ছায়া মানব পর্ব-৬৮+৬৯+৭০

0
797

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৬৮.
মাহতিম অহনার পাশে এসে বসে। অচেতন অহনার উজ্জ্বল মুখশ্রীতে ফ্যাকাশে ভাব স্পষ্ট। অনেকটা দখল গেছে তার উপর দিয়ে।

আরিশ নিজের ঘরে বসে ছিল। লাবনী পা টিপে টিপে তাঁর ঘরে ঢুকল। আরিশ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে থুতনিতে রেখে খাটে ঝুঁকে বসে আছে। নজর তার ফ্লোরের দিকে। অহনার পাশে মাহতিম আছে, তাই সে যেতে পারছে না। অহনার জন্য‌ই তার মনটা উত্তেজিত। ভাবছে একবার গিয়ে দেখে আসবে, কিন্তু সাঁয় পাচ্ছে না।

লাবণী এসেই খাটের অপর পাশ থেকে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে এক ঝটকায় ছুঁড়ে ফেলে। লাবণী নিজেকে সামলে নেয়,
‘ ভালোবাসি বলে এত অপমান করছ তাই না? যেদিন বাসবো না সেদিন কাঁদবে।’

‘ তুমি দেখতে পাচ্ছ না, আমি এখনো কাঁদছি।’ আরিশ বলল।

লাবণী তার দিকে এগিয়ে এসে খুঁটিয়ে দেখে, সত্যি আরিশ কাঁদছে। তার চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে। লাবণী আরিশের কষ্ট নিতে পারেনা। তার‌ও খারাপ লাগে,
‘ এই নিশ্চুপ কান্নার কারণ কি?’

‘তোমাকে জানতে হবে না। তুমি এখান থেকে চলে গেলেই খুশি আমি। যদি এই বাড়ি থেকেই চলে যাও, তাহলে আরো খুশি।’

‘ আমি জানি, অহনার জন্য কাঁদছ তুমি। তার কষ্টগুলো তোমার‌ও হয়। কেন এমন করছ? আমার দিকে কি একটু তাকাতে পারো না? আমি তোমাকে কত ভালোবাসি। সত্যি বলছি, অহনার থেকে বেশি ভালোবেসে দেখাবো আমি তোমাকে! একবার সুযোগ দিয়ে দেখো।’

‘ চলে যাও তুমি। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’

লাবণী তবুও যায় না। আরিশের গা ঘেঁষে বসে। ওর হাতে হাত রাখতেই সরিয়ে দেয় সে। লাবণী তবুও বলল,’ তোমাকে যদি আমি ভালোবাসার সুযোগ পেতাম, তাহলে কখনোই তোমাকে গোপনে কাঁদতে হতো না। জানো, তোমার কান্না দেখলে আমার সহ্য হয় না। আমি ভেতর থেকে কষ্ট অনুভব করি। আমারো খুব কষ্ট হয় তোমার জন্য। ছোটবেলা থেকে তোমার ব‌উ হ‌ওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। ভেবেছিলাম তোমারতো কোনো মেয়েকেই ভালো লাগেনা, তাই হয়তো আমাকে ইগনোর করছ। আমি সময়মতো সুযোগ নিয়ে তোমরা মন জয় করে নেব। সেটা আর হলোনা, অন্য কারো মনে বাঁধা পড়লে তুমি। আমি জানি, আমি অহনার থেকে সুন্দরী না, কিন্তু তার থেকে বেশি ভালোবাসি। অহনা তোমাকে কখনোই ভালোবাসেনি, কারণ তার মনে অন্যকেউ ছিল।
কি অদ্ভুত তাই না? আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে ভালোবাসো না। আবার তুমি অহনাকে ভালোবাসো, সে তোমাকে ভালোবাসে না। এভাবেই কি আমাদের জীবন চলবে? আমাদেরতো জীবনসঙ্গী বেছে নিতে হবে।’

আরিশ গম্ভীর হয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থাকে সে। নাক টেনে বলে,’ যদি তুমি সত্যি সুখ চাও, তাহলে তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে ছেড়ে, যে তোমাকে ভালোবাসে তার কাছে যাও।’

‘ এটাতো বিপরীতভাবে আমিও বলতে পারি আরিশ! আমি তোমাকে ভালোবাসি। কথাটা আর কতবার বলব? আমি হাঁফিয়ে গেছি। কিন্তু ভালোবাসা কমেনি।’

‘ কেন তুমি আমার জন্য নিজের মূল্যবান সময় এবং যৌবন নষ্ট করছ? আমি কখনোই তোমাকে সুখী করতে পারব না। তোমার জন্য যোগ্য ন‌ই আমি। তোমার উচিত যোগ্য কাউকে নিজের জন্য সিলেক্ট করা।’

‘ একজনকেই মনে স্থান দিয়েছি। সেখানে চাইলেও কাউকে আর স্থান দিতে পারব না। তুমি যদি আমার না হ‌ও, তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ আসলেও তাকে আমি মেনে নিতে পারব না‌। তোমাকেই লাগবে আমার, আমৃ’ত্যু!’

মাহতিম হাঁসফাঁস করছে। অহনার এখনো জ্ঞান ফিরেনি। অনেকটা সময় চলে গেল, তবুও কেন যে তার জ্ঞান ফিরছে না কে জানে? রুমি পাশেই বসে ছিল।

হঠাৎ অহনা ঘুম থেকে জেগে উঠে। মাহতিম বলে চিৎকার করে। মাহতিম ওকে ধরার আগেই রুমি ধরে ফেলে।‌ রুমি পানি এনে দেয়,
‘ কি হয়েছে তোর? কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখলি নাকি?’

অহনা আশেপাশে খুঁজতে থাকে মাহতিমকে। কাছে বসে থাকতে দেখে জড়িয়ে ধরে‌,
‘‌কোথায় ছিলে এতদিন? আমাকে রেখে গেলে কেন? আমি কত খুঁজেছি তোমায়! এতটা রেসপনসিবল হয়ে গেলে কি করে? আই মিস ইউ!’

মাহতিম‌ও জড়িয়ে ধরার আগেই রুমি অহনাকে তার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। তার কাছে এসব অদ্ভুত মনে হচ্ছে,
‘ মাহতিম কে রে? কি বলছিস এসব? আমি বুঝতে পারছি না। এখানে কেউ নেই, কাকে জড়িয়ে ধরলি?’

অহনা মাথা ঝেড়ে রুমির দিকে তাকায়। সব ভুলে‌ গেছে পুনরায়। একটু আগে কি করেছিল, সেটাও মনে নেই। রুমির দিকে তাকিয়ে বলল,’ ময়না, ওর খু’নের কোনো কিনারা করেছে আরিশ? আমাকে জানতে হবে। আরিশকে ডেকে আন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করব। আমার বোনকে যে খু’ন করেছে তাকে শা’স্তি দিতেই হবে।’

‘ শান্ত হ। আমি ডেকে আনছি জীজুকে। তুই শুয়ে পড়।’

রুমি অহনাকে শুইয়ে দিয়েই আরিশের কাছে যায়।
মাহতিম অহনার দুশ্চিন্তার কারণ বুঝতে পারে। এটাও বুঝতে পারে, পুরনো স্মৃতিগুলো ওকে তাড়া করছে খুব। অহনা মাহতিমের দিকে সূক্ষ নজর দেয়,
‘ জানো, তোমাকে আমার খুব চেনা মনে হয়। এটা মনে হয়, যেন আরো আগে থেকে চেনা তুমি। তোমাকে আমি অনুভব করি।’

মাহতিম অহনাকে আগলে নেয়,’ ভালোবাসা এমনি। দূরে থাকলেও কাছে মনে হয়। স্বল্প সময়ের সাক্ষাতেও খুব বেশি সময় মনে হয়।’

‘ উঁহু, আরো কিছু আছে যা আমি বুঝতে পারছি না‌।’

‘ কিছুই নেই। তুমি ভেবো না। শান্ত হ‌ও।’

‘ যখন তোমার বুকের ঘ্রাণ নিই, তখনি আমি শান্ত হয়ে যাই। তোমার হৃদস্পন্দন আমার ভালো থাকার একমাত্র কারণ।’

‘ কখনো যদি এই বুকের স্পন্দন থেমে যায় তাহলে কি করবে?’

‘ এমন বলো না। আমি সহ্য করতে পারব না। এসব কথা কখনো মুখে আনবে না।’

রুমি আরিশের ঘরে যাওয়ার আগেই মতি তাকে টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। অহনার অবস্থা জিজ্ঞেস করে। সে সত্যিই রুমিকে অনুভব করতে শুরু করেছে‌। যোকোনো বাহানায় কাছে পেতে চায়। রুমি অহনার কথা বলে চলে যেতে চাইলেই মতি তাকে জোর করে বসিয়ে রাখে,
‘ভাই মনের টানেই হয়তো অহনার কাছে ছুটে গেছে এতক্ষণে, তোমার তাকে খুঁজে আনতে হবে না‌। আপাতত আমাকে সময় দাও।’

রুমি ভেঙচি কাটে,’ তাহলে সময়টা নিয়ে নিন। আর আমাকে যেতে দিন।’

‘ তুমি এবং সময়, পুরোটাই আমার চাই। আমার একমাত্র ফিউচার ব‌উ তুমি।’

রুমি আঁতকে উঠে। লজ্জা ভিড় করে মনে। আজকাল তার‌ও ভালো লাগে মতিকে। সূক্ষ নজরে পরখ করল, মাথার বড় বড় চুলগুলো কেটে আরিশের মতো ছোট করে নিয়েছে। কাঁটা ব্রু ঠিক করে নিয়েছে, ঠোঁটের কোনে যে কামনার হাসি থাকতো, সেটা এখন একদম নেই। চোখে মুখে উজ্জ্বলতা এসেছে। এখন তাকে একটা সাধারণ ভালো মানুষ মনে হয়। যদিও চরিত্র এখনো কিছুটা খাদে আছে। রুমি ঠিক করে নেয়, একেবারে ঠিক করে নেবে সে মতিকে।

মতি রুমির ভাবনা দেখে তুড়ি বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে,
‘ মনে হচ্ছে আমাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিয়ে করে, বাসর করে এখন সংসার করছ কল্পনাতে।’

‘ তেমন কিছু না। আমাকে যেতে হবে। আরিশ জীজুকে ডাকতে হবে।’

রুমি উঠে যেতেই মতি তার হাত চেপে ধরে,
‘ আর দুই মিনিট পরে যেও।’

‘ কি বলার আছে, বলুন তারাতাড়ি।’

‘ ভাবছি তোমাকে ভালোবাসার কথা বলব।’

রুমি লজ্জা পায়, কিন্তু প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক,
‘ এখন উপযুক্ত সময় না। পরে শুনব আমি।’

‘ পালাও কেন! তুমি কি আমাকে পছন্দ করো না?’

‘ পছন্দ করার মতো তেমন কোনো রিজন আছে কি? আপনার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সব ফাঁকা। আগে নিজেকে পূর্ণ করে আনুন, তারপর ভেবে দেখব।’

‘ ফাঁকা মানে! কোথায় ফাঁকা? কি ফাঁকা?’
মতি লজ্জা পেয়ে যায়। আয়নায় গিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে মেয়েদের মতো। কোথাও সে ফাঁকা দেখতে পাচ্ছে না, বলল,’ ফাঁকা কোথায়? তোমাকে পাওয়ার জন্য নিজেকে একদম পূর্ণ করলাম, তবুও ভালো লাগেনি?’

‘ না, আর কখনো লাগবেও না।’

‘ তোমাকে আমি আকাশের চাঁদ, তারা, গ্রহ, নক্ষত্র সব এনে দেব, তাহলে কি আমার ভালোবাসা গ্রহণ করবে?’

‘ আগে সব এনে দিন, তারপর ভেবে দেখব।’

রুমি ত্বরিৎ গতিতে চলে যায়। মতি হ্যাংলার মতো ভাবছে, বেশি ভাব নিতে গিয়ে বলল, এখন সে এসব জিনিস পাবে ক‌ই। কখনোতো মেয়ে পটায়নি। গুগলে সার্চ দিয়ে জেনেছে ছেলেরা এসব বলে মেয়ে পটায়, কিন্তু তার বেলায় কাজ করল না কেন? মাথা চুলকে মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে বলে,’ তুই ভালো নারে মাসুদ, ভুলভাল বুদ্ধি দেস। পৃথিবীর মানুষের জানা উচিত, তুই তাদের মিথ্যে বলে ঠকাচ্ছিস।’

রুমি আরিশের ঘরে না গিয়ে অহনার কাছে যায়। অনেকটাই দেরি করে ফেলেছে, তাই আরিশকে না ডেকে নিজে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করল। রুমি দরজা পেরুতেই তার ফোনে কল আসে। হ্যারি কল করেছে। তার কন্ঠ ভেজা। নেটওয়ার্ক সমস্যা করছে হঠাৎ। রুমি তার কথা বুঝতে পারে না।

নেটওয়ার্কের জন্য সে বাড়ির বাইরে চলে যায়। হ্যারি বলল,’ এক্সি’ডেন্ট করেছে!’

রুমি আঁতকে উঠে ,বলল,’ কে এক্সি’ডেন্ট করেছে? বল তারাতাড়ি।’

‘ টিকু। গুরুতর আঘাত পেয়েছে। মৃ’ত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। তুই অহনাকে নিয়ে আয়।’

রুমির চোখ মুখ বিষাদ হয়ে আসে,’ কিভাবে কি হলো? কোন হাসপাতালে আছে?’

‘ আল শামস্ মেডিকেলে আছে। সব বলব পরে, আগে আয়।’

রুমি কল রেখে দেয়। মাথাটা ভো ভো করে ঘুরছে তার। মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাবে। চোখ ফেটে জল নেমে আসে।

আরিশ বাড়ি থেকে বের হতেই রুমিকে দেখতে পায়। থরথর করে কাঁপছে সে। আরিশ কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,’ কি হয়েছে?’

রুমি কিছু বলতে পারছে না। সে অহনার কাছে যাবে বলে ঠিক করে। আরিশ পুনরায় জিজ্ঞেস করে,’ কি হয়েছে বলবে তো? অহনা ঠিক আছে?’

‘ টিকু এক্সিডেন্ট করেছে। আমাদের বন্ধু। এক্ষুনি অহনাকে বলতে হবে।’

‘ দাঁড়াও! ওকে জানানোর দরকার নেই। ওর শরীরের অবস্থা ভালো না। এখন জানানো উচিত হবে বলে আমি মনে করি না। তুমি ওকে বলো, কিছু কাজের জন্য বাইরে যাবে। আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি টিকুর কাছে।’

চলবে….

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৬৯.
দুইদিন পর বিয়ে। প্রস্তুতিটা এখন থেকেই জাঁকজমকপূর্ণ। সবাই কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত খুব। অথচ দহনে পুড়ে মরছে আরিশ, অহনা। তাদের মনে রোদ নেই, ঘন বর্ষা। অহনা অপেক্ষায় আছে মাহতিম কিছু করবে বলে। আরিশ নিজের ঘরে বসেই চোখের জল ফেলছে। সে জানে মাহতিম আর থাকবে না‌। জ্বীনের সব কথা সে শুনেছে, তার সামনেই সব কথা হয়েছে। তবুও মাহতিম অহনাকে ছেড়ে যাবে না কখনো। সে কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয় বের করবে। আর যদি মাহতিম চলেও যায়, তাহলেও সে অহনাকে পাবার আশা রাখতে পারেনা। কারণ আহনা শুধু মাহতিমকেই ভালোবাসে, চাইলেও আর কাউকে মন দিতে পারবে না। হয়তো অনেকটা সময় নিয়ে নেবে। অন্য কারো ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন আরিশ কখনোই দেখে না। সে সত্যিকারের ভালোবাসা চেয়েছিল, যেটা সে পায়নি। মনকে বুঝিয়ে দেয়,’ সবাই সবকিছুর যোগ্য না, সবাই সবকিছু পায় না। আমিও হয়তো সে দলেই। আমার ভাগ্যে অহনা নেই। তাতে কি হয়েছে, আমি তাকে ভালোবাসি আর বাসবোও আজীবন।’

অহনা আরিশের ঘরে আসে। লাবনী অহনাকে আরিশের ঘরে যেতে দেখে নিজেও দেখতে আসে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে সে। অহনা আরিশের কাছে আসতেই আরিশ নিজেকে সামলে নেয়, অহনার অগোচরে বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখের বর্ষণ লুকিয়ে নেয়,
‘ তুমি এখানে?’

অহনা বলল,’ আমি আসায় খুশি হননি?’

‘ তেমন কোনো ব্যাপার না। আর শুনো, ময়নার খু’নের সব কারণ পেয়েছি।’

আরিশ কিছু পেপারস্ দেয় অহনাকে। অহনা স্পষ্ট দেখতে পেল ময়নার খু’নের বিবরণী। চোখ তার সজল হয়ে আসে। কতটা কষ্ট পেয়ে মা’রা গেছে ময়না। ধ’র্ষ’ণ করা হয়েছিল তাকে।

আরিশ বলল,’ যারা এই কাজ করেছে তাদের ধরা হয়েছে! এখন জেলে আছে। আজ সকালেই তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। তারা তাদের কর্মফল পাবেই।’

‘ কিভাবে এসব হলো? কিছু জানতে পেরেছেন?’

আরিশ উশখুশ করে বলল,’ ময়না বাড়িতে একা ছিল। যথাসম্ভব তার বাবা বাইরে ছিল, সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি। তাদের বাড়িটা বস্তি এলাকায়। সেখানে বখাটের সংখ্যাও বেশি। ময়নার বাড়ির পাশেই একটা ক্লাব ছিল। পরিত্যক্ত সেটা। সেখানে কিছু বখাটেরা ঘাঁটি গেড়েছিল। প্রতিদিনের মতো তারা তাদের কাজ করে ফিরে আসার সময় দেখল ময়না ঘরের চৌকাঠে বসে আছে। ছেলেগুলো মাতাল অবস্থায় ছিল। সজ্ঞানে ছিল না কেউই। ময়না তাদের দেখে ভেতরে চলে গেল। ছয়জন ছেলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দরজা ধাক্কালো। ময়না দরজা খুলল না। দরজা ভেঙ্গে তারা ঢুকেছিল এবং একে একে ছয়জন ছেলে ওর সাথে….’

আরিশ থেমে যায়। অহনা নিশ্চুপ শব্দ বুঝে নেয়। তার কষ্ট হচ্ছে খুব। ময়না কখনোই শান্তিতে দুটো দিন কাটাতে পারেনি। শেষে মৃ’ত্যুটাও এভাবে হলো‌। ছোট্ট মেয়েটা এতো কষ্ট সহ্য করতে না পেরে প্রাণ হারালো।

অহনা ভাবতে থাকে ময়নার সেই মৃ’ত্যুর দৃশ্য। হয়তো অনেকবার ছেলেগুলোর কাছে কাকুতি মিনতি করেছিল। শেষ মুহূর্তে এসে হয়তো তার মুখের ভাষা ফুরিয়ে গিয়েছিল। সে আর নিজেকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টাটাও করতে পারেনি।

আরিশ অহনাকে সান্ত্বনা দেওয়া জন্য বলল,’ ওদের শাস্তির ব্যবস্থা আমি করব। এমন শাস্তি দেব, যেন পরবর্তীতে কখনো মেয়েদের দিকে তাকাতেও ভয় পায়।’

অহনা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না‌। নিজের ঘরে চলে যায়। লাবণী আড়াল থেকে পুরোটাই শুনেছে। তারও খারাপ লাগে বিষয়টা। সে এগিয়ে আসে আরিশের কাছে।
লাবণীকে দেখে আরিশ না দেখার ভান করে তৈরি হতে শুরু করে। এমন ভাব নেয়, যেন সে এক্ষুনি বের হবে কোথাও। লাবণী রাগ দেখায় না কারণ সে জানে আরিশের মনের অবস্থা ঠিক নেই। মৃদু কন্ঠে বলল,’ কোথাও যাবে?’

আরিশ ছোট করে উত্তর দেয়,’ হু।’

‘ কোথায় যাবে?’

‘অফিসে কাজ আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আনাম মৃধা আসছে দেখা করতে।’

‘ তোমার সাথে?’

‘ আমার একার সাথে না, সবার সাথে।’

‘ তাহলে তুমি যেও না। সবার মাঝখানে তোমাকে আলাদা করে চিনতে পারবে না খুঁজবেও না। চলো আজ ফুচকা খেয়ে আসি।’

‘সুন্দরী মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুতে থাকে। এটার প্রমাণ তুমি। আর এই বৃষ্টির দিনে কিসের ফুচকা?’

‘ সমস্যা কি? চলো না, যাই আমরা।’

‘সময় নেই।’

বলেই আরিশ বেরিয়ে পড়ে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসবে আরো দু’ঘন্টা পর। লাবণীর কথায় প্যাঁচ থেকে বাঁচতে আগেই র‌ওনা দিল।

অহনা নিজের ঘরে আসতেই ওর ফোনে কল আসে। হ্যারি কল করেছে। সেদিন রুমি টিকুকে দেখতে গিয়েছি অহনাকে না বলে। সেখানে গিয়ে সবাইকে বলেছে অহনা অসুস্থ তাই যেন তাকে না জানানো হয়।

হ্যারির কল পেয়ে অহনার নিজের প্রতি কেমন একটা বাজে ফিল হয়। নিজের ব্যস্ততার কারণে বন্ধুদের সময় দিতে পারে না। অহনা যখন হ্যারিকে বলল,’ কেমন আছিস?’

হ্যারি পাঙ্গাস মাছের মতো ফোলে উঠে,
‘ কখনো নিজ ইচ্ছায় খবর নিয়েছিস কেমন আছি? মরে গেছি না বেঁচে আছি তা নিয়ে কখনো ভাবিস না‌। এখন তোর আরিশ‌ই সব।’

‘ উফফ্, থামবি? আমার কথা শোন।’

‘ বল!’

‘, ইরা কেমন আছে?’

‘ হ্যাঁ ভালো, বর নিয়ে সুখে আছে।’

‘ টিকু কেমন আছে? অনেকদিন ধরে খবর পাইনা।’

হ্যারি চুপ হয়ে যায়। অহনা পুনরায় বলল,’ বল টিকু কোথায়?’

‘ টিকু মা’রা গেছে। সে আর বেঁচে নেই।’

অহনা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। রুমিকে বলল,’ এসব কি সত্যি?’

সেও মাথা দুলায়। অহনার মনটা বিষিয়ে উঠে। একে একে কেমন সবাই চলে যাচ্ছে।
সেদিন রুমি গিয়ে দেখল টিকুর প্রাণ ছিল না। হাসপাতালেই সে প্রাণ ত্যাগ করেছে। সে বাড়ি এসেও অহনাকে কিছু বলেনি।

অহনা খুব রেগে যায় রুমির উপর। এতবড় সত্যিটা তার থেকে লুকানোর জন্য।
রুমি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অহনার খুব হাঁসফাঁস লাগছে। কি থেকে কি হচ্ছে বার বার। মাথাটা ধরে আছে।
বিছানায় বসতেই চোখ যায় ডায়রিটার দিকে। আবারো সেটা খুলে পড়তে থাকে। জিম মেরে অনেকক্ষণ পড়েই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পুরনো স্মৃতিগুলো তাড়া করছে তাকে। অনেক কষ্টে লেখাটা পুরো পড়ে শেষ করে। কিন্তু শেষ পাতায় আর কিছু ছিল না। শেষের কিছু পাতা এখনো খালি, লেখা হয়নি। অহনা শেষটা জানতে চায়। শেষ পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, অহনা বিয়ে করতে যাচ্ছে তার প্রিয় মানুষটাকে।
অহনাও জানতে চায় তাদের বিয়ে হয়েছিল কিনা। এর‌ই মাঝে তার মাথা ব্যথা করে। সবকিছু কেমন ঘুরছে। মাহতিমের চেহারা বার বার ধরা দিতে থাকে তার কাছে। সবকিছু অস্পষ্ট। কিছুই বুঝতে পারছে না। এক পর্যায়ে লুটিয়ে পড়ে।

আরিশ অফিসে যেতেই দেখা হয় একজন ক্লায়েন্টের সাথে। সে আরিশকে গোপনে বলল,’ স্যরি বলে দিচ্ছি আগে। আমার কথা শুনে আপনি হয়তো আমাকেই ভুল বুঝবেন, কিন্তু এটাই সত্যি।’

আরিশ তাকে অভয় দিয়ে বলল,’ আমি এমন কিছুই করব না। আপনি সত্যিটা বলুন।’

‘ আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পরিবর্তন হ‌ওয়ার পর থেকেই এই সমস্যায় ভুগছি। আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় অ’স্ত্র সংগ্রহ করে রাখতে পারছি না। ওনি আমাদের সকল কাজেই নাকোচ করছেন। যবে থেকে ওনি এসেছেন তবে থেকে আমাদের অ’স্ত্র সব গায়েব। আমরা ধারণ করছি ওনি নিজেই এর সাথে জড়িত। তাই আপনি যদি সাথে থাকেন, তাদের খুব সহজেই আমরা এটা প্রমাণ করতে পারব।’

‘ ওনার কাছে যত সম্পত্তি আছে, তা দিয়ে আমাদের থেকে বেশি অ’স্ত্র সে নিজের কাছে রাখতে পারে। তাহলে কেন সে এমনটা করবে?’

‘ এসব আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে। লোকটাকে সবাই সন্দেহ করছে। এটাও ধারণা করছে, সে কোনো চোরা চালানের সাথে জড়িত। আরো অনেক কিছু। আপনিতো এখানে থাকেন না তাই জানা নেই। জয়ন্ত স্যার বলেছে, আপনি অনেক বুদ্ধিমান, সহজেই এটা ধরতে পারবেন। কিন্তু অনেকে এটার বিরোধীতা করেছে। তারা আপনাকে না জানিয়েই এই বিষয়টা শেষ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি, দুর্ভাগ্য তাদের। তাই আমি বলতে এসেছি, যদি কেসটা আপনি হাতে নেন, আমার মনে হয়না আর বেশিদিন গড়াবে এটা। সর্বোচ্চ দুইদিন আপনার জন্য যথেষ্ট। আপনার আগের রেকর্ডগুলো থেকে এটা প্রমাণিত।।’

‘ ঠিক আছে। আমি দেখছি কি করা যায়। তবে হ্যাঁ, আমি আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে সব বের করব। চ্যালেঞ্জ করলাম।’

‘ আপনার উপর বিশ্বাস আছে আমার।’

চলবে….

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৭০.
অহনার জ্ঞান ফিরতেই সে পাশে মাহতিম এবং রুমিকে দেখতে পায়। অহনার জন্য খাবার আনতে রুমি চলে যায়।
অহনা মাহতিমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মাহতিম চোখ সরিয়ে নিতেই অহনা তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়,’ লুকিয়ে যাচ্ছ কেন? আমি কি তোমাকে চিনি? হ্যাঁ, আমি চিনি, কিন্তু বিশেষভাবে কি সেটা?’

অহনা নিজের হুঁশে নেই। সবকিছু আবছা দেখছে। পুনরায় বলল,’ তোমাকে আমার এত কাছের মনে হয় কেন? কে তুমি? তুমিই কি আমার স্বপ্নে আসো?’

মাহতিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’ আমি তোমার বর্তমান। আমাদের আগে কখনো দেখা হয়নি।’

‘ তুমি মিথ্যে বলছ। আমি সত্যিটা জানতে চাই।’

‘ আমি তোমাকে অনেকবার সত্যিটা জানাতে চেয়েছি কিন্তু তুমি শুনতে চাওনি, বিশ্বাস করোনি। এখন কেন জানতে চাইছ?’

অহনা স্মৃতির পাতাতে ডুব দেয়। পুরনো কথাগুলো কানে বারি খাচ্ছে। দুহাতে নিজের কান চেপে ধরে,
‘ কেন এসব আমার কানে বাজছে? আমি শুনতে চাইনা। মাহতিম কিছু করো। এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? আমি মুক্তি পেতে চাই এই শব্দগুলো থেকে!’

মাহতিম অহনাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে,’ কিচ্ছু হবে না তোমার, আমি আছিতো। আমি তোমাকে বার বার না করা সত্ত্বেও কেন তুমি ডায়রীটা পড়লে? আমি অনেকবার বলেছি এটা না পড়তে। এর জন্য‌ই তোমার সাথে এমনটা হচ্ছে।’

‘, এই ডায়রীটা কার? কেন এটা পড়ায় আমার সাথে এমনটা হচ্ছে?’

‘ তুমি আর কখনো এটা পড়বে না। পড়লেই মন খারাপ করবে।’

‘ তুমি বলো, এটা কার? আমাকে সবটা বলো, কারণ কি এই ডায়রীর?’

‘আমি বলতে পারব না।’

অহনা মাহতিমকে ছেড়ে দেয়,
‘ঠিক আছে, তুমি বলবে না তাই না? বলতে হবে না। তুমি যদি না বলো, তাহলে আর কখনো আমার সাথে দেখা করো না। কখনো আমার সামনেও আসবে না।’

‘, দু’দিন পর এমনিতেই আর খুঁজে পাবে না। অন্তত এই দুইদিন থাকতে দাও তোমার কাছে!’

‘ কি বলছ এসব? আমি এসব শুনতে চাইনি। তুমি আমাকে সত্যিটা বলো, আমি জানতে চাই আমার সাথে এসব কি হচ্ছে।’

‘ মাহতিম দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,’ তুমি সবটা জানতে চাও তাই না? আমি বলব, তার আগে এলবামটা দেখো। আমার মনে হয় না‌ এটা দেখার পর আমাকে আর কিছু বলতে হবে।’

মাহতিম ছবির এলবাম এগিয়ে দেয় অহনার দিকে। তার উদ্দেশ্য, অহনা সবটা জেনে গেলে হয়তো সে বুঝবে। মাহতিম চলে যাওয়ার কারণ‌ও বুঝতে পারবে। আরিশকে মেনে নিয়ে সুখে থাকবে।

অহনার হাতে এলবামটা ধরিয়ে দিয়ে মাহতিম বাইরে তাকিয়ে থাকে।

অহনা এলবামের প্রথম ছবি দেখেই শক খায়। মাহতিমের দিকে একবার তাকিয়ে আবার পরের পৃষ্ঠা দেখে। প্রতিটা পৃষ্ঠায় নিজের আর মাহতিমের এত এত ছবি দেখে অবাক হয়ে যায় অহনা। মাহতিমকে জিজ্ঞেস করে, ‘ আমিতো কখনো তোমার সাথে এত এত ছবি তুলিনি। এসব আসলো কি করে? এই জায়গাগুলোও অচেনা। তবে চিনি মনে হচ্ছে। কেন জানি না মনে করতে পারছি না। চুপ করে আছ কেন?‌ বলো এসব কিভাবে এলো?’

মাহতিম চুপ করেই র‌ইল। কোনো কথা বলল না। অহনা আবারো পরের ছবিগুলো দেখে। এত এত দুষ্টুমিষ্টি ছবি দেখে নিজের অজান্তেই হেসে উঠে। মনে খটকা লাগে ওর। ভীষণ চেনা মনে হচ্ছে। তাও বুঝতে পারছে না। কিভাবে এসব এলো।

অহনা ভাবতে থাকে। বিভোর হয়ে ছবিগুলো দেখে আর ভাবে। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা করতে থাকে‌। নিজেকে আর সামলে রাখা যাচ্ছে না। দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে,
‘ এসব কি হচ্ছে মাহতিম? তুমিতো আমার সাথে ছিলে তাই না? আমার কি হচ্ছে এসব?’

রুমি খাবার নিয়ে আসার সময় মতি তাকে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। আজকাল বড্ড খাপছাড়া হয়ে গেছে এই মতি। যখন তখন সে রুমির জন্য ব্যাকুল। কাছে পেতেই দুহাতে জড়িয়ে ধরে। প্রশান্তিতে শরীরের ঘ্রাণ নেয়। হাতে থাকা খাবারটাকে এক পাশে রাখতেই রুমি বাঁধা দেয়,’ এটা অহনার খাবার, ওর জন্য নিয়ে যাচ্ছি।’

‘ ভাইকে দেখেছি অহনার ঘরে যাচ্ছে। এখন খাবার দিলেও খাবে না। আগে একটু প্রেম করুক তারা। তুমি গেলে তাদের ডিস্টার্ভড হবে। তুমিতো আমাকে সুযোগ দাও না। ভাই আর অহনাকে দেখো, ওরা এখন প্রেম করবে। চলো, আমরাও করি।’

রুমি সাঁয় দেয়। মতি খুশিতে গদোগদো হয়ে উঠে। সে ভাবতে পারেনি রুমি তার কথা মেনে নেবে।
এক ঝটকায় রুমিকে টেনে এনে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। কোমর চেপে ধরে বলল,
‘ আমি যা চাই তুমিও কি তা চাও?’

‘ আপনি কি চান?’

মতি রুমির কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,’ যা চাই আরকি, তুমিও কি চাইবে তেমনটা?’

‘ আমি বুঝতে পারিনি। ঠিক কি বলছেন?’

‘ সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চলো এই সময়টা উপভোগ করি। আমার ইচ্ছে করছে খুব। ভাইয়ের বিয়ের পরেই তোমাকে বিয়ে করব।’

‘ পরিবার মেনে নেবে?’

‘ অহনার মতো মিডেল ক্লাস মেয়েকে মেনে নিলে তোমাকে তো হাজারবার মেনে নেবে। আমাদের দুজনের মধ্যে কোনো বাঁধা থাকার কথা না।’

‘ অহনার মত মেয়ে মানে? আপনি কি বলতে চেয়েছেন?’

রুমি মতির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়,
‘ নিজেকে অনেক বড় মানুষ মনে করেন তাই না? এটা যেদিন বাদ দেবেন সেদিন‌ আমার সাথে দেখা করবেন! আর শোনেন, আমিও আপনাকে পছন্দ করি খুব। তবে আপনার লম্বা লম্বা পা দেখে না, আপনার পরিবর্তন দেখে। প্রথম থেকেই আপনাকে আমার বিরক্ত লাগতো। কিন্তু পরিবর্তন দেখে ভালোবাসার জন্ম নিয়েছে।’

‘ আমি এমনটা বলিনি। আচ্ছা, সব বাদ। আমি তোমাকে ভালোবাসি, এটাতো বিশ্বাস করো? তাহলেই হবে। তুমি বললে আজকেই সবাইকে বলে দেব, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’

‘ লাগবে না। এখন না বলে পরে বলবেন, আগে নিজেকে গুছিয়ে নেন। যার মধ্যে বিলাসীতা থাকবে তাকে আমি মেনে নেব না।’

মতি মাথা নুইয়ে নেয়। লজ্জাবোধ তাকে আকড়ে ধরে। ক্ষমা চেয়ে নেয় রুমির থেকে।

শেষের ছবিগুলো দেখেই অহনা আঁতকে উঠে। পুরনো সময়, জায়গা এবং মুহুর্তগুলো সব মনে পড়ে যায়। চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। ছবিটাতে হাত বুলিয়ে দেয়,’ আমার মাহতিম, কত জায়গায় খুঁজেছি আমি তোমায়। কেন আগে দেখা দিলে না?’

অহনা পাশে থাকা মাহতিমের দিকে তাকায়। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঝাপটে ধরে। কান্নারত অবস্থায় বলে,’ আমার সব মনে পড়ে গেছে। তুমিই আমার মাহতিম। এতোদিন বললে না কেন তুমিই আমার সেই মাহতিম? কেন বলে দিলে না তুমি ফিরে এসেছ? এত অপেক্ষা কেন করালে?’

হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে অহনা। মাহতিম চোখের জল লুকিয়ে রাখতে পারল না। নিজেও কেঁদে দিল,
‘ আমি তোমাকে সব জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি জানতে চাওনি। আজ ভুল সময় সব জানলে। আমি এটা চাইনি। এবার তুমি আরো কষ্ট পাবে। কিন্তু সত্যিটা জেনে আমাকে ছাড়তে তোমার কষ্ট হবে না।’

‘এসব কি বলছ? তুমি কোথাও যাবে না। আমি পুনরায় হারাতে চাই না।’

অহনা কোনো কথা শুনতে নারাজ। মাহতিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ছেড়ে দিলেই হয়তো পালিয়ে যাবে, তাই ছাড়তে অনিচ্ছুক।

এক পর্যায়ে বলল,’ তুমি জানো, আমি কতটা অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য। আমার বিশ্বাস ছিল তুমি ফিরে আসবে। আমাকে বিয়ে করবে তুমি। সে আসায় আমি অপেক্ষা করেছি বিয়ের বেনারসী পড়ে। তুমি আসোনি, তুমি আসোনি আমার কাছে। কোথায় চলে গিয়েছিলে? আসতে এত দেরি করলে কেন? তুমিতো জানতে, আমি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকব না। কোথায় ছিলে এতদিন? এতটা সময় কেন দূরে থাকলে?’

মাহতিম কেঁদে উঠে,
‘ তোমাকে ছাড়া আমি কি করে ভালো থাকি। তাইতো আবার ফিরে এলাম। কিন্তু আমাদের গন্তব্য এখানেই শেষ। তোমাকে মেনে নিতে হবে, আমি আর বেশিদিন নেই। খুব শিঘ্রই চলে যাব। চাইলেও আর ফিরে আসতে পারব না।’

অহনার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল,’ আর বেশি দিন নেই মানে? আমি তোমাকে দ্বিতীয়বার হারাতে চাই না। একবার হারিয়ে যতটা কষ্ট পেয়েছি, এবার হারালে হয়তো ম’রেই যাব।’

‘ অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছ। আমি জীবিত ন‌ই। পৃথিবীতে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তোমাকে সেটা মেনে নিতে হবে।’

‘ আমি বিশ্বাস করি না। তুমি আর কখনো এমন কথা বলবে না।’

‘‌ এটাই সত্যি।’
মাহতিম একে একে সব কথা বলল অহনাকে। বিশ্বাস করতে অনিচ্ছুক সে। ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠে,
‘ না, আমি ছাড়ব না তোমাকে। তুমি আমার হয়েই আমার কাছে থাকবে। আমি সব হারিয়েছি, তোমাকে হারাতে চাই না। এই বিরহ আমি মেনে নিতে পারব না। তুমি আমার থেকে আলাদা হতে পারবে না।’

দুজনে অঝোড়ে কেঁদে উঠে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। চারিদিকটা শূণ্য লাগছে।

মাহতিম দুহাতে আরো শক্ত করে ধরল অহনাকে,’ আমাদের যাত্রাটা আর একটু দীর্ঘ হলে কি হতো? কেন এ জীবনে বিচ্ছেদ লেখা ছিল? আরকি কোনো পরিণতি হতে পারেনি।’

‘, আমার কষ্ট হচ্ছে খুব‌। তুমি ছেড়ে যাবে না আমাকে। যেভাবেই হোক আমি ফিরিয়ে আনব তোমাকে।’

‘ কি করবে তুমি? কিছুই সম্ভব নয়।’

অহনা চোখ মুখ মুছে বলল,’ আমি শুনেছি ইভিল স্পিরিটের মাধ্যমে প্রাণ ফেরানো যায়। আমি তোমার প্রাণ ফিরিয়ে আনব এর মাধ্যমে। আমি হারাতে চাই না তোমাকে! যে করেই হোক, আমার তোমাকে চাই।’

আরিশ দরজার আড়াল থেকে পুরো বিষয়টা দেখল। অহনার স্মৃতি ফিরে আসায় সে খুশি হতে পারল না তবে দুঃখ‌ও পেল না। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। দুহাতের পিঠ দিয়ে তা মুছে নিল। ভালোবাসার পূর্ণতা দেখতেও ভালো লাগে।

ভালোবাসা মানে এটা নয় যে তাকে পেতেই হবে। ভালোবাসা হলো, প্রিয় মানুষটি যেখানেই থাকুক, যার সাথেই থাকুক, সে যেন সুখে থাকে।

আরিশ ইভিল স্পিরিটের কথা শুনে ঘরে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিল। গলা খাঁকারি দিতেই অহনা আর মাহতিম নিজেদের সামলে নেয়।

আরিশ ঘরে ঢুকেই বলল,’ অহনা ঠিক বলেছে। আমিও ইভিল স্পিরিট সম্পর্কে জেনেছি। বলতে গেলে অনেক আগে থেকেই জানি। আপনি এর মাধ্যমে নিজের শরীরে প্রাণ স্থাপন করতে পারেন। তবে একটা সমস্যা রয়েছে…

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে