#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৫৯.
অহনা মোড়লের সামনে বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকে। উত্তর দিতে পারছে না। মোড়ল পুনরায় বলল,’ তোমার এখানে থাকা উচিত নয়। এখানে তোমার বাবা-মা নেই। কিভাবে একা একা থাকবে? আমার মেয়েটার যদি এমন অবস্থা হতো আমি কি করতাম? তুমিও আমার মেয়ের মতো। ছেলের বউ করে নেব না, নিলে মেয়ে করেই নেব। মেয়ে তার বাবার বাড়ি না থেকে এখানে কেন থাকবে? তুমি চলো মা।’
‘ কিন্তু বাবা আমি নিজেই নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাই। আমি একটা চাকরির করে নেব নিজের জন্য আপনি চিন্তা করবেন না।’
‘ আরিশ, বুঝা ওকে। ওর চাকরি করার কি দরকার? বিয়ের পর সুযোগ পাবে চাকরি করার?’
আরিশ মুখ খোলে,’ ও যদি চাকরি করতে চায় আমি আটকাব না। আমিও চাই ও নিজের পায়ে দাঁড়াক। আমি ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কি করে যাই বাবা?’
‘ তাই বলে, দু’দিন পর বিয়ে আর ও চাকরি খুঁজবে এখন? লোকে কি বলবে? তারা বলবে মোড়লের পরিবার তাদের বউকে দিয়ে চাকরি করায়।’
আরিশ অভয় দিয়ে বলে,’ চিন্তা করো না বাবা। ওর সাবলম্বী হওয়াটা জরুরি। আমি চাই না ও পুরুষশাসিত সমাজের ঘ্লানি টানুক।’
‘ আমি সেটা বলিনি। ও পড়াশোনা করছে, করুক। আমি বাঁধা দিচ্ছি না। আমি বলেছি ও আমার মেয়ে। আমি কি আমার মেয়ের ভরণপোষণ নিতে পারব না? তাকে কি চাকরি করে নিজের আবদার মেটাতে হবে?’
মোড়ল অহনার কাছে অগ্রসর হয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’ চাকরি করার ইচ্ছে হলে করবে, আমি বাঁধা দেব না কখনোই। কিন্তু এখনো তোমার পড়াশোনা শেষ হয়নি। মাত্র শুরু, এই মুহূর্তে কি চাকরি পাবে তুমি? আমাকে যদি নিজের বাবার আসনে বসিয়ে থাকো, তাহলে আমার কথায় আর অমত করো না। তুমি আমার ছোট মেয়ে আদ্রিতার মতোই থাকবে আমার কাছে।’
অহনা আর অমত করল না। মোড়লের মুখের উপর আরেকটা কথা বলার মতো সাহস ওর নেই। অহনা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়,’ ঠিক আছে বাবা।’
‘ তাহলে সব গুছিয়ে নাও! সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে বাড়িতে। আমি বলেছি তোমাকে নিয়েই ফিরব।’
‘ কিন্তু বাবা…’
‘ আর কোনো কিন্তু না, চলো।’
অহনা মাহতিমের দিকে তাকায়। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার মন সাঁয় দিচ্ছিল না অহনাকে যেতে দিতে। মোড়ল বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। মাহতিম আরিশ এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
অহনা একটা কথাও বলল না। তৈরি হয়ে সোজা মোড়লের সাথে রওনা দিল। অল্প একটু রাস্তা, তবুও মোড়ল সাথে করে গাড়ি নিয়ে এসেছে। মোড়লের পায়ের ব্যথাটাও বেড়েছে। ডাক্তার বলেছে বেশি বেশি হাঁটতে, পা কে রেষ্ট না দিলে তা অচল হয়ে যেতে পারে। তাই আরিশ আর অহনাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে মোড়ল হেঁটে যাবে বলে ঠিক করে।
অহনা আরিশ পাশাপাশি বসে আছে। কোনো কথা বলছে না কেউই। আরিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অহনার দিকে তাকায়। অহনার পাশে বসে থেকে আরিশের মনের আক্ষেপটা আরো বেশি ব্যথা দিতে থাকে তাকে। হঠাৎ মাহতিম এসে দুজনের মাঝখানে বসে পড়ল। আরিশ ইতস্তত হয়ে হাসার চেষ্টা করে। মাহতিম লক্ষ্য করেছিল, আরিশ এক ধ্যানে অহনার দিকে তাকিয়ে ছিল। তাই বাঁধা হয়ে মাঝখানে আসে।
মাহতিম আরিশকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ স্যরি ব্রো।’
‘ ইটস্ ওকে!’
মাহতিম কথা বলতে চাইলেও অহনা কোনো কথ বলেনি। সবাই পৌঁছে যায় মোড়ল বাড়িতে।
আরিশ দরজায় কলিং চাপতেই দরজা খুলে গেল। এক সেকেন্ডও দেরি হলো না। আরিশের মা আয়েশার মুখ ফুটে উঠল ভেতর থেকে। বাড়ির সকল সদস্যই ছিল। তার মানে সবাই অহনার আসার অপেক্ষায় ছিল। আরিশের বিষয়টা ভালো লাগে। সে আগে ঘরে ঢুকতেই আদ্রিতা তাকে ঠেলে বাইরে বের করে দিল,’ একদম না। তুমি পরে আসবে, আগে ভাবীকে আসতে দাও।’
আরিশের মুখ লাল হয়ে যায় রাগে। আদ্রিতার কানে ধরে বলল,’ বেশি পাঁকা হয়ে গেছিস তাই না? আমাকে ভেতরে যেতে দে, আমি ক্লান্ত খুব।’
‘ উহুম, আমি যেতে দেব না। আগে আমার কান ছাড়ো তারপর দেখছি।’
আরিশ ওর কান ছেড়ে দেয়। আবারো ভেতরে যেতে চাইলে আদ্রিতা হাত টেনে ধরে,’ আ’ক্কেল জ্ঞান সব ভাবী নিয়ে গেছে নাকি?’
‘ আমার রাগ হচ্ছে খুব। যা বলার সোজা বল।’
‘ ঘটে কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। যাই হোক, সব কথা ছাড়ো, টাকা দাও।’
‘ কিসের টাকা?’
‘ বারে, হবু বউকে বিয়ের আগেই বাড়ি নিয়ে আসলে, টাকা না দিলে ঘরে ঢুকতে দেব না।’
‘ এভাবে টাকা চায় কারা, সেটা নিশ্চয় জানিস তুই?’
আদ্রিতা রাগে ফুঁসতে থাকে। আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলল,’ মা, তোমার ছেলেকে বলে দাও। টাকা না দিলে আজকে ঘরে ঢুকতে পারবে না কখনোই।’
‘ আ, হা, এমন করছিস কেন আদ্রিতা? জায়গা দে, ওরা আর কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। অহনা মা, আসো তুমি আমার সাথে।’
আয়েশা অহনাকে আদিখ্যেতা করে ভেতরে নিয়ে যায়। বড়রা সবাই অহনার সাথে গল্প করতে থাকে। আর ওদিকে আদ্রিতা আরিশকে ভেতরে আসতেই দিচ্ছে না। টাকা না দিয়ে কোনোভাবেই সে ভেতরে ঢুকতে পারবে না। আরিশের কাছে কোনো টাকা নেই এই মুহূর্তে। কিন্তু কে শুনে কার কথা? দরজার সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। দুহাতে চেপে ধরে আছে আরিশের হাত। আরিশ চিৎকার করে মাকে ডাকছে তাকে বাঁচাতে। সবাই অহনাকে নিয়ে ব্যস্ত, কেউ আরিশের দিকে নজর দিচ্ছে না।
এরই মাঝে মোড়ল চলে আসে। মোড়লকে দেখতেই আদ্রিতা থেমে যায়। সুযোগ পেয়ে আরিশও ভেতরে ঢুকে যায়।
কোমরে হাত দিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,’ আমি বুঝতে পারছি না, এই বাড়িতে আমি বলে কেউ কি আছে? আমি যে এই বাড়ির একজন সদস্য সেটা মনে হয় কারো মনে নেই।’
আরিশ কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। পায়ে গটগট আওয়াজ তুলে নিজের ঘরে চলে গেল। সবাই অহনাকে নিয়ে ব্যস্ত। অহনার মিষ্টি চেহারা সবার মন জয় করে নিয়েছে। আদ্রিতা পাশে এসেই বলল,’ ভাবী, আমি তোমাকে আজ থেকে পুতুল ভাবী বলে ডাকব।’
অহনা এতক্ষণ চুপ ছিল। কিন্তু এই ভাবী ডাক তার প্রথম থেকেই সহ্য হয়নি। যাকে বিয়ে করবেই না তার বোন অনবরত ভাবী ডাকছে। অহনা বলল,’ তুমিও খুব মিষ্টি। তবে আমাকে আপু ডাকলেও হবে, ভাবী ডাকতে হবে না।’
‘ উহুম, আমি পুতুল বলেই ডাকব। তোমাকে দেখতে একদম পুতুলের মতো লাগে। কত মিষ্টি তুমি।’
অহনা আর কিছু বলল না। বাড়ির প্রতিটি মানুষ খুব মিশুক স্বভাবের। আরিশের মা, কাকি, চাচাতো ভাই, বোন সবাই অহনার সাথে কেমন একদিনেই মিশে গেছে।
মাহতিম পাশে দাঁড়িয়েই সব দেখছে। দেখল অহনা খুব খুশি এমন একটা জয়েন ফ্যামিলি পেয়ে।
আরিশ ঘরে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। অহনার প্রতি সবার এত এত ভালোবাসা দেখে সে মুগ্ধ সাথে হিংসেও হচ্ছে। কেউ তার দিকে নজরই দিচ্ছে না। অহনাকে সবাই ভালোবেসে ফেলেছে অথচ সে এই বাড়িতে বেশিদিন থাকবে না। সময় হলেই মাহতিম তাকে নিয়ে চলে যাবে। মাহতিম নিজেই আরিশকে বলেছে সে অহনাকে নিয়ে চলে যাবে দূরে কোথাও।
আরিশের মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। বিছানা থেকে গিয়ে তার দিনলিপিটা হাতে নেয়। এখানে সে তার সব কথা লিখে রাখে। কলমের রেষারেষিতে এখন হাজার লাইন লিখতে পারবে সে। কিন্তু সে দুই লাইন লিখতে চায় আজ। বেশি নয়। রাতকে সাক্ষী রেখে কিছু অব্যক্ত কথা লিখতে চায়। আরিশ উঠে গিয়ে জানালাটা খুলে দিল। দীর্ঘ রাত দেখে তার মনটা শান্ত হয়ে যায়। মনে পড়ে অহনাকে যখন প্রথম দেখেছিল। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে ছিল। এখনো তাই করে। দেখার তৃষ্ণা মিটে না। অহনা তাকে ভালোবাসে না বলেও সে ভালবাসে। হয়তো এই মন আর কাউকে দিতে পারবে না। তবে অহনাকেও সে চাইতে পারে না। অহনা কখনোই তাকে ভালোবাসবে না। মিথ্যে নিয়ে টিকে থাকাও যাবে না। আরিশের চোখের কার্নিশে পানি জমা হলো। ডায়রির মধ্যপাতায় লিখল,
‘দীঘল রজনী , প্রেমময় চাহনী_
মিথ্যে আজ, সে ভালোবাসেনি।
ফিরে যদি পাই, তবে চাইনা পুনরায়_
মিথ্যেকে আঁকড়ে, সুখ তবে মরীচিকা!’
সকাল হতেই অহনা দেখতে পায় তার সব জিনিস মোড়ল বাড়িতে আনা হয়েছে। এটা মোটেও পছন্দ হলো না অহনার। কিন্তু কি করবে সেটাও জানা নেই। অহনা নিজের ঘরে চলে যায়। রুমিকে কল করে। দ্রুত তার কাছে আসতে বলে।
আরিশ সজাগ হতেই দেখল সে ইজি চেয়ারেই সারারাত ঘুমিয়েছে। ফ্রেস হয়েই অহনাকে দেখতে যায়। দরজার বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখতে পায় অহনা মুখ গোমরা করে বসে আছে। মাহতিম অহনার কাছে এসেছে থেকে আরিশ সরে যায়।
অহনা রাগ করে বসে আছে, কারণ মাহতিম এখন পর্যন্ত কিছুই করছে না। বিয়েটা হয়ে গেলে সে মাহতিমকে হারিয়ে ফেলবে, অথচ মাহতিমের কোনো ব্রুক্ষেপ দেখতে পাচ্ছে না।
আরিশ মোড়লের কাছে যায়। সে আর এসব সহ্য করতে পারছে না। মোড়ল বাইরে খোলা হাওয়ায় বসে ছিল। আরিশকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে,’ কোথাও যাচ্ছিস নাকি?’
আরিশ কোনো কথা না ভেবে সোজা বলে দেয়,’ বাবা, আমি এই বিয়েটা করতে পারব না। অহনার সাথে অন্যায় করা হবে। কখনোই কারো মনের বিরুদ্ধে তার সাথে বিয়ে করা যায় না। আমি চাই না তিনটা জীবন নষ্ট হোক।’
চলবে….
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৬০.
হাকিম মোল্লা নামক একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে মোড়লের কাছে ছুটে আসে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে,’ কর্তা, আগুন লাগছে। তমরুর পুরো বাড়ি জ্বলে গেছে।’
মোড়ল আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ছুটে যায়। আরিশও পেছন পেছন যায়। আরিশের কথা পুরোপুরি শুনেনি মোড়ল।
মাহতিম অহনার বিছানার পাশে একটা ডায়রী রাখে। ঘুমাতে গেলেই এটা চোখে পড়বে। এমনিতে অহনার কখনোই মনে থাকবে না।
মাহতিম অহনার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়,’ এমন করছ কেন?’
‘ এটাই কি স্বাভাবিক না?’
‘ কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটা অস্বাভাবিক আমি বুঝতে চাই না। তুমি আমাকে এখনই এখান থেকে নিয়ে চলো, দূরে কোথাও গিয়ে আমরা একসাথে থাকব। যেখানে পরিচিত কোনো মুখ থাকবে না।’
‘ এটা সম্ভব না।’
অহনা মুখ ফুলিয়ে বলে,’ কেন সম্ভব না? আরিশের সাথে বিয়ে হয়ে গেলেই কি তুমি খুশি?’
মাহতিম কিছু বলার আগেই খেয়াল করল সে সাইকোকাইনেসিসের ব্যবহার করতে পারছে না। মাহতিম নিজের হাত স্পর্শ করে বলল,’ সময়টা খুব শিঘ্রই চলে যাবে। আমি তোমাকে কথা দিলাম আমরা একসাথে থাকব। কখনো আলাদা হব না।’
অহনা মাহতিমকে জড়িয়ে ধরে। ওর বুকে চুমু খায়। অহনা কাঁদছে। ওর মনে হচ্ছে মাহতিম কিছু লুকাচ্ছে, সত্যিটা বলছে না। ভেতর থেকে কষ্টের আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। মাহতিম দীর্ঘশ্বাস নেয়,’ অন্তর্গহীনের তীব্র ব্যথা উপশম করতে তুমিই যথেষ্ট।’
কেউ আসছে ভেবে অহনা মাহতিমকে ছেড়ে দেয়। নিজেকে সামলে নিয়ে খাটে বসে পড়ে। আদ্রিতা এসেছে,
‘ পুতুল ভাবী, তুমি এখনো ফ্রেস হওনি?’
‘ অনেক আগেই।’
‘ নিচে গেলে না কেন? দেখবে চলো কে এসেছে!’
অহনা উৎসুক হয়ে আদ্রিতার সাথে নিচে যায়। দেখল একটা মেয়েকে ঘিরে সবাই বসে আছে। অহনা অবাক হয়ে সবার সামনে যায়। আয়েশা অহনাকে কাছে ডেকেই বলে,’ লাবণী, দেখ, এই হলো তোর ভাবী।’
লাবণী মাথা তুলে একনজর দেখেই আবার চোখ সরিয়ে নেয়। ছোট করে উত্তর দেয়,’ ওহ্ আচ্ছা! আমি কি নতুন ভাবীর সাথে একটু কথা বলতে পারি?’
আয়েশা বলল,’ পারবি না কেন? ওর ঘরে গিয়ে তোরা কথা বল।’
লাবণী অহনার হাত শক্ত করে চেপে ধরে,
‘ চলো ভাবী, আমরা ভেতরে যাই।’
লাবণীর আচরণ অহনার ভালো লাগেনা। এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়,’ আমি যাচ্ছি।’
অহনার ঘরে এসে দু’জন থামে। অহনা কথা বলার মতো ইন্টারেস্ট পাচ্ছে না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। লাবণী তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,’ বড়লোকের ছেলে পটানোর কাজটা খুব ভালোই করেছ। দেখো, পরিবারের সবাই কেমন তোমার কথাই ভাবে। কি জাদু করেছ বলো তো।’
এমন অদ্ভুত কথা শুনে অহনার রাগ উঠে যায়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,’ তোমার কি মনে হয়? ‘
‘ এই যে রুপের পাহাড় দিয়ে এই বাড়ির দুই ছেলেকেই আয়ত্তে করেছ মনে নেই? ছোট ছেলেকে ধরে কোনো লাভ নেই কারণ সে বাবার টাকায় খায়, নিজের কিছুই নেই। তাই বুদ্ধি করে বড়জনকেও ধরলে?’
‘ মানসিকতার দিক থেকে তুমি অসুস্থ। ডাক্তার দেখাবার ব্যবস্থা করো।’
বলেই অহনা চলে যেতে নিলে লাবণী তার হাত চেপে ধরে,
‘ নিজেকে কি বিশ্ব সুন্দরী এলিজাবেথ মনে করো?’
‘ তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না। আমি এই বাড়ির মেহমান।’
‘ হ্যাঁ ঠিক বলেছ, তুমি এই বাড়ির মেহমান। দেখবে তুমি, আমি কিছুতেই তোমাকে আরিশের সাথে বিয়ে করতে দেব না।’
অহনা চমকে উঠে। দ্বিগুণ উৎসাহে জিজ্ঞেস করল,’ মানে? কি বলতে চাও তুমি?’
‘ আমি আরিশকে ভালবাসি। সেই ছোট থেকেই। শপথ নিয়েছিলাম, আরিশকেই বিয়ে করব আমি। না হলে কাউকেই করব না। কিন্তু তুমি কোথা থেকে এসে উড়ে এসে জুড়ে বসলে।’
অহনা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,’ খুব ভালো। তাহলে তুমিই আরিশকে বিয়ে করো।’
‘ কি বললে তুমি?’
‘, কিছু ভুল বলেছি নাকি? তুমিইতো বললে তুমি আরিশকে ভালোবাসো। ভালোবাসার মানুষদেরই একসাথে থাকা উচিত। অন্যকেউ না।’
‘ তুমি কি বিয়ে করতে চাও না?’
‘ না, আমি অন্যকাউকে চাই।’
‘ কে সে? আরিশ কি জানে এই কথা?’
‘ হুম, ওনি জানে। বিয়েটা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল।’
লাবণী আনন্দে নেচে উঠে। মুহুর্তেই আবার মন খারাপ হয়ে যায়। অহনার দিকে তাকিয়ে নিভু কন্ঠে বলে,’ কিন্তু জানো, আরিশ আমাকে দেখতেই পারে না। আমি ওর জন্য এই বাড়িতে আসি, আর ও আমাকে তার থেকে দূরে থাকতে বলে। ওর ঘরে আসলেও রেগে যায়।’
‘ এমনটা কেন করে?’
‘ কারণ তার আমাকে পছন্দ না।’
‘ এখন মনে হয় তার মন গলবে। তুমি ট্রাই করে দেখতে পারো।’
‘ তুমি অনেক ভালো। তোমাকে আমি শত্রু ভেবেছিলাম প্রথমে। তার জন্য স্যরি!’
‘ কোনো ব্যাপার না। আমরা এখন বন্ধু।’
তারা দুজনেই সকালের নাস্তা খেতে নিচে চলে যায়। লাবণী আরিশের খালাতো বোন। মাঝে মাঝেই ওদের বাড়ি আসে। উদ্দেশ্য আরিশকে দেখা, কাছাকাছি থাকা।
আরিশ, মোড়ল একসাথে আসে। লাবণী আরিশকে দেখে চোখ স্থির করে তাকিয়ে থাকে। আরিশ আসতেই সেও খাবার টেবিলে বসে। পরিবারের সবাই একসাথে দেখে অহনার খুব ভালো লাগে। আদ্রিতা অহনার পাশেই বসেছে। অহনার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,’ দেখো পুতুল ভাবী, ঐ লাবণীর বাচ্চা কি করে আমার ভাইকে জ্বালায়। ও আসলেই আমাদের সব আনন্দ মাটি হয়ে যায়। দেখবে একটু পর।’
‘ এমন কথা বলেনা আদ্রিতা। সেতো তোমার বোন তাই না?’
‘ আচ্ছা আর বলব না। কিন্তু তুমি নিজেই দেখবে বিরক্ত হয়ে গেছ।’
আরিশকে অহনার পাশে বসতে বলে। কিন্তু লাবণী এসেই দুজনের মাঝখানে বসে পড়ে,
আমার খুব খিদে পেয়েছে মামুনি, আমাকে খেতে দাও তারাতাড়ি।’
কেউ আর কিছু বলল না। সবাই বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। খাওয়ার সময় অহনা খেয়াল করল, লাবণী আরিশের খাওয়ার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। তার খাওয়া দেখছে। আরিশ বুঝতে পেরে বলল,’ খাচ্ছ না কেন?’
‘ তোমায় দেখছি।’
‘ কি?’
‘ কিছু না। খাও তুমি।’
‘ এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার পেট খারাপ হবে। নিজের খাবারে নজর দাও।’
মাহতিম চলে গেছে সেই জায়গায়, যেখানে তাকে খু’ন করা হয়েছিল। সে কারো মুখ দেখতে পায়নি। কিন্তু এখন জানে কে তাকে মে’রেছিল। মাহতিম সেখানেই সাইকোকাইনেসিসের অস্তিত্ব খুঁজে। কিছুই পায় না সে। শরীরটাও দিন দিন তার নিজস্ব রূপ ধারণ করছে। পারডিউলেটসও পাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে সে টিকে থাকতে পারবে না। যেকোনো মুহুর্তে তার আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসবে।
চিন্তামগ্ন মাহতিম ফিরে আসে। সাইকোকাইনেসিসের উৎপত্তি এবং পারডিউলেটস্ পেয়ে গেলে সে অহনাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবে।
রুমি আসে অহনার কাছে। বাড়িটাতে তার আপন বলতে কেউ নেই। তাই নিজের বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে।
আরিশ নিজের ঘরে ঢুকতেই পেছন পেছন লাবণী ঢুকে পড়ে। আরিশ তাকে দেখেই ব্রু বাঁকিয়ে ফেলে,
‘ এখানে কেন এসেছ?’
‘ তোমরা ঘরে অনেক ধুলো জমেছে তাই না?’
‘ পরিষ্কার করবে নাকি?’
লাবণী থমথম খেয়ে যায়,
‘ আমি তোমার ঘর দেখতে এসেছি। কেন, তুমি কি রাগ দেখাচ্ছ নাকি?’
‘ এই ঘর কি আর কখনো দেখনি? প্রতিবার আসলেইতো দেখো।’
‘ আজ একটু অন্যরকম লাগছে।’
‘ ঠিক কি রকম লাগছে?’
‘ তোমার সবকিছু মানেই সুন্দর। তুমিও সুন্দর। চলো আমরা বাইরে থেকে ঘুরে আসি, প্লীজ!’
‘ সম্ভব না।’
লাবণীর মনটা ভেঙ্গে যায়। মুখটা তার একদম ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কান্না করে দেয়,’ তুমি কখনোই আমার কথা একটুও ভাবো না। তুমি জানো না আমি তোমাকে কতটা…’ লাবণী থেমে যায়।
আরিশ বলল,’ তুমি সবসময় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করো। এছাড়া কি আর কোনো উপায় পাও না? প্রতিবারই আসলে তোমাকে নিয়ে আমার বাইরে যেতে হয়। কান্না করো কেন বার বার?’
‘ এটাইতো রোলস্।’
‘ কিছু বললে?’
‘ নাতো। আমি বলছি আমার কান্না থামবে না আমাকে নিয়ে বাইরে না বের হলে।’
‘ তুমি যেহেতু কান্না করতেই পছন্দ করো। এবং কান্না করেই সবার দুর্বলতার সুযোগ নাও। ভাবছি আমিও বসে বসে কান্না করি, ঢং করে মুখ বাঁকিয়ে বসে থাকি, ন্যাকামো করি। তাহলে আমার পিছু ছাড়বে তো?’
লাবণী রেগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে,’ আমি রাগ দেখাব, ন্যাকামো করব, ঢং করব, কাঁদব। এটা আমার মৌলিক অধিকার। তাই বলে তুমি কেন এসব করবে? কক্ষনো না। মেয়েরা ন্যাকামো করবেই, করতেই হবে তাকে। গম্ভীরতা ছেলেদের মানায়, মেয়েদের না। ন্যাকামো ছাড়া মেয়ে আর কলাগাছের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমি ন্যাকামো করব, হাজারবার, শতবার করব। তুমি খালি চেয়ে চেয়ে দেখবে।’
আরিশ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে,’ বোন রে, আমার কাছ থেকে চলে যা। আমি খুব ক্লান্ত, একটু বিশ্রাম নিতে দে।’
‘ তাহলে আমিও বিশ্রাম নিই।’
‘ হ্যাঁ, তাই কর।’
লাবণী এক লাফে গিয়েই আরিশের বিছনায় গিয়ে বসে। আরিশ ব্রু কুঁচকে ফেলে,
‘ এটা কি করছ তুমি?’
‘ তুমিইতো পারমিশন দিলে বিশ্রাম নিতে।’
‘ আমার বিছানায় কেন? এখানে আমি থাকব।’
‘ সমস্যা নেই। আমি তুমি একসাথে থাকতে পারি। খাটটা অনেক বড়। হয়ে যাবে দুজনের জন্য।’
লাবণী পা ছড়িয়ে আরিশের খাটে শুয়ে পড়ে।
আরিশ লাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,’ শয়’তান যখন আমার সামনে ঘেঁষতে পারে না, তখন তোমাকে পাঠিয়ে দেয় আমার মগজ সাবার করার জন্য।’
চলবে…
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৬১.
আদ্রিতা এসে অহনার পাশে বসে। দুটো চকলেট দু’হাতে। একটি অহনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,’ তুমিও মনে হয় চকলেট প্রেমী তাই না?’
অহনার ধীর স্থিরভাবে বলল,’ না, আমি চকলেট ততটা পছন্দ করি না। তবে আইসক্রিম লাভার।’
‘ উহুম! যারা বেশি কিউট হয় তারা চকলেট লাভার হয়। তারা চকলেটের মতোই কিউট। যেমন আমি, কত কিউট। তবে তোমার থেকে বেশী না।’
‘ কে বলল আমার থেকে বেশি না? তুমি অনেক অনেক কিউট, আমার থেকে হাজার গুন।’
‘ তাহলে আর্মি অফিসার আমাকে পছন্দ করবে তো?’
অহনা হেসে বলল,’ কোন আর্মি অফিসার?’
‘ উফফ্! বুঝোনি? আমার অনেক প্রিয় একটা স্বপ্ন, আমি একজন আর্মি অফিসারকে বিয়ে করব।’
অহনা হাসল,’ বাহ, ভালো তো। আর্মি অফিসারদের তোমার খুব ভালো লাগে তাই না? আমারো ভালো লাগে।’
আদ্রিতা ঢ্যাবঢ্যাব করে অহনার দিকে তাকায়,’ আমার ভাইয়া আর্মি অফিসার না।’
‘ তাতে কি হয়েছে?’
‘ তার মানে ভাইয়াকে তোমার পছন্দ না। তুমি কি নিজের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করছ?’
‘ আরে না। আমি শুধু আমার ভালো লাগা বলেছি। তুমি বলো, আর্মি অফিসারের কি কি গুন থাকলে তুমি তাকে বিয়ে করবে?’
‘ প্রথমত তাকে একজন দেশপ্রেমিক হতে হবে। দেশের জন্য আমাকে মে’রে ফেললেও আমি রাগ করব না। কারণ তার দেশপ্রেম থাকতে হবে। টাকা পয়সা যখন তখন সবার হাতে আসে। তাই তার আহামরি টাকা না থাকলেও চলবে। শ্যামবর্ণ হতে হবে। ঠোঁট কালো থাকা যাবে না। আমার থেকে কিছুটা বড় হতে পারবে, যেমন এখন তার বয়স হতে হবে বাইশ বা তেইশ। যেহেতু আমার পনেরো। আমার সকল আবদার পূরণ করতে হবে। তার সামর্থ্য নেই এমন কিছু আমি চাইব না। তবুও আমাকে খুশি করতে হবে তাকে। এইটুকুই!’
মহৎ চিন্তাভাবনা। কিন্তু একটা কথা বুঝলাম না, ঠোঁট কালো থাকা যাবে না কেন?’
আদ্রিতা লজ্জামাখা মুখে বলল,’ কিছু না।’
‘ না, বলো। কালো হলে কি হবে?’
আদ্রিতা এক আকাশ লজ্জা নিয়ে বলল,’ কালো হলে চুমু খেতে পারব না।’
বলেই এক দৌড়ে অহনার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রুমি সাথে বসেই কথোপকথন শুনছিল,
‘ কি বি’চ্ছু মেয়ে। বলে কিনা কালো ঠোঁটে চুমু খেতে পারবে না।’
রুমি পুনরায় বলল,’ আমার মনে হয় একজনের এই সব গুন আছে, শুধু একটা ছাড়া।’
অহনা দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে বলল,’ কে সে?’
‘ হ্যারি। ও কখনো সিগারেট খায় না। তাই ঠোঁট সুন্দর। কিন্তু সে আর্মি অফিসার না।’
‘ হতে তো পারে।’
‘, এটা মন্দ না।’
মাহতিম আজও সাইকোকাইনেসিস আর পারডিউলেটস্ এর সন্ধান পাচ্ছে না। তার আবছা মনে পড়ে, যখন তাকে মে’রে ফেলা হয়েছিল তখন কিছুক্ষণ পর কেউ তার পাশে এসেছিল। কিন্তু সে কিছুই মনে করতে পারছে না। কেউ একজন ছিল সেখানে, যে তাকে প্রতিশোধ নেওয়া এবং ভালোবাসা পাবার সুযোগ করে দিয়েছিল। মাহতিম অনেক খুঁজেও কাউকে পায় না। শুধু এতটুকুই মনে আছে পারডিউলেটস্ তাকে দিন দিন আরো অদৃশ্য করে দেবে। মনুষ্য স্পর্শে আসলে সে প্রতিনিয়ত দুর্বল হয়ে যাবে। আর তখনি তার সাইকোকাইনেসিসের সব শক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। কেউ এসব বলেছিল। কিন্তু মানুষটাকে তার মনে নেই। সেও ছায়া হয়ে ছিল।
মাহতিম আরিশের কাছে আসে। আরিশ বাংলোতে শুয়ে ছিল। আজকাল সে খুবই বিষন্ন থাকে। তাই এখানে এসে শুয়ে থাকে।
মাহতিমকে দেখে আরিশ হাসি মুখে উঠে বসে। আরিশ বলল,’ হঠাৎ এখানে কেন আসলেন?’
‘ আপনার একটা সাহায্য চাই আমার।’
‘ বলুন। আপনার জন্য সব করতে পারি।’
‘ পারডিউলেটস্ সম্পর্কে জানতে চাই এবং সাইকোকাইনেসিসের উৎপত্তি সম্পর্কে।’
আরিশ তার ল্যাপটপ নিয়ে বসে। অনেকক্ষণ পর বলল,’ সাইকোকাইনেসিসের ধারণা করা যায় কিন্তু বৈজ্ঞানিক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর পারডিউলেটস্ বলতে কিছু নেই। এটা সম্পূর্ণ নতুন শব্দ, এমন শব্দও আবিষ্কার হয়নি এখনো। এর সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না।’
মাহতিমের আত্মা কেঁপে উঠে। দেয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে যায়,’ তার মানে, আমি আর বেশি দিন থাকতে পারব না। এখানেই আমার গন্তব্য শেষ? আরিশ, আপনি কিছু করুন। আমি চাই না ইনভিজিবল হয়ে থাকতে। আমি একটা সুন্দর জীবন চাই, যার প্রতি মুহুর্তে আহির ছোঁয়া থাকবে।’
‘ আপনিতো একটা আ’ত্মা। আমি কখনো আপনাকে এই নিয়ে কিছু বলিনি কারণ আমি আপনার কথার বিরুদ্ধে যাব না। আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি।’
‘ আপনার বলা উচিত ছিল। আমি জানি না, কে আমাকে এই শক্তিগুলো দিয়েছে। দৈব কেউ আমার পাশেই ছিল, যাকে আমি দেখতে পাইনি।’
‘ আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি।’
‘ আমি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি। আমার মৃ’ত্যুর পর কেউ এসেছিল। দৈব কেউ হবে। যার কোনো অস্তিত্ব নেই সাধারণের মাঝে। সে আমাকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শরীরে কিছুক্ষণের জন্য পারডিউলেটস্ দিয়েছে এবং সাইকোকাইনেসিসের সব শক্তি দিয়েছে।’
‘ কে হতে পারে?’
‘ অন্তত সে মানুষ নয়। কোনো জ্বীন হবে।’
‘ তার মানে আপনি মৃ’ত। যেটা আমি আগেই অনুমান করেছিলাম।’
মাহতিম আর কিছূ ভাবতে পারছে না। বুক চিঁড়ে তার আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। চোখের জল অনর্গল বয়ে নামে। আরিশ তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। প্রতিশোধতো নিয়ে নিল, কিন্তু ভালোবাসা সে আর পাবে না। নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রতি ধিক্কার জানায়।
তখনি খুব বাতাস বইতে থাকে। বাইরে থেকে জানালাগুলোও কেঁপে উঠে। আরিশ পর্দা টেনে জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। ঘরের সব লন্ড-ভন্ড হয়ে যায়। এদিক-ওদিক সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। আরিশ ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে বারি খায়। মাথা ফেটে গেছে অনেকটা।
মাহতিমকে এই হাওয়া কিছুই করতে পারছে না। তার কান্নার শব্দ এতোটাই জোড়ালো ছিল যে, বাইরের কোনো কিছুই তার কানে যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পরেই একটি জ্বীনের আবির্ভাব হয়। আরিশের হৃৎপিণ্ড কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে যায় এমন জিনিস দেখে। এমন ভয়ানক রূপ সে কখনো দেখেনি। বুকে হাত দিয়ে দেখে স্পন্দন থেমে গেছে কয়েক সেকেন্ডের জন্য। হুঁশ ফিরতেই সে মাহতিমের কাছে যেতে চায়। কিন্তু সে এক চুলও নড়তে পারেনা নিজের জায়গা থেকে।
মাহতিম উপরে তাকায়। এমন ভয়ানক এক মুখশ্রী দেখে সে দাঁড়িয়ে যায়।
‘ তোমার এই চোখের পানি আমাকে আসতে বাধ্য করেছে। কি হয়েছে তোমার?’
জ্বীনের এমন এমন কথা শুনে মাহতিম অবাক হয়ে যায়। কন্ঠটা তার চেনা মনে হয়, বলল,’ আপনি কি সেই, যে আমাকে এই শক্তি দিয়েছিলেন।’
‘ হ্যাঁ!’
‘ কেন দিয়েছিলেন? সেদিন মরে গেলেই আমার জন্য ভালো ছিল। দ্বিতীয় জীবনে এতটা কষ্ট পেতাম না।’
‘ তোমার উদ্দেশ্যের জন্য তোমাকে পাঠানো হয়নি। তোমাকে পাঠানো হয়েছিল এই দেশকে বাঁচানোর জন্য। এই পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য বা নিজ দেশকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ কাউকে না কাউকে পাঠায় সবসময়। তোমাকে যখন হ’ত্যা করা হয়েছিল তখন আমি উপস্থিত ছিলাম না। কিছুক্ষণ পর ওপাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলাম। বুঝতে পারলাম এই দেশের তোমাকে দরকার। ততক্ষণে তোমার প্রাণ চলে গিয়েছিল। আমি আমার সম্পূর্ণ শক্তি তোমার শরীরে প্রয়োগ করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এটা তোমার দরকার। এবং জেগে ওঠার আগেই আমি কিছু কথা তোমরা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। এখন তোমার কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এবার তোমাকে যেতে হবে। আমি আমার সব শক্তি নিয়ে নেব আর তোমার কোনো অস্তিত্ব কখনো ছিল না, থাকবেও না।’
‘ না, আমি যেতে চাই না। আমি আমার আহির সাথে সারাজীবনটা কাটাতে চাই।’
‘প্রাণহীন হয়ে কিভাবে তুমি থাকবে তার সাথে? তুমি মারা গেছ, আমার একটা রূপমাত্র তুমি।’
‘ জ্বীনেরা খারাপ হয়। সে দেশকে বাঁচানোর জন্য এসব করেছে আমার বিশ্বাস হয় না।’
‘ সব মানুষেরা যেমন খারাপ হয়না, তেমনি সব জ্বীনেরাও খারাপ হয় না। ভালো খারাপ মিলেই সৃষ্টিজগত। মৃ’ত্যুর পর কারো ফিরে আসার অবকাশ নেই। তোমরা ভাগ্য, তুমি আবার কিছু সময় পেয়েছ।’
‘ আমি এটা মানতে পারব না। আমি আহিকে চাই। ওর জন্যই আমি বেঁচে থেকে শান্তি পাই। আমার কোনো কিছুই নেই এই পৃথিবীলোকে। যদি আহিকেও না পাই তাহলে আমি মরে গিয়েও শান্তি পাব না।’
‘ ঠিক আছে। পারডিউলেটস্ এর মেয়াদ পর্যন্ত তুমি সুযোগ পেলে। এই সময়টা তুমি তোমার সেই প্রিয় মানুষটার সাথে কাটাতে পারো। কিন্তু এরপর চলে যেতে হবে।’
‘ না, আমি…’
মাহতিমের পুরো কথা না শুনেই জ্বীনটা চলে যায়। আরিশ। এসে তাকে ধরে। মাহতিম চিৎকার দেয়। বুকটা তার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। আর বেশিদিন তার সময় নেই। জানার পর মনের ভেতরটা তার বিষিয়ে উঠেছে। আরিশকে জড়িয়ে ধরে,’ ভাই আমার ভাই, আমি হেরে গেলাম। আমি কি সত্যি আহিকে সবসময়ের জন্য পাব না? কিছু করুন ভাই আমার। আমি আর পারছি না এর কষ্ট সহ্য করতে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার। আমার আহিকে ছেড়ে কি করে থাকব আমি? আমি পারব না কিছুতেই। আমি ম’রতে চাই না ভাই। আমাকে বাঁচিয়ে নিন। আমি আহিকে ছেড়ে ম’রতে পারি না।’
আরিশ তাকে শুধু বলতে পারল,’ সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি শান্ত হোন।’
মাহতিমের কান্নার স্রোত বয়েই চলেছে। তার চোখের সামনে পুরনো সময়গুলো ভেসে উঠে। কিছুদিন আগের সময়গুলোও মানসপটে আবৃত হতে থাকে। কত ভালোবাসা, কত বিশ্বাস, কতটা চওয়া। সব ছেড়ে কিভাবে যাবে? এত কষ্ট কেন হচ্ছে তার? বুকে ব্যথা অনুভব করে মাহতিম। সেদিকে নজর নেই। ভেতরের আক্ষেপ তার এর কষ্ট থেকেও বেশি। চিৎকারের ধ্বনি প্রকম্পিত হতে থাকে আকাশ জুড়েও।
চলবে….