ছায়া মানব পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0
954

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৪৭.
আরিশ জয়ন্তর সাথে দেখা করে আসার সময় রাস্তায় দেখতে পায়, একজন লোক তার স্ত্রীকে খুব মা’রছে। আরিশের চোখ মুখ লাল হয়ে আসে। লোকটার কাছে গিয়েই কষে গালে কয়েকটা থা’প্পর মারে। লোকটা আরিশের শক্তির কাছে নেহাত বাচ্চা। মুখে তার বিশ্রি গালি,’ মা* কে রে তুই?’

আরিশ তার মুখ বরাবর আরেকটা ঘু’ষি দেয়,
‘ যে নিজের স্ত্রীকে সম্মান করতে পারেনা তার বেঁচে থাকার অধিকার আছে বলে আমার মনে হয় না।’

বিশ বছরের হবে মেয়েটি, যে মুখ বুজে সহ্য করছিল লোকটির অত্যা’চার। কোলে তার ছয় মাসের একটি বাচ্চা। আরিশের কাছে হাতজোড় করে বলছে,’ দোহাই লাগে, ওনাকে ছেঁড়ে দিন। আর মার’বেন না।’

আরিশ মেয়েটিকে এক নজর দেখে বলল,’ যে এতক্ষণ ধরে তোমার উপর জুলুম করছিল, তুমি তাকেই বাঁচাতে চাইছ?’

‘ কি করব সাব? দুই কূলে আর কেউ নাই। ও আমাকে মা’রুক কাটুক, তবুও আমার স্বামীতো। ওর কিছু হলে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?’

লোকটি তেড়ে আসে আরিশের দিকে,’ আমার ব‌উকে আমি যা ইচ্ছা করব, তাতে তোর কি? চলে যা এখান থেকে। আমাদের বিষয়ে নাক গলাতে আসবি না।’

‘ এভাবে তো কোনো পশুও কাউকে আ’ঘাত করে না। আর তুইতো মানুষ। কেন এমন করছিস মেয়েটার সাথে?’

‘ তাতে তোর কি?‌ ওকে বললাম দুই লাখ টাকা আনতে বাপের বাড়ি থেকে, আনল না কেন?’

মেয়েটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,’ বাপ মাতো কবেই ত্যাগ করেছে আমাকে। তাদের কথা না শুনে তোমার হাত ধরে এসেছিলাম। এখন কোন মুখে তাদের কাছে যাব। তারাতো আশ্রয় টুকুও দেবে না থাকত টাকা।’

আরিশ পুলিশ কল করে। এর আগে লোকটাকে আরো কয়েক ঘা দিয়ে দেয়। যেন পরবর্তীতে কোনো মেয়ের গায়ে হাত তুলতে তার হৃদয় কেঁপে উঠে। এতো মার খেয়েও লোকটা এখনো জিজ্ঞেস করে,’ কে তুই? আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কেন নিজেকে জড়ালি? তুই জানিস না আমার হাত কত লম্বা। আমি বললেই এখন হাজারজন তোকে কুটিকুটি করে ফেলবে।’

আরিশ মুচকি হেসে পকেট থেকে একখানা কার্ড বের করে। একজন সিআইডি অফিসারের কার্ড দেখে লোকজন পেছনে সরে আসে। লোকটা সাথে সাথেই তার পায়ে পড়ে কেঁদে উঠে,’ স্যার, মাফ করে দিন। আর কখনো এমন ভুল করব না। ব‌উকে ভালোবাসবো। আর কখনো টাকার জন্য তার উপর মা’রধর করব না। ‘

পুলিশ এসে হাজির হয়। আরিশ কাঠকাঠ গলায় বলে দেয়,’ দু’মাস তাকে জেলে রাখবে‌। এত মারবে যেন রিমান্ডকেও হার মানায়। পরবর্তীতে যেন আর কখনো নিজের স্ত্রী বা অন্য কারো গায়ে হাত তুলতে সাহস না পায়। মারলে কেমন লাগে সেটা তার বুঝা উচিত।’

এটা বলেই আরিশ মেয়েটির নিকট যায়। একটা কার্ড স‌ই করে বলল,’ আশা করি এই টাকা দিয়ে তোমার দুই মাস চলে যাবে। নাম্বারটা দিয়ে দিলাম, কখনো কোনো সাহায্য লাগলে জানাবে।’

পুরো তল্লাটে কেউ এমন কাউকে দেখেনি যে এভাবে প্রতিবাদ করবে। আরিশকে পেয়ে যেন সবাই মুগ্ধ। কিছু কিছু চো’র, ধান্দা’বাজ ভীড়ের মধ্যে‌ই ছিল। তারাও সচেতন হয়ে গেল।

ইরা, রুমি, অহনা রান্নাঘরে কাজ করছে। কেউ রান্না করাটা তেমন জানে না। বিকেলের নাস্তা তৈরি করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। দুপুরে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। এখন ব্যবস্থা করতেই হবে‌। অথচ কেউই রান্না পারে না। অহনা আটার পাত্রটা নামাতে গিয়ে পুরোটা পড়ে গেল তার নিজের শরীরে। মাহতিম হাসছে দেখে আরো রেগে উঠল অহনা। পরিষ্কার করার জন্য নিজের ঘরে চলে যায়। পেছন পেছন যায় মাহতিম।

অহনা পোশাক পরিবর্তন করছিল, মনে মনে গালি দিচ্ছিল নিজেকে অকর্মা বলে। এমন সময় দেখল মাহতিম দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রাগে বেলুনের মতো ফুলে উঠে অহনা,
‘ তুমি বিনা অনুমতিতে কেন ডুকেছ? দেখছ না আমি কি করছি?’

মাহতিম একবার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পরখ করল অহনাকে,
‘ ক‌ই, তেমন কিছুই দেখছি না।’

‘ তুমি কি দেখার অপেক্ষায় আছ নাকি? দিনদিন কেমন হয়ে যাচ্ছ তুমি।’

‘ কেমন হচ্ছি? আরো বেশি রোমান্টিক নাকি আনরোমান্টিক?’

‘ আন্তর্জাতিক লিচু বয়।’

‘ সেটা আবার কি?’

‘ বুঝো না বলেই এমন করছ। আমি ওয়াশরুমে গেলাম চেঞ্জ করতে। তুমি এখানেই থাকো।’

মাহতিম অহনার খুব কাছে এসে কোমর জড়িয়ে ধরে। অহনা নিজেকে ছাড়ার চেষ্টা করে,
‘ কি করছ এসব? তোমার গায়ে আটা লেগে যাবেতো।’

‘এটা আটা না, এটা হলো ভালোবাসার রং।’

‘ ভালবাসার রং সাদা হলে বেশিদিন টিকে না। তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে লালের প্রয়োজন।’

‘ কে বলেছে তোমাকে? আমরাতো এটা পরিবর্তন করে নিতে পারি। সাদা মানে শান্তি, তাই প্রেমে শান্তির জন্য সাদাটাই মুখ্য।’

মাহতিম অহনার চুলে ফুঁ দেয়। চারিদিকটা কেমন সাদাময় হয়ে উঠে। মৃদু হেসে অহনাকে আরো শক্ত করে ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে। অধরে হালকা স্পর্শ করে বলল,’ তোমার বন্ধুদের বলো চলে আসতে, তুমি সব রান্না করবে।’

অহনা বড় বড় চোখ করে তাকায় মাহতিমের দিকে,
‘ কি বললে তুমি? আমি কিভাবে কি করব?’

‘ আমাকে বলতে সময় দেবেতো নাকি?
মেয়েরা এমনি। পুরো কথা না শোনার আগেই তাদের মন্তব্য করতেই হবে।’

‘ তুমি মেয়েদের তুলে কথা বললে কেন? আর কয়টা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল বলোতো।’

‘ এবার শুরু হলো সন্দেহ। মেয়েরা এতো এতো সন্দেহ করে। তবুও ছেলেরা কেন যে এই মেয়েদের প্রেমেই পড়ে কে জানে? একটা কলাগাছের প্রেমে পড়লেও এই সন্দেহের কবলে পড়তে হতো না।’

‘ ঠিক আছে, তো কলাগাছের সাথেই তোমার প্রেম করা উচিত। তাকে বিয়ে করে সংসার করা উচিত। আমি নিজেই তোমাকে সাহায্য করব তোমার এই প্রেমের শুরুতে। কালকেই আমি কলাগাছকে তোমার প্রপোজাল পাঠাব।’

‘ ওহ গড, তুমিও দেখি অন্য মেয়েদের মতো হয়ে গেছ। তোমার গম্ভীর এবং চুপচাপ মুখটাই আমার জন্য ভালো ছিল।’

‘ তার মানে? আমাকে এখন ভালো লাগছে না তোমার? অন্য কাউকে চাই তোমার? ঠিক আছে, আমাকে আর টাচ্ করবে না। অন্যকারো কাছে যাও।’

অহনা নিজেকে মাহতিমের কবল থেকে ছাড়িয়ে ঝট করে চলে যেতেই মাহতিম পুনরায় ওকে বুকের সাথে চেপে ধরে।‌ অহনা লুকিয়ে হাসে।
মাহতাম বলল,’ আমি না হয় অন্য কাউকে খুঁজে নেব। তুমি কাকে খুঁজে নেবে? আর তুমি ভাবলে কি করে আমার অন্য কাউকে লাগবে?’

‘ তুমি নিজেই বললে।’

‘ উঁহু, আমি বলিনি। আমারতো তোমাকেই লাগবে। সে তুমি পরী হ‌ও বা শাকচুন্নী, সকল রুপেই আমার তোমাকে চাই। বার বার হাজারবার ভালোবাসতে চাই।’

‘এতো ভালোবাসো, বলোনা কেন?’

‘ বললে যদি ভাষা ফুরিয়ে যায়।’

অহনার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে। মাহতিম বলল,’ ফ্রেশ হয় নাও। আমি সব রান্না জানি। আজকে আমিই রান্না করব, আর তুমি শিখে নেবে।’

‘ শিখলে কিভাবে?’

মাহতিম হাসল, কিছু বলল না। একজন আর্মি অফিসার হলো হরফুন মোল্লা। এমন কোনো কাজ নেই যেটা তারা পারে না।

বিকেলের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগিয়ে আরিশ রোস্তমের সাথে দেখা করতে যায়। রোস্তম ঘরের চৌকাঠে মাদুর বিছিয়ে বসে ছিল। আরিশকে দেখতেই উঠে যেতে চাইলে আরিশ বাধা দিয়ে বলল,’ আপনাকে উঠতে হবে না। বসুন আপনি। আরিশ‌ও আয়েশ করে রোস্তমের বিপরীত পাশে বসে। প্যান্ট পড়ে থাকায় বসতে কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে নেয়। হবু শশুরের কাছে বিচলিত অবস্থা দেখাতে পারবে না‌।
আরিশ রোস্তমের শরীরের খবর নিল। কাজের কথাও জানল। পরিশেষে রোস্তম বলল,’ বাবা, তুমি আমার থেকে কি জানতে চাও?’

আরিশ সুযোগ পেয়ে বলল,’ অহনার অতীত নিয়ে।’

‘ আমি জানি। অনেক প্রশ্ন তোমার মনে। এটা অস্বাভাবিক না। যাকে বিয়ে করবে তার বিষয়ে সব জানা তোমার অধিকার আছে।’

‘ তাহলে চাচা এটা বলুন, অহনা কি এখনো মাহতিমকে মনে রেখেছে?’

‘ এটা সম্ভব না। সেদিন আমি যদিও অহনাকে মাহতিমের মৃ’ত্যু সংবাদ দেইনি। তবুও কেউ তাকে কল করে জানিয়েছে। কোনো প্রাইভেট নাম্বার থেকে কল এসেছিল। অহনা জানার সাথে সাথেই চিৎকার করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,’ বাবা, তুমি সব জানতে তাই না?’

আমি ছোট করে উত্তর দিয়েছিলাম,’ হুম।’

আমার দিকে না ফিরেই অহনা চলে গেল দৌড়ে। আমি ওর পিছু নিয়েছিলাম কিন্তু হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল আর খুঁজে পাইনি। সন্ধ্যা পর্যন্ত খুঁজলাম। ক্লান্ত হয়ে থানায় ডায়রি করলাম।

কিছুক্ষণ পর থানা থেকে খবর এলো, অহনা সদর হাসপাতালে ভর্তি , মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছে, মৃ’ত্যুর সাথে লড়াই করছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাই। রাত প্রায় দুটোর সময় জ্ঞান ফিরে ওর।’

‘ কিন্তু ওকে হাসপাতালে আনল কে?’

‘ ডাক্তার বলল একজন মধ্যবয়সী লোক ওকে হাসপাতাল নিয়ে এসেছে। এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তখন লোকটা ছিল, সেই নিয়ে এলো এবং পুলিশ কল করল।’

‘ তারপর কি হলো?’

‘ হাসপাতালেও একবার ওর উপর আক্র’মণ হয়েছিল। কালো কাপড় পড়া কেউ অহনাকে মারার জন্য ছু’রি বের করেছিল। আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম, এসেই দেখলাম এই অবস্থা। আমি চিৎকার করায় লোকটা চলে যায়। আমি তাকে আটকানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু আমার হাতে আঘাত করেছিল। তারপর আমি আর ওকে কাছ ছাড়া করিনি। সারারাত পাশে ছিলাম।’

‘ তার মানে অহনা সুস্থ হ‌ওয়ার পর মাহতিমকে খুঁজেছিল।’

‘ না, তা আর হয়নি। সকালে রিপোর্ট আসার পর জানতে পারি অহনার ম্যামোরি লস হয়েছে। গত হয়ে যাওয়া আট মাসের সব ঘটনা ভুলে গিয়েছে। ডাক্তার বলল,’ যে সময়টা ওর স্মৃতিতে বেশি আঘাত করেছে, সে সময়টা ভুলে গেছে।’ আমি মনে মনে খুশিই হলাম। পরদিন‌ই অহনাকে নিয়ে চলে আসলাম। ওখানে আর থাকলাম না। তারপর আরশিনগরের ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিলাম। সেখানেই আবার পড়াশোনা শুরু করে।’

আরিশ বলল,’ ম্যামোরি লস হয়ে গেলে ওদের পুরনো এলবাম অহনার কাছে আসল কি করে?’

‘ কিসের এলবাম?’

‘ মাহতিম এবং অহনার কিছু ছবির এলবাম আমি ওর ঘর থেকে পেয়েছি।’

‘ ওর কিছু মনেই নেই। ছবি কেন থাকবে?’

আরিশের মাথায় ডুকে না কিছুই। অহনা যদি সব ভুলেই যায় তাহলে ছবিগুলো তার টেবিলে আসল কি করে? এসব ভাবতে ভাবতেই রোস্তম বলল,’ ওর অতীত সম্পর্কে কোনো কিছুই ওর মনে নেই। তুমি যদি না চাও তাহলে বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে পারো।’

আরিশ অভয় দিয়ে বলল,’ আমি এমনটা করব না। আমি অহনাকেই বিয়ে করব। আর খুব শিঘ্রই।’

রোস্তমের থেকে বিদায় নিয়ে আরিশ চলে যায়। তার মাথায় ডুকছে না এলবামের বিষয় নিয়ে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, একবার বিষয়টা নিয়ে অহনাকে জিজ্ঞেস করবে। আবার মনে অজানা ভয় ভর করে। হয়তো ভুল করেই এলবামটা ওখানে ছিল, যদি পুরনো ছবি দেখে অহনার কিছু মনে পড়ে যায়? সে ভয়েও কিছু দেখাবে না বলে ঠিক করে।

অহনা ওয়াশরুমে থাকাকালীন সময়েই মাহতিম একবার আশিশের সাথে দেখা করতে যায়। আশিশের বাড়িতে যেতেই দেখল সে নিজে ড্রাইভিং করে কোথাও যাচ্ছে। ঘর সন্ধ্যায় কোথাও যাওয়ার কথা না আশিশের। মাহতিম ভাবল ওকে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু আর করেনি। আশিশকে তার কিছুটা অন্যরকম মনে হয়েছিল। তাই বিষয়টা গোপনে দেখবে বলেই ঠিক করে….

চলবে….

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৪৮.
অহনা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দেখল মাহতিম উধাও। চারিদিকে খুঁজে দেখল, পেল না। রান্নাঘরে আছে ভেবে সেদিকে পা বাড়ায়।

রান্নাঘরে রুমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। ইরা হৃদয়ের সাথে কথা বলছে। রান্না করা দূরে থাক, সবজিটাও কাটা হয়নি। অহনা এমন অবস্থা দেখে হেসে ফেলে। ওদের কাছে গিয়ে বলল,’ তোরা যা, রান্নাটা আমি করে নেব।’

ইরা মোবাইলের ওপাশ থেকে হৃদয়কে বলল,’ একটু রাখোতো।’

কল রেখেই অহনার দিকে তাকিয়ে বলল,’ মশকরা করছিস?’

‘ আরে না‌। আমি সত্যি বলছি, আমি রান্না করে নেব। তোরা ফ্রেস হয়ে আয়। দেখবি আধা ঘন্টায় আমার রান্না কম্প্লিট।’

‘ আর ভাব দেখাতে হবে না। আগে বললি না কেন?’

‘ আগে তোদের সাথে কাজ করলে ক্রেডিট তোরাও পেতি।’

রুমি ব্রু নাচিয়ে বলল,’ আহা, কত সুন্দর কথা। দেখি কেমন পারিস, আমাদের সামনেই রান্না কর।’

‘ না, আমি কারো সামনে কম্পোর্ট ফিল করি না‌। আজকে একা একা করি, কালকে তোদের‌ও শিখিয়ে দেব।’

‘ তাহলেতো ভালোই, আমরা গেলাম তাহলে।’

ইরা রুমি যেতে যেতে বলল,’ নাকি আমাদের সাথে মজা করছে? আজ রাতে মনে হয় না খাইয়েই রাখার প্ল্যান।’

অহনা শুনতে পেয়ে বলল,’ অতটাও স্বার্থপর ন‌ই আমি। নিজের বাড়ির মেহমানকে অভুক্ত রাখব না।’

অহনা কোথাও মাহতিমকে দেখতে পায় না। বড় মুখ করে বান্ধবীদের বলে দিল রান্না করবে। হঠাৎ হঠাৎ মাহতিমের এই উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা হজম হলো না অহনার।

আশিশ একটা গলিতে এসে একটা বাড়ির দরজায় টোকা দিতেই একটি ছেলে বেরিয়ে আসে। বয়স পঁচিশ-সাতাশ হবে হয়তো। ছেলেটির সাথে কিছু কথা বলতেই ছেলেটি ঘর থেকে একটি ব্যাগ এনে দিল আশিশকে। আশিশ ছেলেটির হাতে মোটা অংকের টাকা ধরিয়ে দেয়। ছেলেটি মৃদু হেসে চারিদিকে তাকিয়ে আবার ঘরে ঢুকে কপাট দেয়। মাহতিম বুঝতে পারেনা কি হলো। এরপর কি হবে সেটা দেখার জন্য আশিশের পিছু নেয় আবার। হঠাৎ মনে হলো অহনার কথা। রান্নায় সাহায্য করবে বলে এসেছিল, কিন্তু ভুলেই গেছে। নাহ, আশিশের পেছনে গিয়ে আর কাজ নেই, কারো পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ভেবেও কাজ নেই। মাহতিম অহনার কাছে চলে যায়।

এতোটা দেরী করায় অহনা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। মাহতিমকে দেখেই সাথে সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে,’ কোথায় ছিলে?’

‘ একটা কাজ ছিল।’

‘ এটা অনেক পুরনো কথা। আজতো অন্তত নতুন কিছু বলো। সবসময় শুনি কোনো কাজ করতে যাও তুমি। আমাকে কি তুমি বিশ্বাস করো না কখনো? কোথায় যাও, এই সামান্য কথাটা কি আমাকে জানিয়ে দিলে খুব বেশি সমস্যা হয়ে যাবে?’

‘ রাগ করো না আহি। সব জানতে পারবে তুমি।’

মাহতিম অহনার দুই গালে হাত রেখে আশ্বাস দেয়,’ আমার মিশন শেষ হলেই তুমি সব জানতে পারবে। আমাকে কিছু বলতে হবে না, তুমি নিজেই সব জেনে যাবে।’

‘ কি এমন কথা যেটা জানার জন্য এতো অপেক্ষা?’

‘ খুব শিঘ্রই জানবে।’

অহনা অভিমানের সুরে বলে,’ তোমার নামটা ছাড়া আর কিছুই জানি না, কবে তোমার পরিবারের সাথে দেখা করাবে আমাকে?’

পরিবারের কথা বলতেই মাহতিমের বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠে। পরিবারকে সে হারিয়েছে, তার জন্য‌ই তার পুরো পরিবারকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ছোট বোনটাও রেহাই পায়নি। ডুকরে কেঁদে উঠে মাহতিম। অহনা বিচলিত হয়ে পড়ে,’ কি হয়েছে তোমার? কষ্ট হচ্ছে খুব?’

মাহতিম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’ আমার কোনো পরিবার নেই। এই জগতে আমি একাই থাকি। সবাই শেষ হয়ে গেছে, কেউ বেঁচে নেই।’

অহনার মায়া হয়। মাহতিমের হাত দুটো বুকের সাথে মুষ্টিবদ্ধ করে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়,’ কেউ নেই কে বলল? আমিতো আছি! যারা চলে গেছে, তাদের সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল। তারা চাইলেও আর বেশিদিন তোমার কাছে থাকতে পারতো না। সবাইকেই প্রকৃতির নিয়মে মাথানত করতে হয়। সাড়া দিতে হয় পরকালের প্রতি। কেউ নিজ ইচ্ছায় দু’দিন‌ও বেঁচে থাকার অবকাশ রাখে না‌।’

মাহতিম অহনার চোখের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিল। অহনার চোখের দিকে তাকালেই তার সমস্ত কষ্ট মুছে যায়।

অহনা একটু কেঁশে বলে,’
আমি আছি সবসময় তোমার পাশে, খুব শিঘ্রই আমাদের বিয়ে হবে, তারপর বাচ্চা হবে, তারপর বাচ্চাদের বিয়ে দেব, তারপর আমরা দাদা-দাদি হবো, তারপর দুজন মিলে নাতি-নাতনি সামলাবো আর পান খাবো বসে বসে।’

‘ বাহ! কত কিছু ভেবে নিলে তুমি? বাসরের কথাটা বাদ রাখলে কেন?’

‘ ওটাও হবে।’ লজ্জায় আরক্ত হয়ে অহনা অন্য পাশে ফিরে দাঁড়ায়।

‘ লজ্জা পেতে হবে না। চলো রান্না করে ফেলি। আমার হাতের রান্না খাবে আজ তুমি। তবে আমি আগুনের কাছে যাব না। আমি দেখিয়ে দেব, তুমি রান্না করবে।’

‘ তাহলে এটা তোমার হাতের রান্না হলো কি করে? এটাতো আমার রান্না হবে?’

‘ দেখিয়ে দেবে কে?’

‘ তুমি?’

‘ তাহলে রান্নাটা হবে কার?’

‘ আমার।’

‘আচ্ছা মেনে নিলাম। কবি বলেছেন, মেয়েদের সাথে তর্ক না করে, তাদের না কে না এবং হ্যাঁ কে হ্যাঁ বলা।’

‘ ঐ কবিকে পেলে একটা ম্যাডেল দিতাম।’

‘ তাকে পাবে না। অনেক আগেই ব‌উয়ের অত্যা’চার সহ্য করতে না পেরে সংসার ত্যাগী হয়েছেন। মাঝে মাঝে আমার সাথে দেখা হয়।’

‘ তার কাছে কেন যাও? বুঝেছি… তুমিও পরবর্তীতে সংসারহীন জীবন কেমন কাটাবে তার ধারণা নিতে যাও তাই না?’

‘ এই জন্য‌ই কবি বলেছেন কথা না বাড়াতে। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি তুমি সবজি কেটে নাও।’

আরিশ নিজের ঘরে বসে অফিসের কিছু কাজ করছিল। আচমকা তার চোখ যায় ড্রেসিন টেবিলের উপর। একখানা চিরকুট ভাঁজ করে রাখা আছে‌।
আরিশ উঠে গিয়ে চিরকুটটি হাতে নেয়‌। নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে। কে রেখে গেল এটা? তার জানা মতে মতি ছাড়া এই বাংলোতে আর কেউ যাওয়া আসা করে না। কে রেখে গেল তাহলে?
সন্দিহান ভাবটা তার আরও বেড়ে গেল। দু’ভাঁজ করা চিরকুটটি খুলতেই গেলেই তার ফোনটা বেজে উঠে। ওপাশ থেকে মোড়ল বলল,’ বাড়িতে আয়। কিছু কথা বলার আছে।’

‘ পাঁচ মিনিটে আসছি আমি।’

আরিশ ফোনটা রেখেই হাতের চিরকুটটি পকেটে পুরে নেয়। বাবার বয়ান শুনলেই তার কলিজার কম্পন বেড়ে যায়। কি না কি জিজ্ঞেস করবে সেটা ভেবে পায় না? কিছুদিন যাবৎ এই ভয়টা আরো বেশি তাড়া করে। যখন থেকে সিআইডিতে জয়েন করেছে তখন থেকে। মোড়ল চাইতো না আরিশ আইন নিয়ে পড়াশোনা করুক। কাউকে না জানিয়ে আরিশ জয়েন করে। মোড়লের জানামতে আরিশ একজন স্কুল শিক্ষক মাত্র।

রান্না শেষ করে মাহতিম অহনা প্রশান্তির হাসি দেয়। এর‌ই মাঝে অহনা কি করছে সেটা দেখতে আসে ইরা। দেখল আপনমনে হাসছে। কিছুদিন ধরেই ইরার অহনাকে অস্বাভাবিক লাগছে, সেই অহনাদের বাড়িতে থাকাকালীন সময় থেকেই। দিন দিন সেই সন্দেহটা আরো বেড়ে যাচ্ছে। খাবারের সুন্দর গন্ধ আসছে নাকে। রুমিও ঘরে থেকে বেড়িয়ে এলো। অহনা দেখতে পেয়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়।
ইরা খাবার টেষ্ট করতেই অহনা উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুনাম শুনতে। ইরা খাওয়া শেষ করে বলল,’ এটা আবার কেমন রান্না?’

‘ কেন, ভালো হয়নি?’

অহনার মূখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। রুমিও টেষ্ট করল। ইরা রুমি একসাথে বলে উঠে,’ এক্সি’ডেন্ট!’

অহনা গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। ইরা বলল,’ এক্সিলেন্ট হয়েছে, দুর্দান্ত। তুই রান্না করেছিস আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

রুমিও সুর মেলালো,’ আগে জানলে তোর বাড়িতে এসেই পড়ে থাকতাম। বুয়ার বিচ্ছিরি রান্না হজম করতাম না‌।’

মাহতিমের মনে খচখচানি রয়েই গেল। অহনার থেকে বিদায় নিয়ে আশিশের কাছে যায়। ভেবেছিল আশিশ বাড়িতেই থাকবে‌। অদ্ভুত ব্যাপার, অনেক রাত হয়ে গেল কিন্তু সে বাড়ি নেই। তাই মাহতিম আশিশকে খুঁজতে বের হয়। দিব্য দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝতে পারে, আশিশ একটা নাইট ক্লাবে আছে। মাহতিম তৎক্ষণাৎ সেখানে চলে যায়।

পুরনো একটি পোড়া বাড়িকে নাইট ক্লাব বলে চালিয়ে দিচ্ছে কয়েকজন লোক। ভালোই আয় হচ্ছিল তাদের, সাথে সব খারাপ লোকেদের আড্ডা সেখানে। আশিশকে সেখানে দেখে মাথার উপর দিয়ে রাগ উড়ে যাচ্ছিল মাহতিমের। আর দেরী না করে ভেতরে যায়। দিনদিন শক্তি তার কমেই চলেছে, অনেকটা অসুস্থ বোধ করে। তবুও ভেতরে গিয়ে দেখতে থাকে আশিশ কোথায়। কয়েকটা এরিয়া পেরুতেই আশিশকে দেখতে পায়। মাহতিম হতবাক হয়ে যায় এমন কান্ড দেখে। ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় আশিশের দিকে…..

চলবে…..

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৪৯.
মোড়ল ছেলেকে একপাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ এতদিন ধরে মিথ্যে বলে আসছিলি আমাদের?’

আরিশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মানে মোড়ল সব জেনে গেছে। কিন্তু কে বলল? আরিশের কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় বলল,’ শিক্ষকতায় রয়েছে প্রচুর সম্মান। সকল স্তরের মানুষ শিক্ষককে পছন্দ করে, তাই তোকে এই পেশা বেছে নিতে বলেছি। এমনটা নয় যে আমি অন্য পেশাকে পছন্দ করি না।’

‘ বাবা, আমি আসলে….’

আরিশ পুরো কথা বলার আগে মোড়ল তাকে জড়িয়ে ধরে,
‘ খুব খুশি হয়েছি এই কথা শুনে। তবে কষ্ট পেয়েছি এটা ভেবে যে, আমার ছেলে একজন সিআইডি অফিসার সেটা আমি জানতাম না। আজকেই আমার এক কর্মচারী কথাটা বলে গেল। এটাও বলল কিভাবে তুই নিরীহ একটা মেয়েকে বাঁচালি।’

আরিশ হেসে উঠে। বাপ ছেলে অনেকক্ষণ কথা বলে। এক পর্যায়ে আরিশ উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। শরীরটা কেমন মেজমেজ করছে। গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। হাজারো প্রশ্ন তার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে, যার কোনো উত্তর নেই। ভাবে, সবাইতো জেনে গেছে সে কে? অহনার‌ও জানা উচিত। অহনাকে সব বলে দেবে বলে ঠিক করে। হঠাৎ তার চিরকুটটির কথা মনে হয়‌। পকেট থেকে বের করেই চোখের সামনে মেলে ধরে,

মিস্টার আরিশ,
আমি জানি আপনি একজন সিআইডি অফিসার। আপনার উদ্দেশ্য কি, সেটা অবশ্য এখনো জানতে পারিনি। তবে এটা জানতে পেরেছি, আপনি জয়ন্ত স্যারের প্রিয়, যেমনটা আমি ছিলাম। এও জানি যে আপনি আমার সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছেন। জয়ন্ত স্যার আমাকে ভালবাসেন, আমি মৃ’ত জেনেও এখনো আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইছেন। আপনি তাকে সাহায্য করছেন।
অনেক প্রমাণ আমাদের চোখের সামনেই থাকে, আমরা খুঁজে পাই না। তেমনি আপনার সমানে অনেক প্রমাণ, দেখতে পাচ্ছেন না। আমি এখন কোনোভাবেই মানুষের সামনে যেতে পারব না, তাই আপনার সাহায্য কামনা করছি। বড় ভাই ভেবে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। আপনাকে আর কোনো প্রমাণের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। আমি সব প্রমাণ দেব আপনাকে। আপনি সেটাই পনেরো দিন পর জমা দেবেন। এতে হয়তো আপনার প্রাণের ঝুঁকি থাকবে। কিন্তু আমি চাই তবুও আপনি সেটা করুন আপনাকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমি নিলাম। আপনার মনে এখন অনেক প্রশ্ন, আমি খুব শিঘ্রই আপনার সাথে দেখা করব, সব প্রশ্নের উত্তর জেনে যাবেন।
ইতি মাহতিম

মাহতিমের চিঠি পড়ে আরিশ কয়েক মুহুর্তের জন্য তব্ধা মেরে থাকে। মাহতিম বেঁচে আছে এটা সে মনকে মানাতে পারছে না‌। কারণ ভূত বলে কিছু নেই, এটা সে বিশ্বাস করে। আর যদি মাহতিম না হয় তাহলে অন্যকেউ দূর থেকে মাহতিমের হয়ে সাহায্য করছে। এসব ভাবতে ভাবতেই নিজের মাথা চেপে ধরে আরিশ। কি হচ্ছে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না।

নাইট ক্লাবে একটা মেয়ের সাথে আশিশকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে মাহতিমের মাথায় বাজ পড়ল। কিছুদিন পর যার বিয়ে সে কিনা অন্য মেয়ে নিয়ে….
মাহতিম হাত দু’টো মুষ্টিবদ্ধ করে আশিশের দিকে এগিয়ে যায়। দু’কদম গিয়েই থেমে যায়। মেয়েটিকে এমন অবস্থায় সে দেখতে পারছে না। রঙ্গলীলায় মেতে উঠেছে আশিশ। তার মনেই নেই অন্য একটা মেয়েকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
মাহতিম আশিশকে ডাক দেয়। মাহতিমের বয়ানে আশিশ চমকে উঠে। নিজেকে ঠিক করেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মাহতিমকে দেখতে পেয়ে তার ভয়ের পরিমাণ করো বেড়ে গেল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,’ আমি জানি, তুই এখন আমাকে খুব খারাপ মনে করবি। এটাই বলবি তো, দু’দিন পর যাকে বিয়ে করব তাকে ঠকাচ্ছি?’

মাহতিম আশিশকে কথা শোনাতে গিয়েও আর পারল না। কি বলতে চায় আশিশ। মাহতিম কড়া নজরে তাকায় আশিশের দিকে,
‘এটাই আমার প্রশ্ন। উত্তর দে।’

‘ঐ মেয়েকে আমি বিয়ে করব না। ও আমাকে ঠকিয়েছে। আমাকে ওর ভালো লাগেনি তাই অন্য ছেলেকে ধরে নিয়েছে। আমিও মনের দুঃখে এখানে এসেছি। আমাকে তো তার জন্য বসে থাকলে হবে না, আমাকেও নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে হবে। ভেবেছি এখানে হয়তো কাউকে পেয়ে যাব।’

‘ কিহ! হিয়াকে দেখে আমার এমন মনে হয়নি।’

‘ তুই কি আমাকে অবিশ্বাস করছিস?‌ তোর বন্ধুকে?’

‘ আমি সত্যকে বিশ্বাস করি, কে বন্ধু, কে শত্রু সেটা বিচার করিনা। আমার কখনো মনে হয়নি হিয়া তোকে ঠকাতে পারে।’

এমন সময় আশিশের সাথে একটু আগে মেলামেশা করা মেয়েটা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আশিশকে সামনে দেখে বলল,’ বেবি, এভাবে বেরিয়ে আসলে কেন? তুমিতো বলেছিলে তোমার ক্ষ্যাত পিয়ন্সে কখনোই এই জায়গার সন্ধান পাবে না। কার সাথে কথা বলছ?’

আশিশ ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বললেও সে ইশারা বুঝে না। অনর্গল বলেই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আশিশের কাছে এসে ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে নিল কোনো কথা না বলেই,’ বেবি চিল, এখানে কেউ নেই। চলো আমরা ভেতরে যাই।’

মাহতিম বিরক্তিতে দেয়ালের সাথে ঘু’ষি মারে। আশিশের এমন ভয়ঙ্কর রূপ চোখে আসবে সে ভাবতে পারেনি। আশিশকে বলল,’ হিয়াকে ঠকালি তুই। তোর মতো ছেলের ওর মতো ভালো মেয়েকে পাওয়ার অধিকার নেই। আমি সব জানাবো তাকে।’

আশিশ মেয়েটিকে ছেড়ে গিয়ে ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসে। হাত জোড় করে ক্ষমা চায় মাহতিমের কাছে,
‘স্যরি ভাই, আর কখনো হিয়া ছাড়া অন্য মেয়ের দিকে নজর দেব না। কি করব বল? এই হিয়াতো বেশি কিছু করতেই দেয় না। বলে কিনা বিয়ের পর।’

‘ সেদিন‌ও দেখলাম তোদের একসাথে।’

আশিশ ধরা পড়া চোরের মতো তাকিয়ে র‌ইল মাহতিমের দিকে। মাহতিম পুনরায় বলল,’সত্যিটা এটাই যে, তুই হাজার মেয়ের সাথে রাত কাটাস। একটায় হয়না তোর।’

‘ আমার ভুল হয়ে গেছে। আর করব না।’

‘ হিয়াকে কেন বিয়ে করছিস? হাজারো মেয়েতো এমনিতেই পেয়ে যাচ্ছিস। বিয়ে করে সময় নষ্ট করার কি মানে?’

‘ হিয়াকে বিয়ে করব টাকার জন্য। এই মুহুর্তে আমার খুব টাকার প্রয়োজন। ও ওর বাবার একমাত্র মেয়ে। ওদের অনেক প্রপার্টি। ওকে বিয়ে করলে সব আমার হবে।’

মাহতিম রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে আশিশকে একটা চ’ড় মে’রে বসে। আশিশ কোনো রিয়্যাকশন করে না।

অহনা শুয়ে ছিল। হঠাৎ একজন লোক জানালায় উঁকি দিল। অহনা ইরাকে বলল,’ জানালায় কেউ আছে মনে হচ্ছে।’

‘ কোথায়? আমি দেখতে পাচ্ছি না।’

‘ আচ্ছা আমি দেখে আসছি।’

অহনা পা টিপে টিপে জানালার সামনে যায়। কাউকে দেখতে পায় না। চারিদিকে তাকিয়েও কিছু না দেখে জানালার গ্লাস লাগাতে গেলেই দেখতে পায়, গ্লাসের ফাঁকে একখানা চিরকুট। ব্রু বক্র করে সেটা হাতে নেয়। আবারো একবার চারিদিক দেখে। কেউ তো ছিল, যে এখানে চিরকুট রেখে গেছে। অহনা ভাঁজ করা চিরকুটটি খুলল, লেখা ছিল,

‘আমার কথা শুনলি না। মাহতিমকে সব বলেও দিলি? বলেছি তার থেকে দূরে থাকতে। এবার দেখবি তোর প্রিয়জনদের কি করি আমি। মৃ’ত্যুর খেলা খেলব আমি। হা হা হা!’

অহনা আঁতকে উঠে। ইরাকে ডেকে বলে,’ এটা কে দিয়েছে? কেন সে ভয় দেখাচ্ছে?’

ইরা চিরকুটটি দেখতে বললে অহনা দেখায় না। অহনা চায়না কেউ মাহতিমের কথা জিজ্ঞেস করুক। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’ আমার একটু ঘুমের প্রয়োজন।’

ইরার পাশ কাটিয়ে অহনা বারান্দা থেকে প্রস্থান করে।

মাহতিম পুরো রাস্তায় আর একটাও কথা বলল না আশিশের সাথে। আশিশের বাড়ি আসার সাথে সাথে বলল,’ হিয়ার বিয়ে তোর সাথে হচ্ছে না। এটা ফাইনাল। তুই যত‌ই আমার বন্ধু হোস না কেন, ভালোবাসাবিহীন বিয়ে আমি হতে দেব না। আমারো বোন ছিল, তাকে কখনোই আমি তোর মতো ছেলের হাতে তুলে দিতাম না। তোর আজকের আচরণে আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। জানি না এভাবে কত মেয়ে তোর বেড পার্টনার হয়েছে!’

আশিশ রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। চোখে ঘৃণা তার। মাহতিমের চোখে ভালো সাজার জন্য আরেকবার চেষ্টা করবে বলে ভেবে নেয়। চোখে কিছুটা কান্না ফুটিয়ে তুলে বলল,’ এমনটা আর করব না‌। আমার মনে হচ্ছে আমিও হিয়াকে ভালোবাসি। আগে হয়তো টাকার জন্য বিয়ে করতে চেয়েছি। এখন মনে হচ্ছে সত্যিকারের ভালোবাসি। এমন কিছু করিস না, যেন আমাদের বিচ্ছেদ হয়। আমি আর কখনো অন্য কোনো মেয়ের দিকে ফিরেও তাকাব না।’

‘ মন থেকে বলছিস?’

‘ একদম। আর কখনো এমন ভুল করব না। আজ থেকে সব ভেজাল খাওয়াও বন্ধ করে দিলাম‌। কসম করে বলছি, আর কখনো খাবো না, মেয়েদের থেকে দূরে থাকব।’

‘ মনে থাকে যেন। তুই আমার নজরে থাকবি আজ থেকে। তোকে ঠিক করার দায়িত্ব আমি নিলাম।’

আশিশ মাহতিমকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই মাহতিম বাঁধা দেয়,’ একদম আমাকে ছুঁবি না। তোর এই বাজে স্মেলটা আহির সহ্য হবে না।’

‘ কেন?’

‘ তুই অ্যালকোহল নিয়েছিস। আমাকে জড়িয়ে ধরলে এর গন্ধটা আমার গায়ে থেকে যাবে। আর আহির সেটা ভালো লাগবে না।’

‘ জ্বী‌ গুরু! গার্লফ্রেন্ড‌ই তাহলে তোমাকে জড়িয়ে ধরুক। আমি ঘুমাতে গেলাম।’

মাহতিম আশিশের বাড়ি থেকে এসে অহনার কাছে পা বাড়ায়। কিন্তু কি ভেবে থেমে যায়।
আরিশের সাথে দেখা করা তার জরুরি। আজ রাতেই সুযোগ। আজকের ঘটনার কোনো কিছুই সে আশিশকে বলতে পারেনি। এমন পরিস্থিতি ছিল যে বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি।

মাহতিম আরিশের সাথে দেখা করতে চলে যায়। আরিশ বিশ্বাস করতে চাইবে না। কিন্তু সে বিচক্ষণ, বিশ্বাস তাকে করতেই হবে এক পর্যায়….

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে