ছায়া মানব পর্ব-৬৫+৬৬+৬৭

0
885

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৬৫.
দিনগুলো স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। অহনার চিন্তা হয় খুব। মাহতিমের কোনো ভাবগতি না দেখে সে বিচলিত হয়ে পড়ে। সকালে খুব ভোরে উঠেই আরিশের ঘরে যায়।করাঘাত দেখে আরিশ দরজা খুলে দেয়। অহনা ঘরে ঢুকেই দেখতে পায় আরিশের বিছানায় লাবণী শুয়ে আছে। খুব অবাক হয় অহনা। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে যায়। আরিশ নিজের থেকেই বলে,’ আসলে কাল রাতে ফিরতে একটু দেরি হয়। আমি নিজের ঘরে এসে দেখলাম লাবণী আমার বেডে ঘুমিয়ে আছে, তাই আর জাগাইনি। আমি তাই সোফায় ছিলাম।’

অহনা মৃদু হাসে, বলল,’ এটাতো ওর অধিকার। আপনি কেন ওকে মেনে নিচ্ছেন না?’

আরিশের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। মুখে হালকা হাসি নিয়ে বলল,’ ভাবছি ইউএস‌এ চলে যাব।’

‘ হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত?’

‘ এখানে ভালো লাগছে না। কোথাও যেতে চাই, খুব দূরে। তাই এই সিদ্ধান্ত।’

‘ আপনার এ সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে। পরিবার পরিজন ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়।’

‘ ভাবছি, কি করা যায়।’

অহনা আরেকবার লাবণীর দিকে তাকায়। নিষ্পাপ লাগছে মেয়েটাকে। আরিশের মনে দহন চলছে। অহনাকে সামনে দেখলেই তার এমন হয়। কষ্ট হয় খুব। বুকে মৃদু ব্যথা অনুভব করে। চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। অহনা টের পায় সেটা,
‘ আপনি কি কাঁদছেন?’

আরিশ নিজেকে সামলে নেয়। বাম হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলল,’ সকালের বাতাসের ঝাপটায় কিছু পড়েছিল, তাই লাল হয়ে আছে।’

অহনা ঠোঁট দিয়ে জিভ ভিজিয়ে বলল,’ আমি কিছু জানতে চাই। সত্যি বলবেন!’

‘‌বলো।’

‘ মাহতিম কেন এমন করছে? আর মাত্র পাঁচদিন বাকি বিয়ের। ও কেন কিছু করছে না। আপনি আবার কোনোভাবে ওকে ফোর্স করছেন নাতো?’

শেষের কথাটা আরিশের বক্ষ ছেদ করে যায়। স্থির নজরে অহনার দিকে তাকিয়ে থাকে। না চাইতেই অহনা তাকে কষ্ট দিয়ে দিল। আরিশের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে অহনা অবাক হয়ে যায়। কোনো উত্তর না পেয়ে বলল,’ আমি জানি, আপনি আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু একপাক্ষিক এই ভালোলাগা কখনোই পূর্ণতা পাবে না। আপনি সবটা জানেন। আমার মনে হয় আমি ভুল বলেছি, আপনি কেন মাহতিমকে ফোর্স করবেন। কিন্তু মন মানছে না। দিনদিন ভয়টা আরো বেড়ে যাচ্ছে। সে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। আপনিও কিছু বলছেন না, সব মিলিয়ে আমি ঠিক পাগল হয়ে যাব।’

আরিশ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়,’ ঠিক বলেছ। কিন্তু মাহতিম আমাকে তার পরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলেনি। আমি সত্যি জানি না উনি কি করতে চান।’

অহনা হতাশ চোখে আরিশের দিকে তাকায়। আরিশ তার থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। অহনার চোখের দিকে তাকালেই তার বুকে চিনচিন ব্যথা করে। সে সহ্য করতে পারেনা। তবুও তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে জনমভর। ভুলতেই পারেনা এই মায়াবী চোখ। প্রথম চাহনিই তার হৃদয় হরণ করেছিল, কি করে সেই চাহনি ভুলবে? সম্ভব নয়।

আরিশ জানালার কাছে গেল। বাইরে নজর স্থির রেখে বলল,’ আমি তোমাকে ভালোবাসি! এটা যেমন সত্যি, তেমনি তোমার আর মাহতিমের সম্পর্কটাকেও সম্মান করি। আমি কখনোই চাইব না তোমরা আলাদা হয়ে যাও। আমিওতো ভালোবাসি, আমি জানি প্রিয় জনকে অন্যের সাথে দেখার কি য’ন্ত্রণা! আমি চাইনা আমি ব্যতিত আর কেউ সেই যন্ত্রণার স্বাদ নিক। আমি চাইনা কেউ তার প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে ফেলুক। এই কষ্টটা ভয়ঙ্কর। বুকে ব্যথা হয় খুব।’

অহনা ফিরে তাকায় আরিশের দিকে। লোকটার কথা তার কেমন অন্যরকম লাগল। তারতো কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিল না, তাহলে কি সে তাকেই উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল? ভাবনায় বিভোর হয়ে যায় অহনা। কিছু বলতে যাবে তখনি লাবণী জেগে উঠে। পিটপিট করে তাকিয়ে লম্বা হাই তুলে। অহনাকে আরিশের ঘরে দেখে একটু বিচলিত হয়ে যায়। কিন্তু একটু পর নিজেকে সাত পাঁচ বুঝিয়ে নিজেই আবার শান্ত হয়ে যায়। সে অহনা আরিশকে দেখে সন্দেহ করে। আবার একটু পর ভাবে, আমিতো এই ঘরেই ছিলাম। সো, সন্দেহ করব কোন দুঃখে!

আরিশ লাবণীকে তার ঘরে যেতে বলে। সে যায় না। বিছানায় ঠাঁয় বসে থাকে। অহনা বিদায় নিয়ে চলে যায়। দুজনের মাঝখানে থাকাটা যুক্তিযুক্ত মনে করল না।

আরিশ লাবণীর হাত ধরে বলল,’ তোমার জন্য অহনা হয়তো কিছু ভেবে নিয়েছে? তুমি কেন আমার ঘরে ঘুমালে? কি জানি কি ভেবেছে অহনা?’

লাবণী ঠোঁট উল্টে বলে,’ কিছু ভাবলেও কি। তোমার সমস্যা কোথায়? সে জানে আমি তোমাকে পছন্দ করি এবং তার নিজেরো বয়ফ্রেন্ড আছে। তাহলে কিছু ভাবলে তেমন কিছু আসে যায় না।’

‘ আমার আসে যায়। কারণ আমি তাকে….’

আরিশ পুরো কথা শেষ করে না। লাবণী উৎসুক ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে,’ তুমি তাকে কি?’

‘ কিছু না। চলে যাও আমার ঘর থেকে।’

‘ তুমি তাকে ভালোবাসো তাই তো?’

‘ এমন কিছুই না।’

‘ আমি জানি। আমি আসার পর থেকেই খেয়াল করছি অহনা তোমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। কিন্তু তুমি তার কেয়ার করে যাচ্ছ। লুকিয়ে লুকিয়ে তার চলাফেরা, কাজকর্ম সব দেখছ। আমি সব খেয়াল করেছি। তুমি জানো, তার বয়ফ্রেন্ড আছে, তবুও কেন অন্যের জিনিসে নজর দিচ্ছ? আমাকে কি তোমার ভালো লাগে না।
ওহ, আমিতো তার মত সুন্দরী না। তার মত এত সুন্দর একটা চেহারা নেই আমার। আমি তার মত স্মার্ট না, তার মতো হাসতে পারি না। তার সাথে আমার যায় না। কিন্তু ভালবাসা কি এতটাই ঠুংকো? আমাকে কি তুমি কোনোভাবেই ভালোবাসতে পারো না? কেন এ মেয়ের পিছে পড়ে আছ?’

লাবণী ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠে। বুকে হাজারটা কষ্ট জমা হয়েছে তার। ভালোবাসা না বোঝার বয়স থেকেই লাবণী আরিশকে পেতে চেয়েছে। এখনো চায়। আরিশের মন জয় করার হাজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আরিশকে ভালোবাসে বলে কখনো কোনো ছেলের দিকে তাকিয়েও দেখেনি।

‘ আমার খুব কষ্ট হয়, যখন ভাবি তুমি আমাকে ভালোবাসো না।’

আরিশ লাবণীকে শান্ত করার জন্য তার দুই কাঁধে হাত রাখে,’ রিল্যাক্স লাবণী! তোমাকে কান্না করা মানায় না! সুন্দরী মেয়েদের কান্না করলে শা’কচুন্নীর মতো লাগে। আমার জানামতে তুমি শাক’চুন্নী না।’

‘‌সত্যি বলছ?’

‘ একদম সত্যি। কান্না করোনা আর।’

লাবণী চোখ মুছে নেয়,
‘ তাহলে বলো, আমাকে ভালোবাসো?’

আরিশ চুপ করে যায়। লাবণী পুনরায় বলে,’ ভালোবাসোতো আমায়, তাই না? কতটা বাসো?’

‘ ভালোবাসা মনের ব্যাপার। আর তুমি জানো, এই মনটা আমি কখনো কাউকে দিইনি, একজনের জন্য রেখেছিলাম। সে ছিল অহনা। যাকে আমি আমার মনে স্থান দিয়েছিলাম। তার সাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু হয়নি। সেতো আগে থেকেই অন্য কারো মনে ছিল। তার মনেও ছিল সেই ব্যক্তিটি। তাদের ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা নিছক পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু কি করব? মনতো তাকেই দিয়ে বসেছি। আমি কি করে তা আবার ফেরত আনব? অহনাকে না পেলেও আমি কখনোই অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসতে পারব না।’

‘ওহ!’

লাবণী বেরিয়ে যায় আরিশের ঘর থেকে। আর এক মুহূর্তও দেরি করে না। নিজের ঘরে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। মুখ চেপে ধরে গগনবিদারী চিৎকার দেয়। কান্নার তীব্রতা বাড়ে অথচ কেউ শুনতে পায় না। দাঁত দিয়ে দুহাতের আঙুল কামড়ে ধরে কাঁদে। বুকে ব্যথা অনুভব করে। কতটা কষ্ট হচ্ছে মনে।

আদ্রিতা নাস্তার জন্য লাবণীকে ডাকতে এসে দেখে সে মাটিতে লুটিয়ে বসে আছে, কাঁদছে অনবরত। আদ্রিতা দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। বিছানায় তুলে আনে। লাবণী আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরে আরো কাঁদে।

‘ আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আদ্রিতা। আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি হেরে গেলাম একটা মেয়ের কাছে।’

‘ কি হয়েছে আপু, বলো আমাকে।’

‘ আরিশ আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি। আমি মিছেমিছি তার জন্য অপেক্ষা করেছি। তুই বল বোনো, আমি কি দেখতে খুব খারাপ? ওর কেন আমাকে কখনো ভালো লাগেনি? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি নিতে পারছি না এসব?’

‘ কেঁদো না আপু। তুমিতো জানতে ভাইয়া তোমাকে কখনো ভালোবাসেনি। তুমি নিজেই ভালোবেসে গেলে, এখন কষ্ট পাচ্ছ। কেঁদো না তুমি, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘ কিচ্ছু ঠিক হবে না। আরিশ অহনাকে ভালোবাসে। পাঁচদিন পর ওরা বিয়ে করে নেবে। আদ্রিতা কিছু কর তুই। আমি ম’রে যাব আরিশকে না পেলে। আমি সহ্য করতে পারব না।’

আদ্রিতা শান্ত করার চেষ্টা করে লাবণীকে। এতদিন মেয়েটার প্রতি বিরক্তি ধরেছিল সবসময় আরিশের সাথে মেখে থাকে বলে। আজ জানতে পারল তার এই কাজগুলোর আসল কারণ। মানুষ ভালোবাসার কাছে কতটা অসহায় হলে এমনটা করে। বেহায়ার মতো হয়ে যায়। লাজ লজ্জা ভুলে যায়। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে সে ভালোবাসা চায়। জীবনের বিনিময়েও ভালোবাসার ছোঁয়া চায়। আদ্রিতার মনটাও খারাপ হয়ে যায়।

অহনা রুমিকে কয়েকবার ডাকল উঠার জন্য। সে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। উঠতে অনিচ্ছুক সে। তাই আর বিরক্ত না করে বারান্দায় যায়। শীতলতা ঘিরে ধরে তাকে। মাহতিমকে দেখে কাছে যায়। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে,
‘ যখন তোমার খুব কাছাকাছি থাকি, আমার মনে হয় পৃথিবীর অন্য সুখগুলো সব ফিকে।’

মাহতিম দূরেই তাকিয়ে থাকে। মুখে তার কথা নেই। সকাল থেকেই সে সাইকোকাইনেসিসের ব্যবহার করতে পারছে না। সব শক্তি চলে গেছে।

‘ কি হলো? কিছু বলছ না যে!’

মাহতিম এখনো চুপ। অহনা মৃদু হেসে তার সম্মুখে যায়,
‘‌ যখন তুমি চুপ করে থাকো, আমার মনে গভীর প্রশ্নগুলো সব উদয় হয়। মনে হয় মিথ্যে বলতে চাও না বলেই চুপ থাকো। বারবার সেটাই প্রমাণিত হয়ে এসেছে।’

‘ আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, সেটা কি এই প্রকৃতি জানে?’

‘ প্রকৃতি সব জানে। তার নিয়মেই আমরা চলি।’

‘ তাহলে কেন এই প্রকৃতি আমাকে নিয়ে যেতে চাইছে? সে কি জানে না আমরা একে অপরকে ছাড়া সুখী হব না? কেন সে নিজ কর্তব্যে অটুট? একটু কি দয়া হয় না তার?’

‘ এমন বলো না। তোমাকে কেউ আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। আমরা বৃদ্ধ বয়সেও একসাথে থাকব।’

‘ তুমি আরিশের সাথে খুব ভালো থাকবে। সে তোমাকে অনেক ভালো রাখবে আমি সেটা জানি!’

‘ তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই আমি বিয়ে করব না। আমি কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারব না কখনো। মরে যাব, তবুও তোমাকে ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষকে মেনে নিতে পারব না। ভালোবাসি ভীষণ!’

অহনা মাহতিমের বুকে মাথা রাখে। পরম যত্নে মাহতিম তাকে জড়িয়ে ধরে,
‘ পরপারে আমি তোমাকেই চাইব। যদি আরেকবার জন্মগ্রহণ করা যেত, তাহলে সে জন্মেও আমি তোমাকেই চাইতাম। হাজার জনম চাই তোমার জন্য।’

ভোরের পাখিগুলোর কলতান শুনে অহনার মন আরো ফুলকিত হয়। মাহতিমের দীঘল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,’ জানি না, শেষ পর্যন্ত কি করবে তুমি! তবুও তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। নিশ্চয় তুমি আমাকে নিয়ে চলে যাবে আর সবাই উপায় না পেয়ে লাবণীর সাথেই আরিশের বিয়েটা দিয়ে দেবে। এটাই কি তোমার প্ল্যান?’

মাহতিম মাথা নাড়ায়। সম্মতি পেয়ে অহনা আরো শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে।

আরিশ ডায়রিটা খুলে বসে আছে। আঙুলের উপর কলম ঘুরাচ্ছে। মন তার অন্যদিকে। মনটা ভীষণ নেতিয়ে পড়েছে। থেকে থেকে ঘন মেঘের ঘনঘটা। মনে মনে বলল,’ ভালোবাসার উৎপত্তি কোথা থেকে শুরু হয়েছিল? প্রথমে কে, কিভাবে প্রেমে পড়েছিল?’ বিভোর হয়ে ভাবে সে। উত্তর মেলে না। কারণ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই প্রেম, ভালোবাসার উৎপত্তি। সেই আদিকাল থেকেই মানুষের মনের মিলন হয়ে আসছে।

আরিশ চিন্তা করে ভালোবাসার পূর্ণতা নিয়ে। নিরানব্বই শতাংশ বিচ্ছেদ ভেসে আসে তার মস্তিষ্কে। প্রেমে জয়ী হয়ে বার্ধক্য পর্যন্ত পাশে থাকা মানুষের সংখ্যা নগণ্য, বিচ্ছেদ বেশি। আরিশ ভাবে,’ কেন এত বিচ্ছেদ? কেন এত হাহাকার? কেন তারা পেয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়? তারা কি আমার মত ভালোবাসতে পারে না।’

তাদের মন ভিন্ন, তারা যাকে প্রথমে চায়, শেষে আর তাকে চায় না। একজনকে পাওয়ার জন্য তারা সবকিছু করতে রাজি থাকে। তাদের ভাবনা, আমিতো এমন কাউকেই খুঁজেছি পোড়া জীবনে। কিন্তু যখনি পেয়ে যায় তখন ভাবে, আমিতো তাকে চাইনি, আমি অন্য কাউকে চেয়েছি।

রং পরিবর্তন হয় মানুষের। আরিশ নিজেকে বলে,’ আমার মনের রং এক‌ই থাকবে। আমি কখনো তোমাকে ভুলব না অহনা‌। না পেয়েও ভালবাসি তোমাকে। মুখ ফুটে কথাটা বলতে পেরেছি এটাই অনেক। ভালোবাসলেই শান্তি। তাকে পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই।’

মতি সকালে মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে আসার সময় তার চোখ যায় বাইরে থাকা ফুলের টবে। এর উপর কিছু পড়ে থাকার জন্য গাছটা নেতিয়ে পড়েছে। মতি টবের কাছে গিয়ে দেখল একটা ডায়রি। বৃষ্টি হয়েছিল তাই ভিজে গেছে। কিন্তু উপরের মলাট শক্ত হ‌ওয়ায় তেমন কিছু হয়নি। পাতার উপরে এবং নিচের পাশগুলো কিছুটা ভিজে গেছে‌। মতি গাছটিকে ঠিক করে দিয়ে ডায়রি নিয়ে নিজের ঘরে আসে। ফ্যান অন করে শুকাতে দেয়। নিজেও বের হবে, তাই ওয়াশরুমে যায় গোসল করতে‌।

আয়শা মতিকে ডাকতে তার ঘরে আসে। বিছানায় ডায়রিটা দেখে অবাক হয়ে তা হাতে নেয়। পৃষ্ঠা উল্টে দেখে।

চলবে….

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৬৬.
আয়শা ডায়রীটায় তেমন কিছুই দেখল না। তাই রেখে দিয়ে মতিকে ডাকল। মতি ওয়াশরুম থেকে বলল দুই মিনিট পর সে আসছে। আয়শা চলে যায়।

রুমির ঘুম ভাঙতেই সে অহনাকে দেখতে পায়। অহনা মাহতিমের থেকে নিজেকে সরিয়ে রুমির কাছে আসে। রুমি ফ্রেস হয়ে আসে। বারান্দা থেকে মাহতিম অহনাকে সূক্ষ নজরে দেখতে থাকে।

পুরো পরিবারের সাথে একসাথে বসে খাবার খাওয়াটা অহনার খুব ভালো লাগে। প্রতিটি সদস্যকে দেখে আরো বিমোহিত। খাওয়ার ফাঁকে মতি বার বার তার দিকেই তাকিয়ে থাকে। তবে আবার চোখ সংযত করে নেওয়ার চেষ্টা করে দ্রুত। আজকাল সেটা কমে গিয়েছে অনেক। এখন তার নজর থাকে রুমির দিকে। রুমিও আড়চোখে তাকে দেখে।

খাওয়া শেষে করে মতি নিজের ঘরে গিয়ে ডায়রীটা নিয়ে বসে। প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখতে পায়, অহনা এবং মাহতিম নামটি খুব বড় করে লেখা। এক প্রকার পাত্তা না দিয়েই সে ডায়রিটা পড়তে থাকে। কারো ভালোবাসা শুরু থেকে দেখে তার চোখ মুখ চকচক করে উঠে। তবে শেষটা আর পড়তে পারল না। কারণ শেষটা আর লেখা ছিল না। মতির মনটা উশখুশ করতে থাকে। সে শেষটা জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে‌। কিন্তু করা দিনলিপি এটা, বুঝতে পারল না‌। সে মনে মনে অঙ্ক কষে। অহনার মনে করাটা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়নি। হতেও পারে। তাই সে ডায়রীটা হাতে নিয়ে অহনার ঘরের দিকে অগ্রসর হতেই রুমির সাথে ধাক্কা খায়। দু’জনের মাথা ঠুকে যায়। রুমি মাথায় হাত দিয়ে বলে,’ কানা নাকি, চোখে দেখেন না?’

মতি দাঁত বের করে বলে,’ সুন্দরী মেয়েদের দেখি না।’

‘ চোখের ডাক্তার দেখান।’

‘‌তুমিতো সাইন্স ডিপার্টমেন্টের তাই না?’

‘ না, আমি বাংলা নিয়ে পড়ছি।’

‘ ইশশ্, কি ভুলটাই না করে ফেললে তুমি। না হয় তোমার থেকেই নিজের চিকিৎসাটা করাতে পারতাম। কাছাকাছি থাকতে পারতাম।’

‘ ম’রা মানুষকে চিকিৎসা করতাম তবুও আপনাকে করতাম না।’

‘ এত নিষ্ঠুর ডাক্তার হলে কিভাবে হবে?’

‘ কথা না বাড়িয়ে আবার মাথা ঠুকেন। না হয় শিং উঠবে।’

‘ কে বলল তোমাকে মাথায় শিং উঠবে পুনরায় বারি না খেলে?’
পরক্ষণেই মতি কিছু একটা ভেবে বলল,’ আমি শুনেছি একজনের মাথার সাথে আরেকজনের মাথা ভুল করে ঠুকে গেলে পরবর্তীতে তিন মিনিট চুমু খেতে হয়, না হয় শিং এর সাথে সাথে দাঁতে পোকা হয়।’

‘ কিসব আছে বাজে বলছেন?’

‘ আমি একদম সত্যি বলছি। ইয়াং জেনারেশনের জন্য এটাই প্রযোজ্য। আর সবার জন্য না, তাদের শিং উঠবে না। এখন তুমি ডিসাইড করো কি করবে?’

রুমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, সত্যি এসব কিছু হবে নাকি মিথ্যে বলছে মতি,
‘ আপনি একটা মিথ্যুক, বিশ্বাস করি না।’

‘ তাহলে ঠিক আছে, পুনরায় মাথায় বারি খাও।’

রুমি এগিয়ে আসলেই মতি তাকে এক টানে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল,’ এবার যা করার করো, বাইরে কেউ দেখে যাবে।’

‘ আমি কিছু করতে আসিনি। শুধু মাথায় বারি খাব।’

‘ তাহলে ঠিক আছে।’

রুমি মতির মাথায় বারি খেতে গেলেই সে এক ঝটকায় রুমির ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসে। রুমির শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে যায়। অদ্ভুত এক ভালোলাগা থেকে সে নিজেও আত্মসমর্পণ করে নেয়। মতি তাকে ছেড়ে দেয়,’ ঠোঁটে কি দাও, একদম তেতো!’

রুমির হাত পা কাঁপছে। এর মাঝে মতি বলল ঠোঁট তেতো। রাগে ফুঁসে উঠে,
‘ আমি কিছু দেই না ঠোঁটে।’

‘ তাহলে এমন তেতো কেন? মিষ্টি হলে আর কিছুক্ষণ টেস্ট করতাম।’

রুমি অগ্নিশর্মা হয়ে তেড়ে আসে মতির দিকে,
‘ আপনার নামটা যেমন বাজে আপনিও বাজে।’

‘ আমার নাম আবার কি সমস্যা করল?

‘ মতি মানে মূর্খ চন্ডী।’

‘ একদম না। নামটা আমার দাদিমা দিয়েছিল, আমার আসল নাম আরশিমান মোড়ল। দাদির ডাকার পর থেকে এ নামটাই কমন হয়ে গেল।’

‘ সে যাই হোক। আপনার চরিত্রে সমস্যা, নিজেকে কি কখনোই ঠিক করতে পারবেন না?’

‘ আমি ভালো হয়ে গেছি।’

‘একটু আগে আমার সাথে কি করলেন? এখন বলছেন ভালো? আপনার মনে হয় নিজেকে সাধু লাগে।’

মতি চুপ করে যায়। নিজের প্রতি তার আবার বিরক্ত লাগে। সে নিজেকে ঠিক করতে পারছে না। কখন যে ভুল করে বসে খেয়াল থাকে না। সে রুমির কাছে মাফ চায়। রুমি কিছু বলে না। তার ঘর থেকে চলে যায়।

রুমি যাওয়ার দুই মিনিট পর মতি অহনার ঘরে আসে। মতিকে এমন সময় দেখে অহনা একটু অবাক হয়। ছেলেটার চেহারা সে দেখতে চায় না। তবুও কেন বার বার চোখের সামনে আসে কে জানে। অহনা চেহারায় বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল,’ আপনি এখানে কি‌ চান?’

‘ আগে ঘরে আসার অনুমতি দিন।’

মতি তাকে আপনি করে বলছে বলে অনেকটাই অবাক হয় অহনা। এত তারাতাড়ি পরিবর্তন আশা করেনি সে। কিছুটা খুশিও হয়, অন্তত ছেলেটা নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টাতো করছে। অহনা ভেতরে আসার অনুমতি দেয়।

অহনা মাহতিমের দিকে তাকায়, মাহতিম তাকে শান্ত থাকতে বলে। মতি কি বলতে চায় তা যেন শুনে।

মতি এসেই রুমিকে দেখে চোখ টিপলো। অপ্রস্তুত হয়ে রুমি সরে যায়। মনে মনে তাকে হাজারটা গালি দিতে থাকে।

মতি এগিয়ে এসে অহনাকে বলল,’ তা ভাবি। বিয়ে নিয়ে আপনার ফিলিংস কেমন?’

এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে অহনা আরেক দফা মতিকে পর্যবেক্ষণ করল, বলল,’ জ্বী ভালো, আমার মনে হয় না এটা বলার জন্য এখানে এসেছেন, আসল কথা বলুন।’

‘ আপনি আসলেই অনেক বুদ্ধিমতী। যাই হোক, এই ডায়রীটা কি আপনার?’

মতি তার হাতে থাকা কাপড়ে মোড়ানো ডায়রীটা অহনার দিকে এগিয়ে দেয়। উৎসুক হয়ে রুমিও এগিয়ে আসে।
অহনা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে দেয়,’ আমার না, এটা অন্য কারো হবে হয়তো!’

‘ না দেখেই কি করে বলে দিলেন?’

‘ কারণ, আমি কখনো ডায়রী লিখি না। এটা নিঃসন্দেহে আমার না।’

‘ হতে পারে আপনার না। কিন্তু এর ভেতরের কাহিনি দেখে আমার কেন জানি না আপনার কথাই মনে হলো। আপনি পড়ে দেখতে পারেন। এটা সকালে আপনার ঘরের জানালা বরাবর নিচে পেয়েছি।’

অহনা আরেক দফা অবাক হয়ে ডায়রীটা নেয়।

‘ তাহলে আসি ভাবি! আর হ্যাঁ, এই ডায়রীতে যে গল্পটা, তার এন্ডিং দেওয়া হয়নি। যদি জেনে থাকেন শেষের বিষয়ে আমাকে বলবেন। আমি আবার জানতে আসব। আল্লাহ হাফেজ!’

মতি চলে যেতেই অহনা ডায়রীটা খুলে দেখে মাহতিম এবং অহনার নাম। এতটা কাকতালীয় হতে পারে, অহনা তা কল্পনা করেনি। খুলে দেখতে গেলেই মাহতিম এসে বাঁধা দেয়,
‘ কার না কার ডায়রী, তোমার পড়া উচিত নয়।’

অহনা মাহতিমের এমন কথা শুনে তাতে কান দেয় না। এটা পড়বে বলেই ঠিক করে। পুনরায় বাধা দেয় মাহতিম,
‘ এটা পড়া ঠিক হবে না তোমার জন্য।’

অহনা ডায়রীটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলে,’ এটাকে আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে‌ কোথায় যেন দেখেছি।’

‘ কোথাও দেখনি। এটা মতি চালাকি করে হয়তো তোমাকে দিয়েছে।’

‘ মনে পড়েছে, এমন একটা ডায়রী তুমি আমাকে দিয়েছিলে। আমার পড়তে মনেই ছিল না। কিন্তু এটাতো আমি আনিনি, কে আনল? আর কেইবা ফেলে দিল?’

‘ এতটা না ভেবে তুমি এটা আমাকে দিয়ে দাও। কি আছে আমি দেখে নেব।’

‘ তুমি নিজেই আমাকে দিলে, আমিতো পড়িনি।’

এমন‌ সময় আয়শা এবং তন্দ্রা আসে অহনার কাছে। তাদের হাতে একটি বাক্স। অহনা তারাতাড়ি ডায়রীটা পেছনে ওয়্যার ড্রপের ভেতর রেখে হাসি মুখে বসতে বলে তাদের।

আয়শা এক গাল হেসে অহনাকেও পাশে বসায়,’ তোমার চাঁদমুখখানা দেখলে পুরো দিনটাই ভালো যায়। আমার আরিশ অনেক ভাগ্যবান তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে।’

তন্দ্রা এই সুনাম ততটা নিতে পারছে না। তবে মৃদু হেসে আয়শার সাথে তাল মেলায়, বলল,’ হ্যাঁ গো ভাবী, ঠিক বলেছ। মেয়েটা লক্ষী একদম। সবার সব কথা মান্য করে, কেমন কয়দিনেই সবার মন কেড়ে নিল। জাদু জানে এই মেয়ে। নজর না লাগুক।’

অহনা লাজুক হাসে। কানের গোঁড়ায় চুলগুলো গুঁজে দেয় আয়শা।
বাক্সটা খুলতেই কতগুলো বাহারী গয়না বেরিয়ে আসে। অহনার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সে এত গয়না একসাথে কখনো দেখেনি। তার মায়ের খুব সামান্য পরিমাণ গয়না ছিল। তাই এখনও আঁকড়ে ধরে আছে সে। মাঝে মাঝে গয়নাগুলো দেখে আর চোখের জল ফেলে।

আয়শা একটা সাত লহরী হার অহনার গলায় পড়িয়ে দিয়ে চোখের পলক না ফেলে দেখে,’ বাহ, আমার হবু ব‌উমাকে কত সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে এই গয়না ওর জন্য‌ই বানানো হয়েছে।’

তারপর অহনাকে বলল,’ সাবধানে রাখবে এটা। আমার শাশুড়ি বড় ব‌উ হিসেবে আমাকে এই হার দিয়েছিল। আরিশের ব‌উ হিসেবে আমি তোমাকে দিলাম। আজ থেকে এটার মালিক তুমি। এখানে যত গয়না আছে, সব তোমার। সাবধানে রেখো সব।’

অহনা নাকোচ করে,’ না মা, আমি এটা নিতে পারব না। আপনার সম্পদ আপনার কাছেই রাখুন। আমি এটার ভার নেওয়ার মত যোগ্যতা এখনো অর্জন করিনি। আমাকে এত বড় দায়ভার দেবেন না।’

‘ পাগলী মেয়ে। নিজের জিনিস কেউ না নিতে বলে? এরকম আরো অনেক গয়না আছে। আরশিমান আর আদ্রিতার জন্য‌ও আছে। কারো ভাগেরটা তোমাকে দিচ্ছি না, তোমার যা প্রাপ্য তাই দিচ্ছি। বাকিগুলো বিয়ের দিন দেওয়া হবে।’

অহনা আর না করতে পারল না। তন্দ্রার চোখে মুখে লোভ। মনে হচ্ছে সে এক্ষুনি এইসব গয়না নিজের করে নেবে। কিন্তু সম্ভব না। তাই আয়শার সাথে অহনাকে আশ্বাস দিতে থাকে।

গয়না দিয়ে চলে যায় তারা। অহনা ঠিক করে, সব গয়না সে আরিশকে ফেরত দেবে। হঠাৎ মনে পড়ল আয়শা তাকে বলেছে আরশিমানের জন্য গয়না রেখেছে। ভ্রু উল্টে রুমিকে বলে,’ আচ্ছা, এই আরশিমান কে রে?’

‘ মতি, ওর আসল নাম আরশিমান।’

অহনা ঢ্যাবঢ্যাব করে রুমির দিকে তাকায়,’ তুই কি করে জানলি?’

রুমি অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিছু বলতে পারছে না, বলল,’ আমার একটু কাজ আছে। বাইরে যাই আমি।’ বলেই রুমি চলে যায়।

রুমি চলে যেতেই অহনা ডায়রীর কথা মনে হয়। এখন মাহতিম নেই। হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। সুযোগ পেয়ে অহনা ডায়রিটা নিয়ে খাটের উপর বসে পড়া শুরু করে।

চলবে….

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৬৭.
অহনার চোখ দুটো শীতল হয়ে আসে ডায়রীটার প্রতিটি লাইন পড়ে। সে বুঝতে পারছে না এই ডায়রী কার? আর এই লেখা? হুবহু তার কপি। এটা কিভাবে সম্ভব? অহনা বিভোর হয়ে ভাবে। আবারো পড়তে শুরু করে। কত শত ভালো লাগা, ভালোবাসার মুহুর্ত বন্দি রয়েছে এ ডায়রীতে। কার এই ডায়রী, না জানলেও এটা পড়তে ভালো লাগছে। অদ্ভুত এক আবেশে বার বার মনটা আনন্দে নেচে উঠছে। কিছু কিছু স্মৃতি মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে। অহনা আরো মনোযোগ দিয়ে পড়ে। হঠাৎ তার মনে হলো এই ডায়রীতে লেখা প্রতিটি ঘটনার সাথে সে পরিচিত। রেস্টুরেন্টে যাওয়া, ট্রাকের পেছনে দৌড়ানো, মাহতিমের কাঁধে করে পুরো তল্লাট ঘোরা, জ্বরের সময় পুরো রাত সেবা করা, সেই শিউলি ফুলের মালায় আসক্তি, হাজারো খুনসুটি পড়তে গিয়ে অহনার চোখ ভিজে আসে। ঘটনাগুলো তার চোখে সামনে আবছা ভাসছে।
অহনার মাথা ধরে আসে। আর পড়তে পারছে না। আচমকা তার মাথা ব্যথা করছে। চোখ স্থির রাখতে পারছে না ডায়রীতে। কিন্তু শেষে কি হয়েছে পড়ার জন্য পুনরায় নজর দেয়। একদম পারছে না। মাথায় হাজারো ঘটনা ঝাঁপসা হয়ে চোখের সামনে ধরা দিচ্ছে।
মাথা ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠে অহনা। হাত দিয়ে চেপে ধরে কান। কতগুলো শব্দ তার কানে বারি খাচ্ছে। কেউ তাকে বলছে,’ আজীবন থাকব, তোমার পাশে আঠার মতো লেগে থাকাই আমার কাজ, আজ যদি না পাই তো কাল তুলে নিয়ে যাব, ভালো আমি বাসব‌ই তাতে তোমার মর্জি থাকুক বা না থাকুক, গোমরা মুখেও তোমাকে বিষন্নপরী লাগে, আবার আসবেতো কাল? অপেক্ষা করে থাকব কিন্তু।’ শব্দগুলো কানে বারি খাচ্ছে। অহনা বুঝতে পারছে না, কে এসব বলছে। কে সে, যে বার বার বলছে ছেড়ে যাবে না। অহনা শুনতে পেল,’ আমার আহিরানী, খুব ভালোবাসি গো।’

অহনা চিৎকার করে উঠে। এসব সে শুনতে চায় না। কথাগুলো আ’ঘাত করছে খুব। আরিশ ছুটে আসে,
‘ কি হয়েছে তোমার? অহনা, কিছু বলো!’

অহনার চোখ বেয়ে নোনা পানির স্রোত বয়ে নামছে। চিৎকার করে মাহতিমকে ডাকে।
সাথে সাথেই মাহতিম এসে যায়। সে বাহু দ্বারা আঁকড়ে ধরে অহনাকে,
‘ কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে? এমন করছ কেন?’

অহনা কথা বলছে না। মুখ থেকে শব্দ আসছে না। হেঁচকি ওঠে যায়। আরিশ পানি এনে দেয়। কিছুটা পানি খেয়েই অহনা শান্ত হয়। মাহতিমের বুকে মুখ গুঁজে নেয়। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে,’ কখনো ছেড়ে যাবে না আমাকে। কখনো না!’

মাহতিম দেখতে পায় ডায়রীটা। পাশেই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। বুঝতে আর বাকি র‌ইল না অহনার কি হয়েছে। লেখাগুলো অহনার স্মৃতিতে আঘা’ত করেছে। পুরনো কথা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিল।

মাহতিম কোমলভাবে অহনাকে শুইয়ে দেয়। ইতিমধ্যে সবাই অহনার ঘরে চলে আসে। চিৎকারের শব্দ সবার কানে পৌঁছেছে।
লাবণী আরিশকে চুপিচুপি বলল,’ তুমি কেন অহনার ঘরে আসলে?’

আরিশ রাগচটা অবস্থায় ছিল তখন। অহনার এমন অবস্থা দেখে সে শান্তি পাচ্ছে না। এমন সময় প্রশ্নটা বিরক্তির কারণ হলো।

আদ্রিতা পাশেই ছিল, বলল,’ কোথায় কি প্রশ্ন করতে হয় সেটা জানো না বুঝি? ভালোবাসলে বোকা হয়ে যায়, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ তুমি। এখন ভাইয়ার মোড ঠিক নেই, পরে জিজ্ঞেস করো।’

আদ্রিতা সরিয়ে নিয়ে আসে লাবণীকে। আদ্রিতা দুটানায় আছে। সেকি অহনার সাথে আরিশকে চাইবে নাকি লাবণীর সাথে চাইবে, বুঝে উঠতে পারছে না। এতদিন অহনাকে আরিশের সাথে কামনা করেছে। কিন্তু এখন লাবণীর জন্য কষ্ট হচ্ছে। আদ্রিতা চায় অহনার সাথে আরিশের বিয়ে হোক। আবার এটাও চায় লাবণীও আরিশকে পাক। নিজের মাথায় নিজের বারি দিতে ইচ্ছে করে আদ্রিতার। তার ছোট্ট মাথা বুঝতে পারছে না কি করা উচিত।

প্রায় ত্রিশ মিনিট পর অহনা চোখ মেলে। সামনে আরিশকে দেখে প্রথমে। মাহতিম নেই। সে মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে চলে গেছে। অহনাকে চোখ মেলতে দেখে সবাই জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছিল! অহনা সকলে থাকা ডায়রীটার দিকে তাকায়, বলল,’ হঠাৎ মাথা ঘুরছিল খুব, মাথা ব্যথাও করছিল।’

আয়শা বলল,’ হঠাৎ এমন কেন হলো? কি হয়েছিল তোমার?’

‘ আমি জানি না।’

কলিং বেলের শব্দ কানে আসতেই আয়শা কাজের মেয়ে তারিমাকে বলল, কে এসেছে দেখতে। চলে যায় তারিমা। মেইন ফটক খুলতেই দেখল কম বয়সী একটা ছেলে এসেছে। সে অহনার কথা জিজ্ঞেস করছিল। তারিমা ছেলেটিকে বসিয়ে আয়শার কাছে আসে।

সবাই দেখতে যায় কে সে আগন্তুক। ছেলেটি বলল,’ অহনা আপাকে আসতে বলেন তারাতাড়ি, তার বোন মা’রা গেছে। আমাকে খবর দিতে বলছে।’

সবাই জানে অহনার কোনো বোন নেই। তাই ছেলেটির কথা কেউ বিশ্বাস করল না। ছেলেটি বুঝানোর চেষ্টা করল, কেউ কানে নিল না। সবাই ভাবল, হয়তো বাচ্চা ছেলে মজা করছে। ছেলেটি যাওয়ার সময় বলে যায়,’ ময়না আপার বাপে আমাকে আসতে বলছিল। আমি কিছু জানি না।’

আদ্রিতা দৌড়ে গিয়ে অহনাকে বলল,’ পুতুল ভাবী, তোমার কি কোনো বোন আছে?’

অহনা সবে একটু সুস্থ বোধ করছে, বলল,’‌ হ্যাঁ আছে।’

‘ তার নাম কি ময়না?’

‘ হ্যাঁ, কি হয়েছে ময়নার?’

‘ একটা ছেলে এসে বলল,’ ময়না নামে তোমার কোনো বোন মা’রা গেছে।’

‘ কিইই!’

অহনা আঁতকে উঠে। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে। দৌড়ে গিয়ে নিচে নামে। আরিশ দেখতে পেয়ে তার পিছু নেয়। অহনা নিচে থাকা প্রতিটি সদ্যসকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করল, ময়নার কি হয়েছে?’

অহনাও খোঁজ করছে দেখে আয়শা বলল,’ কিছুক্ষণ আগে একটা ছেলে এসে খবর দিল মা’রা গেছে।’

অহনা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। আরিশ ভাবগতি হাতের বাইরে দেখে নিজেও অহনা পেছন পেছন যায়। গাড়ি বের করে অহনাকে উঠতে বলে‌। কাঁদতে কাঁদতে অহনা গাড়িতে উঠে। মুখে তার একটাই কথা,’ তারাতাড়ি চালান। আমার বোনের কি হয়েছে কে জানে! দ্রুত যান।’

পৌঁছেই দেখতে পায় ময়নাদের বাড়ি ভর্তি মানুষ। লোকজনকে ঠেলে অহনা ভেতরে ঢুকে। দেখতে পায় সাদা থানে আবৃত ময়নার পুরো দেহ। মুখের উপর থেকে কাপড়টা সরাতেই অহনার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। পাথর হয়ে যায় একদম। সামনে থাকা বিষয়টা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।

মাটিতে থপাশ করে বসে পড়ে। আরিশ ওকে সামলানোর চেষ্টা করে। অহনা এক নজরে তাকিয়ে আছে ময়নার দিকে। নিস্তেজ দেহটা পড়ে আছে ময়নার। অহনা হাত উঁচিয়ে ছুঁতে চায়। এর আগেই তার শরীরটাও নেতিয়ে পড়ল। আরিশ অহনাকে পাঁজাকোলা করে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। চোখে মুখে পানি দেয়।

মাহতিম এসে দেখে অহনা তার বিছানায় নেই। অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় গেছে ভাবতে থাকে সে। চিন্তা হচ্ছে তার। পুরো বাড়ি খুঁজে দেখতে থাকে। এখন দেখতেও পারবে না অহনা কোথায় আছে, কারণ তার কোনো শক্তি নেই।

অহনা চোখ খুলে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। আরিশ তাকে থামানোর চেষ্টা করে। অহনার বুকটা চৌচির হয়ে গেছে। একে একে সে সব হারালো। শেষমেশ আদরের বোনটাও। কষ্টে তার দম আটকে আসছে। আরিশ অহনার এই কান্না সহ্য করতে পারল না। তার‌‌ও কান্না পাচ্ছে। সে বাইরে গিয়ে জানতে চায় ময়নার মৃ’ত্যু কিভাবে হলো।
মৃ’ত্যুর কারণ জানতে পেরে আরিশের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়।
রাতে ময়না ঘরে একা ছিল, তার বাবা কাজ থেকে ফিরতে দেরি করেছে। বাড়ি ফিরেই দেখতে পায় ময়না র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে।
কথাগুলো শুনে আরিশ পেছনে তাকাতেই দেখতে পায় অহনা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। বাঁশের খুঁটি ধরে সে কাঁদছে। আরিশ জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। কি করবে বুঝতে পারে না‌। এমনিতেও অহনার শরীরের অবস্থা ভালো না। এর মধ্যে এসব সে মেনে নিতে পারছে না। রাগে ফেঁটে পড়ে আরিশ। ময়নার বাবাকে বলল,’ যে বা যারা এই কাজ করেছে, আমি তাদের খুঁজে বের করব‌‌ই, তাদেরকে আমি কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি দেব। আপনি আমার উপর ভরসা রাখেন।’

‘, কি হবে শাস্তি দিয়ে? আমার মনিতো আর ফিরে আসবে না। কষ্টেই বুঝি আমার মেয়েটার শেষ সময় গেল। কখনোই আমি তাকে একটু শান্তি দিতে পারিনি। দুঃখেই তার জীবনটা শেষ হলো। সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। আমি কেন দেরি করে ফিরলাম। তাহলে এখনো আমার মেয়েটা বেঁচে থাকতো‌।’

‘ আপনার কোনো দোষ নেই। দোষতো তাদের, যারা ময়নার ক্ষতি করেছে।’

আরিশ শপথ নেয়,’ যাদের জন্য অহনার চোখের জল ঝড়েছে তাদের সে ছাড়বে না।’

অহনার শরীর খারাপ বলে এক প্রকার জোর করেই আরিশ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

অহনা অচেতন হয়ে যায় গাড়িতেই। একসাথে এতটা দখল সে নিতে পারেনি।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে