#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৬২.
আরিশ মোড়লের কাছে গিয়ে অনুনয় করে বলল,’ বাবা, মতিকে বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করুন।’
মোড়লের ব্রু জোড়া কুঁচকে আসে। আরিশের মুখে এমন কথা সে আশা করেনি। আরিশ তো নিজেই বলেছিল তাকে শাস্তি দিতে, এখন আবার ফিরিয়ে আনার কথা বলছে কেন? মোড়ল আরিশের সাথে কোনো কথা না বলে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় আলোচনা করছিল দুজন লোকের সাথে।
আরিশ পুনরায় বলল,’ মায়ের শরীরটা ভালো নেই। আপনার উপরে কথা বলেনা বলে বলতে পারছে না। আজও দেখলাম মা কাঁদছে মতির জন্য।’
মোড়ল বলল,’ উকিলের সাথে সাক্ষাৎ কর। আরিশ সালাম জানিয়ে প্রস্থান করে। বাবারা একটু বেশি নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়। সহজে তারা কোনো অপরাধ ভুলে না, ক্ষমাও করতে পারে না সহজে। কিন্তু মা! মা কখনো এমনটা করতে পারেনা। কখনো সে খারাপ সন্তানটাকে ছাড়াও থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
আরিশ চলে যায় থানায়। এক ঘন্টার মধ্যে সব কাগজপত্র তৈরি করে মতির কাছে যায়। আরিশকে দেখে মতি খুব খুশি।
মতির অবস্থা নাজেহাল। এই দেড়মাসে তার চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। পুরো শরীরে তার আঘাতের চিহ্ন। নিয়ম মতো তাকে প্রতিদিন চাবুকের ঘা দেওয়া হয়েছে। পুরো শরীরে চাবুক আর লাঠির আঘাতে জখম হয়ে গেছে। মতি আরিশের দিকে তাকাতেই তার চোখে জল নেমে আসে,’ ভাই, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও। আর কখনো এমন কোনো কাজ করব না যেটার জন্য আমাকে শাস্তি পেতে হয়। আরিশ মতির কাছ থেকে চলে যেতেই তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। কাঁদতে থাকে। কবে সময় শেষ হবে, আর কবে এই অত্যা’চার থেকে মুক্তি পাবে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আবেগে সে আরিশের গলা জড়িয়ে ধরে,’ ভাই আমার, আমি জানতাম তুমি আমাকে ছাড়িয়ে নেবে।’
আরিশ তার পিঠে চাপড় মেরে বলল,’ চল বাড়ি।’
মতি ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠে। পুরো শরীরে তার বি’চ্ছিরি রকমের ব্যথা করছে।
অহনা আর রুমি মিলে গল্প করছিল। অহনার নজর ছিল বারান্দার দিকে। মাহতিমকে খুঁজে ম’রছে। আজকাল বড্ড অবহেলা করে মাহতিম। দিনে একবার দেখা করে, বাকি সময় কোথায় থাকে বলা যায় না।
রুমি অহনার ব্যাকুলতা টের পায়। চারিদিকটা পর্যবেক্ষণ করে বলল,’ কাকে খুঁজছিস?’
‘ কাউকে না।’
‘ জীজুকে মনে হয় তাই না? তবে আমার মনে হয় না তোদের মধ্যে আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে। তোরা কখনোই একে অপরের সাথে দেখা করিস না। কথা কম বলিস। সারাদিনতো এই ঘরে বসেই কাটিয়ে দিস। ভার্সিটিতে তিনদিন গেলি এই এক মাসে। বিষয়টা আমার ভালো মনে হচ্ছে না।’
‘ তেমন কিছু না।’
‘ মন খারাপ?’
‘ না!’
‘ জীজুকে ডাকব? আমার মনে হচ্ছে না কিছু ঠিক আছে। আর পনেরো দিন পর বিয়ে।’
অহনার সময়ের দিকে একদম খেয়াল ছিল না। পনেরো দিন আছে জেনে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। জানালার দিকে নজর দিতেই মাহতিমকে দেখতে পায়। অহনা রুমিকে বলল,’ আদ্রিতা বলেছিল ওর কোনো কাজ আছে তোর সাথে। গিয়ে দেখে আয়।’
রুমি চলে যেতেই অহনা ছুটে যায় মাহতিমের কাছে। রাগে অভিমানে মনটা বিষিয়ে উঠেছে। মাহতিমের বুকে কি’ল বসিয়ে বলে,’ কোথায় থাকো সারাদিন? আমি খুঁজে মরি সর্বক্ষণ।’
মাহতিম কিছু বলার আগেই অহনা তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুর তুলে,’ আমাকে কষ্ট দিতে তোমার খুব আনন্দ লাগে তাই না?’
মাহতিমের মুখের শব্দগুলো তার নিজস্ব ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অহনাকে কাছে পেলেই কেমন দুর্বল হয়ে যায়। বুকের ব্যথাটা আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।
‘ ক্ষমা করে দিও আমাকে।’
মাহতিমের কথা শুনে অহনা তার দিকে তাকায়,’ এমন কেন বলছ? তুমি কি কোনো অপরাধ করেছ?’
‘ অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি। তোমাকে ভালোবেসে। আমাকে মাফ করে দিও। আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি।’
‘ এমন কথা মুখেও আনবে না। আমি তোমায় ভালোবাসিতো। এটা কি যথেষ্ট না। কেন এমন অদ্ভুত কথা বলছ?’
‘ ভালোবাসাটাই অন্যায়। ঘোর অন্যায়। ভুলে যেতে পারো না কোনোভাবে?’
অহনা মাহতিমের বুক থেকে মাথা সরিয়ে সূক্ষ দৃষ্টিতে তাকে দেখে। কপালে গলায় হাত দিয়ে দেখে,’ তোমার কি জ্বর আসল নাকি? এমন অদ্ভুত কথা বলছ কেন? নাকি ভূতে ধরেছে?’
‘ কেন অবুঝের মতো আচরণ করো? তুমি আমাকে ভুলে যাও।’
‘অন্তর্গহীনের তীব্র ব্যথা উপশম করতে তুমিই যথেষ্ট। ভুলি কি করে?’
অহনা পুনরায় মাহতিমের গলা জড়িয়ে ধরে,’ আজকাল খুব কম দেখা করো। এর কারণ কি? তুমি কি কিছু নিয়ে আপসেট? আমার কেন জানি না মনে হয় তুমি সুখী নও।’
‘ আমি ঠিক আছি।’
‘ আর পনেরো দিন পর বিয়ে। তুমি জানো কিন্তু কিছু করছ না।’
‘ তো, বিয়ে করে নাও।’ মাহতিম অন্যদিকে ফিরিয়ে কথাটা বলল।
‘ মাথা ঠিক আছে তোমার? আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে স্বামীরূপে গ্রহন করতে পারব না। তোমার সাথেই বাকি জীবন কাটাতে চাই।’
‘ আমারতো জীবনটাই নেই। কাকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখছ?’
‘ উফফ্! আবার বোকা কথা!’
‘ আরিশ খুব ভালো ছেলে। বিয়ে করে তাকে নিয়ে সুখে থাকো।’
‘ মরে যাব। বিশ্বাস করো, তোমাকে না পেলে আমি মরে যাব। যে জীবনে তুমি নেই, আমার সে জীবনের কোনো মূল্যও নেই।’
মাহতিম অহনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঝরঝর করে কেঁদে উঠে। বুকটা কেমন শূন্য লাগছে। চিনচিন ব্যথা করছে বুকে। অহনা আবদার করে,’ আমায় এখন নদীর পাড়ে নিয়ে যাবে? ইচ্ছে করছে সন্ধ্যাটা তোমার সাথে সূর্যাস্ত দেখেই কাটাই। মাহতিম চোখের নিমেষে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।
আকাশে সোনালী আলো ছড়িয়ে রয়েছে। মাহতিম অহনাকে পাঁজাকোলে এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মনোমুগ্ধকর লাগছে ওকে। এত রূপ তার। হৃদয় ঝলসে যাওয়ার জোগাড়। মাহতিম অহনার ঠোঁটে চুমু খায়। বাতাসের দাপটে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। মাহতিম এক হাতে তা গুছিয়ে দেয়।
নদীর পাড়ে পৌঁছে যায়। একটা গাছের গুঁড়িতে গিয়ে বসে দুজন।
রুমি আদ্রিতার ঘরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে ডেকেছে কিনা। কিন্তু আদ্রিতা ডাকে নি। অহনা মিথ্যে কেন বলল রুমি বুঝতে পারেনা। আদ্রিতার সাথে গল্প করে। তার মনে হয়েছিল অহনা তাকে ঘর থেকে বের করতেই এই কায়দা করেছে। তাই রুমিও স্বইচ্ছায় আদ্রিতার সাথে কথা বলে।
আরিশের কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই সবাই বেরিয়ে আসে। আয়শা মতিকে দেখে এগিয়ে এলো। শরীরের এমন অবস্থা দেখে কান্না আসে তার। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দেয়।
আদ্রিতা রুমিও বেরিয়ে আসে। মতি রুমির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে আয়শাকে জিজ্ঞেস করে,’ মেয়েটা কে মা?’
‘ সেসব পরে জানবি। আগে ফ্রেশ হ, আমি খাবার দেই। প্রাণ ভরে কিছু খেয়ে তারপর সব হবে।’
অনেকটা রাত হয়ে এসেছে। অহনা মাহতিমের কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাই আর জাগায়নি। এক দৃষ্টিতে অহনার মুখের দিকে তাকিয়েই চার ঘন্টা পার করে দিল।
আরিশকে তার মা পাঠালো অহনাকে ডেকে আনতে। আরিশ অহনার ঘরে গিয়ে দেখল রুমি আয়নার সামনে বসে আছে। অহনা কোথাও নেই। আরিশ রুমিকে জিজ্ঞেস করে অহনার কথা। রুমি নিজেও কিছুই বলতে পারে না। চিন্তায় পড়ে যায় আরিশ। তখনি জানালায় তাকিয়ে থেকে মাহতিম অহনাকে নিয়ে আকাশপথেই আসছে। রুমি দেখে ফেললে খুব সমস্যা হয়ে যাবে। তাই আরিশ তাকে বলল,’ রুমি আপু, তোমাকে খেতে ডাকছে, তুমি যাও। আমি অহনার জন্য অপেক্ষা করছি ঘরে।’
‘ ওকে ছাড়া আমি যেতে পারি না। ও আসলেই যাব। জানি না কোথায় গেছে!’
‘ তোমাকে যেতে বলেছে। আমি অহনাকে নিয়ে আসছি,
তুমি যাও। তুমি যাওয়ার সাথে সাথেই অহনা আসবে।’
রুমি চলে যায়। আরিশ জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অহনা ঘুমিয়ে আছে। এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি। মাহতিম স্বযত্নে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মাহতিম সরে যেতে চাইলেই অহনা তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নেয়।
আরিশ ঘর থেকে চলে যেতেই দেখল সমানে অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাবণী। আরিশ তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই সে আবারো পথ আঁটকে দাড়ায়,’ তোমার কি মনে হচ্ছে না, তুমি আমাকে ইগনোর করছ?’
‘ এত ভালোভাবে বুঝেও কেন এমনটা করো?’
‘ কারণ আমি তোমাকে…’
‘ আমাকে কি?’
‘ শুনবে তুমি?’
‘ বলো তবে!’
‘ আমার ঘরে চলো।’
লাবণী আরিশকে টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। তাকে দাঁড় করিয়ে নিজের সব জিনিস ব্যাগ থেকে বের করতে থাকে। একটা ডায়রি বের করে আরিশের হাতে দিল। ডায়রিটা খুলতেই আরিশের চোখ ছানাবড়া। পুরো ডায়রি জুড়ে আরিশের কথা লেখা। তার প্রতিদিনের নিয়মনীতি, খাওয়া-দাওয়া হতে সব কিছু। তার পছন্দ, অপছন্দ সব এখানে লেখা। হাজারটা প্রেমের কবিতাও লেখা। আরিশ লাবণীর দিকে তাকায়। লাবণী একখানা রোমাল বের করে তার হাতে দেয়। যেটাতে আরিশের নামের পাশে লাবণীর নাম লেখা। একটা এলবাম দেয়, যেটাতে আরিশের অগণিত ছবি, সাথে লাবণীর। লাবণী নিজের মোবাইলের ওয়ালপেপার, আইডি, পাসওয়ার্ড সব দেখালো। সবকিছুতে আরিশের নাম। আরিশ লাবণীর নোটপ্যাডে গিয়ে দেখল সেখানে আরিশকে উদ্দেশ্য করে হাজারটা লেখা। কত শত আবদার আর বিভিন্ন ভঙ্গিতে প্রেম নিবেদন করার প্রক্রিয়া। এসব দেখে আরিশ থ হয়ে যায়,
‘ আমার নামে এতো লেখা কেন তোমার কাছে?’
‘ এসবের মানে কি তুমি নিজেই বের করো। কেন একটা মানুষ তার সব কিছুতে তোমাকে রেখেছে?’
আরিশ বুঝতে পেরে বলল,’ আমার বিয়ে, সেটা কি জানো?’
‘ জানি, আর এটাও জানি বিয়েটা অহনা করবে না। কারণ তার বয়ফ্রেন্ড আছে।’
‘ এত কিছু জেনে গেলে? এখন কি চাও?’
‘ আমি তোমাকে চাই। আমি তোমাকে ভালোবাসি!’
আরিশ চমকে উঠে,’ মাথা ঠিক আছে? এই ভালো লাগা এখানেই স্থগিত রেখে দাও। তুমি আর আমি…. এটা কখনোই সম্ভব না। আমি তোমাকে বোনের নজরেই দেখেছি।’
‘ এবার নজরটাকে চেঞ্জ করে নাও। আমি তোমাকে চাইই চাই।’
‘ পাগলামো করো না।’
‘ তুমি কি চাও না, আমার একটা সংসার হোক। আমিও সব মেয়েদের মতো সুখে থাকি?’
‘ চাই, তবে আমার পিছু ছাড়ো। তোমার জন্য আরো অনেক হ্যান্ডসাম ছেলে অপেক্ষা করে আছে।’
‘ আমি তাদের চাই না। আমার তোমাকে লাগবে। এক কথায়, আমি তোমার বাচ্চার মা হতে চাই।’
‘ কেউ শুনে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
‘ কিছুই হবে না। সবার জানা উচিত তোমার লাইফ পার্টনার আমি হব ঐ অহনা না। একবার ভালোবাসো আমাকে।’
আরিশ চলে যেতে নিলেই লাবণী পেছন থেকে তার শার্ট খামচে ধরে,’ তুমি যাবে না। আগে বলে যাও আমাকে ভালোবাসো কিনা?’
‘ পাগলামো মানায় না। বড় হয়েছ তুমি।’
লাবণী আরিশকে জড়িয়ে ধরে,’ তুমি এমনটা করতে পারো না। আমি অসহায়ের মতো তোমার কাছে ছুটে আসি বার বার। আর তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিতেই ব্যস্ত। একটু ভালোবাসলে কি হয়?’
‘ আমাকে ছাড়ো। কেউ দেখে ফেলবে।’
‘ দেখুক, আমি তোমাকে চাই। তোমার এই শরীরটাও আমার। আমাকে সরিয়ে দিও না। সেই ছোট থেকে তোমার স্বপ্ন দেখে বড় হয়েছি। কেন অবহেলা করছ?’
লাবণী কেঁদে উঠে। ভেতরের অভিমান সব আজ বেরিয়ে এসেছে। লাজ লজ্জা ভুলে গিয়ে বেহায়ার মতো আরিশকে জড়িয়ে ধরেছে। কারণ ইউটিউবে ছেলে পটানোর অনেক ভিডিও দেখেছে। তার মধ্যে কয়েকটায় বলা হয়েছে, ছেলেদেরকে জড়িয়ে ধরলে, তাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। তারা ভালোবাসা অনুভব করে। আরো কাছে পেতে চায়।
তাই চোখ মুখ খিঁচে সে আরিশকে জড়িয়ে ধরে আছে। আরিশ ছাড়াতে পারছেই না। শক্ত করে ধরে আছে লাবণী।
আরিশ দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল আয়শা দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো। তার চোখ থেকে আগুন ঝরছে।
চলবে….
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৬৩.
আরিশ এক ঝটকায় লাবণীকে সরিয়ে দেয়। আয়শা এসেই ঠা’শ করে আরিশের গালে চ’ড় বসায়,
‘ এসব কি আরিশ?’
আরিশ গালে হাত দিয়ে মায়ের দিকে তাকায়,’ মা, যেমনটা ভাবছ তেমন কিছু না। তুমি ভুল ভাবছ।’
‘ আমাকে শেখাতে আসিস না। কবে থেকে চলছে এসব?’
লাবণী আয়শার দিকে এগিয়ে আসে,’ খালামনি, তুমি ভুল ভাবছ। আসলে.. তেলাপোকা দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, তাই…’
আয়শা সন্দিহান চোখে তাকায় দুজনের দিকে। আরিশকে বলল,’ ও কি ঠিক বলছে?’
‘ হ্যাঁ মা, তুমি শুধুই সন্দেহ করলে।’
‘ কিন্তু তুই ওর ঘরে কেন?’
‘ আসলে আমার ডায়রিটা ওর কাছেই ছিল। সেটা নিতেই এসেছি।’
‘ ঠিক আছে, অহনাকে নিয়ে নিচে আয়।’
আয়শা আরেক তরফা ওদের দিকে তাকিয়ে প্রস্থান করল। আরিশ লাবণীকে একবার পর্যবেক্ষণ করে চলে গেল। পেছন থেকে কয়েকবার ডাকল লাবণী, আরিশ সাড়া দেয়নি।
বারান্দা পেরুতেই রুমি দেখতে পায় পাশের ঘর থেকে মিউজিকের শব্দে আসছে। এই বাড়িতে কেউ কখনো লাউড স্পিকারে গান বাজায় না, রুমি সেটা জানত। হঠাৎ এমন সাউন্ড শুনে সে দেখতে যায় বিষয়টা। ঘরটাতে উঁকি দিতেই কাউকে দেখতে পায় না। ভেতরে প্রবেশ করে। পা টিপে টিপে চারিদিকে দেখে। কাউকেই চোখে পড়ছে না। কার ঘর এটা, তাও জানা নেই। ঠোঁট বাঁকা করে ঘরে থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই একটি শক্তপোক্ত পুরুষালী হাত তাকে টেনে নিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ধরে। চিৎকার করার আগেই তার মুখ চেপে ধরে।
রুমি চোখ বড় বড় করে দেখতে পেল মতিকে। সে তার বাহু দ্বারা সম্পূর্ণভাবে আবদ্ধ করে রেখেছে রুমিকে। মতি তার লালসার দৃষ্টিতে কয়েক পল দেখে নিতেই তার ঘাড়ে ঠোঁট দিল। মুহুর্তেই নিজেকে আবার সরিয়ে নিল। হাত দিয়ে দেয়ালে আ’ঘাত করে,’ তুমি আমার ঘরে কেন?’
রুমি ছাড়া পেয়ে প্রাণভরে শ্বাস নেয়,’ এই যে মশায়, আর একটু হলে আমার প্রাণপাখি পটল তুলতে যেত। এভাবে কেউ কারো উপর অ্যাটাক করে বুঝি?’
‘ ওয়ান সেকেন্ড, তুমি কি আমাকে দেখতে এই ঘরে এসেছিলে?’
‘ আমার বয়েই গেছে। গানের শব্দ শুনে এসেছিলাম।’
‘ আসলে আমি গান প্লে করে গোসল করতে যাই।’
রুমি মতিকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল উপর থেকে নিচ পর্যন্ত। এতক্ষণ খেয়াল করেনি মতি খালি গায়ে একটা টাওয়াল পরে ছিল। লজ্জায় লাল হয়ে আসে রুমির গাল দুটো। সে কখনো কোনো পুরুষকে এমন অবস্থায় দেখেনি। রুমি খেয়াল করে, মতির বুক বেয়ে বিন্দু বিন্দু পানি ঝড়ে পড়ছে। মাথার চুলগুলো ভিজে চোখের কিছু অংশ ঢেকে নিয়েছে। জিমধরা বডি দেখে রুমি নিজের চোখ ঢেকে নেয়,’ দূরে সরুন। আপনার লজ্জা নেই।’
মতি নিজের দিকে তাকিয়ে আরেকবার রুমির দিকে তাকায়,’ কেন, কি হয়েছে?’
‘ টাওয়াল পরে কেউ এভাবে দাড়িয়ে থাকে?’ বলেই রুমি পেছনে ফিরে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায়। মতি তার সামনে এসে পথ আটকায়,’ উহুম, তুমি যেতে পারবে না।’
‘ কেন?’
‘ আমি এখনো পারমিশন দেইনি। আমার ঘরে আসে সবাই নিজের ইচ্ছায় আর যায় আমার ইচ্ছায়। সো, তোমাকেও আমার পারমিশন নিয়েই বের হতে হবে।’
‘ আমি এখন বের হব, দেখি কিভাবে আটকান!’
মতি তার হাত চেপে ধরে,’ যেতে তুমি পারবে না।’
রুমি মনে মনে বলল,’ নির্ল’জ্জ, খচ্চ’র, চেঙ্গিস খান লাজ ল’জ্জা আমার হাতে তুলে দিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। ল’জ্জা পাওয়ার কথা তার, আমার কেন পাচ্ছে? ছেড়ে দে না হয় তোর এই বডি দিয়ে অমলেট বানাব।’
‘ কিছু বললে?’ মতির সন্দিহান উক্তি।
‘ কিছু না। আমাকে যেতে দিন। আমার এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে।’
‘ ভুলতো করেই ফেলেছ, এবার তার প্রায়শ্চিত্ত করবে তুমি।’
‘ হোয়াট? কিসের জন্য কিসের প্রায়শ্চিত্ত করব আমি?’
মতি রুমিকে ছেড়ে দেয়। হঠাৎ তার শরীরে বিদ্যুতের শক লাগে। নিজেকে সামলাতে অনেকটা সময় নিয়ে নেয় সে। রুমি অবাক হয়,’ কি হয়েছে আপনার?’
‘ আই এম এক্সট্রিমলি স্যরি।’
‘ স্যরি কেন?’
‘ আমি কিছু একটা ভুল করে বসার আগে এই ঘর থেকে চলে যাও।’
‘ কিন্তু…’
‘ কোনো কিন্তু নয়। চলে যেতে বলেছি।’
রুমি আর এক মুহূর্তও দেরি না করে চলে যায়। সবকিছু তাঁর কাছে অদ্ভুত লেগেছে। মতির সম্পর্কে হাজারটা খারাপ কথা সে শুনেছে কিন্তু আজ তাকে দেখে ততটাও খারাপ মনে হচ্ছে না। গায়ে তার অসংখ্য ক্ষতের চিহ্ন দেখে রুমির খুব মায়াও হয়েছিল।
মতি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বিছানায়। মেয়েদের প্রতি তার যে আসক্তি, সে সেটা কমিয়ে আনতে পারছে না। জেলে থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর কখনো কোনো মেয়েকে সে টাচও করবে না। সব মেয়েদের মা মনে করবে। গার্লফ্রেন্ডের বয়সী মেয়েকেও সে মায়ের মত মনে করবে। কিন্তু স্বভাব বদলাতে সময় লাগে। রুমিকে দেখেই তার কামনা জাগ্রত হয়েছিল। কিন্তু সে নিজেকে দমন করে নিয়েছিল।
লাবণী নিজের ঘরে বসে কেঁদে উঠে। অসহায়ের মতো মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। আবার নিজেকেই প্রশ্ন করে,’ কার উপর রেগে আছিস লাবণী? যে কিনা তোর রাগ আছে কিনা সেটাও জানে না।’
আবার নিজেকেই বলল,’ রাগতো মানুষের তার সাথে কথা উচিত, যে রাগ ভাঙায়। অভিমান তার সাথেই করা উচিত, যে অভিমানের পেছনে ভালোবাসা বুঝে। সেই ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য সে অভিমান ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে।
কিন্তু আমার তেমন কিছুই নেই। সো, অভিমান করা যাবে না।’ বলেই আয়নায় তাকিয়ে একটা হাসি দিল। নিজেকেই নিজে বলল,’ সবসময় হাসবে, কারণ হাসিতেই তোমাকে সুন্দর লাগে বেশি। পেঁচার মতো মুখ করেছ তো আর সুন্দর লাগবে না।’
ইরার বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিল কিছুদিন আগে। তাই ইরার মন রাখতে আরিশ এবং অহনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সকাল সকাল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুজন। বিয়ে বাড়ির গমগমে পরিবেশ অহনার অনেক ভালো লাগে। মাহতিম তার পাশে পাশেই ছিল।
হঠাৎ হ্যারি এসেই অহনাকে বলল,’ একটা বিষয় ভেবে পাচ্ছি না। এমন সময় এটা বলা ঠিক হবে কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না।’
অহনা রয়েসয়ে বলল,’ কি হয়েছে সেটা বল?’
‘ ড্রেককে অনেকদিন খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় গেছে সে। শেষবার বলেছিল ট্যুরে গিয়েছে। কিন্তু খবর নিয়ে দেখলাম সে তার শেষ লোকেশন আমাদের সাথে কাটানো সময়টা। ভার্সিটি প্রাঙ্গনে আমরা পার্টি করেছিলাম। এরপরদিন থেকে আর তাকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু পরদিন সে বলেছিল সে ট্যুরে ছিল। মূলত তার অস্তিত্বই ছিল না। হঠাৎ গায়েব। থানায় ডায়রি করা হয়েছিল। তারাও কোনো খবর পায়নি। চিন্তা হচ্ছে খুব।’
অহনার কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সেতো সবটাই জানে। কিন্তু বলে দিলে সবাই তাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। অহনা বলল,’ এসে যাবে। খুব শিঘ্রই। ইরার বিয়ের হয়ে যাচ্ছে, আমাদের এখন যাওয়া উচিত আসরে।
সন্ধ্যায় অনেক ক্লান্ত হয়ে যায় অহনা। ইরার বিয়ের শেষ দিকে আসতেই তার মাথা চক্কর দেয়। সে মনে করতে পারছে না কেন এমন হচ্ছে? চারিদিক ঝাপসা দেখতে থাকে।
অহনা যখন জোস নিচ্ছিল তখন একটা ছেলে তার জোসে কিছু মিশিয়ে দেয়।
ওয়াইন খাচ্ছিল ছেলেটি। অহনাকে সাধলেও সে না করে দেয়। আরিশ এসে বাঁধা দেয়। ছেলেটি বার বার বিরক্ত করতে থাকে। এক পর্যায়ে আরিশ তাকে চ’ড় মে’রে বসে। রাগে গজগজ করতে করতে ছেলেটি চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে যায়,’ দেখে নেব তোকে আর এই সুন্দরীকেও।’
অহনা ঢুলতে থাকে। আরিশের সাথে দেখা হয় আমিনুলের। কিছু কেস নিয়ে তারা ডিসকাস করতে থাকে। এমন সময় ছেলেটি নাক পর্যন্ত ক্যাপ লাগিয়ে অহনাকে জোস সার্ভ করে। অহনা সেটা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর নেশালো হয়ে পড়ে।
মাহতিম অহনার সাথেই ছিল। ছেলেটির এমন কার্যকলাপ দেখে তার মাথায় র’ক্ত চড়ে বসে। এত লোক সমাগমের মাঝে মাহতিম কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয় না। সময়ের অপেক্ষা করে।
ছেলেটি অহনাকে আস্তে আস্তে লোক সমাগম থেকে দূরে নিয়ে যায়। ইরাদের বাড়ির পেছনের বাগানে নিয়ে যায়। চোখ দুটো তার স্থির হয়ে থাকে অহনার শীতল চেহারায়।
চলবে….
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৬৪.
সুনসান নীরবতায় গ্রাস করা অন্ধকার বাগানটা ক্রমশ আরো কালো হয়ে আসে। ছেলেটির নাম জিসান।
তৃপ্তির এক হাসি দিয়ে সে অহনার বুকের উপর থাবা বসানোর আগেই কেউ তাকে ছিটকে দূরে ফেলে দেয়। অহনা চারিদিকটা ঝাপসা দেখে। অস্ফুট স্বরে মাহতিমকে ডাকে।
জিসান আকস্মিক ঘটনায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। চোখ কচলে দেখতে পায় সামনে আবছা কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সম্মুখে এগিয়ে আসে,’ কে রে তুই।’
‘ তোর জম।’ বলেই মাহতিম তার গলা চেপে ধরে।
জিসান মাহতিমের সাথে পেরে উঠছে না। এক পর্যায়ে মাফ চায়। তখনি আরিশ চলে আসে। সে জিসানকে ছেড়ে দিতে বলে।
মাহতিম কিছুক্ষণের জন্য টের পেল তার শক্তি ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে। তাই সে ছেড়ে দেয় জিসানকে। আরিশকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ আমি আহিকে নিয়ে যাচ্ছি এখান থেকে, আপনি বিয়েটা শেষ করেই আসুন। না হয় ইরা আপনাদের দুইজনকেই মিসিং দেখলে খুঁজবে।’
‘ ঠিক বলেছেন।’ আরিশ চলে যায়।
মাহতিম অহনাকে নিয়ে আরিশের বাড়ি আসে। অহনার চারপাশ ঘুরছে। তাই সে মাহতিমকে জড়িয়ে ধরে,
‘ তুমি দেখতে পাচ্ছ?’
অহনার কথায় চারিদিকে দেখে মাহতিম।
‘ কি দেখব?’
‘ ঘরটা ঘুরছে। ঐ দিকে দেখো, আলমারিটাও ঘুরছে।’
‘ ওসব কিছু না, তুমি শুয়ে পড়ো।’
‘ আগে এগুলো থামিয়ে দাও। আমার মাথা ব্যথা করছে এগুলোকে ঘুরতে দেখে।’
‘ মাথা ব্যথা নয়, ওদের সাথে সাথে তোমার মাথাও ঘুরছে।’
‘উহুম, আমি ঠিক আছি।’
অহনা ঢ্যাবঢ্যাব করে মাহতিমের দিকে তাকায়। চোখের পলক ফেলে আবার তাকায়,
‘ তুমি কি তিনটা মাহতিম?’
মাহতিম ওকে বলল,’ তুমি শুয়ে পড়ো। এখন তোমার কন্ডিশন ঠিক না।’
‘ উফফ্! আমার এই সকালবেলা ঘুম পায়নি যে এখন শুয়ে পড়বো। তোমাকে খুব ভালো লাগছে আমার। এভাবেই আমার সাথে থাকো।’
মাহতিম কি করবে এই মুহূর্তে। ভেবেও কিছু পাচ্ছে না। নেশার ঘোর কাটতে কিছুটা সময় লাগবে। ভাবছে, বুদ্ধি করে যদি রুমিকে সাথে নিয়ে আসত, তাহলে ভালো হতো।
অহনা মাহতিমের গাল টেনে বলে,’ তোমার মিষ্টি গালগুলো খুব সুন্দর, তুলতুলে।’ বলেই চুমু খেতে যায়।
মাহতিম সামনে এক হাত রেখে বলল,’ নিজেকে সামলাও। রেষ্ট নাও, আমি এখানেই আছি।’
‘ আমার খুব শীত করছে, একটা গরম চুমু দাও।’
মাহতিম বৈদ্যুতিক শক খায়,’ গরম চুমু আবার কেমন?’
‘ উফফ্! কি বোকা তুমি। এটাও জানো না?’
‘ নাতো।’ মাহতিম ভাবছে।
অহনা বলল,’ রান্নাঘরে গিয়ে আগুন জ্বালাও, তারপর খুন্তি গরম করে ঠোঁটে লাগাও। ব্যাস, ঠোঁট গরম হয়ে গেল। এরপর তুমি গরম ঠোঁট দিয়ে তিন ঘন্টা গরম চুমু খাবে আমাকে। যাও তারাতাড়ি।’
‘ এটা আবার কেমন কথা!’
‘ যাও বলছি। আমার গরম চুমু চাই।’
মাহতিম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কি করবে এখন। অহনার কাছ থেকে উঠে যেতেই অহনা আবারো তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,’ উঁহু! যেও না। তুমি চলে গেলেই আমরা খারাপ লাগবে।’
‘ ঠোঁট গরম করব না?’
অহনার চোখ নিভে আসে। ঘুম নেমে আসতে চাইছে। কিন্তু ও বলল,’ আমার ঘুম পাচ্ছে কেন? ঘুমালে তুমি চলে যাবে তাই না?’
অহনার চোখ সজল হয়ে আসে। মাহতিম আশ্বাস দেয়,’ না, আমি যাব না।’
‘ জানো, তোমাকে আমি কত ভালোবাসি?’
‘ কতটা?’
‘ বলব না। তোমাকে কেন বলব?’
মাহতিম হেসে উঠে। অহনা নিজের সজ্ঞানে নেই, কি বলছে কিছু বুঝতে পারছে না। পরে হয়তো এসব জানতে পারলে নিজেও বোকা বনে যাবে। মাহতিম অহনাকে শক্ত করে বুকের সাথে বেঁধে নেয়। পরম শান্তিতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
‘ সারাজীবন এভাবেই থেকো।’
মাহতিম কিছু বলল না। দীর্ঘশ্বাস নিল। অহনা পুনরায় বলল ‘ ঘুম এসে গেলে তোমাকে আর দেখিনা। আমার তখন খুব খারাপ লাগে। সারাজীবন যদি তোমাকে দেখে কাটিয়ে দিতাম?’
আরিশের প্রতি অহনার কোনো আকর্ষণ আছে কিনা মাহতিম তা জানতে চায়। মাহতিম চায় অহনার জীবনটা আরিশের সাথে পূর্ণতা পাক। তাই বলল,’ আরিশের সাথে কেন সারাজীবন কাটাতে চাও না?’
অহনা মাহতিমের বুকে কি’ল বসায়,’ আরিশ তোমার থেকে সুন্দর না, এত ভালোবাসতেও পারবে না।’
‘ কে বলল আমি সুন্দর?’
অহনা মাহতিমের চোখের দিকে তাকায়,’ তোমার এই শ্যামবর্ণ মুখ, নৌকার মতো ঠোঁট, পটলের মত নাক, অন্ধকার ব্রু, খাঁজকাটা থুতনি, পশমভর্তি বুক….’
‘ আর কিছু বলতে হবে না। তোমার মাথা ঠিক নেই।’ মাহতিম অহনাকে থামিয়ে দেয়। এভাবে কেউ কারো চেহারার বর্ণনা দেয়, মাহতিম সেটা অহনার থেকে জানল,বলল,’ যদি এমনটা হয় তাহলে আরিশ ভালো। সে দেখতে সুদর্শন।’
‘ উহুম, সুন্দর হলেই ভালোবাসা যায় না এত বেশি। সে কি আমাকে তোমার মত করে ভালোবাসতে পারবে? সে সুন্দর কিন্তু তোমার থেকে বেশি না। তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। আমার প্রিয়, অনেক ভালোবাসি তোমা….’
অহনা ঘুমে তলিয়ে যায়। মাহতিম ওকে শুইয়ে দেয়। ঘুমন্ত অহনার কপালে চুমু খায়। নিষ্পাপ মেয়েটিকে তার ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করবে না কখনোই। কি করবে সে? ভাবছে বিভোর হয়ে। কোনো উপায় ঠিক বের করবে।
মতি টুংটাং করে গিটারে সুর দিচ্ছে। অহনার জন্য তার ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। জীবনে অনেক মেয়ের সংস্পর্ষে এসেছে সে, কিন্তু অহনাকে স্পর্শ না করেও কামনা করে। অনেকবার ভেবেছে, সব মেনে নেবে। নিজের ভাইয়ের সাথে অহনাকে গ্রহণ করে নেবে। কিন্তু নষ্ট মস্তিষ্ক তাকে বার বার বাঁধা দিচ্ছে। ভেতর থেকে আক্ষেপের সুরে ভেসে আসে।
খুব রাত না করেই ফিরে আসে আরিশ। বিয়ে বাড়িতে হাজারজনের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হিমশিম খায় সে। সবাইকে একই উত্তর দিয়েছে, অহনা আশেপাশেই কোথাও আছে। আসার সময় রুমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করল। আরিশ মৃদু কন্ঠে বলল, তাদের একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে তাই অহনা আগেই বাড়ি ফিরে এসেছে।
মাহতিম অনেকক্ষণ অহনার দিকে তাকিয়ে ছিল। আক্ষেপে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে। আরিশের আসার উপস্থিতি টের পায়। তাই চলে যেতে চাইল কারণ রুমিও হয়তো এসে গেছে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করল ডায়রিটা অহনার টেবিলের উপর। মাহতিম অহনাকে আর কষ্ট দিতে চাইল না। রেখেছিল অহনার দেখার জন্য, যেন সে কিছু হলেও মনে করতে পারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না এটা কোনো কাজে লাগবে। মাহতিম ডায়রিটা হাতে তুলে জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। এটার আর প্রয়োজন মনে করছে না সে।
রুমি অহনার ঘরে আসার সময় খেয়াল করল মতির ঘরের সামনে থেকে গিটারের শব্দ আসছে। ছেলেটাকে প্রচন্ড ভয় পায় রুমি। তবুও ভাবল, একবার উঁকি দিয়ে দেখে আসবে কি করছে! শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে মতির ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ঘরের ভেতরে উঁকি দিতেই মতি তাকে হেঁচকা টানে ভেতরে নিয়ে যায়। রুমি চিৎকার করার আগেই মতি তার ঠোঁটে কিস করে বসে।
রুমি আসার আগেই মতি তার ছায়া দেখেছিল। তাই ওঁৎ পেতে দরজার আড়ালে ছিল।
রুমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। পরক্ষণেই মতি তাকে ছেড়ে দেয়,’ মেয়ে মানুষের আমার ঘরে আসা নিষেধ। কেন আসলে?’
‘ বা’জে, ফা’লতু ছেলে। এটা আপনি কি করলেন?’
মতি মেয়ে দেখলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনা। ভুল করেই বসল,
‘ স্যরি!’
‘ স্যরি রান্না করে স্যুপ খান।’
রুমি কেঁদে দেয়। মতি তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কাঁধে হাত দিতেই রুমি তাকে কষে একটা থা’প্পর মারে,
‘ বেয়া’দবি কি আরো বাকি আছে? আজ পর্যন্ত কোনো ছেলে কখনোই আমাকে টাচ করতে পারেনি। আর আপনি দুবার আমার সাথে নোং’রামি করলেন।’
‘ আমি ভালো হয়ে গেছি। বিশ্বাস করো, কিন্তু কি করে যে আবারো ভুল করে ফেললাম।’
‘ আমি জীজুকে সব বলব। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও না।’
মতি কোনো উপায় না পেয়ে বলল,’ আমার তোমাকে খুব ভালো লাগে। তোমাকে দেখলেই ইচ্ছে করে বিয়ে করেই নিই। মনে মনে বউ ভেবে নিয়েছিলাম। নিজের বউকেতো কিস করাই যায় তাই আমিও তোমাকে করলাম।’
‘ আমি আপনাকে…’ রুমি তেড়ে আসে মতির দিকে। বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মতির উপর। মতি বিছানায় গিয়ে পড়ে। ইচ্ছামতো পিটুনি দেয় রুমি।
এক পর্যায়ে রুমি বলল,’ ছাড়ুন আমাকে, উঠুন।’
মতি এক গাল হেসে বলল,’ মেয়ে মানুষের মা’র খেতেও ভালো লাগে। এমন মা’র প্রতিদিন খেতে চাই।’
রুমি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,’ উঠুন বলছি।’
‘ আমি না, তুমি আমার উপর। উঠলে তুমি উঠবে।’
রুমি অপ্রস্তুত হয়ে মতির উপর থেকে উঠে যায়। বিড়বিড় করে,’ তিতুমীর, খচ্চ’র একটা।’
‘ কিছু বললে?’
‘না।’ রুমি রেগেমেগে বের হতেই মতি বলল,’ তোমাকে সত্যিই আমার ভালো লাগে।’
রুমি থমকে দাঁড়ায়,’অহনাকেও ভালো লেগেছিল কিছুদিন আগে।’
‘ ওকে আমি ছুঁয়েও দেখিনি। ভেবেছি বিয়ের পর সব হবে। কিন্তু সে সুযোগ আর পাইনি। কিন্তু এখন ভুলে গেছি, আমার ভাবী হবে সে।’
মতির কুরুচি এবার রুমির দিকে। রুমি দেখতে সাদামাটা গড়নের। ওকে দেখতে অনেকটা বাচ্চা টাইপের মনে হয়। অনেকটা লম্বা। মতির বাজে মস্তিষ্ক চাইছে রুমির সাথে কিছু করুক। কিন্তু শাস্তি এবং আরিশের কথা মনে হতে থাকে। নিজেকে সংযত করে নেয়। তবুও একটু পরপর নিজের আসল রুপ বেরিয়ে আসে।
রুমির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,’ তোমাকে আমার প্রচুর ভালো লাগে। কত সুন্দর একটা মেয়ে তুমি। নিশ্চয় বয়ফ্রেন্ড বা পুরুষজাতি নামক কিছু একটা তোমার জীবনে দরকার।’
রুমি ভেংচি কেটে বলে,’ আমার কি দেখে আপনার পছন্দ হলো?’
‘ তোমার লম্বা লম্বা পা দেখে।’
‘কিইই!’
চলবে….