#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৭১.
আরিশের সম্পূর্ণ কথা শেষ না হতেই আদ্রিতা এসে পড়ে। অপ্রস্তুত হয়ে মাহতিম সরে যায়। আরিশ বাহানা দিয়ে আদ্রিতাকে বের করতে চায়। কিন্তু সে যেতে অনিচ্ছুক। অহনার পাশে এসে বসে। একটা ললিপপ দিয়ে বলে,’ ভাইয়াকে ঘর থেকে বের করে দাও, গোপন কথা আছে।’
আরিশ ধমকের সুরে বলল,’ এত বড় মেয়ে ললিপপ নিয়ে ঘুরিস, আবার নাকি গোপন কথা। পিচ্চিদের গোপন কথা বলতে কিছু নেই, এসব বড়দের।’
‘ সারাদিনতো পুতুল ভাবীকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেই দিন কাটিয়ে দাও, ভয়ে কথা বলতেও পারোনা। এবার বলো, পিচ্চি কে?’
আরিশ লজ্জা পেয়ে যায়। এমন অবস্থায় সে আদ্রিতার মাথায় গাট্টা মেরে বাইরে চলে যায়। আর একটু দেরি করলে মান ই’জ্জতের ফালুদা বানিয়ে ফেলবে। ছোট বোন মানেই কাল নাগিনী। যখন তখন কথার ছোবল মারে।
আরিশ বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করে কখন আদ্রিতা বের হবে আর সে ইভিল স্প্রিট নিয়ে কথা বলতে পারবে। এরই মাঝে তার কল আসে। একজন ইনচার্জ কল করেছে। তাকে আরিশ দায়িত্ব দিয়েছিল আনাম মৃধা সম্পর্কে তথ্য দিতে। তার পুরো দিনের ডিটেইলস দিতে।
আরিশ জানতো, প্রতিটি অপরাধী অপরাধ করার পর কোনো না কোনো প্রমাণ রেখে যায় বা সেই প্রমাণ লোপাট করার জন্য আগের জায়গায় ফিরে যায়। কেউবা অপরাধপ্রবণ জায়গায় অনেকবার যেতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আরিশও এটার সুযোগ নিয়েছে। সে আনাম মৃধাকে গোপন কিছু সূত্র দেয় অপরাধীদের নিয়ে এবং বলে, সে অপরাধী ধরতে পেরেছে। আর কোনো অপরাধী আপাতত নেই এটা দেশে। আনাম মৃধা স্বস্তির নিশ্বাস নেয়। তিনি মনে করেছেন অপরাধী ধরা পড়ে যাওয়ার পর কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। যদি সন্দেহ না থাকে তাহলে তিনি নিজের অবৈধ কাজগুলো অনায়াসেই করতে পারবেন।
আরিশের মতলব ছিল এটাই। সে ভেবে চিন্তে মিথ্যে বলেছে, যেন আনাম তার কাজ চালিয়ে যায় এবং আরিশ সহজেই ধরে নিতে পারে।
কল থেকে জানতে পারে আনামের গুপ্ত ঘাঁটি ছিল কুমিল্লার ময়নামতিতে। সেখানকার বিজ্ঞান কলেজের প্রিন্সিপালও তার সাথে জড়িত। কলেজের পেছনে গুপ্ত ঘর রয়েছে, সেখানেই তারা তাদের গোপন অ’স্ত্র রাখে।
আরিশের হাতে প্রমাণ আসতেই সে আর দেরি করেনি। রওনা দিল ময়নামতির উদ্দেশ্যে। সাথে কাউকে নেয়নি। সে চেয়েছিল কাজটা নিজেই সামলে নেবে।
আদ্রিতা পা নাচিয়ে নাচিয়ে অহনাকে অনেক কথা বলল। অহনাও বসে বসে তার কথাগুলো শুনতে থাকে। যেহেতু আগের সব কথা মনে পড়ে গেছে। তাই অনেকটাই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। অহনা ছোট থেকেই খুব গম্ভীর ছিল। সবার সাথে কম কথা বলতো। কিন্তু মাহতিম জীবনে আসার পর থেকে রং পাল্টাতে শুরু করে। সে অনেকটাই চঞ্চল হয়ে ওঠে। অবশ্য তার জন্য অনেক জ্বালা সহ্য করতে হয়েছে মাহতিমকে। ভালোবাসার জন্য অদ্ভুত সব কান্ডও করতে হয়েছে।
এক পর্যায়ে আদ্রিতা বলল,’ পুতুল ভাবী, তুমি কি আরিশ ভাইয়াকে খুব ভালোবাসো?’
অহনা উত্তর দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। আমতা আমতা করেও কিছু মুখে আনতে পারল না।
আদ্রিতা নিজে থেকেই আবার বলল,’ আমি জানি, তুমি ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসো, ভাইয়াও বাসে। তবে ভাইয়ার ভালোবাসা একটু বেশি। কিন্তু আরেকজন ভাইয়াকে খুব ভালোবাসে, হয়তো তোমার থেকে বেশি।’
অহনা জেনেও না জানার ভান ধরে জিজ্ঞেস করল,’ কে সে?’
‘ আগে বলো, হার্ট হবে না?’
‘ একদম না। ভালোবাসা হচ্ছে মনের এক প্রকার ব্যাধি। এই ব্যাধি যার হয় সেই বুঝে ভেতরের ভয়াবহতা। তুমি বলো, আমি কিছু মনে করব না।’
‘ লাবণী আপু ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসে, কিন্তু ভাইয়া বাসে না। আবার দেখো তুমি আর ভাইয়া দুজন দুজনকে ভালবাসো, এখন বলো আমি কি করব? আমি না, এসব ভাবতে গিয়ে নিজেই সব গুলিয়ে ফেলেছি। লাবণী আপুর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। যদি তোমার একটা হ্যান্ডসাম ভাই থাকতো তাহলে তাকে বলতাম লাবণী আপুকে ভালোবেসে ভাইয়ার কথা ভুলিয়ে দিতে। এখন কি করব?’
‘ এত ভাবছ কেন? তোমার ভাইয়ার সাথে লাবণীকে দেখবে তুমি!’
‘ কিইই! তুমি কি বিয়ে করবে না?’
‘ তুমিইতো বললে, লাবণী আরিশকে ভালোবাসে।’
‘ তাই বলে তুমি লাবণী আপুকে ভাইয়ার সাথে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করবে নাকি?’
‘ তাহলে কি করব?’
‘ উফফ্! তোমাকে বুঝাতে পারছি না। আমি চাই লাবণী আপু কষ্ট না পাক। দেখো আমি বলি, তোমরা আর ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, চাইলেও এখন আর ভাঙতে পারবে না। কিন্তু আমরা চাইলেই লাবণী আপুকে ঠিক করতে পারি। তার জন্য আমাদের কিছু করা উচিত।’
‘ ওহ আচ্ছা।’
‘ শুধু আচ্ছা?’
‘ আর কি বলব?’
‘ কি করব সেটাতো প্ল্যান করতে হবে।’
‘ তুমি এখন যাও। পরে কিছু ভেবে বলব আমি তোমাকে।’
আদ্রিতা চলে যায়। অহনা মাহতিমের কাছে যায়। দুজনে মিলে বারান্দায় গিয়ে বসে। চন্দ্র বিলাস করে তারা। মাহতিমের কাঁধে মাথা রেখেছে অহনা। প্রশান্তিতে দুজন হাতের উপর হাত রাখে। মাহতিম আগ্রহ বশত বলল,’ আমাকে চিনতে না তুমি, তাও কেন এত বিশ্বাস নিয়ে ভালোবাসলে?’
অহনা মৃদু হাসে,’ তুমি কি চাইছিলে, আমি তোমাকে রিজেক্ট করে দিই?’
‘ না, তবে কিছু না জেনে শুনে কেন তুমি আমাকে এতটা প্রিয় বানিয়ে নিলে? আমার পরিবার, পরিজন নেই জেনেও।’
‘ বলতে পারব না। আমার তোমাকে খুব আপন মনে হয়েছিল। তোমাকে কাছে পেলেই আমার মনটা তৃপ্তি পেত।’
‘ এখনো কি সেই তৃপ্তি আছে?’
‘ এখন শুধু তৃপ্তি না। ভালোবাসার উইল আছে। যেটা একবছর আগে থেকেই ছিল। এবার সেটা পূর্ণতা পাবে। আমার আর তোমরা বিয়ে হবে। তারপর সমুদ্রের পাড়ে একটা ছোট্ট বাড়ি করে দুজনে থাকব। আমাদের আটশ বাচ্চা হবে।’
মাহতিম গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,’ আটশ একটু কম হয়ে গেল না? আমিতো ভেবেছি বারোশ হবে।’
‘ সামলাবে কে?’
‘ তুমি!’
‘ না, তুমি।’
‘ আমরা দুজনেই।’
পরপরই দুজনেই হেসে উঠে। অহনা লাজুক দৃষ্টিতে তাকায় মাহতিমের দিকে। আজকের তাকানো ভিন্ন। ঠিক আগে যেমন ছিল। মাঝখানের পরিবর্তনে সব পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। এখন তা আবার ফেরত এলো।
অহনা মাহতিমের আঙুলের ভাঁজে আঙুল রেখে বলে,’ এইযে ধরলাম, এই হাত কখনো ছাড়বো না।’
অহনা মাহতিমের বুকে হাত রাখে,’ তোমার প্রতিটা স্পন্দনে আমি থাকতে চাই। সারাজীবন এভাবেই থাকতে চাই। যদি অমরত্ব পেয়ে যেতাম, তাহলে তুমি আর আমি এক হয়ে থাকতে পারতাম।’
অহনা আবারো যোগ করল,’ এই চন্দ্র বিলাসে সমুদ্র দেখতে চাই। নিয়ে যাবে আমাকে?’
মাহতিম এক গাল হেসে বলল,’ চলো তবে। হয়তো এটাই আমাদের শেষ সমুদ্র বিলাস।’
মাহতিম অহনাকে পাঁজাকোলে করে রেলিংয়ের কাছে নিয়ে যায়। অহনা মাহতিমের গলা জড়িয়ে ধরে। মাহতিম আকাশ পথে রওনা দিতে গেলেই বুঝতে পারে, তার কোনো শক্তি নেই, কাজ করছে না কিছুই।
মাহতিম পুনরায় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বুঝতে পারছে খুব, শক্তি তার এক ফোঁটাও নেই। অহনাকে নামিয়ে দিয়ে বলল,’ আমার কোনো শক্তি কাজ করছে না। হয়তো সব শক্তি শেষ। এখন আর কিছু করার নেই। আস্তে আস্তে আমিও শেষ হয়ে যাব।’
‘ এভাবে বলো না। আরিশ আসলেই একটা ব্যবস্থা করবই। আমি তোমাকে হারাতে পারব না। শক্তি নেইতো কি হয়েছে? আমরা হেঁটে যেতেতো পারি তাই না?’
‘ কিন্তু তুমি বের হবে কি করে?’
‘ আমার কাছে আইডিয়া আছে।’
‘ বলো শুনি।’
‘ ওড়ঁনা টানিয়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যাব। যেই ভাবা সেই কাজ। দুজন মিলে জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায়।
গ্রামের সাধারণ রাস্তা। বৃষ্টি ভেজা রাত। কাঁদামাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ফুল-পাতা। মাহতিম অহনার হাত ধরে রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসে। তারা দুজনেই নদীর পাড়ে আসতে পেরে খুব খুশী। গা ভিজিয়ে দেয় অহনা। মাহতিম তাকে মানা করে। কিন্তু অহনা শুনে না, খুশিতে সে আত্মহারা। জীবনের সবচেয়ে বড় খুশিটা এখন তার কাছে।
মাহতিম বাঁধা দিতে পারেনা। অহনা আপনমনে পূর্ণিমাতে স্নান করছে। সেই অপরূপ সৌন্দর্য মন্ত্রমুগ্ধ নয়নে দেখছে মাহতিম। তার মনে হচ্ছে কোনো হুর বা পরী চাঁদনী রাতে নদীতে গোসল করছে।
মোড়ল সন্ধ্যায় একবার বাড়িটা টহল দিচ্ছিল। এমন সময় দেখল অহনার ঘর বরাবর ওড়ঁনা ঝুলানো। তৎক্ষণাৎ কিছু না ভেবেই অহনার ঘরে গিয়ে তাকে ডাকে। কিন্তু সাড়া পায় না। তাই সে নিশ্চিত হয় অহনা বাইরে গেছে। এভাবে চোরের মতো যাওয়াটা তার পছন্দ হয়নি। যেহুতু ওড়ঁনা ঝুলানো তাই বেশ বোঝা যাচ্ছে অহনা নিজ মর্জিতেই গিয়েছে। তাই তিনি অহনার ঘরে বসেই তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
আরিশ ময়নামতি বিজ্ঞান কলেজের দিকে পা বাড়াতেই কেউ তার মাথায় আঘা’ত করে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। এক নজর খেয়াল করে আ’ঘাত করা লোকটিকে। দেখেই আঁতকে উঠে।
চলবে….
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৭২.
অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে। স্নিগ্ধ নদীর পাড়ে দুজন কপোত কপোতী সুখ নিচ্ছে। তাদের মনে কষ্টের ছিটে ফোঁটাও নেই।
মাহতিম অনেকক্ষণ পর বলল,’ আমাদের এখন বাড়ি যাওয়া উচিত।’
অহনা অনিচ্ছায় মাথা নাড়ায়। মাহতিমের বুকে পরম শান্তিতে চোখ বুঁজে আছে। মাহতিম পুনরায় তাড়া দিতেই অহনা বিরক্তিতে তার মুখ চেপে ধরে,’ চুপ করে থাকো তো। এখন বাড়ি গিয়ে কি করব? এর থেকে ভালো হবে যদি আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিই। একদম কথা বলবে না।’
মাহতিম অহনাকে কোলে তুলে নেয়,’ এবার দেখি কিভাবে এখানে থাকো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সবাই খুঁজবে তোমাকে। মাথায় যদি একটু বুদ্ধি থাকতো তাহলে এমনটা করতে না।’
‘ আমি এতটা বাধ্যবাধকতায় থাকতে পারিনা। তুমি আমাকে নামিয়ে দাও। বাড়িটার থেকেও এখানে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে।’
মাহতিম কোনো কথা শুনে না পাঁজাকোলে করে অহনাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়।
মোড়ল এখনো বসে আছে। অহনার কান্ডে সে অনেকটাই কষ্ট পেয়েছে।
অহনা ওড়ঁনা বেয়ে উপরে উঠে আসে। চোখের সামনে মোড়লকে দেখতে পেয়ে কলিজা কেঁপে উঠে। মোড়ল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। অহনার কাছে আসতেই আরেক দফা হৃদ কেঁপে উঠে অহনার। কোথায় ছিল এতক্ষণ, এই প্রশ্ন করলে কি উত্তর দেবে সেটা ভেবে চলেছে। মস্তিষ্ক একদম ফাঁকা। কোনো আইডিয়া মাথায় আসছে না।
মোড়ল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানতে চায়,’ কোথায় গিয়েছিলে?’
অহনা কি বলবে বুঝতে পারে না। এত রাতে বাইরে ছিল, সেটা কোনোমতেই সে বলতে পারছে না। মোড়ল গলা নরম করে বলল,’ তুমি এই বাড়িতে আমার আরেকটি মেয়ে। তোমার ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার, যেমনটা পালন করি আমার নিজের মেয়ের প্রতি। বাবা মনে করে থাকলে কৈফিয়ত দিতে নিশ্চয় দ্বিধা নেই?’
‘ আসলে বাবা.. আমি… ওই।’
অহনা কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাথায় এই মুহূর্তে কোনো বুদ্ধি আসছে না।
মোড়ল পুনরায় বলল,’ বাবাকে কখনো তার মেয়ে ভয় পায়? শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থাকে শুধু। আমি জানি, তুমি এমন কিছু করোনি আমার অগোচরে, যার কারণে আমি অসন্তুষ্ট হতে পারি। কেন বাড়ির বাইরে গিয়েছিলে? তাও আবার জানালা বেয়ে। একা একা বের হলে কেন? আমি শুধু জানতে চেয়েছি।’
অহনা বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে বলল,’ বাবা, আমার নদীর পাড়ে যেতে খুব ইচ্ছে করছিল, তাই গেলাম। সন্ধ্যায়তো বের হতে দেবে না মা, মঙ্গল মনে করেন না। তাই কাউকে না জানিয়ে গেলাম।’
‘ ঠিক আছে! তোমার ইচ্ছে হয়েছে, আরিশকে বলতে। আরিশ তোমাকে নিয়ে যেত। একা একা এভাবে বের হওয়াটা কি ঠিক হলো?’
‘ স্যরি বাবা, আর কখনো এমন ভুল হবে না। আর কখনো না বলে যাব না।’
‘ তুমি হয়তো আমাদের নিজের পরিবার মনে করো না। তাই বলার প্রয়োজন মনে করোনি। আমি তোমার এই আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছি।’
অহনার অনুতাপ হয়। যারা এত ভালোবাসা দিল, তাদের নাকি সে কষ্ট দিল। মনে হলো, মাহতিমের সাথে চলে গেলে বাড়ির প্রতিটি সদস্য খুব কষ্ট পাবে।
অহনা ছলছল চোখে মোড়লের দিকে তাকায়,’ বাবা, আমি বুঝতে পারিনি। একবার মাফ করে দিন। আর কখনো এমনটা করব না। না বলে কোথাও যাব না।’
মোড়ল কঠোর হয়ে যায়। ঘর থেকে বের হতে গেলেই অহনা বলল,’ বাবা চলে যাওয়ার পর আপনিই আমার বাবা। এই পরিবারটাই আমার পরিবার। আমি কখনো ভাবিনি সব হারিয়েও সব পেয়ে যাব। আমিতো আপনার মেয়ে তাই না? মেয়েকে কি ক্ষমা করে দিতে পারেন না?’
মোড়ল বলল,’ অপরাধ করলেই তো ক্ষমা করব। তুমি অপরাধ করোনি। করেছে আরিশ, শা’স্তি তাকেই দেব।’
অহনা অবাক হয়ে বলল,’ ওনার দোষ নেই। ওনিতো জানেইনা আমি নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম।’
‘ ওর শা’স্তির কারণ হলো, ও তোমার খেয়াল রাখেনি। না হয় এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে না তুমি। এই ঘরটা হয়তো তোমার কাছে বন্দিঘর মনে হয়। ওর উচিত ছিল তোমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাইরে ঘুরতে যাওয়া।’
মোড়ল বেরিয়েই আরিশের ঘরে যায়। আরিশ নিজের ঘরে ছিল না। মোড়ল তাকে কল করে। নট রিচেবল বলছে। কয়েকবার চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পেল না। চিন্তার ভাঁজ পড়ে মোড়লের কপালে।
কিছুক্ষণ পরপরই তিনি আরিশকে কল করে। বার বার নট রিচেবল বলছে।
রাত একটায় রূপ নিল। এখনো আরিশের আসার নাম নেই। লাবণী সেই সন্ধ্যা থেকে আরিশের ঘরে বসে আছে। কারো চোখে নিদ নেই। আয়শা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।
আরিশ কখনো এতটা দেরি করে না। যখন দেরি হতো, আগে থেকেই কল করে বলে দিত, সে আসতে পারবে না। এবার বলেনি। প্রতিটি সদস্য আরিশের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে।
বৈঠকখানায় সবাই মুখ ভার করে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই ইন্সপেক্টর রিজু এসেছিল। তিনি সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছেন। কেউ তেমন কিছুই বলতে পারল না।
আদ্রিতা, লাবণী, রুমি, অহনা আরিশের ঘরে বসে ছিল। লাবনী কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। সে জানতো আরিশ ভয়ঙ্কর সব কাজেও নিজেকে একা ছেঁড়ে দেয়। কখনো নিজের প্রাণের পরোয়া করে না। কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে! চিন্তায় কিছু ভাবতে পারছে না।
রাত আরো গভীর হয়, না আরিশ আসছে না তার কোনো খবর। এক পর্যায়ে রুমি অহনাকে বলল,’ বিকেলে জীজুকে দেখলাম কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল।’
লাবণী উৎসুক হয়ে রুমির দিকে এগিয়ে আসে,’ কার সাথে কথা বলছিল? তুমি কিছু জানো? বলো আমাকে।’
‘ তেমন কিছু না, তবে আনাম মৃধা নামক কাউকে নিয়ে কথা বলছিল। আমি শুধু এই নামটাই শুনেছি।’
‘ তুই সেটা আগে বলতি। হয়তো এটা থেকে কোনো সূত্র পাওয়া যেত।’ কথাটা বলেই অহনা ইন্সপেক্টর রিজুকে কল করে আনাম মৃধা সম্পর্কে বলে।
সকালবেলা সবার চোখ নিভু নিভু। কেউ ঘুমায়নি। বাড়ির ছেলেকে যথাসময়ে বাড়িতে ফিরতে না দেখে সবার মনের অবস্থা ঠিক ছিল না।
আরিশ অচেতন অবস্থায় ছিল অনেক সময়। চোখ খুলতেই দেখতে পায় একটা ঘরে সে বন্দি অবস্থায় রয়েছে। হাত পা বাঁধা তার। ঘরটার চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, চারপাশে অনেক ফাইল জমা রয়েছে। মনে হচ্ছে হাজার বছরের পুরনো ঘর এটা। কাগজের স্তুপ অনেক।
আরিশ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, পারেনা। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ছিঁড়ে যাবে।
দরজা খোলার খটখট শব্দ হতেই আরিশ চমকে উঠে। প্রবেশ করে আনাম। হাতে সিগারেট, মোটা ফ্রেমের চশমা পরেছে। আরিশের মুখ বরাবর এগিয়ে এসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে,
‘ আমার সম্পর্কে জানার খুব আগ্রহ ছিল তাই না? তোমার মতো হাজারো অফিসারকে পায়ে পিষেছি আমি।’
আনামের চোখে মুখে হিংস্র হাসি। নিজেকে সে অনেক চতুর দাবি করছে। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। তড়িঘড়ি হয়ে বেরিয়ে যায়। একটা লোককে ডেকে বলল আরিশের খেয়াল রাখতে। যেন পালাতে না পারে।
আরিশের হাতে পায়ে বাঁধন। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে সফল হয়। এক হাতের বাঁধন খুলতে সক্ষম হয়। অনেক কষ্টে পকেট থেকে ফোনটা বের করে। সাথে সাথেই নাম্বার টাইপ করে। ইন্সপেক্টর রিজুকে কল করে। লোকেশন বলে দেয়।
রিজু কয়েকজন কন্সটেবল নিয়ে পৌঁছে যায় ময়নামতি। আরিশের দেওয়া লোকেশন অনুযায়ী তারা বিজ্ঞান কলেজে তল্লাশি নেয়। স্টোর রুমে আরিশকে বন্দি অবস্থায় পেয়ে যায়। পাহারাদারকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
আরিশ আনাম মৃধার সমস্ত কর্মকান্ডের কথা বলে দেয়। বিজ্ঞান কলেজের স্টোর থেকেই তার সমস্ত ফাইল খুঁজে পায়।
আনাম মৃধা ভেবেছিল কেউ তার সম্পর্কে জানতে পারবে না। তাই সে অনায়াসেই কনফারেন্সে যোগ দেয়। যেখানে গিয়ে প্রথমেই আরিশ সমস্ত লোকের সামনে তাকে অপরাধী শনাক্ত করে।
বাড়িতে খবর দিয়েছিল আরিশ ঠিক আছে। এগারোটায় মোড়ল গিয়ে তাকে নিয়ে আসে। বাড়িতে সবার শান্তি ফিরে আসে আরিশকে দেখে।
বিকেলে আরিশ ঘুমিয়ে ছিল। অনেকটা আ’ঘাত পেয়েছে মাথায়। তাই এপাশ ওপাশ করছে। স্বস্তিমতো সে শুতে পারছে না।
অহনা আসলো আরিশের ঘরে। তাকে এমন এপাশ ওপাশ করতে দেখে মায়া হয় অহনার, বলল,’ কষ্ট হচ্ছে খুব?’
আরিশ চোখ মেলে দেখে। এই মুহূর্তে অহনার চোখজোড়া দেখে সে সুস্থ। মনে হচ্ছে কখনো কোনো ব্যথা ছিল না। চক্ষু শীতল করা চাহনীই তার সুস্থতার কারণ।
অহনা আবার বলল,’ আপনার কষ্ট হচ্ছে তাই না? আমি কি সাহায্য করব?’
‘ আমি ঠিক আছি। মাহতিম কোথায়?’
‘ সে ঘরেই আছে। পুরনো এলবাম দেখছে।’
‘ তুমি বরং তার কাছে যাও। এখানে আসা উচিত হয়নি।’
‘ আপনাকে দেখতে এসেছি। কাল থেকেই সবাই আপনার জন্য চিন্তা করছিল। আপনি আসার পর সবটা ঠিক হলো। আসার পর তেমন কথা বলতে পারিনি, তাই দেখতে এলাম।’
‘ তোমার কি চিন্তা হয়েছিল?’
অহনা নিশ্চুপ। আরিশ তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। উঠে বসতে চাইলে ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করল। ‘উঁহ’ শব্দ করতেই অহনা তাকে সামলানোর জন্য ধরতে গেলেই কোথা থেকে লাবণী এসে ধরে নেয়,’ তুমি ঠিক আছ? খুব বেশি ব্যথা করছে?’
আরিশ লাবণীকে ছেড়ে দিতে বলে,’ আমি ঠিক আছি। এখন অনেকটাই ব্যাটার। তোমরা দুজনই আসতে পারো এখন। আমার বিশ্রামের দরকার।’
‘ আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না। কিন্তু তোমার সেবা করতে অন্তত দাও। একদম চুপ থাকবে, আমি ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি।’
অহনা মৃদু হেসে বলল,’ আসি তাহলে।’
লাবণী আরিশের ঘাড় ম্যাসাজ করে দেয়। আরিশের কষ্টে সেও কষ্ট পাচ্ছে। মনে মনে ফরিয়াদ করছে, কষ্টটা যেন আরিশের না হয়ে তার হয়। টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আরিশের ঘাড়ে।
আচমকা টের পায় আরিশ। লাবণীকে বলল,’ ঠিক আছে, আর কিছু করতে হবে না। তুমি নিজের ঘরে যাও।’
লাবণী ছেড়ে দেয়। ঘর থেকে যাবার প্রস্তুতি নিয়েই আবার ফিরে আসে,
‘তুমি কি সত্যি কখনো আমাকে ভালোবাসতে পারবে না?’
আরিশ শার্ট গায়ে দিয়ে নেয়। লাবণীর দিকে একবার নজর দিয়ে আবার গুটিয়ে নেয়,’ এক মন কয়জনকে দেওয়া যায়? কোনো উপায় কি আছে? থাকলে বলো, সে উপায়েই না হয় তোমাকে ভালোবাসবো।’
‘ কি জাদু করেছে এই অহনা তোমাকে? কাল কি সত্যি তাকে বিয়ে করে নেবে?’
‘ কাল সম্পর্কে বলতে পারছি না। তবে ওকে আমি পাব না।’
‘ যদি ও তোমাকে বিয়ে করে নেয় কাল, তাহলে আমার সুইসা’ইড করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’
‘ এসব পাগলামো একদম করতে যাবে না। জীবন আল্লাহর মহৎ দান। তুমি চাইলেই তা নষ্ট করতে পারো না। তাই চাইব তুমি তোমার লাইফ এনজয় করো। যে তোমাকে ভালোবাসবে, তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নাও। আমি চাই তুমি সুখী হও।’
‘ তুমি বললে না, এক মন কয়জনকে দেওয়া যায়? আশা করি উত্তর তোমার জানা। আমি কখনোই অন্য কাউকে মেনে নিতে পারব না। হয়তো তুমি থাকবে জীবনে আর না হয় জীবনটাই থাকবে না।’
চলবে…
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৭৩.
বাড়ি ভর্তি মেহমান। এক দন্ড ফাঁক নেই কোনো কিনারায়। হ্যারি এসেই এদিন ওদিক দেখছে। মনটা বিষন্ন তাও সে ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে অহনার কাছে আসে। ড্রেককে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে হঠাৎ সে পৃথিবী থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে। পুলিশরাও কোনো কিনারা করতে পারল না। অর্থাৎ ড্রেক নামের কাউকে তারা শনাক্ত করতেই পারছে না, খুঁজে পাওয়া অনেক দূরের কথা। এরই মাঝে টিকুর এক্সি’ডেন্ট তাকে ভেতর থেকে আরো ভেঙে দিল। প্রিয় দুই বন্ধুকেই হারালো। চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তড়িঘড়ি হয়ে নিজেকে সামলে নেয়। একজনকে জিজ্ঞেস করল,’ ভাই, বউয়ের ঘর কোন দিকে?’
সে ছিল আরিশের মামাতো ভাই রাতুল। রাতুল ইশারা করে দেখিয়ে দিল অহনার ঘর। হ্যারি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে অহনার সাথে দেখা করতে যায়। কিন্তু দেখল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
ভেতরে মহিলারা অহনাকে মেহেদী অনুষ্ঠানের জন্য সাজাচ্ছে। হলুদ শাড়ি পরানো হয়েছে ওকে। ফুলের কানের দুল, টিকলি, চুড়ি, গলার হার সবকিছু। মনে হচ্ছে ফুলে ফুলে আজ ফুলপরীতে পরিণত হয়েছে অহনা। এসবে তার কোনো আগ্রহ নেই। ঘরের কোণায় রাখা ফুলদানিটার দিকে তাকিয়ে আছে প্রথম থেকেই। মহিলারা হাজার রংয়ের কথা বলছে, সেদিকে কান নেই অহনার। একজন বলল,’ এত রূপবতী দেখেছি বলে মনে হয় না কখনো। কিগো আরিশের মা, কোথা থেকে আনলে এই হিরেকে?’
আয়শা এক গাল হেসে বলল,’ আমাদের গ্রামের মেয়েই, শহরে ছিল ছোট থেকে, তাই দেখনি। আমার আরিশের সাথে কেমন মানাবে গো?’
কয়েকজনের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। অহনাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, যদি কোনো খুঁত পেয়ে যায়, তাহলে আরিশের মায়ের বড় বড় কথা বের করে নেবে। কিন্তু নিখুঁত অহনার কোনো খুঁত তারা পেল না। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল একজন,’ দেখো বোন, সুন্দরী বলে আদরে গাছে তুলো না যেন, পরে নামাতে পারবে না বলে দিলাম। এখনকার মেয়েরাতো জামাইকে আঁচলে বেঁধে রাখতে চায়। দেখো, তোমার ছেলেটা আবার যেন বউয়ের রুপে পাগল হয়ে তোমাদের ভুলে যায়। এসবতো অহরহ ঘটছে। আমি বাপু তোমার ভালো চাই, তাই সাবধান করলাম।’
‘ যদি নিজের জামাইকে আঁচলে বাঁধতে চায়, তাহলে বাঁধুক, তাতে আমার কি? ছেলেকে বিয়ের পর বউয়ের হাতে তুলে দিয়েই আমি মুক্ত। বউ এবার যাই করুক তার সাথে। আমার শিক্ষা যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে সে ভালোটাই করবে। আমার বিশ্বাস আছে আমার ছেলে এবং ছেলের হবু বউয়ের উপর। তোমাদের এত চিন্তা করতে হবে না।’
তন্দ্রা সুর মিলিয়ে বলল,’ হ, আপা। ঠিক বলেছ। এমন চাঁদমুখের মেয়েকে তো আমিই চোখের আড়াল করতে চাইব না। আরিশ কি দোষ করল তাহলে?’
উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠে। মায়াবী অহনার মায়াবী নজর সবাইকে মুগ্ধ করছে। আয়শা এসেই চোখের কাজল লাগিয়ে দিয়ে বলে,’ নজর না লাগুক। এই উজ্জ্বলতা দিয়ে আমার পুরো বাড়িটাকে উজ্জ্বল করে রেখো।’
তন্দ্রা বলল,’ বিয়ের পরপরই কি তাকে সংসারের চাবি দিয়ে দেবে নাকি?’
‘ চুপ কর ছোট! এখন এসব কথা নয়। সেটা পরে দেখা যাবে। বড় বউ হয়েছে যেহেতু তাকেই সব সামলাতে হবে। কিন্তু এখন এসব কথা না।’
আয়শা অহনার কপালে চুমু খেয়ে চলে যায়। একে একে সবাই বেরিয়ে যায়। শুধু রুমি আর আরিশের একটা ছোট চাচাতো বোন থাকে।
মাহতিম এতক্ষণ আরিশের ঘরে ছিল। তারা কিছু আলোচনা করেছে। মাহতিম বেরিয়ে এসে অহনার কাছে যায়। অহনা পেছন ফিরে বসে ছিল, তাই তেমনটা দেখতে পায়নি। মাহতিম অহনা বলে ডাক দিতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে অহনা পেছনে তাকায়। মাহতিমের হৃদয়টা যেন কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়। স্পন্দন থেমে যায়। ভুবনমোহিনী সুন্দরী রমনী এখন তার চোখের সামনে। চোখ ফেরাতে পারছে না সে। এতোটাই গভীর অহনার চোখ, মনে হলো কোনো মায়া হরিণী তার দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিমের সম্মুখে। বুকের ভেতরটা চিনচিন করছে। অহনা রুমি আর তিন্নিকে বলল,’ তোমরা একটু বাইরে যাও, আমি একটু একা থাকব। একটু পর আবার এসো।’
ওরা ঘরে থেকে চলে যেতেই অহনা দরজা বন্ধ করে দেয়। দৌড়ে মাহতিমের কাছে আসে। মাহতিম এখনো হা হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক পড়ছেনা তার। সবকিছু গুলিয়ে গেছে তার। অহনা ওর চোখ চেপে ধরে বলল,’ এবার দেখি কি করছ দেখো, আর কতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থেকে কাটাবে?’
মাহতিম অহনার হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেকে আরও কিছুটা সামনে নেয় অহনার, এত সৌন্দর্য কেন তোমার? বার বার কেন মুগ্ধ হই আমি? এটা কি ব্যাধি নাকি আমাকে ঝলসে দেওয়ার অন্য কোনো মন্ত্র?’
অহনা হেসে ফেলে,’ এসব কি বলছ? মাথা ঠিক আছে?’
মাহতিম অহনার ঠোঁট স্পর্শ করে বাহু দ্বারা। কিছুটা লাল লিপস্টিক তার হাতে লেগে যায়। কাজলের আঁকা চোখগুলো স্পর্শ করে দেয়,’ জাদু কি জানো?’
অহনা বিস্ময়ে হতবাক,’ উঁহু!’
‘ তোমার মায়াময় দুটি চোখ। যার মায়ায় আমি বার বার পড়ি।’
অহনা কোমরে হাত দিয়ে বলে,’ তুমি কি চাও বিয়েটা হয়ে যাক? দেখো, আমি এত অভিনয় করতে পারব না। তুমি তাড়াতাড়ি কিছু করো।’
‘ করবতো, সব করব!’
‘ কবে করবে? তুমি কি আরিশের সাথে কথা বলেছ? সে কি বলেছে? আমি জানি এটা অন্যায়, খারাপ কাজ, বিরোধী এটা। কিন্তু তোমাকে আমি চাই, এইটুকু রিস্ক আমি নিতে চাই। তারপর সব ঠিক হবে যাবে।’
‘ হ্যাঁ, আমি করা বলেছি আরিশের সাথে।’
‘ কখন কি করবে আমাকে বলো?’
‘ কিছুই করতে হবে না। একটু অপেক্ষা করো, তারপর সব বুঝতে পারবে।’
অহনা মাহতিমকে জড়িয়ে ধরে,’ আমি সবসময় চাই তোমাকে। ভালোবাসি খুব বেশি।’
‘ আমিও।’
হঠাৎ কেঁদে উঠে মাহতিম। বুকটা কেন জানি হুঁ হুঁ করে উঠল। বুক চিঁড়ে আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইছে। অহনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। পরম যত্নে একজন অন্যজনের নিঃশ্বাসের গভীরতা শুনতে থাকে।
মাহতিম অহনার কপালে চুমু এঁকে দেয়,’ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে আজ।’
‘ তোমাকেও, সবসময় সুদর্শন লাগে আমার।’
‘ ছিন্নভিন্ন হৃদয়টা শেষ পর্যন্ত তোমাকেই চাইবে দেখে নিও।’
হ্যারি বাইরে পায়চারি করছিল। রুমি বলেছে কিছুক্ষণ পর ঢুকতে, এখন বিরক্ত না করতে। তাই সে যায়নি। অনেকটা সময় অপেক্ষা করেছে। তাই অহনার ঘরের দিকে রওনা দেয়।
হঠাৎ হাঁটার মাঝখানে পা পিছলে গিয়ে একটি মেয়ের উপর পড়ে। তার হাত থেকে সব মেকআপ ইন্সট্রুমেন্ট পড়ে যায়,
‘ ওমাগো, মরে গেলাম গো, আস্ত একটা হাতি আমাকে থেঁতো করে দিল। ষাঁড়ের বা’চ্চা উঠতে বলছি।’
হ্যারি না উঠেই তাকিয়ে থাকে সামলে থাকা রমণীর দিকে।
আবার চিৎকার করে উঠে,’ জল’হস্তি কোথাকার আমাকে মেরে ফেলল।’
হ্যারি এবার নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পড়ে। গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,’ তোমার লাগেনিতো পিচ্চি?’
‘ তোমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরোটা পিচ্চি। এই আদ্রিতাকে পিচ্চি বলতে আসো, কতবড় সাহস তোমার।’
‘স্যরি, নামটা জানা ছিল না, তাই বললাম। কিন্তু তুমি এত ঝগড়ুটে কেন? এত প্যাচপ্যাচ করে কথা বলো কেন? এটাই কি তোমার স্বভাব?’
‘ তুমি খচ্চ’র চিনো?’
‘হুম চিনি। তা দিয়ে তোমার কাজ কি?’
‘ ঐ খচ্চ’রের মতো চলাফেরা তোমার। দিলেতো আমার সব মেকআপ ইন্সট্রুমেন্ট খারাপ করে। তোমার জন্য অনেকগুলো প্রোডাক্ট নষ্ট হলো।’
‘ সে কখন থেকেই আমার সাথে যা নয় তাই ব্যবহার করে যাচ্ছ। তোমার জন্মের সময় মনে হয় এদেশে মধু ছিল না। তোমার মা তোমার মুখে মধু দিতে পারেনি। তাই এমন তেতো কথা বের হয় মুখ দিয়ে।’
আদ্রিতা আঙুল উঁচিয়ে বলল,’ মুখ সামলে কথা বলো। এটা তোমার বাড়ি নয়।’
হ্যারি আদ্রিতার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,’ এই বাড়িটা আমার না হলেও তুমি যে এই বাড়ির কাজের লোক সেটা ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। আমার সাথে লাগতে এসো না।’
‘ আমি তোমার সাথে লাগছি না। তুমিই আমার সাথে লাগছ। প্রথমেই আমার ড্রেস আর মেকআপ খারাপ করলে। এখন মুখে মুখে তর্ক করছ। কি ঝগড়ুটে ছেলে তুমি।’
হ্যারি আদ্রিতার মুখ চেপে ধরে। কিছুটা দূরে নিয়ে বলল,’ এবার যা ইচ্ছা বলো। আমি কান খুলে শুনি। ওখানের মানুষজন যেভাবে দেখছিল, আর একটু হলে আমাকে কাটা চামচ দিয়ে কষিয়ে খেতো। কিন্তু তোমার সমস্যা কি?’
আদ্রিতা চুপ করে যায়, একটা কথা মনে পড়ে। একটু আগেই আয়শা বলেছিল কারো সাথে ঝগড়া না করতে। একটু পান থেকে চুন খসলেই সে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। তাই পুরো সময় চুপ থাকতে বলেছিল। কিন্তু ভুলে গিয়েছে। এখন চুপ, আর কোনো কথা বলবে না। সোজা চলে যেতে চাইলে হ্যারি সামলে বিয়ে দাঁড়ায়,’ তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ? একটু আগেতো বাঘিনীর মতো কথা বলছিলে। এখন সব উড়ে গেল।’
‘ মা বলেছে ঝগড়া না করতে। তাই কিছু বলছি না। না হয় আমার থেকে রেহাই পেতে না।’
‘ ওহ আচ্ছা। কিন্তু এটা বলো, তুমি কে? বরের কি হও?’
‘ আমার ভাইয়ার বিয়ে আজকে পুতুল ভাবীর সাথে।’
‘ পুতুল কে? ওর নামতো অহনা।’
‘ আমি আদর করে পুতুল ভাবী ডাকি। তোমাকে এর কৈফিয়ত দেব না।’
‘ দিয়ে দিয়েছ অলরেডি। আর দিতে হবে না।’
‘ বেশি কথা বলো। আমি গেলাম।’
‘ আশা করি আবার দেখা হবে। আরেকবার ধাক্কা খেলে এবার তুমি আমার গায়ে পড়ো, সমস্যা নেই।’
‘ যার রুচি যেমন, সে তেমনি ভাবে। পাশে ওয়াশরুম আছে গিয়ে নিজের রুচি ধুয়ে আসুন।’
আদ্রিতার্ ভেঙচি কেটে চলে যায়। হ্যারি পেছন থেকে তাকিয়ে থেকে বলল,’ পেয়ে গেলাম আমি। এবার জমবে মজা। ইয়েস!’
হ্যারি উল্টো দিকে ফিরতেই আরিশের চোখাচোখি হয়। আরিশের চোখ বড় বড়। চোখে থেকে যেন আগুন ঝড়ে পড়ছে।
চলবে….