#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৪১.
‘মাহতিম’ শব্দটা শুনে মাহতিম এবং অহনা দুজনেই বেশ চমকে উঠে। অহনা ব্রু কুঁচকে মাহতিমের দিকে তাকায়। বুঝতে পারছে না আর্মি অফিসারদের সাথে মাহতিমের কি সম্পর্ক। অথচ এটাও জানে না মাহতিম কে? তার পরিবার কি?
মাহতিম ঘাবড়ে গিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে আরিশের দিকে তাকিয়ে থাকে। অহনা নিজেকে বুঝালো, হয়তো অন্য কেউ হবে, এক নামের আরও অনেকেই আছে। তাই সে জিজ্ঞেস করল,’ কিছু কি পেলে সেই আর্মি অফিসারকে নিয়ে?’
‘ এখনো পাইনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পুরো ডিটেইলস আমার কাছে আসবে।’
মাহতিমের পুরো সন্দেহটা আরিশের উপর যায়। সেই সিক্রেট অপরাধী আরিশকেই মনে করে। কিন্তু আরিশ কি করে এসব করছে? যদি সে সব করছেই তাহলে মাহতিমকে তার চেনার কথা। মাথায় কিছুই ঢুকছে না মাহতিমের। মাহতিম এখনো জানে না তার পরিবারের আসল খুনি কে?
হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে মাহতিম অহনার পাশ থেকে উঠে যায়। অহনা বাঁধা দিতে পারেনি।
মাহতিম চলে যেতেই অহনা ভাবতে থাকে আরিশ ঠিক কোন মাহতিমের কথা বলেছে। তাই জিজ্ঞেস করেই বসে,’ আচ্ছা ঐ মাহতিমকে কি তুমি চেনো?’
‘ না, পুরো বিষয়টা এখনো ধোঁয়াশা। তার পরিচয়টাই খুঁজছি আমি। যা তথ্য পেয়েছি, তা থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, মাহতিম খুবই ভালো একজন দেশপ্রেমিক ছিল। যে দেশের জন্য নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করত না।’
‘ এখন কোথায় আছে সে?’
‘ এখন বেঁচে নেই। আটমাস আগেই সুপ্রিম কোর্ট তাকে ফাঁসি দেওয়ার আদেশ করেছিল। তারপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশ্য এখন মৃ’ত বলেই সবাই জানে। কি হয়েছিল ঠিক, সেটাই আমি জানতে চাইছি।’
অহনা অবাক হয়ে যায় এত কথা শুনে। মাহতিম যেহেতু তার কাছেই আছে, তাই নিশ্চিত হয় এটা অন্য কোনো লোক। অহনা পুনরায় জিজ্ঞেস করে,’ তার কোনো ছবি আছে আপনার কাছে?’
‘ না, তার পুরো লাইফস্টাইল ডিলেট করা হয়েছে। কেন সেটা আমি জানি না। খুব শিঘ্রই হাতে পাব সেটা।’
‘ আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করব আপনাকে, উত্তরটা সঠিকভাবে দেবেন।’
‘কি জানতে চাও বলো?’
‘ পার্কে একজন উকিল আপনাকে স্যার বলেছিল কেন?’
‘ ওহ এই ব্যাপার? আসলে আমি পড়াশোনার পাশাপাশি একটা স্কুলে প্রাইভেট টিচার হিসেবে জয়েন করেছি। তাই তিনি আমাকে স্যার বলেছেন।’
অহনার কেমন খটকা লাগে। অহনা তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,’ লোকটা বলছিল দেখা হলে ট্রিট দিতে হবে। কোথায় দেখা হবে? মনে হলো আপনাদের কাজ একসাথেই।’
‘ সেটা তোমাকে পরে বলব। বিয়ের পর সব জানতে পারবে। আমার সব সিক্রেট জানার অধিকার থাকবে তোমার। এখন কিছু খেয়ে নাও।’
মাহতিম গিয়ে দেখা করে আশিশের সাথে। অফিসে বসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ফাইল দেখছিল। মাহতিমকে দেখেই সব বন্ধ করে এগিয়ে আসে,
‘ হাই বস। কি খবর?’
‘ ততটা ভালো না।’
‘ কেন?’
‘অহনার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকে আমার সন্দেহ হয়।’
‘ খুলে বল বিষয়টা। বুঝতে সমস্যা হচ্ছে।’
‘ আরিশ আমার ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে। কিন্তু কেন? সেতো আমাদের সাথে ছিল না? তাকে আগে কখনো দেখিওনি, হঠাৎ কোথা থেকে এসে আমার বিষয়ে খবর নিচ্ছে। কারণটাও অজানা।’
আশিশ কোমরে হাত রেখে বলল,’ আমার মনে হচ্ছে আরিশের সাথে জয়ন্ত স্যারের কোনো ব্যাপার আছে। অনেকদিন আগে একবার আরিশের সাথে দেখেছি আমি জয়ন্ত স্যারকে। অবশ্য আর কখনো তাদের এক সাথে দেখিনি। আমি ভেবেছিলাম কোনো গোপন ব্যাপার হবে। খোঁজ নিয়েছি, কিছুই পাইনি এই ব্যাপারে।’
‘ এত বড় একটা বিষয় আমাকে আগে বললি না কেন? এখন তো আমার এই আরিশকেই আসল অপরাধী মনে হচ্ছে। সে আবার অহনার কোনো ক্ষতি করতে চাইছে নাতো?’
আতঙ্কে মাহতিমের চোখ মুখ খিঁচে আসে। ভয় পাচ্ছে অহনার জন্য। আশিশকে বলল,’ দ্রুত খবর নে এই আরিশের ব্যাপারে। কে সে? আর্মিদের সাথে তার কি যোগসূত্র। সব রাতের মধ্যেই আমাকে জানাবি।’
‘ শান্ত হ। আমি বিষয়টা দেখছি, তোকে ভাবতে হবে না।’
অহনা কিছু খাচ্ছে না। খাবার নাড়াচাড়া করছে। আরিশ বলল,’ কিছু ভাবছ মনে হয়?’
অহনা অন্যমনস্ক ছিল, বলল,’ কিছু না।’
আরিশের ফোনে কল আসে। তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শব্দ এলো,’ স্যার, আপনার কাজ হয়ে গেছে।’
‘ ঠিক আছে। পাঠিয়ে দাও আমার বাড়ি, রাতের মধ্যেই যেন চলে আসে। বিষয়টা সিক্রেট তাই তুমি নিজেই নিয়ে আসো। ঠিকানা হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলাম।’
‘ জ্বী স্যার।’
আরিশ কল রেখে দিতেই অহনা জিজ্ঞেস করল,’ কি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলছিলেন?’
‘ তেমন কিছু না। তুমি খাও।’
অনেক কথা বাড়ালো না। আরিশ কিছুক্ষণ পরেই বলল,’ তোমার ক্লাস নেই?’
‘ এগারোটায়।’
‘ আর পনেরো মিনিট আছে।’
‘ ওহ গড। আমি একদম ভুলে গেছি। আমাকে যেতে হবে।’
আরিশের মুখে ঘন মেঘ নেমে আসে। কিছু বলার আগেই অহনা পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পজিশন নেয়। আরিশ বলল,’ ভেবেছি কিছুটা একা সময় কাটাবো, কিন্তু হলো না।’
অহনা চারপাশে তাকিয়ে বলল,’ এই টেবিলে আপনি আর আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। একাইতো ছিলাম আমরা। সময়টাও একাই কাটালাম।’
‘ আমি এটা বলতে চাইনি। তুমি এসেছো কয়টায়? মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যেই আবার চলে যাচ্ছ। এর মাঝে অফিসার মাহতিমকে নিয়ে কথা হলো দশ মিনিট। দশ মিনিট খাওয়া এবং একটু কথা বলা।’
‘আপনার উচিত ছিল আমাকে সকাল সাতটায় আসতে বলা। দোষটা আপনার।’
‘ সাতটায় তুমি ঘুমে ছিলে।’
‘ তাতে কি হয়েছে?’
আরিশ কিছু একটা মনে করার ভান করে বলল,’ ওহ একটা কথা মনে পড়ল। তুমি বলেছিলে দেখা হলে বলবে, রাতে কি করেছিলে, তার কারণে ঘুমাতে দেরি হলো।’
অহনা কি বলবে বুঝতে পারেনা। আমতা আমতা করে বলল,’ আমি ঘুমের ঘোরে কি বলেছি জানি না। আমার তেমন কিছু বলেছি বলে মনে নেই।’
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু….’
‘ কিন্তু কি?’
‘ আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে আরও দূরে সরে যাচ্ছি আমরা।’
‘ এমন কিছু না। আমার ক্লাস না থাকলে যেতাম না।’
‘ ঠিক আছে যাও তবে। আবার দেখা হবে।’
অহনা চলে যেতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আরিশের। ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে অহনাকে। এই মুহূর্তে যদি তার জন্য প্রাণ দিতেও বলা হয় তো দিয়ে দেবে। আজকে সালোয়ার কামিজে দেখা অহনাকে তার আরও ভালো লেগে গেল। ইচ্ছে করছিল, একবার তার কোমল হাতটা ছুঁয়ে দিক।
যখন টেবিলের হাত রেখে অহনা কথা বলছিল, তখন আরিশের ইচ্ছে করছিল একবার ওর হাতে হাত রাখতে। সাহস করে উঠতে পারেনি। কয়েকবার চেষ্টা করেও পারেনি। এক রাশ ভারী বুক নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। দু মাস অনেক দেরি। এতদিন অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। অহনাকে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছা তাকে আঁকড়ে ধরেছে। কাছে পেতে চাইছে বারবার। কিন্তু উপায় কি? মাথায় তার কোনো মতলব কাজ করছে না।
অহনা ভার্সিটিতে চলে যায়। প্রতিদিনের মতো আজও দেরি করায় আশরাফুল ইসলাম তাকে ঢুকতে দিল না। কড়া গলায় বলে দিল,’ বাইরে দাঁড়িয়েই ক্লাসটা করো।’
অগত্যা অহনা বাইরে দাঁড়িয়েই নোট করতে লাগল।মাহতিম এসে পাশে দাঁড়াল। অহনার মনোযোগ নষ্ট করার জন্য বলে,’ তোমার হাতের উপর তেলাপোকা হাঁটছে দেখো।’
অহনা না দেখেই চিৎকার করে উঠে। মাহতিমকে ধাক্কা দিয়ে এক পাশে এসে দাঁড়ায়। ক্লাসের ব্যাঘাত ঘটতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে শিক্ষক,
‘ কি হয়েছে এখানে?’
অহনা বলল,’ স্যার, তেলাপোকা।’
‘ কোথায় তেলাপোকা?’
অহনা চারিদিকে তাকিয়ে বলল,’ ছিল তো। চলে গেছে হয়তো।’
‘ বেড়িয়ে যাও এখান থেকে। আজকেও জন্য আর কোনো ক্লাস করতে হবে না তোমাকে।’
অহনা আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল ভার্সিটি থেকে। রাগে ফেটে পড়ছে। মাহতিম সেধে এসে বলল,’ ভেবেছি তেলাপোকা বললে জড়িয়ে ধরবে আমাকে, সেটা না করে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে? কত নি’ষ্ঠুর তুমি।’
‘ একদম চুপ। আর একটা কথা বললে ফুচকা গাছের সাথে বেঁধে রেখে যাব তোমায়।’
মাহতিম হেসে উঠে,
‘ ফুচকার গাছ কোথায় পেলে।’
‘ কানে বেশি শুনো। ফুচকা দোকানের সাথে বেঁধে রাখব বলেছি।’
‘ চিলে কান নিয়ে গেছে বলে চিলের পেছনে দৌড়াচ্ছ। অথচ একবার পরখ করে দেখছ না তোমার কান আসলেই চিলে নিয়ে গেছে কিনা!’
‘ কি বোঝাতে চাইছ?’
‘ এটাই যে। আমি তেলাপোকা বললাম, আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে? একবার তো খেয়াল করে দেখতে পারতেন, আসলেই তেলাপোকা নামক ভয়ঙ্কর জন্তুটা আছে কিনা!’
‘ ফ্লার্ট করছ?’
‘ এত সাহস নেই আমার।’
অহনা কথা না বাড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে চলল। বাড়িতে গিয়েও কোনো কথা বলল না।
সন্ধ্যা হতেই একজন লম্বা চওড়া লোক আরিশের কাছে আসে। কিছু জিনিস তার হাতে দিয়েই আবার চলে যায়। বিষয়টা খেয়াল করে মোড়ল।
চলবে….
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৪২.
মাহতিম বারান্দায় বসে অহনার রাগী মুখশ্রী দেখে। রাগলেও তাকে সুন্দর লাগে খুব। সকল রুপেই রূপবতী লাগে। এই চাহনি ভুলে যাওয়ার নয়। মনে মনে বলল,’ মেয়েদের রাগ করা উচিত প্রতি কদমে। রাগ করলে তাদের সৌন্দর্য আরো কয়েক গুন বেড়ে যায়। আরো বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।’
অহনা বাঁকা চোখে মাহতিমকে দেখছে। রাগ দেখিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কাছে না পেলেও ভালো লাগে না। একবার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু রাগ করে আছে সেটাই এখন মুখ্য বিষয়। এটা বুঝতে দিলে চলবে না অহনা তার প্রতি দুর্বল। একটু আধটু ভাব না নিয়ে ভালোবাসাটা ঠিক জমে না। ভালোবাসা বাড়ানোর জন্য কিছুটা অভিমানের সুরে কথা বলা জরুরি। মাঝে মাঝে গাল ফুলিয়ে বসে থাকাও জরুরি।
অহনার রাগ আরো বেড়ে যায়। মাহতিম রাগ ভাঙাতে আসছে না কেন? অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। নিজেকে দমিয়েও রাখতে পারছে না। আবার আশা করে বসে আছে মাহতিম এসে স্যরি বলবে।
মাহতিম যখন কিছুই করল না। তখন অহনা এসেই তার পাশে দাঁড়াল। ফুলের টব গুলো পরিষ্কার করে দিল। আড়ালে দেখল মাহতিমকে। নাহ! মাহতিমের কোনো ভাবগতির পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। সে আপনমনে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।
অহনা নিজের রাগ সব হাতের তালুতে নিয়ে মাহতিমের গলা জড়িয়ে ধরে। কোনো ভাবগতি দেখল না মাহতিমের। অহনা আরো চটে যায়। এভাবে ইগনোর করাটা তার সহ্য হচ্ছে না।
অহনা রাগে ফুঁসে উঠে। মাহতিমের মুখটা এক হাতে নিজের দিকে ফিরিয়ে এনেই তার ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বন করে। মাহতিমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। সে এটাই চেয়েছিল, অহনা রাগের বশে ভুল কিছু করে বসুক। হলোও তাই। অহনা মাহতিমের ঠোঁট কামড়ে ধরে। সুযোগ পেয়ে মাহতিমও ছাড়ার পাত্র নয়। দখল করে নেয় অহনার সমস্ত অধর। ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় কেটে যায় অনেকটা সময়।
মাহতিম অহনাকে ছেড়ে দিয়েই বলল,’ স্যরি ম্যাডাম!’
অহনা কিছু বলল না। এতক্ষণে রাগ গলে পানি নয় কেবল বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাহতিমের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
মাহতিম পুনরায় বলে,’ আনলিমিটেড স্যরি আমার জান। তোমার ভালোবাসা একটু বেশি পেতে এই কায়দা ধরেছি। তুমি আগেও এমনটাই করতে। যখন আমি রেগে যেতাম তখন এসেই কোনো কথা না বলে চুমু খেতে। তুমি নিজে রেগে গেলেও একই কাজটাই করতে।’
অহনা বলল,’ আমার লজ্জা পাচ্ছে খুব।’
মাহতিম শয়তানি হেসে আরো লজ্জা দেওয়ার জন্য বলল,’ তোমার কিসিং স্টাইলটা সুন্দর। কিভাবে আমার পায়ের উপর পা তুলে গলা জড়িয়ে ধরে, এক হাতে চুল খামচে ধরে চুমু খেলে! আরেকবার খেতে চাই তোমার সেই বিখ্যাত চুমু।’
‘ আমাকে লজ্জা দিতে তোমার খুব বেশি ভালো লাগে তাই না?’
‘ তোমার লজ্জায় নুইয়ে যাওয়া মুখটা আমার ভীষণ প্রিয়। দেখলেই ভালোবাসার মুহূর্তটাকে আরো গভীরভাবে কল্পনা করি।’
‘ আমি রেগে আছি।’
‘ আবার কি হলো?’
‘ আগের রাগটাই আবার এসেছে আমার। ভীষণ রাগ পাচ্ছে আমার।’
‘ রাগ ভাঙাতে কি করতে পারি?’
অহনা খুশিতে লাফিয়ে উঠে,
‘ তোমার হরমোনের খুব কাছাকাছি নিয়ে নাও আমায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। এক ঘন্টার আগে ছাড়তে পারবে না।’
‘ আমিতো এটাই চাই।’
‘ কিছু বললে?’
‘ না বলিনি।
মাহতিম কোনো কথা না বলেই দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় অহনাকে। কপালে চুমু খায়। অহনা আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল,’ আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সবসময় আমার থাকবে। আমার প্রশান্তি সব আমার হবে। কখনো যেন ছেড়ে যাওয়ার কথা কল্পনাও করো না।’
‘ কখনো না। এই বুকের প্রতিটি স্পন্দন তোমার জন্য। তুমি ছাড়া আর কেউ এর অস্তিত্ব টের পাবে না। আমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপ তোমাকে চায় ভীষণ করে, তুমি ভুলে যেও না।’
‘ আর একটা কথা। এভাবে স্যরি না বলে থাকবে না। দোষ তোমার হোক বা আমার, স্যরি তোমাকেই বলতে হবে!’
মাহতিম হেসে অহনার ঘাড়ে অধর স্পর্শ করায়,
‘ ঠিক আছে মহারানী। কবিরা ঠিকই বলেছেন, মেয়েদের মন আর আকাশের রং মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়।’
‘ কোন কবি এমন বাজে কবিতা বলেছে।’
‘ আমার মতো সার্টিফিকেট ছাড়া কবিগণ।’
অহনা আয়েশ করে মাহতিমের বুকে এক হাত রাখে। বুকের বা পাশে হাত দেয়। মাহতিম ওর হাতের উপর হাত রাখে। সময় গড়িয়ে চলতে থাকে। অথচ দুটি অতৃপ্ত হৃদয়ের প্রেম বিনিময় শেষ হয় না। তাদের প্রেম ভিন্ন। শরীরের প্রতিটি ভাঁজের প্রতি আকর্ষণ নেই। নির্দিষ্ট একটি অংশই বড্ড আপন। যেখানে মিলিত হলেই শান্তি খুঁজে পায়। তৃষ্ণার্ত মন জেগে উঠে। দুটো প্রাণ একে অপরের শরীরের ঘ্রাণ নেয়, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনে। তলিয়ে যায় জড়ানো বন্ধনের মোহমায়ায়।
আরিশ ফাইলগুলো একে একে দেখে। একটা পেনড্রাইভও ছিল। সবকিছু বিশ্লেষণ করে আরিশ এটা বুঝতে পারে যে, অনুজই সব কাজ করেছে। সেই নিমোসহ বাকিজনদের মার্ডার করেছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না অনুজকে কেউ মেরেছে?
আরো কিছু তথ্য দেখে বুঝতে পারে, মাহতিমকে ফাঁসি দিতে পারেনি। সে পালিয়েছিল। আরিশ মনে করে মাহতিম এখনো বেঁচে আছে। আর কিছু প্রমাণ জোগাড় করেছে সে, সেগুলো থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, মাহতিম দেশ’দ্রো’হী’ নয়, অন্য কেউ।
কিন্তু কেন নিমো এবং মাহতিম বিদেশিদের সাথে গোপনে দেখা করতে যায় তা কেউ জানে না। আরিশ সিদ্ধান্ত নেয় মাহতিমকে নির্দোষ প্রমাণ করবে এবং প্রকাশ্যে তাকে খুঁজবে। আরিশ সবার থেকে নিজের আসল পরিচয় গোপন করে রেখেছে এতদিন, কাউকে বলেনি।
আরিশ ফাইলগুলো রেখে দিতেই দেখতে পায় একটা হুমকিমূলক বার্তা। আরিশের চোখ মুখ বিকৃত হয়ে যায়। মাহতিমকে সে অনেক ভালো মনে করেছিল। কিন্তু অনুজের সাথে শত্রুতা ছিল।
আরিশ এক মুহুর্তের জন্য ধরে নেয় মাহতিম অপরাধী। পরপরই আবার ভাবে, যে মানুষটা এতকিছু করে গেছে এই দেশের জন্য। সে কিভাবে দেশের ক্ষতি করবে?
আরিশ আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে। যেভাবেই সত্যিটা জানবে। সত্যিটা জানতেই তাকে এতো বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আরিশ কিছু কিছু ক্লু পায়।
হঠাৎ তার অহনার কথা মনে হয়। তাকে কল করে। ফোনের আওয়াজ কানে আসতেই অহনা ‘চ’ এর মতো করে বিরক্তিসূচক শব্দ করে।
মাহতিম বলল,’ কে কল করেছে দেখো একবার?’
‘ একদম না। এক ঘন্টা হয়নি এখনো।’
কলের উপর কল দিচ্ছে আরিশ। আরিশের চিন্তা হচ্ছে। এতবার কল করার পরেও কেউ ধরছে না। আরিশের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সে রোস্তমের ফোনে কল করে। রোস্তম অহনার ঘরে আসে। দরজা খোলা থাকার দরুন দেখতে পায়, অহনা অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কাউকে জড়িয়ে ধরে আছে। কিছুদিন হলো রোস্তম বিষয়টা খেয়াল করেছে। রোস্তমের কপালে গুটিকয়েক ভাঁজ পড়ে। সে অহনাকে ডাক দিতেই অহনা চমকে উঠে। এক ঝটকায় মাহতিমের থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেকে ঠিক করে নেয়।
এমন কান্ড দেখে রোস্তম সত্যি ভয় পেয়ে যায়। অহনাকে জিজ্ঞেস করে,’ কি হয়েছিল তোর?’
‘ কই বাবা! কিছু না তো। আমি ব্যায়াম করছিলাম।’
‘ এই অসময়ে কিসের ব্যায়াম।’
‘ তুমি বুঝবে না সেটা।’
‘আমার বুঝেও কাজ নেই। বলতে এসেছিলাম, আরিশ কল করেছে। তোকে নাকি কলে পাওয়া যাচ্ছেনা। ছেলেটা চিন্তা করছে তোর জন্য, একবার কথা বলে নে।’
মনে মনে হাজারটা গালি দিল আরিশকে। পরক্ষণেই বলল,’ আমিতো এক্ষুনি ওনাকে কল করতাম, তুমিও মনে করিয়ে দিলে।’
রোস্তম চলে যায় অহনার ঘর থেকে। অহনা মাহতিমের দিকে তাকিয়ে সজোরে বলে উঠল,’ সবাই আমার বিরোধীতা করে।’
‘ কে তোমার বিরোধীতা করল?’
‘ আরিশ, আমার বাবা, আরো কতজন। এক ঘন্টা হতে আর আরো দশ মিনিট বাকি ছিল। হলো না এক ঘন্টা।’
এমন পাগলামি দেখে মাহতিম সজোরে হেসে উঠে। পাশাপাশি চোখে পানি আসে তার। কতটা ভালোবাসলে কেউ এমনটা বলতে পারে? মাহতিম বলল,’ তাহলে এখন শোধ করে নাও। আমিতো এখানেই আছি।’
‘ আবার এক ঘন্টা।’
আরিশের কল আসে। অহনা ফোনটাকে আছাড় মারতে গিয়েও কল ধরে,
‘হ্যালো!’
‘ এত বিজি তুমি! ফোনটা কই রেখেছিলে?’
‘আমিতো ফোনের কাছেই ছিলাম।’
‘ তাহলে কলটা ধরলে না কেন?’
‘ আমি ফোনের কাছে ছিলাম। কিন্তু ফোন আমার কাছে ছিল না।’
‘ এটা আবার কেমন কথা। কি বলছ এসব?’
‘ এটাই যে, ফোনের আওয়াজ আমার কানে পৌঁছালেও আমি ফোনের কাছে পৌঁছাইনি।’
,’ সে যাই হোক। তোমার কথা তুমি বুঝলেই হয়। এখন বলো, কি করছ?’
‘ জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছি।’
আরিশের মুখের রং পাল্টে যায়,
‘ কি বললে তুমি? কাকে জড়িয়ে ধরেছ?’
আরিশ চেয়ার থেকে উঠে পড়ে। কথাটা শোনার পর তার র’ক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়।
অহনার মজা নিতে ভালো লাগছে। তাই বলল,’ আমার প্রিয় পুতুলটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। কথা ছিল এক ঘন্টা সে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখবে। কিন্তু তোমার জন্য হলো না। তোমার কলের কারণে সব ভেস্তে গেল।’
আরিশের মাথা থেকে যেন একটা বোঝা নেমে গেল। নিশ্চিন্ত মনে বাইরে খোলা আকাশের নিচে গেল।
মাহতিম অহনাকে বলল,’ আমার একটা কাজ আছে, এখন যেতে হবে। আমি তাহলে যাই।’
মাহতিম চলে যায়। অহনা ফোনের ওপাশে আরিশের কথা শুনছে। আরিশ বলল,’ তুমি যেভাবে বলেছিলে, আর একটু হলে হার্ট অ্যাটাক করতাম।’
অহনা হেসে বলল,’ কেন?’
‘ আমার দুষ্টু মাইন্ড অনেক কিছু ভেবে নিল।’
‘ কথা শেষ। আমি এবার রাখি?’
‘ না, থামো। আর কিছুক্ষণ সময় দাও আমাকে।’
অহনা চুপ করে থাকে। মনে হলো আরিশকে সে ঠকাচ্ছে। এটা ঠিক করছে না সে। বলল, ‘ আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।’
‘ তার আগে আমি তোমাকে বলতে চাই।’
‘ বলুন।’
‘ তুমি কি আমার জন্য কিছুই ফিল করো না? জানি, সবকিছু এক্সিডেন্টাল, তবুও আমি চাই তুমি আমাকে অনুভব করো।’
‘ অনুভূতি আসে না। কি করব আমি?’
‘ তুমি কি জানো, কখন কারো অনুভূতি আসে না অন্যের জন্য?’
‘ আমার জানা নেই।’
‘ যখন কেউ অন্য কাউকে মন প্রাণ দিয়ে বসে থাকে, তখন সেই কাঙ্ক্ষিত লোকটা ছাড়া তার আর কাউকেই ভালো লাগে না। সে আর কারো শব্দ শুনতেও আগ্রহ দেখায় না। একজনের ভালোবাসায় অন্ধ হলে কেউ আর অন্যজনের দিকে নজর দিতে পারে না। তোমার ক্ষেত্রেও কি তাই?’
অহনা কে জবাব দেবে বুঝতে পারে না। কিন্তু সত্যিটা বলা দরকার। এভাবে কাউকে ঠকিয়ে অহনা সুখী হতে পারবে না। বলতে গিয়েও যেন স্বর থেমে এলো। অহনা কথাটা বলতে পারল না। এখনো সে তার বাবাকেও এই বিষয়ে কিছু জানায়নি। আগে আরিশকে জানালে যদি কোনো সমস্যা হয়? মোড়ল জানতে পারলে পুরো এলাকা জানবে। গ্রামে তাদের সম্মান থাকবে না। এক ঝটকায় অনেক কিছু ভেবে নেয় অহনা।
নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’ না, তেমন কেউ নেই। আমার কিছু সময় লাগবে।’
‘ ভালোবাসা সময় দেখে হয় না। ভালোবাসা এমন একটা জিনিস এক পলকেই হয়ে যায়। আমার অনেক আফসোস, তোমার মনে জায়গা করতে পারছি না। অসহায় ভালোবাসা আমার। কয়দিন পর বিয়ে করলে তোমার থেকে আমি কি আশা করব। এটাই হবে যে, জোরপূর্বক বিয়ে করেছি আমি তোমাকে। আমি কি করব? আমার মাথায় কিছুই কাজ করছে না।’
আরিশের চোখ লাল হয়ে আসে। অহনার কথায় কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে। মেয়েটাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছে। চাইলেও এখন তাকে ছাড়তে পারবে না।
অহনা বলল,’ আপনি আমাকে কিছুটা সময় দিন।’
‘ হালকা সময়েও যা হচ্ছে না। তার আর কখন হবে? আমার নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। এমন আর কখনো হয়নি আমার সাথে।’
অহনা নিশ্চুপ। আরিশ খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে আবার যোগ করল,’ আমি তোমাকে অনুভব করি। তোমায় প্রথম দেখার যে অনুভূতি, সেটার রেশ এখনো কাটেনি আমার। প্রতি মুহূর্তে আমি তোমার কথা ভাবি। প্রচন্ড মিস করি। কাছে পেতে চাই। অদ্ভুত এক আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে বিরাজ করে। প্রতি রাতে আমার ঘুম হয়না তোমার কথা ভেবে। এতটাই ভাবতে মশগুল যে, ঘুমানোর সময় পেরিয়ে যায়।
আমি কি কখনোই তোমার ভালোবাসা পাব না। ভীষণ ভালবাসি তোমায়। জানি না কেন তোমার প্রতি আমার এতো ভালোলাগা, ভালোবাসা। আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়েই যেন তুমি রয়েছ।’
অহনার মনটা গলে আসে। নিজের প্রতি এক আকাশ খারাপ লাগা জন্ম নেয়। আরিশকে সে ঠকাচ্ছে, কথাটা মনে হতেই নিজেকেও বিষাক্ত মনে হচ্ছে।’
‘, আমার ঘুম পাচ্ছে খুব। এখন না ঘুমালে ম’রে যাব। আপনি এবার কাকে বিয়ে করবেন?’
আরিশ মৃদু হাসে,
‘ ঠিক আছে, ঘুমাও। দেখা করব কাল।’
মাহতিম আশিশের সাথে দেখা করে। আশিশ বলল,’ তোর ধারণা সঠিক। আরিশ আসলে একজন খারাপ লোক। সে দেশের বড় বড় অবৈধ ব্যবসায়ীদের সাথে চলাফেরা করে। আমি কিছু সূত্র থেকে জানলাম, সে এখন তোকে খুঁজছে। তার জানামতে তুই বেঁচে আছিস। আর সব খু’নের জন্য তোকে দায়ী করছে। আমাদের নেক্সট টার্গেট থাকা উচিত আরিশের দিকে। আমার মনে হচ্ছে এই আরিশই আমাদের নাকের ডগায় ঘুরাচ্ছে। যত তারাতাড়ি সম্ভব তাকে শেষ করতে হবে।’
মাহতিমের চোখ আগুনে পরিণত হয়। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগার কারণ, আরিশ অহনাকে ঠকাচ্ছিল। আবেগীয় কথা বলে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। আমি ওকে ছাড়ব না। আজকেই ওর শেষ রাত। আমি যাচ্ছি।’
মাহতিম প্রথমে অহনার কাছে যায়। দেখল অহনা ঘুমিয়ে গেছে। একটু সুযোগ পেলেই অহনা ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিন ঘুমাতে বললেও সে পারে। মাহতিম অহনার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে জাগাবে না বলে ঠিক করে। গায়ের কাঁথাটা টেনে দেয়। পেছন ফিরে চলে যেতেই আবার কাছে আসে। ঝুঁকে গিয়ে কপালে চুমু এঁকে দেয়। প্রশান্তিতে অহনার ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠে। ঘুমের ঘোরে মাহতিমের হাত চেপে ধরে। মাহতিম সরাতে গেলেই আরো শক্ত করে ধরে। মাহতিম নিজেকে আস্তে আস্তে সরানোর চেষ্টা করে, তখনি অহনা অপর পাশে ফিরে যায়। যার কারণে তাল সামলাতে না পেরে মাহতিম ওর গায়ের উপর পড়ে যায়।
অহনা চোখ খুলেই মাহতিমকে চোখ মেরে বলল,’ বাংলা সিনেমার বিপরীত হলো এটা।’
‘ কিসের সিনেমা? কি বিপরীত?’
‘আমি তোমার গায়ে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু তুমি আমার গায়ে পড়লে। এখন উঠো, না হয় আমি থ্যাতো হয়ে যাব। তুমি অনেক ভারী।’
মাহতিম উঠে যায়,
‘ হিন্দি সিরিয়াল হলে বেশি ভালো হতো। একটু বেশি ভালোবাসতে পারতাম।’
‘হয়ে যাও তেমন।’
‘কিন্তু এখন একটা কাজ আছে, যেতে হবে।’
অহনা বাঁধা দেয় না। মাহতিম অহনার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের মিশন কমপ্লিট করতে যায়।
আরিশের ফোনে কল আসে। একজন এজেন্ট তাকে বলল সে মাহতিমের পূর্ব পরিচিত। এবং তার কিছু ফটো আছে তার কাছে। লোকটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। আরিশকে বলল,’ আপনি আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিন, তাহলেই আমি আপনাকে সেই ছবিগুলো দেব। না হয় দেব না।’
আরিশ কোনো কিছু না ভেবেই লোকটার একাউন্টে টাকা দিয়ে দেয়। কারণ, মাহতিমের বিষয়ে জানাই তার একমাত্র কাজ এখন। রহস্য ভেদ করতে না পারলে চাকরিটাই হারাবে হয়তো।
টাকা দেওয়ার সাথে সাথেই লোকটা আরিশকে কিছু ছবি সেন্ড করে।
আরিশ একে একে সবগুলো ছবি দেখতে থাকে। প্রায় পঞ্চাশটা ছবি সেন্ড করেছে। শেষে গিয়েই আরিশের হাত পা অসাড় হয়ে আসে। এমনটা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মাথায় যেন পুরো আকাশটা ভেঙ্গে পড়ল। আরিশের হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায়। আকস্মিক ঘটনায় সে নিজেকে বোঝাতেও পারল না কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা….
চলবে…
#ছায়া_মানব
#সাথী_ইসলাম
৪৩.
আরিশ মাহতিমের সবগুলো ছবির মাঝে একটি ছবি দেখতে পায় ভিন্ন। মাহতিমের পাশে অহনা ছিল। একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় তোলা ছবি। একে অন্যকে খাইয়ে দিচ্ছে।
আরিশ মূর্তির মত ঘরের এক কোণে বসে রইল। নিজের হবু স্ত্রীকে দেখতে পেল অন্য একজনের সাথে। এমন একজনের সাথে, যে আপাতত নিখোঁজ। আরিশ নিজের মনকে বলল,’ আচ্ছা, অহনা কি তাহলে তার জন্যই অপেক্ষা করছে? সেই অপেক্ষা থেকেই বুঝি আমাকে মেনে নিতে পারছে না। এখনো হয়তো তাকেই ভালোবাসে। কাউকে হয়তো বলতে পারেনি মনের কথাটা।’ আরিশ সিদ্ধান্ত নেয় অহনাকে জিজ্ঞেস করবে এই বিষয় নিয়ে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল ফে’টে গেছে, ব্যাটারিও শেষ। তাই কল করতে পারল না।
আরিশ কথাটার জন্য অহনার থেকেও রোস্তমকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করল। কাল সকালে গিয়েই জিজ্ঞেস করবে এই বিষয়ে।
হাজারো প্রশ্ন তার মনে। এসব ভাবতে ভাবতেই শুয়ে পড়ে। তবে দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।
মাহতিম এসে পৌঁছায় আরিশের কাছে। দেখল বিভোর হয়ে কিছু ভাবছে আরিশ, দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে। মাহতিমের কেন জানি না মায়া হলো। আরিশের দিকে কদম নিতেই আবার পেছনে ফিরে তাকাল। আরিশকে তার অপরাধী মনে হয় না। নিষ্পাপ মনে হলো। মাহতিম নিজের মধ্যে আরিশের জন্য ঘৃণা আনতেও ব্যর্থ হলো।
এক প্রকার মনের সাথে যু’দ্ধ করেই মাহতিম আরিশের সামনে যায়।
হঠাৎ মাহতিমের মনে হলো, আরিশকে মা’রার আগে তার গবেষণাগুলো দেখা দরকার। আজ পর্যন্ত কি কি করেছে সে, সেটা জানা জরুরী। মাহতিম আরিশের ল্যাপটপটা খোলে। অবাক হয়ে যায়। সমস্ত কিছু তাকে নিয়েই। তাকে নিয়েই আরিশ এত এত গবেষণা করে গেছে। এবং এই পর্যন্ত খু’ন হওয়া সবার ডিটেইলসও। মাহতিম চমকে যায় এটা দেখে যে, আরিশ মার্ক করে রেখেছে কে খু’ন করেছে। যদি আরিশই সত্যিকারের খারাপ লোক হত তাহলে সে বিষয়টা আগে থেকেই জানত। মাহতিমকেও চেনার কথা ছিল, কিন্তু সে চেনে না। সমস্ত কিছু দেখে মাহতিম বুঝতে পারে আরিশ শুধু খবরই নিচ্ছে, এর বাইরে আর কিছু না। মাহতিম আরো অবাক হয় আরিশের বিষয়ে জেনে। সে বলেছিল সে একজন স্কুল শিক্ষক তাও আবার প্রাইভেট। সবকিছু কেমন গড়মিল লাগছে মাহতিমের। মনে মনে নিজেকে বাহবা দেয়, কেননা এতক্ষণে একটা নিরপরাধের প্রাণ নিয়ে নিত। ভাগ্যিস সব দেখেছিল। মাহতিম বেরিয়ে যায় আরিশের ঘর থেকে। তবে খুব শিঘ্রই কথা বলবে ভেবে নেয়। আরিশের মাধ্যমেই সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবে।
এরপর তিনদিন কেটে যায়। একটা কেস নিয়ে ভাবতে গিয়ে তিনদিন দেখা করতে পারেনি। এতটাই বিজি ছিল যে অহনাকে কলও করেনি। তিনদিন পর ফ্রি হয়ে আরিশ অহনার সাথে দেখা করতে আসে।
অহনাদের বাড়িতে এসে কলিং বেল চাপে। রোস্তম দরজা খোলে দেয়। অহনা ভার্সিটিতে ছিল তাই বাড়িতে নেই। এক উছিলায় খুশি হয় আরিশ। রোস্তমকে সবটা জিজ্ঞেস করবে সে।
রোস্তম আরিশকে খাতির করে ঘরে আনে। সোফায় বসালো। কফি আনতে গেলেই আরিশ বাঁধা দেয়, বলল,’চাচা, আমি এখন কিছু খাব না। খেয়েই এসেছি, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। সেটাই বলতে এসেছি।’
রোস্তম এক গাল হেসে বলল,’ কি কথা বাবা। যা জানার বা বলার, সব অকুন্ঠচিত্তে বলতে পারো।’
আরিশ বলল,’ চাচা, আপনি ব্যস্ত না হয়ে ধীরস্থিরভাবে একটু বসুন। কিছু বিষয়ে জানতে চাইব শুধু।’
রোস্তম সন্দিহান চোখে তাকায়,’ জ্বী বাবা।’
আরিশ প্রথমেই বলল,’ আপনার শরীর কেমন আছে এখন? কাজের চাপে থাকায় খবর নিতেও পারিনি।’
‘ আলহামদুলিল্লাহ অনেকটাই ভালো।’
‘ আসলে চাচা, আমি আপনাকে কিছু দেখাতে চাই এবং আমি চাই এই বিষয়ে আমাকে আপনি সত্যিটা বলুন।’
বলেই আরিশ তার মোবাইল থেকে ছবিটা বের করে, যেটায় অহনা এবং মাহতিম খুব ছিল। ছবিটা রোস্তমের নজরে যেতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে যান। মনে হলো কেউ বিশাল পুরনো ক্ষ’তটায় আরেকবার আ’ঘাত করেছে।
আরিশ জিজ্ঞেস করে,’ চাচা, আমি সত্যিটা জানতে চাই। বলুন আমাকে। এর রহস্য কি?’
রোস্তম কি বলবে বুঝতে পারছে না। কোথা থেকে শুরু করবে, কি বলবে, কিছুই তার মাথায় আসছে না। আরিশের প্রশ্নটা তাকে ভেতর থেকে মুচড়ে দিল। আরিশ পুনরায় বলল,’ আমাকে সত্যিটা বলুন। নিজের ছেলে ভেবে আমাকে বলুন এর আসল রহস্য কি? কথা দিলাম, যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেব আমি।’
রোস্তম বলল,’ পুরনো সময়টা আবার ফিরে আসবে তা কল্পনাও করিনি। বাবা, তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, অহনাকে এই ব্যাপারে কিছু বলো না। মেয়েটা দ্বিতীয়বার প্রাণ ফিরে পেয়েছে, এসব জানতে পারলে আবার আমি মেয়েটাকে হারাতে বসব।’
আরিশ রহস্যের বেড়াজালে আটকা পড়ে বলল,’ আমি কিছুই বলব না। আপনি বলুন।’
‘ আটমাস আগের কথা, ছেলেটার নাম ছিল মাহতিম। সে একজন আর্মি অফিসার। অহনার সাথে তার সম্পর্ক ছিল। ছেলেটার পরিবার খুব ভালো ছিল। আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ে মনে করত। বড়লোক বলে কখনোই আমাকেও অসম্মান করত না। তাদের কথা ছিল, জীবন কাটাবে ছেলে-মেয়ে, তারা যা সিদ্ধান্ত নেয় তাই সঠিক, বড়রাতো শুধু চাপিয়ে দিতে জানে। দুই পরিবারের সম্মতিতেই আমরা বিয়ের জোগাড় করি।’
‘ তারপর কি হলো?’
‘ এটাই মাহতিম আর অহনার শেষ দেখা ছিল। তারা ভালোবাসায় পূর্ণতা পাবে ভেবে কত খুশি ছিল। তাদের জুটি দেখে প্রশংসা করেনি এমন কেউ নেই। আমার মেয়েটা ভগ্যবতী ছিল বলেই মাহতিমের মত কাউকে পেয়েছিল। এই সুখ আর দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বিয়ের আসরেই পুলিশ এসে হাজির হয়। সমস্ত প্রমাণ নিয়ে এসে বলেছিল, মাহতিম একজন দেশ’দ্রো’হী। সে নিজের দেশকে শত্রুদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছিল। বিয়েটা হতে দিল না তারা। নিয়ে গেল মাহতিমকে। আমি একজন বাবা হয়ে মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারিনি। অবুঝের মত মেয়েটা মাহতিমের হাত ধরে অঝোরে কেঁদেছে। হাতজোড় করে পুলিশকে বলেছিল বারবার,’ আমার মাহতিম এমনটা করতেই পারেনা। আমি ওকে ভালোবাসি, আমি ওকে চিনি, ও কখনোই দেশের সাথে বিশ্বাস’ঘাত’কতা করবে না।’
কান্নাগুলো কারো চোখেই পড়েনি। নিয়ে গেল মাহতিমকে। অসহায়ের মত সবাই দেখছিল শুধু। উন্মাদের মত হয়ে গিয়েছিল অহনা। সবকিছু ভাঙচুর করেছিল। কেউ ওকে থামাতে পারেনি।’
আরিশের চোখ বেয়ে এক ফোঁটা নোনা পানি গড়িয়ে পড়ল। এত বড় একটা ঘটনা তারই প্রিয় মানুষটার সাথে ঘটে গেল। অথচ সে সেটা আজই জানতে পারল। দ্বিগুণ উৎসাহে আরিশ জিজ্ঞেস করল,’ তারপর কি হলো? মাহতিম কি ফিরে এসেছিল?’
রোস্তমের চোখজোড়া ভিজে এসেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার যোগ করল,’ না, এটাই শেষ যাওয়া। তাকে ফাঁ’সির আদেশ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সে নাকি পালিয়ে গিয়েছিল। এটা কেউ বিশ্বাস করেনি। কারণ, মাহতিম সমস্যার মোকাবেলা না করে কাপু’রুষের মত পালিয়ে যাবে না কখনোই, শেষ চেষ্টা করবেই সে। তা আর হলো না। তার মৃ’ত্যুর সংবাদ দিয়ে গেল একজন আগন্তুক।’
‘ কে ছিল সে?’
‘ আমি জানি না। তার মুখে কালো কাপড় বাঁধা ছিল। সে শুধু খবরটা জানিয়েই চলে গেছে। অহনাকে আমি বিষয়টা জানাইনি। লুকিয়েছিলাম ওর থেকে।’
‘ তাহলে আমরা মাহতিমের বাড়ি গিয়ে খবর নিতে পারি। সে হয়তো বাড়িতেই লুকিয়ে আছে!’
‘ পাবে না তাকে।’
‘ কেন?’
‘ কারণ তার বাড়িটা এখন সরকারের অধীনে আছে। মাহতিমের মৃ’ত্যু সংবাদ দেওয়ার ঠিক ত্রিশ মিনিট পরেই জানতে পারলাম ওদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। তার পুরো পরিবারকে কেউ মে’রে দিয়েছিল।’
আরিশ বলল,’ দেশের আইন কোথায় গেল? এতকিছু হয়ে গেল, কেউ কিছু বুঝতেই পারল না।’
‘ আইন ঠিকই ছিল। আইন তখনি কার্যকর হয়, যখন আইনের লোক সাধারণের পাশে থাকে।
তার পরিবারের কেউ বেঁচে ছিল না, কেস লড়বে কে? কিছুদিনের মাথায় কেসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আইনের লোকরাই বিষয়টা ধামা চাপা দিয়েছে। আমি চেয়েও পারিনি কিছু করতে।’
আরিশ কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে, তখনি খেয়াল করল দরজার সামনে অহনা দাঁড়িয়ে আছে…
চলবে….