ছায়া মানব পর্ব-৪+৫+৬

0
1207

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৪.
পাঁচজন যুবক একে একে এগিয়ে আসে অহনার দিকে। অহনা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পেছনে পেছাতে থাকে যতক্ষণ না পিঠ ঠেকে যায়। এক পর্যায়ে অহনা মুছড়ে পড়ে যায়। একজন এগিয়ে এসে তার কানে কানে বলে,’ এই বেলায় মেয়েলোক বাড়ি থেকে বের হয় না।’

সবাই খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।
‘ সেরা একটা মাল ভাই‌। তারাতাড়ি কাজে লেগে পর।’

কে আগে যাবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব বাঁধে তাদের মধ্যে। সবাই অহনাকে আগে ভোগ করতে চায়। শেষমেশ তারা সিদ্ধান্ত নেয় টস করবে। সেখানে যার নাম আগে হবে সেই আগে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথম পড়ল শরিফ নামের ছেলেটির কাছে। সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে।
শরিফ অহনাকে স্পর্শ করতেই তার শরীর বিষিয়ে উঠেছে। একের পর এক ছোঁয়া তার শরীরে বেদনার জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু ছায়া মানব আসবে না। একটু আগেই অহনা তাকে সামলে আসতে বারণ করেছে। সে কি করবে?
শরিফের কামনার দৃশ্য দেখে অন্যরাও হামলে পড়ে। তারা নিজেদের সংযত রাখতে পারছে না।
অহনা কোনো উপায় না পেয়ে চিৎকার করে ছায়া মানবকে ডাকে। বিষাক্ত হয়ে যাবে তার শরীর আর একটু দেরি করলে। অহনা ডাকার সাথে সাথেই ছায়া মানবের আবির্ভাব। পাঁচজনকে একাই সে আছাড় মারে। হাত গুড়িয়ে দেয়। ছেলেগুলো অদৃশ্য মার খেয়ে বোকা বনে যায়। তারা পালাতে চাইলেই ছায়া মানব তাদের ছিটকে দূরে ফেলে। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের মতো উড়তে থাকে।
অহনা তাকে থেমে যেতে বলে। কিন্তু সে থামে না। মেরে ফেলতে চায় সেই অশালীন যুবকদের। প্রায় আধমরা হয়ে যায় তারা। অহনা কাকুতি মিনতি করছে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
ছায়া মানব তাদের ছেড়ে দেয়। মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে। পরপরই অহনাকে শূন্যে তুলে একটা উঁচু ঢিবির উপর নিয়ে যায়। সেখান থেকে আকাশকে অনেক সুন্দর দেখা যায়। চাঁদটাকে ছুঁতে পারবে এমন মনে হতে থাকল তার। আনন্দের সাথে দুঃখ হতে থাকে অহনার। কেঁদে উঠে, তার সাথে এসব কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে, বুঝতে পারছে না। উঁচু জায়গায় রেখে ছায়াটিও কেমন উধাও হয়ে গেছে। সব দোষ দিতে থাকে সেই ছায়া মানবকে। সে না আসলে এতকিছু হতই না। পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে না আসলে এতক্ষণে সে মৃত থাকত। এগারো জন পশুর কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে যেত সম্মান, পরিশেষে মৃত্যু‌ই একমাত্র অপশন হতো। কিন্তু এই মুহূর্তে তার একা লাগছে। বাড়ি যেতে চায় সে। আচমকা ছায়া মানবের আবির্ভাব হয়। অহনার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। অহনা তার চেহারা ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। ছায়াটি নরম ঘাসের উপর বসে পড়ে। অহনাও বসল, কিছুটা দূরে।
‘ কে তুমি?’ প্রশ্ন করল অহনা।

কোনো উত্তর আসে না। ছায়াটি আকাশের উজ্জ্বল চাঁদের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। অহনা আবারো বলল,’ কে তুমি? কেন আমার পিছে পড়ে আছ? কেন সাহায্য করছ? কিন্তু এটা সাহায্য না, অন্যায় করছ তুমি!’

ছায়াটি উত্তর দেয় না। অহনা বিরক্ত হয়ে পড়ে। সে তেড়ে আসে ছায়াটির দিকে। তাকে হাত দিয়ে ধরতেই পিঠ ভেদ করে অহনার হাত অপর পাশে বেরিয়ে এলো। মনে হলো কোনো শরীর নেই। অহনা ছিটকে দূরে সরে যায়। তার মানে এটা সত্যি ছায়া? তার কোনো শরীর নেই। আঁতকে উঠে অহনা।
‘ তোমার শরীর কোথায়? ধরতে পারছি না কেন?’

কোনো উত্তর নেই। অহনা আবারো তাকে ধরতে যায়। আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে‌। অহনা তার পিঠে হাত দিতেই তা ভেদ করে পেট দিয়ে বেরিয়ে আসে‌। ছায়াটি শুধুই ছায়াই। তাকে ধরা যাচ্ছে না। অহনা আবারো জিজ্ঞেস করল,’ কে তুমি? পরিচয় কেন দিচ্ছ না? আমার সাথে কি তোমার কোনো যোগসূত্র আছে?’

‘আছে।’ ছোট করে উত্তর দিল ছায়াটি। এতক্ষণে একটু কথা শুনে অহনা কিছুটা শান্ত হয়। পুনরায় জিজ্ঞেস করে,’ কে তুমি?’

‘ জানতে চাও?’

‘ হ্যাঁ, বলো তুমি, কে তুমি? আমাকে কি করে চেনো? সব জানতে চাই আমি।’

‘ আমি তোমার খুব কাছের।’

অহনা ভাবে,’ কতটা কাছের? আমারতো কাছের বলতে বাবা-মা আর বন্ধুরা ছিল। তাদের আপনি মেরে দিলেন।’

‘ মরেনি তারা। তাদের শুধু ভয় দেখিয়েছি। পরেরবার আর তোমায় বিরক্ত করবে না।’

‘ কোথায় আছে ওরা?’

‘স্থানীয় হাসপাতালে। বিস্ফোরণটা ততটা তেজি না। সাথে সাথে পুলিশ কল করেছি, তা হয়েছে বলতে, কিছুটা আঘাত শুধু।’

‘ আপনার পরিচয় দিন।’

‘ আগে তোমার বাড়ি যাওয়া উচিত।’

‘ কিন্তু কিভাবে?’

‘ চোখ বন্ধ করো।’

অহনা চোখ বন্ধ করে। একটু পর‌ই চোখ খুলে দেখতে পায় সে আকাশে ভাসছে। কেউ তাকে পাঁজাকোলে করে জড়িয়ে রেখেছে। তার দিকে দৃষ্টি দেয়। খুব চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না, কে সেই ব্যক্তি। তার উজ্জ্বল মুখশ্রী, চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে, ঠোঁটগুলো মৃদু নড়ছে। অহনা বিভোর হয়ে তাকে দেখছে। লোকটাকে তার ভীষণ ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে আগেও তাদের দেখা হয়েছে, কিন্তু কোথায়? মনে করতে পারছে না অহনা। এতো চেনা মনে হ‌ওয়া লোকটাকে সে আজকেই দেখছে। অহনা কোল থেকে নেমে যেতে চাইলেই নিচে চোখ দেয়। উঁচু-নীচু বাড়ি-ঘর, রাস্তা, মাঠ, নদী দেখে আতঙ্কে কেঁপে উঠে। লোকটির শার্ট খামচে ধরে। মনে হচ্ছে এই বুঝি নিচে পড়ে যাবে।
কারো বুকের গরম আভায় অহনা চোখ বন্ধ করে নেয়।

চোখ খুলতেই দেখতে পায় সকাল হয়ে গেছে এবং সে বিছানায় শুয়ে আছে। মাথা ধরে আছে তাই কিচেনে গিয়ে আঁদা চা খাওয়ার কল্পনা করে। কিচেনে যেতেই দেখতে পায় কেউ আগে থেকেই চা করে রেখেছে। অহনা অবাক না হয়ে চা খায়।
অহনা উদগ্রীব হয়ে যায় সেই অদৃশ্য মানুষটিকে দেখতে, তার পরিচয় জানতে। অহনা ভাবে, তাকে বিপদে দেখলেই ছায়াটির আবির্ভাব হয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় এখন সে পড়ে যাওয়ার নাটক করবে। তাই একটা চেয়ারে পা দিয়ে ওয়্যার ড্রপ এর উপর থেকে ব‌ই আনার চেষ্টা করে। ইচ্ছে করেই পা চেয়ার থেকে বাইরে নিয়ে আসে। পড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই কেউ তাকে ধরে ফেলে। অহনা অবাক হ‌ওয়ার ভান ধরে, মূলত তার আইডিয়া কাজে দিয়েছে।
যেহেতু স্বশরীরে ছায়াটি তাকে ধরল তাই অহনা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এবার আর পালানোর সুযোগ নেই। আজ তার পরিচয় জেনেই ছাড়বে……

চলবে……

#ছায়া_মানব
#সাথীইসলাম

৫.
অহনা ছায়া মানবটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়। ছোটার চেষ্টা করে না সে। আস্তে আস্তে তার চেহারা স্পষ্ট হতে থাকে। অদৃশ্য হয়ে ধরেছিল অহনাকে, কিন্তু এখন আস্তে আস্তে তার আসল রুপ বেরিয়ে আসছে। অহনা দেখছে তাকে। এক পর্যায়ে পুরো শরীর দৃশ্যমান হলো। অহনা তার কোল থেকে নেমে পড়ে। অবাক হয়ে যায়। কাল রাতে যার সাথে আকাশ ভ্রমণ করছিল, এটা সেই লোক। অহনা খপ করে তার হাত ধরে ফেলে।
হাত ধরতেই মনে হয়, এই স্পর্শ তার খুব চেনা। এই হাতে আরো অনেকবার হাত মিলিয়েছিল। অহনা জিজ্ঞেস করে,’ কে তুমি?’

তখন‌ই অহনার ফোনে কল আসে। কল ধরতেই ওপাশ থেকে শব্দ আসে,
‘তুই কোথায় রে তারাতাড়ি আয়। ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

হ্যারির গলা পেয়ে অবাক হয় অহনা। হ্যারি তাকে দোষারোপ করছিল সব কিছুর জন্য। এখন ডাকছে কেন? অহনা উত্তর দেয়,’ এইতো ভাই, বিশ মিনিট পরেই আমি আসছি।’

‘ তারাতাড়ি আয়। আজ পার্টি হবে।’

অহনা কল রেখে দেয়। পাশে তাকিয়ে দেখে সুযোগ পেয়ে ছায়া মানব উধাও। রাগ হয় তার। মনে মনে গালি দিতে থাকে। পরক্ষণেই মনে হয়, ছায়া মানব তার মনের কথাও জেনে নেয় পরপরই লজ্জিত হয়।

অহনা তৈরি হয়ে কলেজে চলে যায়। দেখা হয় হ্যারি, টিকু, রুমি আর ইরার সাথে। অহনা দেখে তারা এগিয়ে আসে। রুমি বলল,’ কিরে, এতো দেরি করলি কেন?’

‘ একটু বেশি ঘুমিয়েছিলাম, তাই। কিন্তু কালকের কথা কি তোদের কারো মনে নেই?’

‘ কি বলছিস এসব? কি মনে থাকবে?’

অহনা আর কিছু বলে না। এতো সহজে সবটা ভুলে যাওয়ার মতো পাবলিক তারা নয়। মোবাইলে তাকাতেই দেখতে পায় মেসেজ,’ সুস্থ হ‌ওয়ার পর ওদের স্মৃতি মুছে দিয়েছি। তারা ভ্রমণের বিষয়টাও ভুলে গেছে। ওদের আচরণে তোমার কষ্ট হবে ভেবেই এটা করলাম।’

অহনা খুশি হয়ে মোবাইলে চুমু খায়। এদিকে সবাই ড্রেককে একের পর এক ফোন দিতে থাকে। কল লাগছে না। লোকেশন ট্রেক করে দেখল, মোবাইলের লোকেশন বান্দরবান দেখাচ্ছে। টিকু বিশ্রী এক গালি দিয়ে বলে,’ শা* আমাদের না বলে কেমন ঘুরতে চলে গেল। বা* আসলে তারে এমন কেলানি কেলাবো, আমাদের জমের মতো ভয় পাবে।’

ইরা অহনার কাছে এসে দাঁড়ায়,’ কিরে, কার মেসেজে চুমু খাচ্ছিস?’

অহনা হকচকিয়ে উঠে। মোবাইলটা লুকিয়ে নিতেই ইরা কেড়ে নেয়।
‘ দেখি তো কাকে মেসেজ করছিস? আমাদের জিজু নাতো আবার?’

‘ তেমন কিছু না। দিয়ে দে মোবাইলটা।’

ইরা কোনো কথা না শুনে মেসেজগুলো দেখে। উপরের লেখাটা দেখেই কেমন অদ্ভুত হয়ে যায়। অহনা ভয়ে আছে। যদি ইরা সব বুঝে যায় তাহলে কি হবে?

‘ কিরে, এসব কোন গাধার সাথে মেসেজ করলি। কেমন অদ্ভুত কথা। এই মাতালকে ক‌ই পেলি? কার স্মৃতি কেউ মুছে দিয়েছে?’ বলল ইরা।

‘ আরে দূর, এটা আমার এক কাজিন। ভৌতিক কথা বলতে ওর ভালো লাগে। কেউ আড্ডা দেওয়ার নেই তাই আমার সাথে কথা বলে। আমরা এসব হাবিজাবি অনেক কথাই বলি। তুই বুঝবি না।’

‘ তুই যেমন, তোর কাজিন‌ও তেমন।’

ইরা হেসে মোবাইল দিয়ে দেয়। অহনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ক্লাসে ঢুকে সবাই মিলে। অহনা লক্ষ্য করল পাশের রুমে কিছু অঘটন ঘটছে। অহনা ওদেরকে বসতে বলে সেখানে চলে যায়। দেখল কলেজের ভেতরেই ছেলেটা জুনিয়র একটা মেয়েকে রেগ দিল। অহনা ছিল সিনিয়র। ছেলেটা তার ক্লাসমেট। বলা হয়েছিল ছেলেটাকে কিস করতে হবে। গ্রাম থেকে আসা মেয়েটি রাজি হলো না বলে সবগুলো ছেলে তাকে ঘিরে ধরল। কথা একটাই, যেকোনো একজনকে কিস না করলে তারা সবাই মেয়েটাকে কিস করবে। এমন উদ্ভট নিয়ম দেখে অহনা আর স্থির থাকতে পারল না। এগিয়ে গেল।
অহনাকে দেখেই অনিত বলল,’ এখানে ছোটদের রেগ দেওয়া হচ্ছে, তুমি তোমার ক্লাসে যাও।’

অহনা রেগে যায়, বলল,’ এটা রেগ না। মেয়েটাকে অসম্মান করা হচ্ছে। ওদের যেতে দাও, না হয় আমি তোমাদের এমন হাল করব যে কাউকে দেখাতে পারবে না।’

‘ কি করবে তুমি, হ্যাঁ? এটা আমাদের কলেজ, আমরা যা ইচ্ছা করব। তোমাদের মেয়েদের এতো জোর আসে কোথা থেকে। তোমরা শুধু আমাদের কথায় উঠবে আর বসবে, এছাড়া কিছু নয়।’

অহনা রাগে ছেলেটিকে থাপ্পর দিতে যায়। থাপ্পর দেওয়ার আগেই সে হাতটা ধরে মুছড়ে পেছনে দিক বরাবর নিয়ে যায়,’ এই কচি হাত, কাউকে চর মারার জন্য নয়, তাকে আদর করার জন্য।’

অহনার শরীর রাগে ফুঁসে ওঠে। ছেলেটির অন্ডকোষ বরাবর লাথি দেয়। মুহুর্তেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বন্ধুর এমন অবস্থা দেখে আর কয়জন এগিয়ে আসে। অহনা দু’হাতে দুটোর গলায় ধরে আছাড় মারে। এতেই সবাই ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে বেরিয়ে যায় সবাই। অনিত বের হ‌ওয়ার সময় বলে যায়,’ দেখে নেব তোকে। ম* তোর তেজ বের করব।’

অহনা মেয়েটিকে তার ক্লাসে পাঠিয়ে দেয়। নিজের হাতে দিকে তাকিয়ে দেখে, হাতটাতো নরম লাগছে, কিন্তু একটু আগে কেমন শক্তিশালী ছিল, হাত দুটো টান টান শক্ত ছিল। এখন তো ফুলকে টোকা দিলেও ব্যথা পাবে না।

অহনা ক্লাসে বসে ছিল। হঠাৎ মনে হলো কেউ তার পাশেই বসে আছে। তার শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছে। অহনা সরে বসে। আবারো মনে হয় কেউ তার কাছে, খুব কাছে। অহনা প্রশ্ন করে,’ তুমি কি আমার পাশে?’

উত্তর আসে না। শিক্ষক দেখল অহনা অমনোযোগী, তাকে দাঁড়াতে বলে। অহনা কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষক প্রশ্ন করে,’ একা একা কার সাথে কথা বলছ?’

অহনা আমতা আমতা করে বলল,’ না স্যার। আমি কারো সাথে কথা বলিনি।’

‘ আমি স্পষ্ট দেখলাম। ক্লাসে মনোযোগ দাও, আর না হয় বেরিয়ে যাও।’

‘ স্যরি স্যার। আর ভুল হবে না।’

‘ সিট ডাউন।’

অহনা বসেই ছায়া মানবকে উদ্দেশ্য করে বলে,’ তোমার জন্য‌ই এসব হলো। আমি জানি, তুমি এখানেই, আমার পাশেই আছ। কথা বলতে পারো না নাকি ব্রাশ করোনি?’

অহনার কথায় ছায়া মানবটিও কেমন শব্দ করে হেসে উঠে। তবে সেটা অহনা ছাড়া আর কেউ শুনতে পায়নি। ছায়াটি জানালার কাছে চলে যায়। অহনা জানালার দিকে তাকিয়ে হাসে। আবারো শিক্ষকের নজরে পড়ে যায়। শিক্ষক ঝাঁঝালো বাক্য বলল,’ এখনি বেরিয়ে যাও বলছি।’

‘ স্যার, আমি…. আসলে….’

‘ বেরিয়ে যাও।’

অহনা বেরিয়ে যায় ক্লাস থেকে। বেরুতেই ছায়া মানবটি তার পাশে এসে দাঁড়ায়। পিনপতন নীরবতা, অহনা রেগে আছে। মুখ ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে,’ তোমার যোগ্যতা নেই আমার পাশে দাঁড়ানোর। অপরিচিত কেউ আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকুক সেটা আমি চাই না।

ছায়া মানবটি চোখ তুলে তাকায় অহনার দিকে,’ তুমি নিজেই ভুলে গেলে, আমি অপরিচিত কি করে হ‌ই?’

অহনা ভালো করে দৃষ্টিপাত করে। কোনভাবেই মনে পড়ছে না।
‘ কিন্তু আমি তোমাকে চিনি না। কে তুমি?’

‘ আমি….

চলবে……

#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম

৬.
অহনা আবারো জিজ্ঞেস করে,’ বলো কে তুমি?’

অহনা আগ্রহ নিয়ে তাকায় ছায়া মানবের দিকে। সেও পূর্ণ দৃষ্টি দেয়।
‘ আমি মাহতিম। কিন্তু….’

অহনা উৎসুক হয়ে তাকায়,’ কিন্তু কি?‌ আর মাহতিম নামটা আমার খুব চেনা মনে হচ্ছে। মনে পড়ছে না‌ তাও। আমাদের কি আগে কখনো দেখা হয়েছিল?’

‘ দেখা নয়, আমাদের মনের মিল ছিল।’

‘ আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’

‘ তুমি বলোতো আজ থেকে দুই মাস বা তিন মাস আগে তোমার সাথে কি ঘটেছিল?’

‘ আমি জানি না। মনে নেই।’

‘ পাঁচ মাস বা ছয় মাস আগে কি ঘটেছিল?’

অহনা ভাবে। কিন্তু তার ভাব শূন্য। আগামী কিছু মাসের কোনো কথাই তার মনে নেই। মনে পড়ছে না এক মাস আগে কি হয়েছিল!
‘ আমার মনে পড়ছে না কিছু।’

‘ কারণ কোনো ঘটনাই তোমার মনে নেই। তুমি….’

ক্লাস শেষে সবাই বের হচ্ছিল তাই ছায়াটি কথা বন্ধ করে দেয়। উধাও হয়ে যায় কোথাও।

অহনা বাড়ি যায়। একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। মালিক একজন মহিলা। খুব খিটখিটে মেজাজের তিনি। একদম অনিয়ম পছন্দ করে না। হ্যারি কল করে অহনাকে,
‘ ক‌ই গেলি তুই? পার্টি এরেঞ্জ করেছি, আসবি কখন?’

‘ স্যরি ব্রো, আমার মনে ছিল না। ক্লাস শেষে বেরিয়ে পড়েছি। শরীরটা ভালো নেই, আমি ঘুমাব।’

‘ তোর ঘুমের মা* বাপ। এখন আসবি তুই। এতো কিছু জানতে চাই না।’

‘ আচ্ছা আসছি, দশ মিনিট লাগবে।’

অহনা নিজেকে জোর করে ঠেলতে ঠেলতে পুনরায় কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে কাউকে দেখতে পেল না। তাই কল করে হ্যারিকে। হ্যারি বলল তাদের বাড়িতে আসতে। অহনা রেগে যায়,’ একটু আগে কলেজে আসতে বললি, এখন তোর বাড়ি যাব কেন? আমাকে কি ঘানি টানার বলদ পেয়েছিস নাকি?’

‘ ওফফ্ রাগ করিস না। তোর কি মাথা খারাপ নাকি? পার্টি বাড়িতে না করে কি কলেজের অফিস রুমে করব নাকি?’

‘ আচ্ছা আসছি। কথা বাড়াবি না আর।’

অহনা কলটা রাখতেই তার বাড়ি থেকে কল আসে। অহনার বাবা কল করেছে। কাঁদছেন তিনি,’ মা তুই কেমন আছিস?’

‘ আমি ভালো বাবা, তুমি কেমন আছো? গলাটা এমন শুনাচ্ছে কেন?’

অহনার বাবা রোস্তম আলী ঝরঝর করে কেঁদে উঠে,’ তোর মা আর আমাদের মাঝে নেই রে।’

অহনা আঁতকে উঠে,’ কি বলছো বাবা? তুমি মায়ের কাছে কল দাও, আমি কথা বলব।’

রোস্তম নিজেকে সামলে নেয়,’ হ্যাঁ রে মা, সুমা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তুই তারাতাড়ি তোর মাকে দেখতে আয়। তোকে শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিল, পারেনি। তুই তাকে শেষ দেখে যা।’

‘ বাবা তুমি কাঁদবে না, আমি আসছি এখুনি।’

অহনার মনটা যেন মুহুর্তেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মা তাকে দেখতে চেয়েছিল, শেষ দেখা আর দেখতে পেল না। ছুটে যায় মায়ের কাছে গ্রামের বাড়িতে।

হ্যারি কল করতে থাকে বার বার। লোকেশন ট্রেক করে জানতে পারে সে আসছে না, অন্য কোথাও যাচ্ছে।

অহনা বেলা একটার সময় বাড়ি পৌঁছায়। মাকে খাটিয়ারে দেখে অঝোরে কেঁদে উঠে। পাগলের মতো আচরণ করে সে। মাকে সে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না। জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করে। রোস্তম তাকে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে নেয়। দাপন করা হয় অহনার মাকে।

অহনা দক্ষিণ জানালার পাশে মুখ করে বসে আছে। টিনের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। অহনার মনে হলো, মা তাকে বলেছিল বৃষ্টির সময় যদি আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া হয় তাহলে সেটা পাওয়া যায়। অহনা কেঁদে কেঁদে মাকে ফেরত চাইল। রোস্তম মেয়ের এমন অবস্থা দেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

সারাদিন কিছু খায়নি অহনা। রোস্তম কিছু খাবার নিয়ে আসে। অহনা দক্ষিণের দুয়ারে তাকিয়ে আছে। কিছুই মুখে রুচছে না। একমনে তাকিয়ে থেকে একসময় আন্দাজ করে, তার পাশে কেউ বসে আছে। অহনা খাবারের থালা হাতে নিয়ে বলল,’ বাবা, তুমি এখন বিশ্রাম নাও, আমি খেয়ে নেব।’

রোস্তম চলে যায়। অহনা পাশে না ফিরেই বলল,’ ভাবি নি এখানেও আসবে।’

‘‌আমার যে আসতেই হতো।’

‘ কেন?’

‘ তুমি এখানে।’

‘ আমার বাড়িতে আমি এসেছি। তোমার কাজ কি?’

ছায়া মানবটি কিছু বলে না। সেও দক্ষিণে তাকিয়ে থাকে। অহনা বলল,’ উত্তর নেই?’

ছায়াটি সরে যায় অহনার থেকে। সে উত্তর দিতে চায় না। গলায় বিঁধে তার।

বিকেল হতেই অহনা ঘুম থেকে জেগে উঠে। সন্ধ্যা হবে হবে প্রায়। গ্রামের নাম ইলাশপুর। গ্রামের পাশেই একটি নদী। অহনা সন্ধ্যা উপভোগ করতে নদীর পাড়ে যায়।
মিষ্টি বাতাসে গা এলিয়ে দেয়। পেছন থেকে কারো চিৎকার শুনে অস্বাভাবিকভাবে ভয় পেয়ে যায়। দেখল সাদা থান পড়া একটি মেয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। অহনা ভাবল এটা তার চোখের ভ্রুম। কিন্তু একদম কাছে চলে আসায় বিশ্বাস করল, এটা জলজ্যান্ত একটা মানুষ। মেয়েটির বয়স পনেরো কি ষোলো হবে। তার শরীরে ক্ষতের চিহ্ন। কেউ তাকে খুব মেরেছে। মেয়েটি অহনাকে বলল,’ বোন আমাকে বাঁচাও। ওরা খুব নিষ্ঠুর, আমাকে মেরে ফেলবে।’

অহনা অভয় দেয়,’ কেঁদো না তুমি, কেউ কিছু করবে না। আমি আছি।’

‘ ওরা ভয়ঙ্কর। আমাকে লুকিয়ে ফেলো বোন, আমাকে লুকিয়ে ফেলো।’

‘‌ভয় পেয়ো না। তুমি আমার সাথে আমার বাড়িতে চলো।’

অহনা মেয়েটিকে নিয়ে নিজের ঘরে যায়। রোস্তম জিজ্ঞেস করলে বান্ধবী বলে পরিচয় দেয়। অহনা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে,’ তোমার নাম কি বোন?’

মেয়েটি ঢকঢক করে গ্লাসের সব পানি সাবার করে বলল,’ ময়না…. আমার নাম ময়না। বাবা আদর করে মনি ডাকত।’

‘ ওহ… তোমার বাবা কোথায়?’

‘ বাবা, বাবার বাড়িতে।’

‘ তোমার কি আর কেউ নেই?’

ময়না কেঁদে উঠে,’ আমার কোনো কালেই আপন কেউ ছিল না। আজ একদম নেই, আরো নিঃস্ব আমি।’

‘ তোমার কি হয়েছিল, খুলে বলো আমাকে?’

‘ আমার খুব ক্ষুদা লেগেছে আপা, আমাকে কিছু খেতে দেবে?’

অহনা লজ্জিত হয়। মেয়েটাকে হাজারটা প্রশ্ন করছে কিন্তু তার যে ক্ষুদা লেগেছে কিনা একবারও জিজ্ঞেস করেনি।

‘ তুমি বসো, ভয় পেয়ো না। আমি এখনি যাব আর খাবার নিয়ে আসব।’

অহনা রান্নাঘরে যায়। পাতিলের ডাকনা উঠিয়ে দেখল খাবার স্বল্প। সেটাই বেড়ে নিয়ে আসে অহনা। ময়না গপাগপ করে খেতে থাকে। মনে হলো অনেকদিনের অনাহারি সে। অহনা ময়নার খাওয়ায় দেখে মনভরে।

খাওয়া শেষে অহনা তাকে বলল,’ এখন তোমার বিশ্রাম নেওয়া দরকার বোন। তুমি বরং কিছুক্ষণ গা এলিয়ে নাও। ততক্ষণে আমি ভাত রেঁধে আসি।’

‘ আচ্ছা আপা।’

আপা শব্দটা অহনার হৃদয়ে গিয়ে লাগে। কত মায়া জড়ানো কন্ঠে ময়না তাকে আপা ডাকল। অহনা ময়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে যায়। রান্নাঘরের কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। অহনার মা কখনো মেয়েকে দিয়ে কাজ করাতো না। ছোট থেকেই কষ্ট করে শহরে পড়াশোনা করাচ্ছে। ছুটিতে এলেও তাকে আদর যত্নে রাখত। কখনো তার ঘর কন্যার কাজ করতে হয়নি। অহনা রান্নার জন্য কাঠ আনে, কিন্তু কোনমতেই আগুন ধরাতে পারে না। ধোঁয়ায় তার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসে। এমতাবস্থায় তার চোখ যায় রান্নাঘরের জানালায়। ধোঁয়া যাওয়ার জন্য যে সুড়ঙ্গটা রেখেছে সেটা দিয়ে কেউ দেখছে। অহনা উপরে তাকাতেই সরে যায় সেটি। অহনা আবার চেষ্টা করতে থাকে আগুন ধরানোর, আবার সে কাউকে দেখতে পায়। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অহনা। কাউকেই দেখে না।
অহনা আবার ফিরে আসতেই উঁকি দেয় সে মানব। মাথার চুল তার নজরুলের মতো লম্বা, খোঁচা খোঁচা দাড়িতে মুখ ভর্তি। সে পকেট থেকে একখানা ছু*রি বের করে। অহনা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে…..

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে