্ট।’
মাহতিম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শরীরে তার আর কোনো শক্তি নেই। নিজেকে সে সামলাতে পারছে না। আর এক কদমও দিতে পারবে না। অহনা মাহতিমের বুকে হাত রাখে। ছ্যাঁত করে উঠে তার বুক। ব্যথাটা আরো বেড়ে যাচ্ছে।
মাহতিম ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠে,’ এই ব্যথা থেকে আমাকে মুক্তি দাও। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
অহনা চারিদিকে তাকায়। কি করবে এই মুহূর্তে? কিছুই সে খুঁজে পাচ্ছে না। ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে।
মাহতিমের শরীর ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
অহনা উন্মাদ হয়ে যায়। কিছুই করার মত পাচ্ছেনা সে। মাহতিমকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে,’ তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? আমি কি করব এখন? আমি যে ব্যর্থ। আমি পারছি না নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে বাঁচাতে।’
আরিশ অহনাকে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পাশের বাগানে আসে। পরিত্যক্ত জায়গাটা। দূরে অহনাকে দেখে সে এগিয়ে যায়। কিছুটা গিয়েই থমকে দাঁড়ায়। মাহতিম আর বেশিক্ষণ নেই। তাই এই মুহূর্তে না গিয়ে সে দূর থেকেই বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করে। সে কিছুই করতে পারবে না।
মাহতিম আরো নেতিয়ে পড়ে। কথাও বের হচ্ছে না মুখ থেকে। শীতল শরীরটা আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অহনা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মাহতিম এত কষ্টের মাঝেও হাসে। ঘনঘন শ্বাস নেয়। একবার থেমে গিয়েও আবার শ্বাস চলে। মাহতিম অনেক কষ্টে বলল,’ আমি খুব খুশি। আমি শেষ সময়টাতে তোমার সাথে আছি। সময়টা আরো দীর্ঘ হলে হয়তো তোমার বুকে মাথা রেখে আমার মৃ’ত্যুটা হত না। আমি জয়ী প্রেমিক। জয় করতে পেরেছি তোমাকে। আমার আর কোনো আফসোস নেই।’
‘ এভাবে বলোনা।’
অহনা চারপাশে তাকিয়ে দেখে, সুনসান সবকিছু। কেউ নেই সাহায্য করার মত। এখন তার মনেও জানা হয়ে গেছে মাহতিম আর বেশিক্ষণ নেই।
মাহতিম বলল,’ একটু হাসো। হাসলে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগে।’
অহনা কান্নামাখা ঠোঁটজোড়ায় হাসির রেখা টানে। পারছে না সে। তবুও মিথ্যে হাসি দেয়। মাহতিম প্রশান্তিতে চোখ বুঁজে। গাঢ় নিঃশ্বাস নেয়,’ আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি! হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসি।’
মাহতিম পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়। অবশিষ্ট কাপড় আঁকড়ে ধরে থাকে অহনা। চিৎকার করে কাঁদে সে। কাপড়গুলো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে গগনবিদারী ধ্বনিতে আর্তনাদ করে। বুকের ভেতরটা কষ্টে পুড়ে যাচ্ছে। কিভাবে সহ্য করবে এই কষ্ট? ভালোবাসা হারানোর এই আর্তনাদ অম্বরে প্রতিধ্বনিত হয়।
অহনা উদাসীন হয়ে যায়। মাহতিমকে হারিয়ে নিজেও ম’রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গায়ের সমস্ত গয়না খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। উন্মাদের মত হাতের কাঁচের চুড়ি খান খান করে ভেঙ্গে ফেলে। সেগুলো দিয়ে নিজেকে আ’ঘাত করতে থাকে অনবরত।
আরিশ দ্রুত গতিতে এসে অহনার হাত থেকে চুড়ির ভাঙ্গা টুকরো সব ফেলে দেয়। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। অহনা থামে না। ঘর্মাক্ত দেহটা ভিজে একাকার। হাত থেকে র’ক্ত পড়ছে।
আরিশ ওকে উঠানোর চেষ্টা করে। অহনার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেয়,
‘ মাহতিম আর আসবে না। কিন্তু তোমাকে তার জন্য ভালো থাকতে হবে। তাহলে সে কষ্ট পাবে। তোমাকে কষ্ট পেতে দেখলে তার আরও বেশি কষ্ট হবে।’
অহনা দূরে তাকিয়ে হাসে,’ ঐ দেখুন, মাহতিম আসছে। আমি জানতাম ও আসবে। আমাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না। ছাড়ুন আমাকে, আমি মাহতিমের কাছে যাব।’
আরিশ সূক্ষ্ম নজরে দেখে,’ কই, আমিতো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তুমি ভুল দেখছ, মাহতিম নেই।’
‘ আসছে ও, আমার কাছেই আসছে।’
অহনা দৌড়ে গিয়ে মাহতিমকে ধরতে যায়। মরীচিকার মত মিলিয়ে যায় মাহতিমের প্রতিবিম্ব। অহনা আবারো কেঁদে উঠে,’ আবারো চলে গেলে? আমাকে কষ্ট দিতে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না। খুব বাজে তুমি।’
অহনা আবারো বলে,’ এইতো আমার সামনেই তুমি। এবার আর ছাড়ব না। কোথাও যেতে পারবে না।’
আরিশ অহনাকে সরাতে পারে না ঐ জায়গা থেকে। সে চারিদিকে মাহতিমকে দেখতে পাচ্ছে। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে অহনার।
অহনার চোখ দুটো নিশ্চল হয়ে আসে। আরিশের কোলে ঢলে পড়ে। জ্ঞান হারিয়েছে!
আরিশ পাঁজাকোলে করে নেয় অহনাকে। নিস্তেজ দেহটাকে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
চলবে….